Featured Post
প্রবন্ধ ।। নারীবাদ ও নারীবাদী --- ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ ।। সবিতা বিশ্বাস
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
নারীবাদ ও নারীবাদী -- ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ
সবিতা বিশ্বাস
নারীবাদ অর্থাত্ Feminism বলতে কি বোঝায়?
'নারীবাদ' বলতে ঠিক কি বোঝায় এ সম্পর্কে নির্দিস্ট তাত্ত্বিক কাঠামো এখনো পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি | সাধারণভাবে বলা যেতে পারে, নারীবাদ হল এমন একটি শক্তি যা নারীজাতিকে একটি আত্মসচেতন সামাজিক শ্রেণীতে পরিণত করেছে (Feminism is the force which has transformed women into self conscious category--- Bandana chatterji, women and politics of India) |
নারীবাদী লেখিকা রাজশ্রী বসুর মতে, নারীবাদ হল তত্ত্ব ও বাস্তবের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যা সমাজে পুরুষের তুলনায় নারীর নিম্নতর অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করে, এবং নারী হওয়ার কারণেই একজন মহিলা সমাজে যে অসাম্যের স্বীকার হয় তার কথা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে | সমাজকে বোঝা, সমাজে নারী পুরুষের অবস্থাগত বৈষম্যকে বোঝা, লিঙ্গভিত্তিক ক্ষমতার অসম বন্টন ও বিন্যাসকে অনুধাবন করা, এবং কিভাবে এর সমাধানসূত্র খুঁজে বার করা যায় –--এই সমস্ত কিছু নিয়েই নারীবাদ চর্চা করে |
নারীবাদ একাধারে রাজনৈতিক দর্শন, সামাজিক আন্দোলন, যা লিঙ্গবৈষম্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে চায় | এককথায় বলতে গেলে, নারীবাদ হল এমন একটি প্রত্যয় যেখানে নর অথবা নারী যে- কোনো মানুষের প্রকৃতি ও যোগ্যতার বিচারে লিঙ্গের কোনো ভূমিকা নেই (In its essence it [Feminism] is the belief that the nature and worth of a human being, man or woman, should be independent of gender) |
ফরাসী বিপ্লবকেই নারীবাদী আন্দোলনের সূচনাকাল হিসেবে গণ্য করা হয় | ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার বাণী সেখানকার মহিলাদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে | কিন্তু ফরাসী বিপ্লব সফল হলেও মহিলাদের অবস্থা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে গেল | ১৭৯১ সালে পুরুষদের ভোটাধিকার স্বীকার করা হলেও মেয়েদের বঞ্চিত রাখা হল | এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন ফরাসী নাট্যকার ও বিপ্লবী নারী অলিম্পে দ্য গ্গস | তাঁর আহ্বানে বিশ্বের নারী সমাজ জেগে উঠেছিল যা মেনে নিতে পারেনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ | ১৭৯৩ সালের ৩রা নভেম্বর ফ্রান্স তাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছিল | অসীম সাহসী নারী অলিম্পে ফাঁসির মঞ্চে যাবার আগে বলেছিলেন, "মেয়েদের যদি ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার অধিকার থাকে তবে পার্লামেন্টে যাবার অধিকার থাকবে না কেন?"
ফরাসী দেশের নারীবাদী আন্দোলনের ঢেউ ক্রমশ ইউরোপের অন্যান্য দেশে পৌছায় | ১৮৩০ সালে ইংল্যান্ডের নারীরা বেশ কিছু দাবির ভিত্তিতে 'চার্টার অব ডিম্যান্ডস' পেশ করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে | বিশ্বের আর এক ধনতান্ত্রিক দেশ আমেরিকাতে আনুষ্ঠানিকভাবে লড়াইটা শুরু হয়েছিল ১৮৪৮ সালে 'সেনেকা কনভেনশন ফলস' এ | সেখানে ৩০০ নারী পুরুষ একসাথে সমবেত হয়েছিলেন নারী অধিকারের পক্ষে | আমেরিকার নারীরা তাদের লর্ডের পাশে গম্ভীর ও সুসজ্জিত চেহারা থেকে বেরিয়ে এসে রাজনৈতিক সচেতনতা গ্রহণ করলে নারী পুরুষের বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে | এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন ভল্টারিন ডি ক্লেইর ও মার্গারেট সাঙ্গার | তারা অর্থনৈতিক সাম্য ও সন্তানের জন্মদানে নারীর ইচ্ছে অনিচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়ে ক্যাম্পেন করেছিলেন | এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন লুসি স্টোন, সুজন বি এন্থনি, হেলেন পিটস প্রমুখ |
নারীবাদী আন্দোলনের প্রথমপর্বে মেয়েদের যে অধিকার গুলো ছিলনা, তা হল উইল কিংবা কোনো আইনি কাগজে স্বাক্ষর দেওয়া, বিচারক কিংবা জুরি বোর্ডের সদস্য হওয়া, নির্বাচনে ভোট দেওয়া, স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্কে অসম্মতি দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, সন্তানের আইনি কাস্টডি পাওয়া, বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়া, কোনোপ্রকার সম্পত্তির অধিকার রাখা |
এই ছিল সে সময়ে পশ্চিমা নারীদের জীবন যাপনের ধরণ |
এখন যারা নারীবাদীদের কটূক্তি করেন তাদের বলি, নারীর অধিকার আদায়ের পথ কুসুমাস্তীর্ন ছিলনা সেটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন | নারী নিজে কোনো সম্পত্তি রাখতে পারত না, কারণ নারী নিজেই সম্পত্তি ছিল | প্রথম ধাপের আন্দোলনের ফলে ব্রিটেনে ১৯১৮ সালে 'দ্য পিপলস রিপ্রেজেন্টেশন অফ দ্য অ্যাক্ট' পাশ হয় এবং ত্রিশোর্ধ নারী, যাদের নিজস্ব বাড়ি আছে তারা ভোটদানের অধিকার পায় | ১৯২৮ সালে এই শর্ত থেকে সরে গিয়ে সকল নারীকেই ভোটদানের অধিকার দেওয়া হয় |
এতক্ষণে নিশ্চয় বোঝা গেল নারীবাদের উত্পত্তি নারীকে অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা দেবার জন্য হয়নি | ফেমিনিস্ট থিওরির মূল কথা হচ্ছে লিঙ্গ সমতা নির্ধারণ ও স্থাপন |
১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সময়কে ধরা হয় নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপ | দ্বিতীয় ধাপের প্রাপ্তি নারী যে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে পুরোপুরি আত্মনির্ভরশীল এই বোধটা জাগ্রত হওয়া | এছাড়াও শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ, সাংস্কৃতিক বৈষম্যের প্রতি জোর দেওয়া হয় দ্বিতীয় ধাপে |
১৯৬৩ সালে আমেরিকান নারীবাদী লেখক বেটি ফ্রিড্যান রচিত বই 'The Feminine Mystique" নারীবাদী আন্দোলনকে গতি প্রদান করে | শুধুমাত্র গৃহিনী ভূমিকাটি একজন নারীকে যে কতটা অপূর্ণ রাখে এ বিষয়ে হাইপোথিসিসমূলক ধারণা দিয়েছেন | নারীর অন্যান্য ভূমিকা তার পূর্ণতার জন্য কতটুকু গুরুত্ব বহন করে ও কিভাবে এটা অর্জন করতে হবে, কিভাবে মিথ্যা বিশ্বাসের ছায়া থেকে নারীকে বেরিয়ে এসে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে এই বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা আছে এই বইয়ে | বইটি সকল মানুষকে ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছিল | নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছিল বইটিকে ঘিরে | তবুও এই সময় বইটি বেস্টসেলার হয় |
নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপ নারীকে কর্মক্ষেত্রে যাবার স্বাধীনতা দিয়েছে ঠিকই সেই সাথে জুড়ে দিয়েছে 'সুপার মম' ট্যাগ | সন্তানও মনে করে মা ঘরে, বাইরে সমান তালে কাজ করবে একটুও হাঁপাবে না | 'মা' মানেই সব্যসাচী কোনো চরিত্র |
আবার পুরুষদের মনোভাবটি, বেশ তো বাইরে যাচ্ছ যাও, কিন্তু ঘর তোমাকেই সামলাতে হবে | পুরুষ বাইরে গেলে ঘরের চিন্তা কমই করে কিন্তু নারীকে সমানতালে দুটোই সামলাতে হয় |
১৯৯০ সালে দ্বিতীয় ধাপের ভুলগুলো শোধরাবার জন্য শুরু হয় তৃতীয় ধাপের যাত্রা | তৃতীয় পর্বের নারীবাদের সূত্রপাত ঘটে ১৯৯১ সালে রেবেকা ওয়াকার প্রণীত "Becoming the Third Wave" নামক প্রবন্ধটির মধ্য দিয়ে | এই পর্যায়ের নারীবাদ যাদের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁরা হলেন, সেলা স্যান্ডোভাল, বেল হুকস, গ্লোরিয়া আনজালডুয়া, চেরি মোরাগা প্রমুখ |
ধর্মসম্পর্কিত নারীবাদী পামেলা অ্যান্ডারসন "A Feminist Philosophy of Religion" এ বলেছেন, ঈশ্বরের কন্ঠস্বর আসলে পুরুষের কন্ঠস্বর যা নারীকে বদ্ধ ও বন্দী রাখতে সাহায্য করে | আরো বলেছেন, বিশ্বের সব ধর্মের মধ্যে কমবেশি পুরুষ কেন্দ্রিকতা পিতৃতান্ত্রিকতার উপাদান নিহিত রয়েছে |
দীর্ঘদিন ধরে মহিলাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল | এই প্রবণতা থেকে কোনো দেশই মুক্ত নয়, এমনকি উন্মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে দাবী করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নয় | এই প্রসঙ্গে একট ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৮১ সালে নিজের যোগ্যতার সুবাদে মার্কিন দূত হিসেবে নিযুক্ত হওয়া কারপ্যাট্রিক অভিযোগ করেন যে তিনি তাঁর কাজে মার্কিন বিদেশ দপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাননি |
তবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীবাদী চিন্তাধারাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে | এর কৃতিত্ব যেমন বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অগ্রণী মহিলাদের, তেমনি কতিপয় কৃতবিদ্য পুরুষেরও | বর্তমানে বহু মহিলা বিশ্বের নানা প্রান্তে নারীবাদী সংগঠন গড়ে তুলেছেন, নারীবাদী পত্র, পত্রিকা, গ্রন্থ প্রকাশ করছেন |
নারীবাদী আন্দোলনের একজন তাত্ত্বিক নেত্রী হলেন টিকনার | তিনি তাঁর গ্রন্থে নারীবাদ নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, ক্ষমতাকে শুধু প্রাধান্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণের নিরিখে বিচার করলে তা পুরুষতন্ত্রীদের উল্লসিত করলেও নারী-পুরুষের মিলিত প্রয়াসে সমস্যা সমাধানের বিষয়টি অবহেলা করা হবে |
নারীবাদীদের আলোচনার মাধ্যমে এটা প্রতিষ্ঠিত যে, আন্তর্জাতিক সম্গর্কের সমগ্র ক্ষেত্রটি লিঙ্গভিত্তিক; যেখানে পুরুষদের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত | নারীবাদ আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষমতাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে একটা ধাক্কা দিতে সমর্থ হয়েছে | নারীবাদের কল্যাণে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সুরক্ষার সংজ্ঞা অনেকখানি বদলে গিয়েছে | বর্তমানে কেবলমাত্র সামরিক সামর্থ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচিত হয়না, এর সঙ্গে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত সুরক্ষাকেও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয় | পুরুষদের ক্ষমতা নির্ভর রাজনীতির পরিবর্তে নারীদের সংবেদনশীল মনোভাব বিশ্ব রাজনীতির সমস্যা সমাধানে বেশি সাফল্য পাবে বলেই ধারণা করছেন অনেকেই | এই পথে হাঁটলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়টিকে ক্রমান্বয়ে কল্যাণমুখী করে তোলা সম্ভব হবে |
------
শব্দ সংখ্যা—১১২০
তথ্যসূত্র – ১) ফেমিনিজম এর গোড়ার কথা – আন্তর্জাল
২) নারীবাদ –উইকিপিডিয়া
৩) Feminist approach to International relations –আন্তর্জাল
Sabita Ray Biswas
Shankar Tower
Block—4, Flat—3k
Italgachha
Kolkata—700079
Mob/ w/a—8900739788
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন