Featured Post
প্রবন্ধ ।। দ্বন্দ্বতত্ত্বের আবহে সাহিত্যে কল্পকথা ও কল্পচিত্র ।। রণেশ রায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
সাহিত্য ও সাহিত্যিকের সঙ্গে কল্পকথা কল্পচিত্র সৃষ্টির ওতপ্রোত সম্পর্ক থাকলেও সাহিত্যকে নেহাত সাহিত্যিকের স্বপ্ন বিলাস অলস কল্পনার এক আবেগঘন ক্ষণিক মুহূর্তের নান্দনিক প্রকাশ বলে মনে করার কারণ নেই। প্রকৃতিরই অংশ মানুষ তার বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাঁচে। এই অন্তর্মুখী বৈশিষ্ট্য তার চেতনায় আলোকিত। সেটা তার মনোজগত তথা মানসলোক। এই মনোজগতকে মানুষ কথায় প্রকাশ করতে পারে ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে পারে ইঙ্গিতে উপমায় প্রকাশ করতে পারে। একে সাহিত্যিক তাকে নিজের জীবন বোধ সৌন্দর্য বোধে নান্দনিক করে তোলেন সন্দেহ নেই। তিনি সাহিত্যে কল্পকথা কল্পচিত্র সৃষ্টি করেন। কিন্তু তাঁর এই শিল্প সৃষ্টি নেহাত স্বপ্ন বিলাস, জীবনবোধ বর্জিত কল্পনার জালবোনা নয়, তার থেকে বেশি আরো কিছু। একটা সমাজ কাঠামোয় সাহিত্য কোন সমাজের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে বেষ্টন করে থাকে। সাহিত্যিকের জীবন দর্শন জীবন বোধ সমাজের প্রতি দায়িত্ব বোধকে তুলে ধরে।
এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বিষয়টাকে সামগ্রিকতায় বিচার করা দরকার । এই সামগ্রিকতা হল এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড যা প্রকৃতি ও মানব সমাজ আর প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কে সম্পর্কিত। মানুষে মানুষে সম্পর্ক নিয়ে এই সমাজ। প্রকৃতি মানুষকে নিয়ে এই বস্তু জগৎ বা ভৌত জগৎ যা সাহিত্যিককে তার বিষয় বস্তু বেছে নিতে সাহায্য করে।মানুষ তার ইন্দ্রিয় দিয়ে এই বস্তুজগতকে অবলোকন করে, তার বিবর্তন প্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে।তার মনোজগতে প্রতিবিম্বিত হয় এই প্রকৃতি এই মানব সমাজ যখনই সে প্রকৃতিকে মানব সমাজকে প্রত্যক্ষ করে তাকে অবলোকন করে। বস্তুজগতের প্রতিফলন ঘটে তার স্নায়ুজগতে। তার মনোজগৎ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আবার মনোজগৎ এইভাবে যে বার্তা পায় সেটা তাকে উপলব্ধিতে সাহায্য করে। অতীত বর্তমানকালকে সে যেভাবে বোঝার চেষ্টা করে তা তাকে জীবনটাকে বুঝতে সাহায্য করে। তার জীবন বোধ তৈরি হয়। অতীত ও বর্তমানের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়ে ভবিষ্যতকে দেখে মানুষ। সাহিত্যিক তা দিয়ে তাঁর কল্পনার মালা গাঁথেন। এক কল্পচিত্র তৈরি হয় যার থেকে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি যা একান্তই সাহিত্যিকের নিজের এক অনবদ্য সৃষ্টি। ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করতে চান তিনি। এর থেকে সৃষ্টি হয় কল্পকথা যা সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে ভাষায় রূপ পায়। ছন্দ তাল লয়ে কবিতায গল্পে সেজে ওঠে। অর্থাৎ বস্তুজগত যেমন মনোজগতের ওপর ক্রিয়া করে তেমনি মনোজগত প্রকৃতি জগৎকে আলোকিত করে, মানব সমাজের দিক নির্দেশ করে, তাকে বুঝতে সাহায্য করে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে হাসি কান্না প্রেম ভালোবাসা জীবন যুদ্ধকে বোঝার চেষ্টা করেন সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্য চর্চায়। এসবই তাঁর কল্পকথা হয়ে ওঠে, কল্পচিত্র সাহিত্যের সৃষ্টি করে যা সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন ভাবে রূপ পায়। সৃষ্টি হয় সাহিত্য শিল্প।সেখানে মনোজগতের প্রকৃতিজগতের ওপর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াটাও গুরুত্বপূর্ন। এখানেই বস্তু জগৎ ও মনোজগতের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা তাৎপর্যপূর্ণ যা আর বস্তুজগতকে বাদ দিয়ে কল্প বিলাস থাকে না। কবিতায় উভয় জগতের বিষয়টা মূর্ত হয়ে ওঠে। বাস্তব অবস্থা থেকে উঠে এসে লেখকের কল্পজগতে এক কল্পচিত্র সৃষ্টি হয়। সে আবেগ তাড়িত হয়ে ওঠে তাঁর ভাবের জগতে তাঁর ভাবনা তাঁর কল্পকথায়।
আমরা বলেছি যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বস্তুজগত মানুষের মননে কল্পজগতে প্রতিবিম্বিত হয়। সাহিত্যিক তাঁর পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করেন কল্পকথা কল্পচিত্র যা সুর ছন্দ লয়ে ভাষায় সেজে ওঠে সাহিত্যিকের সাহিত্য চর্চায়। মানুষের মনন সাহিত্যের মাধ্যমে বস্তুজগতের ও সমাজজীবনের কর্ম কাণ্ডকে অবলোকন করে তাকে নিজের ভাবনায় রাঙিয়ে নেয়। প্রশ্ন হলো কোনটা প্রধান। বস্তুলোক না মনলোক কোনটা সাহিত্য সৃষ্টিতে সাহিত্যের আধারে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? যারা সাহিত্য সৃষ্টিতে মনলোককে প্রধান বলে মনে করেন তাঁরা মনে করেন বস্তুজগত যেমনই হোক না কেন সাহিত্যিক তাঁর ভাবনায় তাকে যেভাবে দেখেন কল্পনায় তাকে যে ভাবে ভাবেন সেভাবে নিজের ভাবনায় তাকে উপস্থাপন করেন।বস্তুজগতকে তাঁরা মনোজগতের প্রতিবিম্ব বলে মনে করেন। পাঠকের স্বাধীনতা আছে তাঁর মনন দিয়ে গল্প কবিতাকে নিজের মত বুঝে নেওয়ার।তার ফলে বিমূর্ত ভাবে গল্প কবিতাকে পরিবেশন করার সুযোগ থাকে, তাকে নিজের মত করে বুঝে নেয় পাঠক। লেখক যা বলতে চান তা না বুঝলেও তা যদি পাঠকের মননে আনন্দ উৎসারিত করতে পারে তবেই সাহিত্যিকের সাহিত্য পরিবেশন সার্থক বলে এঁরা মনে করেন। আর যাঁরা মনে করেন বস্তুজগতটা প্রধান তার আধারে কল্প কথার সমন্বয়ে সাহিত্য সৃষ্টি হয় তাঁরা বস্তুজগতকে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দিয়ে চেনার চেষ্টা করেন।মনোজগতকে বস্তুজগতের প্রতিবিম্ব বলে মনে করা হয়। যেটা যেমন তাকে পাঠক সেভাবে যেন দেখতে পারেন। সাহিত্যিক সমাজের ভবিষ্যত গতিপথ নিয়ে ছবি আঁকতে পারেন। সাহিত্য সমাজের কাজে লাগে পরিবর্তনের দিশা দেখাতে পারে নেহাত পাঠকের মনোরঞ্জন করে না, নেহাত বিমূর্ত ভাবে তাকে পরিবেশন করে না।
দেখা গেল বস্তু ও ভাবের এক দ্বিমুখী সম্পর্ক দেখা যায়। হেগেলের মত দার্শনিকরা বস্তু ও ভাবের মধ্যে ভাবকে প্রাধান্য দিয়ে জীবনকে জীবনের ভালমন্দকে ব্যাখ্যা করেছেন । তাঁর অনুগামী সাহিত্যিকরা সাহিত্য কর্মকে সাহিত্যিকের মনের রঙে রাঙানো বলে মনে করেন। রামায়ন মহাভারতে সাহিত্যিকের কল্পনায় চরিত্রের সৃষ্টি। তার বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। সেখানে মানুষকে দেবতার আসনে নয়তো রাক্ষস খোক্ষস বা অসুর বলে চিত্রিত করা হয়ছে। অপরদিকে বস্তুবাদী ভাবনায় বস্তু প্রাধান্য পায়। বস্তুজগতকে সাহিত্যের আধার বলে বিবেচনা করা হয়। কার্ল মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন অনুসরণ করে সমাজের শ্রেণী দ্বন্দ্বকে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রধান দ্বন্দ্ব বলে মনে করেন। আর শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিতে সাহিত্যিকের কাঙ্ক্ষিত জীবন বোধকে দেখার চেষ্টা করেন।তাকে কেন্দ্র করে মার্কসবাদী সাহিত্য গড়ে ওঠে যেখানে তথাকথিত শ্রেণীনিরপেক্ষ সাহিত্য সৃষ্টিকে শোষক সম্রদায়ের স্বার্থ সিদ্ধ করে, শোষণ নিপীড়নের হাতিয়ার বলে মনে করা হয়। তাঁরা মনে করেন শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রেণী নিরপেক্ষ সাহিত্য বলে কিছু হয় না।
সাহিত্যের আঙিনায় বিচরণরত বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনার আগে সাহিত্যের সঙ্গে অর্থনীতি রাজনীতি ইতিহাস দর্শনের মত বিষয়গুলোর সম্পর্ক নিয়ে কিছু আলোচনা নেওয়া উচিত।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন