Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

পুস্তকের আলোচনা ।। অরবিন্দ পুরকাইত (পুস্তক : দলিত মুক্তি সূর্য । লেখক : নৃপেন্দ্রনাথ জোলুয়া)



দলিত-ভাবনা বা আম্বেদকর-দর্শন অধিগত যত, কবিতা তত সবল নয়

 অরবিন্দ পুরকাইত

 

নৃপেন্দ্রনাথ জোলুয়া মূলত কৃষক পরিবারের সন্তান, কিন্তু একইসঙ্গে শিক্ষিত পরিবারেরও বটে। যে শিক্ষা তাঁকে কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে এবং 'ধর্ম'ক্ষেত্রে দিয়েছে ভিন্নতর দিশা। জয়নগর থানার মিঠানী নামক সুমিষ্ট-নাম গ্রামে তাঁর জন্ম (১৯৬২)। তাঁর পিতা অভিমন্যু জোলুয়া মাইতিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক ছিলেন, নিয়মমাফিক অবসর গ্রহণের পরেও যিনি শিক্ষোন্নতির ভাবনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি কোনোদিনই।

দলিত মুক্তি সূর্য — শ্রী জোলুয়ার নিজের ভাষায়— 'দলিত কবিতার বই' এবং এটি তাঁর 'প্রথম প্রয়াস'। চার ফর্মার বইটিতে রয়েছে চল্লিশটি ছোট-বড় লেখা।

'কবি কথা'য় আত্মপরিচয়ে বলেছেন তিনি, 'দলিত গ্রামের মূলত কৃষক পরিবারের জন্ম আমার। পদবিতেও সেই দলিতের ছোঁয়া। হয়তো নিঃশ্বাসেও সেই দলিতের গন্ধ। সেই ছোট্ট বেলা থেকে গ্রাম্য প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে শহরের কলেজ পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী বন্ধুবান্ধব এমনকি অভিভাবকদের মধ্যেও লক্ষ্ করেছি একটি প্রকট পার্থক্য সামাজিক উঁচু নিচুর। লক্ষ করেছি আমাদের প্রতি এদেশের উচ্চ বর্ণ মানুষের অসীম অপমান ও ঘৃণা। স্নাতকের পর চাকরির ক্ষেত্রেও সর্বত্র সংরক্ষণের বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে অথচ সে সময় আমাদের অনেকেই তথাকথিত উচ্চবর্ণের ছাত্র ছাত্রীদের থেকে কোন অংশেই কম ছিলো না। পরন্তু সংরক্ষণ আমাদের গণতান্ত্রিক দেশের বিশ্ববিখ্যাত সংবিধান স্বীকৃত, সর্বসম্মত এবং সংখ্যাধিক্যের বিচারে এদেশের সকল মূলনিবাসীর পাওনা, দয়া অথবা ভিক্ষে নয়। তবু অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে আমাদের দলিত সমাজের ছেলে মেয়েরা আজও কাল ঘুমে ঘুমিয়ে আছে এবং মাঝ পথেই কেমন হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে নিজেদেরই হীনমন্যতা থেকে।'

তাঁর লেখাতেও তাই তিনি গগনমার্গে বিচরণ করেননি, নিত্য সামাজিক বাস্তবতা থেকে সওয়াল করেছেন দলিত-জাগরণের সপক্ষে। বাবাসাহেব আম্বেদকর-দর্শনের অনুসারী হয়ে একান্তভাবে জোর দিয়েছেন তিনি প্রকৃত শিক্ষার উপর আর সে শিক্ষার হাত ধরে যাবতীয় কুসংস্কারমুক্ততার উপর, অন্ধ দেব-দ্বিজভক্তির বিরুদ্ধাচরণের উপর, তুকতাক-মন্ত্রতন্ত্রের প্রতি আস্থাহীনতার উপর। আর এসবের সঙ্গে সঙ্গে হীনমন্যতায় না ভুগে তথাকথিত নিম্নবর্ণ বা নিম্নবর্গ হিসাবে গর্ব অনুভব করা, নিজেদেরকে উন্নত ও প্রতিষ্ঠিত করা এবং সেইসঙ্গে পিছিয়ে-থাকা স্বজনের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। দলিতদের আত্মসম্মানজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে আত্মসমালোচনার পথ ধরে মহিমান্বিত আত্মমর্যাদার অধিকারী হওয়া। আর সার্বিক সেই উত্তরণ-অভিযাত্রায় সমাজের 'অর্ধেক আকাশ' যেন অবহেলিত না থাকে। বঞ্চনা ও অধিকারদমনের ধারাবাহিকতায় যুগের পর যুগ কটিয়েও সমাজের পরম সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই অংশে— বিশেষত বাবাসাহেবের সংগ্রামী প্রচেষ্টায়— আজ যখন আলোকিত অংশ নগণ্য নয়, পনেরোর জায়গায় পঁচাশি হয়েও কেন তাদের যোগ্য প্রতিনিধিত্ব প্রতিফলিত হবে না সমাজ-কাঠামোর সর্বস্তরে— প্রশ্নদীর্ণ হন তিনি এই ভাবনায়, হন প্রতিবাদী।

চার ফর্মার বইয়ের তাঁর লেখার ভাষায় যেভাবে এসেছে, সংক্ষিপ্ত কয়েকটি উদ্ধৃতির মাধ্যমে একটু আভাস নেওয়ার চেষ্টা করা যাক। একাধিক দৃষ্টান্তের উদ্দেশ্য রয়েছে, সে কথা যথাসময়ে।

নাম-কবিতায় শুরু হচ্ছে বই এই উচ্চারণে —

'অজ্ঞতার অন্ধকারে

তুমিই আলোর সূর্য

হে মহামানব

আম্বেদকর,

প্রণাম তোমাকে

তোমাকেই প্রণাম।'

এমন ছয় চরণের সাতটি অনুচ্ছেদ, শেষ হচ্ছে এইভাবে —

'দলিতের মরণ ঘুম

ভাঙিয়েছ তুমিই

অন্ধকার পূব আকাশ

রাঙিয়েছ তুমিই,

প্রণাম তোমাকে

তোমাকেই প্রণাম।'

আরও একটি দীর্ঘ লেখা রয়েছে আম্বেদকরকে নিয়ে 'হে মহামানব' শিরোনামে।

আজও অনেকের কাছে আম্বেদকর মূর্তিমান এক অস্বস্তি! —

'মোড়ের মাথায় ওই লোকটাই

কোট-প্যান্ট-টাই-চশমা পরা,

ওই আসল নাটের গুরু

হাতে একটা বইও ধরা।' (ওই লোকটাই)

বাস্তব কী?

'জানি বাস্তবে নেই

কোন জাত ধর্ম বর্ণ

তবু মানুষের তৈরি সমাজে

আমাকে ফেলা হ'ল

নিচু জাতের দলে।' (দলিতের গন্ধ)

থোড়াই কেয়ার —

'আজ আমি দ্বিজ

না না, ব্রাহ্মণ দ্বিজ নই

আজ আমি শুদ্র-দ্বিজ

মা শুদ্রাণী বাবা শুদ্রই।' (আজ আমি দ্বিজ)

'জন্ম আমার দলিত ঘরে

দলিত হয়েই মরতে চাই,

দলিত আমার মাতা পিতা

দলিত আমার বোন ও ভাই।' (দলিত আমি)

'তোমরাই বলো আমরা তেওর

তোমরাই বলো বাগদি পোদ,

তোমরাই বলো ছোট জাত

নেই আমাদের বুদ্ধি বোধ,

আমরা পুজো বন্ধ রেখে

আরামে পোহাচ্ছি রোদ।'

...

'মন্দির নয় ইস্কুল গড়ে

সব জানাবো কিতাব পড়ে,

সব চালাকি ধরবো এবার

ধরবো এবার সব গলদ,

আমরা পুজো বন্ধ রেখে

আরামে পোহাচ্ছি রোদ।' (তোমরাই বলো)

গ্রামদর্শন না হলে কি দলিত-দর্শন পূর্ণতা পায়? —

'আমি গ্রাম দেখিয়াছি গ্রাম

অবহেলিত দলিত নিপীড়িত গ্রাম,

মিঠানী কামদেবনগর রাজাপুর

কাঁটাপুকুর ত্রিলোক পাত্রের চক।'

...

'আমি গ্রাম দেখিয়াছি গ্রাম, যাই হোক নাম

যেথায় মন্দিরে মন্দিরে দেব-দেবীর সমারোহ

সকাল সন্ধ্যায় যারা ঘণ্টা বাজায় প্রদীপ জ্বালায়

তাদের ঘরে অন্ধকার, নেই জ্ঞানের আলো।' (আমি গ্রাম দেখিয়াছি। ষাট চরণের লেখার প্রথম ও শেষ অনুচ্ছেদ)

চাষির ছেলের চাষই গৌরব—

'আমি কিন্তু চাষির ছেলে

চাষ আমার পারিবারিক পেশা

মাছ ধরা ঘনি আটোল বোনা

আমার বংশগত নেশা।' (আমি কিন্তু)

শিক্ষা ও কুসংস্কারমুক্ততার কথা, দলিত-জাগরণের কথা আসে তাঁর একাধিক লেখায়—

'মানুষ হতে শিক্ষা চাই

যে শিক্ষায় গলদ নাই,

যা দিতে পারে 'মা-বাবা'ই

আর স্বচ্ছ শিক্ষক শিক্ষিকাই।

'খাই বা না খাই

শিক্ষা চাই,

ভিক্ষা নয়

শিক্ষা চাই,

দীক্ষাও নয়

শিক্ষা চাই।' (শিক্ষা চাই)

'কুসংস্কারে আগুন চাই

জীর্ণ সমাজ শুদ্ধি চাই,

উড়ুক অশুভর দগ্ধ-ছাই

মানুষের মত মানুষ চাই।' (এসো সবাই)

'জানি মন্ত্রে কোন শক্তি নেই

কোন কালে কেউ ভষ্মও হয়নি,

সাপের বিষও নামেনি কখনও

বশীকরণও হয়নি কোথাও,

তবুও আমরাই শ্রাদ্ধে মন্ত্র পড়ি

মা-বাবা স্বর্গে যাবে বলে।' (এসো শুরু করি)

'আর কবে জাগবে দলিত

ভাঙবে তাদের কাল-ঘুম,

আর নিজেদের চিনবে কবে

ফিরবে আলোর মরসুম।' (কাল-ঘুম)

'ছোট জাত'কে মাথায় তুলতে নেই। তাদের ভোটটা নিশ্চিত করা চাই -

'ভোট এলো, ভোট চাই

দলিতের ভোটটা চাই,

তাই বাজাই দলিত-ঢাক

জাত ধর্ম তোলা থাক।' (ভোট এলো)

 

'তখনই বলেছিলাম

ছোট জাত মাথায় তুলতে নেই

...

এখন নিজেরাই দিচ্ছে বিয়ে

আমাদের ভাত মেরে দিয়ে,

শ্রাদ্ধর বদলে শ্রদ্ধা শুরু

দেখতে হবে আরও কত কি...' (তখনই বলেছিলাম)

দোষ আমাদেরও কম নয়, ফুটে ওঠে আত্মসমালোচনার সুর -

'আমরাই আমাদের খু্ঁড়েছি কবর

ভবিষ্যত প্রজন্মকে তুলেছি চিতায়

বাপ-ঠাকুরদার দোহাই দিয়ে

আজও ব্রাহ্মণের পা ধোয়াই

বিধান মানি তেত্রিশ কোটির প্রণামী দিই

অবুঝের মতো যোহুজুর হই আমরাই

তাই দোষ অন্য কারোর নয়

দোষ আমাদের আমাদেরই।' (দোষ কারো নয়)

 

অর্ধ-অঙ্গকে দুর্বল রেখে, অবহেলা করে আমরা সজীব, সফল হওয়ার স্বপ্নে মশগুল! -

'তুমি নারী

কেবলমাত্র নারীই

অচ্ছুৎ তাই পুরুষ সমাজে,

তুমি নারী তুমিতো নারীই

তাই পুরুষ রাখে তোমায় অন্তরালে

পুরুষ বাঁধে তোমায় বেড়াজালে

নিজেরা না বেরোলে মুক্তি নেই কোন কালে।' (তুমি নারী তাই)

জাতের নামে বজ্জাতি করে জাত জালিয়াত যারা খেলছে জুয়া, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীকেও কি তারা ছোট জাত বলে অবহেলা করবে! -   

'জাতের নামে বজ্জাতি

ঘুচবে না ভাই রাতারাতি,

অনেক দিনের অভ্যেস

এক দিনে হবে না শেষ।' (বজ্জাতি)

'এখনো কি কেউ বলবে তোকে অস্পৃশ্য ছোট জাত

দেশের পায়ে জীবন রেখে কাটালো কত অতন্দ্র রাত,

কে কি বলে কি আসে যায় তুই আমাদের নয়ননিধি

পরাধীন আমরা নিজের দেশে এখনও সেই জাতপাত...' (শ্রদ্ধাও করি)

ভড়ংসর্বস্বদের পয়সামুখী মন্ত্র আর লুটে উদাসীন ভগবান -

'শুধুই তিলক টিকিধারী

পৈতেধারী অহংকারী

ধান্দাবাজি ধাপ্পাবাজি,

পয়সা পেলেই অংবংচং

নইলে ফটো ঢংঢংঢং

টাকা না পেলে পাজী।' (আমি এখন দ্বারকায়)

 

'মুরাদ থেকে ঔরংজেব

দস্যু ডাকাত লুটেরা,

ধ্বংস করে নিয়ে যায়

সোনা দানা খুঁটেরা।

 

তুমি নাকি ভগবান

তুমি অসীম শক্তিধর

সেদিন কেন নীরব ছিলে

আছে কি কোন উত্তর।' (সোমনাথ)

স্বাধীনতার পঁচাত্তরেও কতটা পালটেছে গরিবের দুর্গতি? -

'পঁচাত্তর বছরেও সেই একই ছবি

নুন আনতে পান্তা ফুরাতে আমি

আর তুমি শুয়ে টাকার পাহাড়ে

এ স্বাধীনতার দাবিদার আমি নই।' (স্বাধীনতা)

'প্রতিবছর 'বৃষ্টি-চাপান'

ভাসায় মাঠের ধান,

ভরসা ঐ শাক পাতা থোড়

আর সরকারি কিছু অনুদান।

 

নিয়মমাফিক কেউটে কামড়

রোগ শোক জ্বালা বজ্রপাত,

এইতো জীবন, আমার জীবন

বৃষ্টিমুখর দিন ও রাত।' ( বাল্যের বর্ষা)

'ভুল তোদের একটাই

একটাই অপরাধ,

গরীব ঘরে জন্মেছিস

কখনও মিটবে কি তোর সাধ!' (একটাই অপরাধ)

আমাদের মতো নিম্নবর্গের মানুষই যে যে কারণে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিল তার মধ্যে 'নিচু জাত' হিসাবে তথাকথিত উচ্চবর্ণের অবহেলা ছিল অন্যতম প্রধান কারণ। সম্প্রীতির বাণী শুনি এখানে -

'তোমার আমার একই দেহ

একই রক্ত একই প্রাণ,

তোমার আমার একই পণ

বেঁচে থাকুক দেশের মান।

 

তোমার আমার একই হাত

একই সালাম-আলিঙ্গন,

তোমার আমার একই মাটি

একই দেহ একই মন।' (শপথ)

একইসঙ্গে সংশয় আর উন্নতির অঙ্কটাও বুঝে নেওয়া -

'যার যত সংখ্যা ভারী

তার তত অংশীদারি,...

জানতে অজান্তেই ভুরি ভুরি

স্বপ্ন যাদের হচ্ছে চুরি,

সেই আদিম ভূমিসন্তান

আর কবে হবে তাদের উত্থান।' (আর কবে)

'তোমরা তো ভাই পনের মাত্র

আমরা সেথায় পঁচাশি,

ঠিক হিসেবে অঙ্কটা হোক

ফুটুক সবার মুখে হাসি।' (সংরক্ষণ)

অদৃশ্য কলকাঠিতে নাড়াতে কেমন আমরা লড়াই করি নিজেদের মধ্যে! -

'তোমরা বাধাও মুরগী লড়াই

লড়াই করি আমরাই

তোমরাই বসে মজা দেখ

হাততালি দাও তোমরাই।' (মুরগী লড়াই)

'আর দেরি নয়' কবিতায় বইটি শেষ করেছেন তিনি এইভাবে —

'যে আগুন আজ ওদের ঘরে

সে ভীষণ ভয়াল,

আমার ঘরেও লাগতে পারে

আজ নয়তো কাল।

 

আর দেরি নয় আসুন সবাই

ঘর ছেড়ে পথেই নামি,

সব বাধা বিপদ দেখুন

কেমন সহজে যায় থামি।'

 

উদ্ধৃত করা হল যথেষ্টই, তার দু একটি কারণ আছে। শ্রী জোলুয়ার বক্তব্যের জোর, একইসঙ্গে কবিতা হিসাবে লেখার মানের দিকও যাতে আড়ালে না থেকে যায় পাঠকের। সর্বোপরি বইটি বেশি মানুষের কাছে হয়তো পৌঁছাবে না, এই লেখার মাধ্যমে দু-একজনকে কিঞ্চিৎ স্বাদ দেওয়া। কবিতা নানা রকমেরই হয়। সহজ ভাষায় সরাসরি বক্তব্যপ্রধান কবিতা অবহেলার নয় নিশ্চয়ই, তবে প্রথম এবং প্রধান শর্ত এই যে তাকে অবশ্যই কবিতা হয়ে উঠতেই হয়। বিজ্ঞানের ছাত্র-এ-বইয়ের লেখকের দলিত-ভাবনা তথা আম্বেদকর-দর্শন যতটা অধিগত, কবিতা হিসাবে লেখাগুলি অধিকাংশই সেই স্তরে উন্নীত হতে সক্ষম হয়নি। এ বিষয়ে 'কবি কথা'র শুরুতেই তাঁর সংশয় আমূলক নয়, "'কবি' বলছি কিন্তু সেই অর্থে আমি কবিই নই।" শেষের দিকেও লিখেছেন, 'কবিতার বই বলছি বটে কিন্তু এগুলো আদৌ কবিতা হয়েছে কিনা তার বিচারের ভার রইল আমার প্রিয় পাঠকের উপর।' বক্তব্য (বা বক্তব্যহীনতা) যেমনই হোক, লেখাকে আগে কবিতা হয়ে উঠতেই হয়। যদিও পিছনের প্রচ্ছদে শংসামূলক সংক্ষিপ্ত এক লেখায় ('কবি পরিচিতি') এ জেলার একাধারে মান্য কবি, কথাকার এবং গীতিকার পঞ্চানন দাস একাধিকবার কবি উল্লেখ-সহ এমনকি 'স্বভাব-কবি'ও বলেছেন শ্রী জোলুয়া সম্বন্ধে। স্বভাব-কবি অনেক মানুষকেই বলা যায়, কারণ অন্তরে অনেকেই কবি-স্বভাব বা কবি, কিন্তু পাঠক বা দর্শকের সামনে যতক্ষণ স্বভাব-কবির বৈশিষ্ট্য ফুটে না উঠছে ততক্ষণ স্বভাব-কবি হিসাবে পাঠক বা দর্শকস্বীকৃতি লাভ করা মুশকিল। শ্রী জোলুয়ার লেখাতে সে বৈশিষ্ট্য অমিলই। শ্রী দাসের কলমে শ্রী জোলুয়ার – প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিক যাঁর 'কর্মজীবনও শিল্পবিদ্যা সম্বন্ধীয়' - যে যাপনচিত্রটি ফুটে উঠেছে তা বড় সুন্দর, স্নিগ্ধ।


    শ্রী দাস লিখেছেন, 'এ কাব্যের কবি স্বচক্ষে দেখেছেন এক উলঙ্গ হৃদয়হীন সমাজ, শোষক ও অত্যাচারী, দৃষ্টিহীন ও অহংকারী সমাজ, দেখেছেন ধর্মান্ধ ও বিকলাঙ্গ সমাজ। দেখেছেন সমাজের উদভ্রান্ত মানুষ, ভাষাহীন ক্ষুধিত মানুষ। দেখেছেন দলিতের ওপর নির্যাতন, শুনেছেন অবহেলিতের কান্না। আর দেখেছেন একদিকে ধর্মীয় আফিঙ-এ জারিত মানুষ, অন্যদিকে অসহায় মানুষের বেদনা ও আর্তি। স্বভাবতই কবির কলমে এ সবেরই প্রতিচ্ছবি-প্রতিধ্বনি এবং প্রতিবাদ না থেকে পারে না। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে প্রতিবাদ ও হুঁশিয়ারী।'
    বইটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, শ্রী দাস বইটি পড়ে লেখা এবং লেখকের সংক্ষিপ্ত সুন্দর একটি পরিচিতি লিখে দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর সুদক্ষ কবিতার হাতে যদি একটু সংস্কৃত হতে পারত এই লেখাগুলো তাহলে এর মান খানিকটা উন্নত হত বলেই স্থির বিশ্বাস এই আলোচকের। এত বানানভুলও প্রশ্রয় পেত না কিছুতেই।
আশা রাখব শ্রী জোলুয়া তাঁর চিন্তন, মনন ইত্যাদির প্রকাশ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবেন না, মাধ্যম যেমনই হোক।
    পুস্তকটি উৎসর্গীকৃত শ্রী জোলুয়ার মাতা-পিতা ঊষারাণী-অভিমন্যু জোলুয়াকে।
    অংশুমান সরদারের প্রচ্ছদ ভাল। 
 
-------------------------------------
 
পুস্তকের নাম : দলিত মুক্তি সূর্য
লেখকের নাম : নৃপেন্দ্রনাথ জোলুয়া
প্রকাশকের নাম : সুস্মিতা জোলুয়া ও মৌমিতা দাস, বেলিয়াডাঙ্গা, দক্ষিণ বারাশত, জয়নগর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
প্রকাশকাল : ৩০ চৈত্র ১৪২৯ (১৪ এপ্রিল ২০২৩)
মূল্য : ৭০ টাকা
  =========================

(পুস্তকটি সহকর্মী রমানাথ জোলুয়ার থেকে পাওয়া, তাকে ধন্যবাদ)

 

 

অরবিন্দ পুরকাইত

গ্রাম ও ডাক – গোকর্ণী,

থানা – মগরাহাট

জেলা – দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩