Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গল্প ।। ভয়ংকর স্মৃতি ।। অনিন্দ্য পাল

 

ভয়ংকর স্মৃতি // অনিন্দ্য পাল 

                                                এক 

" এক হস্তিনীর প্রেমে পাগল দুটি দাঁতাল হাতির লড়াইয়ে একটি দাঁতালের মৃত্যু হয়েছে। রবিবার সকালে ঝাড়গ্রামের লোধাশুলি রেঞ্জের আসনবনি জঙ্গলে ওই যুবক হাতির মৃত্যু হয়। বনদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, হাতিগুলি সবই দলমা থেকে আসা। নয়াগ্রাম এলাকা থেকে প্রায় ৬০টি হাতির দল এখন দলমার দিকে ফিরছে।" খবরটা এই অব্দি পড়ে সৌম্য আড়চোখে রিমির দিকে তাকাল। একমনে রাত্রের শেষ সাজগোজটুকু সেরে নিচ্ছে। আয়নায় রিমি, সেই প্রতিফলন চোখে নিয়ে সৌম্য সৌন্দর্যের জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। শরীরের আংশিক অনাবৃত ধবলতা রিমিকে একধরনের স্বর্গীয় সৌষ্ঠব দিয়েছে, কিন্তু সৌম্যর কেন জানি মনে হচ্ছে, রিমির এই রূপ আসলে অনেক মাজা-ঘষার ফল। গত পাঁচ বছর ধরে রিমির শরীরের চড়াই-উৎরাই ভাঙতে ভাঙতে আর বিপজ্জনক খাদের অতলান্তে তলিয়ে যেতে যেতে সৌম কখনো ক্লান্ত হয়নি। আর হবেই বা কেন, এই জন্যই তো সে রিমিকে চেয়েছিল। প্রকৃতিগতভাবেই সৌম কখনো বেশি ন্যাকামো করেও না, কারও ন্যাকামো পছন্দও করে না। ভালোবাসা, মন, আবেগ-- এসব তার কাছে একধরনের সুচতুর ন্যাকামি। সৌম্য জানে এবং বিশ্বাস করে শরীরের উপভোগ দিয়েই সব সুখ শান্তি পাওয়া যায়। পয়সা ছড়ালে সব কিসমের সুখ, মায় নারীও যে সুলভ, এটা সৌম্য প্রায়শই তার বন্ধুদের বোঝায়, ঠিক যেমন করে তাকে বোঝানো হয়েছিল ছোটবেলা থেকে। 
       ছোটখাটো একটা কম্পিউটার সেন্টার চালায় সৌম্য, সঙ্গে জমির দালালি করে অবসর সময়ে। বেশ ভালোই কামায়। এখন অবশ্য কম্পিউটার সেন্টারের থেকে দালালিতে বেশি উপার্জন হচ্ছে তার। সারাদিন ছোটাছুটি, একবার ছুটছে সোনারপুর তো কয়েকঘণ্টা পরে যেতে হল ডায়মণ্ডহারবার। একটা এনফিল্ড বুলেট কিনেছিল, সেকেন্ডহ্যান্ড কিন্তু খুব ভালো কন্ডিশনের। সেটাই তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। সারাদিন পয়সার পিছনে ক্ষুধার্ত বাঘের মত দৌড়ে রাতে বিছানায় তরল হয়। রিমি সবদিন সমানভাবে সাড়া দিতে না পারলেও সৌম্য নিজগুণে ক্ষমা করে দেয়। বছর তিনেকের ছেলে কুনাল দোলনায় দুলতে দুলতে ঘুমায়, মাঝে মাঝে জেগে উঠলেও মায়ের উপর বাবার দাবীর কাছে সে বারবার পরাজিত হয়। সৌম্যর কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে রিমি যখন কুনালকে বুকে তোলে, বেশিরভাগ দিনই কুনাল ককিয়ে যায়। নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে সৌম্য। পরদিন সকালে আবার উঠতে হবে তাকে। তাদের পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবন এভাবেই চলছে। আজও রিমি সাজগোজ শেষে কুনালের দোলনায় একটু দোল দিয়ে বিছানায় এল। 
        সৌম্য রাত্রে ডিনারের প্লেটে যেমন নিজের পছন্দ মতো খাবার নিজেই সাজিয়ে নেয়, বিছানাতেও রিমিকে নিজের পছন্দ মত ব্যবহার করতে ভালোবাসে। অন্যান্য দিনের মতো আজও অভ্যাসবশত রিমির দিকে ফিরতেই হঠাৎ কিছুক্ষণ আগে পড়া খবরটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। রিমিকে তার হঠাৎ করেই মনে হল ওই হস্তিনীটার মত। আর নিজেকে তার মনে হল ওই দাঁতাল যুবক হাতি দুটোর একটা। যেন সে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে, তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে খতম করে রিমির দখল নিয়েছে। কেমন একটা অস্বস্তি তাকে অস্থির করে তুলল। অনেকদিন আগের একটা রাতের ছবি সৌম্যর স্মৃতির পর্দায় জীবন্ত হয়ে উঠতে চাইল, প্রাণপণ চেষ্টা করে সেটাকে আবার কালের অন্ধকার গুহায় বন্দী করার চেষ্টা করছিল সে, একটু আঁতকে উঠে বিছানায় উঠে বসলো। রিমি তার বিছানায় উঠে বসাটাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও, সৌম্যর চোখ-মুখের আকস্মিক পরিবর্তনে অবাক হয়ে গেল। 
-- কী হলো তোমার? শরীর খারাপ লাগছে? জল দেব? 
-- না, না। আমি ঠিক আছি। একটু পায়চারি করে আসছি, তুমি শুয়ে পড়। 
রিমির অবাক চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল সৌম্য। বলা ভালো কোনোমতে নিজেকে সরিয়ে নিল সে। 
       
                                                  দুই 
রাত তখন প্রায় ১১টা। মফস্বলের রাস্তা দিয়ে দুজন মানুষ হেঁটে আসছে। মৃদুস্বরে তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলছে। রাস্তার টিউবের আলোয় পথ চলতে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। হঠাৎ চারজন অপরিচিত যুবক ঘিরে ধরল তাদের। পুরুষ দুজন সবিস্ময়ে দেখলো তারা চারজনই সশস্ত্র। মুখগুলো খোলা। তারা কিছু বুঝে উঠার আগেই শুরু হয়ে গেল বেদম প্রহার। এলোপাথাড়ি লোহার রড নেমে আসতে লাগল মাথা থেকে পা পর্যন্ত বারবার। মানুষ দুটো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পড়ে গেল রাস্তার উপর। চিৎকার টুকুও করতে পারলো না তারা। আততায়ী চারজনের একজন এবার পকেট থেকে একটা ধারালো ক্ষুর বার করলো। তারপর দ্রুত এগিয়ে গেল রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে। কিন্তু কি আশ্চর্য! ক্ষুরটা কেবল মাত্র রাস্তার উপর পড়ে থাকা একজন মানুষের গলার নলিটা উন্মুক্ত করে দিয়েই আবার শান্ত হয়ে গেল। 
     পরদিন সকাল। ভিড়ে ভিড়াক্কার। সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, পুলিশ আর স্থানীয় নেতারা হাজির হয়েছে অকুস্থলে। স্থানীয় মানুষ ও ভিড় করেছে কাতারে কাতারে। রাস্তায় পড়ে থাকা বডি দুটোকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কিছুক্ষণ পর খবর এল, পড়ে থাকা একজন মানুষ গতকাল রাতেই মারা গেছে আর অন্য জন এখনও হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। ইতিমধ্যে দুজন মানুষেরই বাড়ি থেকে আত্মীয় স্বজনরা চলে এসেছে। তাদের কাছ থেকে জানা গেল পুরুষ দুজন গত রাতে কোনো এক বন্ধুর বাড়ি বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিল। কারোরই গত রাতে ফেরার কথা ছিল না। বাড়ির লোক নিশ্চিন্তেই ছিল। সকালে হঠাৎ এই খবরে তারা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। 
      মানুষগুলোর দেহ যেখানে পড়ে ছিল, সেটা বিয়েবাড়ি যাবার ঘুরপথ। অজস্র কান্নাকাটি আর জনগনের কৌতুহলী প্রশ্নের মুখে মৃত পুরুষের দেহটা হাসপাতাল থেকে বের করে মর্গে পাঠানো হল। অন্যজন সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় রইলো। 
     ঘটনার পর প্রায় ১৫ দিন কেটে গেছে। অপর পুরুষ প্রায় সুস্থ। পুলিশের প্রশ্নের মুখে সে যা বললো, 
-- আমরা দুই বন্ধু হেঁটে বিয়েবাড়িতে যাব বলেই ওই পথ ধরে যাচ্ছিলাম। উপহার হিসেবে আমাদের কাছে একটা হীরের নেকলেস আর ফুলের তোড়া ছিল। হঠাৎ করে চারজন লোক মুখে রুমাল বেঁধে আমাদের ঘিরে ধরল। ওরা প্রত্যেকেই সশস্ত্র ছিল। আমরাও তাই ওদের সঙ্গে কোনো বচসায় যেতে চাইছিলাম না। নেকলেসটা নিয়ে নেওয়ার পরেও ওরা আমাদেরকে মারলো। আমার বন্ধু একটু প্রতিবাদ করতে তাকে একেবারে শেষ করে দিল। 
এই ঘটনার পর আজ প্রায় ছ'বছর কেটে গেছে। সেই খুনিরা আজও ধরা পড়েনি। বেঁচে যাওয়া পুরুষটা এখন ভালোই আছে। 
  
                                                        তিন 

গত তিন দিন ধরে সৌম্য বারবার নিজেকে অতীতের গুহায় হারিয়ে ফেলছে। দু-দিন হল তার কম্পিউটার সেন্টারেও যায়নি। আজও সকালে সোনারপুরে যাওয়ার কথা ছিল, একটা জমি বিক্রি হত। সৌমর ইচ্ছা করলো না। সে একটু এদিক সেদিক করে বুলেটটা নিয়ে বের হল। রিমিকে বলে যাওয়ার ধার সে কোনো দিনই ধারে না, আজও বললো না। 
      কতটা সময় এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছে সেটা সৌম্য খেয়াল করে নি। হঠাৎ সে নিজেকে আবিষ্কার করলো, অঞ্চলদের বাড়ির সামনে। অঞ্চল বোস, তার ক্লাসমেট, সেই প্রাইমারি থেকে কলেজ পর্যন্ত। বছর ছয়েক আগে খুন হয়ে গেলো হঠাৎ। বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। অঞ্চলের বাবা ওর ছোটবেলাতেই মারা যান। গুড়াখুর পারিবারিক ব্যবসাটা ওর মা একাই চালিয়ে অঞ্চলকে মানুষ করে তুলছিলেন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ভালো চাকরি পেয়েছিল, জয়েন করার মাত্র তের দিনের মাথায় খুন হয়ে গেলো ছেলেটা। বছরখানেকের মধ্যে মারা গেলেন অঞ্চলের মা, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। তিনি কি জানতেন এমনটা হবে বা হতে পারে? না হলে কেন তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গেলেন "শান্তিনীড়" বৃদ্ধাশ্রমকে। 
      মিনিট খানেক একদৃষ্টিতে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলো সৌম্য। অনেক পরিবর্তন হয়েছে, সামনে বিশাল গেট সহ পাঁচিল। ভিতর থেকে সমবেত জাতীয় সঙ্গীত ভেসে আসছে। এখন এখানে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালায় শান্তিনীড়। বাইক থেকে নেমে গেটের দিকে একটু এগিয়ে গেল সৌম্য, কিন্তু একটা জিনিস চোখে পড়তেই সৌম্যর মাথাটা ঘুরে গেল! দেওয়ালের গায়ে আঁকা একটা হাতির ছবি, হাতিটা যেন তার দিকেই শুঁড় তুলে তাকালো! সৌম্যর চোখে ভেসে ওঠে সেই খবরটা। দেওয়ালে আঁকা হাতিটা যেন সেই হস্তিনী হয়ে উঠে তার দিকে তেড়ে আসতে লাগলো। আর ঠিক তার পরেই রিমির মুখটা ভেসে উঠলো, সে যেন পরম ঘৃণাতে মুখটা অদ্ভুত আর অসম্ভব বিকৃত করে তার দিকে একটা তির্যক দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে অন্যদিকে মুখটা ফিরিয়ে নিল। নগ্ন শরীর নিয়ে তাকে পিছনে ফেলে কোন কুয়াশাময় একটা রহস্যের দুনিয়ায় হারিয়ে গেল। কোনো রকমে বাইকের উপর এসে বসলো সৌম্য, চাবিটা দেওয়াই ছিল, ঘুরিয়ে স্টার্ট দিল, কিন্তু কয়েক মিটার গিয়েই সৌম্যর মাথাটা গেল ঘুরে, আর বাইকটা নিয়ে পিছলে গিয়ে পড়ল কংক্রিটের ঢালাই রাস্তায়। 
  
                                            চার 
নার্সিংহোম থেকে সৌম্যকে বার করে নিয়ে বাড়ি ফিরতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেল রিমির। বাড়ি ফিরে প্রথম যে কাজটা সে করলো, ফোন করলো তার দাদা অবনীশ কে। তিনি ডাক্তার এবং এতদিন যাবৎ রিমির অভিভাবকত্ব করে এসেছেন। আগামীকাল সকালে আসবেন বললেন।  
        সৌমকে অঞ্চলদের বাড়ির সামনে পড়ে থাকতে দেখে কয়েকজন এলাকাবাসী। তারাই ব্যবস্থা করে সৌমকে নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। ওর পার্সের পকেটে থাকা কাগজপত্র থেকে তারা ফোন নম্বর পেয়ে রিমিকে ফোন করে জানায়। রিমি এই হঠাৎ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় কেমন যেন ভূতগ্রস্তের মত হয়ে আছে। বিয়ে হওয়া ইস্তক সৌমকে সে কয়েকবার মাত্র জ্বরজারি-সর্দি ছাড়া আর কোনও অসুখেও পড়তে দেখেনি। সৌমর সুঠাম শরীর আর ইস্পাতের মত শক্ত মন রিমিকে সুখ আর দুঃখের নাগরদোলায় দুলিয়েছে বরাবর। আর আজ সেই মানুষটা এরকম একটা কান্ড কি করে ঘটালো সেটা কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছে না। 
     নার্সিংহোম থেকে বাড়ি পর্যন্ত সৌম একটাও কথা বলেনি। শুধু মাথার দু-দিকটা হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে আছে। বহুবার জিজ্ঞাসা করেছে রিমি, অনুনয় বিনয় করেছে বহুবার কিন্তু কোনো ফল হয়নি। আর এটাতেই রিমি আরও বেশি করে ঘাবড়ে গেছে। কিন্তু খাওয়া দাওয়া তো করতে হবে, কুনালকে পাশের বাড়ির গীতা বৌদির কাছে রেখে এসেছে। ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করে তবে আনতে যাবে। রিমি কিচেনে ঢুকল, সৌম বেডরুমে খাটের উপর বসে আছে, নির্বাক নিস্তব্ধ। সব্জির একটা আঝালা তরকারি করে, কুনালের জন্য দুধটা গরম বসাতে যাচ্ছিল সবে, পিছনে একটা পায়ের শব্দ শুনে চমকে পিছন ফিরে তাকাল রিমি। কিন্তু যা দেখলো, তাতে তার হাড় হিম হয়ে গেল! সৌম কখন পায়ে পায়ে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, হাতে তার সদ্য কয়েকমাস আগে লাইসেন্স পাওয়া রিভলবারটা। এ কি ভয়ঙ্কর দৃষ্টি সৌমর চোখে! এমনটা তো এর আগে কখনও দেখেনি রিমি! সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল তার। একটা বিশ্রী খিস্তি দিয়ে সৌম বললো, 
-- সব শেষ করে দেব আজ! সব ধংস করে দেব। না তুই, না আমি। 
আতঙ্কে মূহ্যমান রিমির মাথায় কিছুই আসছিল না। সভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে হঠাৎ তার অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, 
-- কেন? কী হয়েছে? আমি কী করলাম? তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? 
ভয়ঙ্কর মুখ বিকৃত করে চেঁচিয়ে উঠলো সৌম, 
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি! তোর জন্য রে শয়তানি! তোর জন্য সেই কলেজ থেকে আমি পাগল হয়ে গেলাম আর তাই… 
এইটুকু চিৎকার করে বলে থমকে গেল সৌম। হতবুদ্ধি রিমি বললো, 
-- এতদিন পর এই সব কচকচি করে কি লাভ? 
-- লাভ? লাভ কিছুই নেই। সবটাই লোকসান। আমার সব গেছে শুধু তোকে পেতে গিয়ে। 
আরও বিস্মিত হয়ে রিমিও এবার প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো, 
-- মানে? কি বলতে চাইছো? আমার জন্য? আমার জন্য তোমার কি ধংস হয়েছে? কিইবা ক্ষতি-লোকসান হয়েছে? ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে রিমি। দু-হাতে আঁকড়ে ধরে নিজের বুক। 
-- জানিস না, তুই কিছুই জানিস না। কেমন একটা অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মত হেসে উঠলো সৌম। 
তারপর কয়েক পা এগিয়ে এসে বললো, 
-- অঞ্চলের কথা ভুলে গেছিস না একে বারে? তোদের তো সবই হয়ে গেছিল। বিয়েটাও হত যদি না... 
অত্যন্ত উত্তেজনায় কথা আটকে গেল সৌমর। কয়েকবার কাশির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠলো তার শরীর, তারপর আবার নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে লাগলো, 
-- যদি না আমি সেদিন অঞ্চলকে সরিয়ে দিতাম চিরকালের মতো। 
-- তুমি? তুমি মেরেছ অঞ্চলকে? এসব কি বলছো? অঞ্চল তো তোমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল। তুমি যে বলেছিলে মরার আগে অঞ্চল তোমাকে বলে গেছে " রিমিকে দেখিস, ওর যেন কোনো কষ্ট না হয়"। তা হলে সে সব? 
-- সব, সব মিথ্যে! ওই নেকলেসের গল্পটাও। ওগুলো আমারই বানানো গল্প। ওদিন আমিই মেরেছি অঞ্চলকে। শুধু তোকে পাওয়ার জন্য, তোর সবকিছু ভোগ করার জন্য আমিই, আমিই করেছি। আমার লাগানো লোকেরাই তো রড দিয়ে এলোপাথাড়ি মেরেছে ওকে। আমার পিঠে আর পায়ে মারতে আমিই বলে দিয়েছিলাম ওদেরকে। অঞ্চলের গলায় ক্ষুরটা তো চালিয়েছি আমি নিজেই। কিন্তু ও সেই মুহূর্তে যে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে, সেটাই, সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টিটাই আমাকে কয়েকদিন ধরে কুরে কুরে খাচ্ছে! কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না আমি। সব ভুলে গেছিলাম। কিন্তু ওই হস্তিনী! ওই হস্তিনীটাই আমাকে আবার সব কিছু মনে করিয়ে দিল। আর পারছি না, পারছি না ওই ভয়ানক দৃষ্টিটা সহ্য করতে। মরতে হবে, মরতে আমাকে হবেই। আর আমি তো তোকে রেখে মরবো না, তোকে আগে মারবো, তারপর নিজেকে শেষ করবো। কুনালটা আছে ওখানে, থাক, ও কখনো জানতেই পারবেই না! 
  থেমে গেল সৌম। তার চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। লাল হয়ে গেছে চোখদুটো। রিমি একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ হাতে গরম ছ্যাঁকা খেয়ে ওর সম্বিত ফিরে এলো। কুনালের দুধটা উথলে উঠেছে সসপ্যানে। এগিয়ে আসছে সৌম্য, রিভলবার তাক করেছে রিমির মাথা লক্ষ্য করে। কয়েক সেকেন্ড, হঠাৎ দরজার বাইরে গীতা বৌদির গলা, " রিমি, রিমি কি হয়েছে রে? এত চিৎকার করছিস কেন তোরা?" 
  রিমির ভিতরে একটা আগুন জ্বলে উঠলো এতক্ষণে। হাতের মুঠোয় সসপ্যানের হ্যান্ডেলটা ধরে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করলো সৌমর মাথায়। রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেল হাত থেকে। সৌম সটান পড়ে গেল কিচেনের মেঝেতে। অঞ্চল! এভাবেই তবে অঞ্চলকে তার জীবন থেকে সরিয়ে তাকে দখল করেছিল সৌম। না, এখন এই মুহূর্তে আর কোন ভালোবাসা বা আকর্ষণ নেই তার সৌমর প্রতি। রিমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তুলে নিল রিভলবারটা, সৌম শিখিয়ে দিয়েছিল তাকে কি ভাবে চালাতে হয়। 



মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩