সমাজতন্ত্র গঠন প্রক্রিয়ায় সাংস্কৃতিক বিপ্লব
রাশিয়ায় নভেম্বর বিপ্লবপূর্ব জার আমলে জারের নেতৃত্বে রাশিয়া বহুধা বিভক্ত
ছিল । বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত মানুষজনের আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার খর্ব করে
তাদের ওপর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাশিয়ার প্রাধান্যবাদের অধীনে তাদের পশুর জীবন
যাপনে বাধ্য করা হয়েছিল। নাগরিকদের ভোটাধিকার স্বীকৃত ছিল না। রাশিয়ায়
পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটলেও পশ্চিমি দেশের পুঁজিবাদের তুলনায় রাশিয়া ছিল পশ্চাপদ।
সেকানে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে নি । সামাজিক জীবনে রেনেসাঁর প্রভাব পড়ে নি।
সাধারণ মানুষ ছিল দারিদ্র নিপীড়িত। মহিলাদের স্বাধিকার খর্ব হত। সেটা ছিল
জারের আমলের বহু নিন্দিত অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ । নভেম্বর বিপ্লব রাশিয়াকে এই
অবস্থা থেকে মুক্ত করে বৃহত্তর সোভিয়েত রাশিয়ার জন্ম দেয় যার অর্থনৈতিক
ভিত্তি সমাজতন্ত্র । এটা নেহাত বিভিন্ন ভৌগলিক অঞ্চলের যোগফল নয় । জন্ম নেয় এক
নতুন মানস যে মানস মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়, যে সমতার ভিত্তিতে মানুষের
জীবন জীবিকা শিক্ষা চিকিৎসা নিশ্চিত করার কথা বলে । মুষ্টিমেয় পুঁজিবাদীর
ক্ষমতার ও তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা তাদের রাজত্বের অবসান ঘটায় । রাজতন্ত্রের
অবসান ঘটে । রাষ্ট্র দেশের সম্পত্তির মালিক হয় । রাষ্ট্রের মালিকনাকে ও তাকে
কার্যকরী করার স্বার্থে গড়ে তোলা হয় এক সোভিয়েত যার রূপকার সোভিয়েত বিপ্লবের
নেতা ভি আই লেনিন। পশ্চিমি গণতন্ত্রের নামে পুঁজিবাদকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না
। বিপরীতে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় । এক বিকল্প শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে
তোলার কাজ শুরু হয় । স্বাভাবিক কারণেই রাশিয়ার ধনিক সম্প্রদায় একে মেনে নেয়
না। পশ্চিমী পুঁজিবাদী সমাজ এর বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে। এই চক্রান্ত
ব্যর্থ করে প্রথমে লেনিন ও পরে তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী স্টালিনের নেতৃত্বে
সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার প্রভূত উন্নতি হয়। সাধারণ মানুষের জীবিকা নিশ্চিত হয়।
যদিও তাদের জীবন বিলাস বহুল প্রাচুর্যময় হয়ে উঠতে পারে নি বরং ধনীদের জীবন
যাপনের মান নেমে আসে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবিকা শিক্ষা চিকিৎসা নিশ্চিত হয়
। 1925 সালের পরে যখন পশ্চিমি দুনিয়া অথনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত, অর্থনৈতিক
মম্দা সে দেশগুলোকে গ্রাস করে, উন্নয়নের গতি স্তদ্ধ হয়ে যায় তখন সোভিয়েত
রাশিয়া উন্নয়নের গতি বাড়িয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করে । সারা পৃথিবী জুড়ে বিকল্প এই
উন্নয়নে সাড়া পরে যায় । মানুষ নতুন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। এই সময়কালে
সোভিয়েত রাশিয়ায় ধর্ম্ম বর্ণ নিয়ে দাঙ্গা বন্ধ হয় । জনসাধারনের স্বার্থে আইন
রচিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানের ফ্যাসিস্ট শাসক হিটলারের পতন ঘটে
স্টালিনের নেতৃত্বে । পশ্চমি দুনিয়াতেও সোভিয়েতের এই জয়ে সাড়া পরে যায়।
চার্চিল বা আইসিনহাওয়াররাও স্টালিনের নেতৃত্বের মৌখিক স্বীকৃতি দেন যদিও তাদের
স্টালিনের তথা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত বন্ধ হয় না । মিথ্যার বন্যা
বইয়ে দিয়ে মানুষের পশ্চাদপদ চেতনাকে উস্কে দেওয়ার কাজ চলতে থাকে। পার্টি ও
জনগনের মধ্যে বিশ্বাসঘাতক ঢুকিয়ে দেওয়া হয় । সমাজতন্ত্র গঠনের পাশাপাশি তার
বিরোধী শক্তির প্ররোচনায় সমাজতন্ত্র ধ্বংসের কাজ চলতে থাকে । শেষ পর্যন্ত
চক্রান্তকারীরা জয়ী হয় । ইতিমধ্যে চিনেও মাওসেতুঙের নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক
বিপ্লব সম্পন্ন হ্য় । সেখানেও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি স্বার্থকতার সঙ্গে গড়ে
ওঠে । কিন্তু পরে সোভিয়েতের মত চিনও তেঙসিয়াও পিংয়ের নেতৃত্বে পুঁজিবাদের পথ
ধরে। এভাবে সমাজতন্ত্রের পশ্চাদঅপসারণের সঠিক কারণ খুঁজতে গেলে বিপ্লবের পরে
সমাজতান্ত্রিক গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজন কেন
সেটাও বুঝতে হয়। সেটা লেনিন ষ্টালিন মাও সবাই বুঝেছিলেন। বিপ্লবের আদর্শে
বিশ্বাসী ও সেই কাজে নিয়োজিত মানুষকেও আজ সেটা বুঝতে। নভেম্বর বিপ্লবের
তাৎপর্য বুঝতে গেলে এটাও বোঝা অবশ্য কর্তব্য। নভেম্বর বিপ্লব মানে নেহাত একটা
বিকল্প অর্থনীতি ও তার সঙ্গে রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা নয় তার সঙ্গে উন্নত
মানবমুখী সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা যে সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করবে তার
জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে ।
মাওসেতুঙের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক চিনে ষাটের দশকে সমাজতন্ত্র গঠন প্রক্রিয়ায়
সাংস্কৃতিক বিপ্লব কথাটা ব্যাপকতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করলেও কথাটা সমাজতান্ত্রিক
সোভিয়েত গঠনতন্ত্রের আমলেও বিশেষ তাৎপর্য বহন করতো। আর মানব সমাজের বিকাশের
বিভিন্ন স্তরে অর্থনৈতিক বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতে
বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। সেদিক থেকে সাংস্কৃতিক বিপ্লব একটি বহমানতা, ধারাবাহিক
বিপ্লবী অগ্রগমন যা ঘটে চলেছে আদিম সমাজকাল থেকে। আজও তা বহমান। অর্থনৈতিক
কাঠামোয় পরিবর্তনের সঙ্গে উপরিকাঠামোয় এই পরিবর্তন অর্থনৈতিক পরিবর্তনকে
অনুসরণ করে। সমাজতন্ত্র আবির্ভাবের আগে বিপ্লবী পরিবর্তনগুলো প্রথমে অর্থনীতির
ভিতে পরিবর্তন আনে। সেখানে বিপ্লব ঘটলেও শোষণ ব্যবস্থা অন্যভাবে টিকে থাকে
একটা স্তরে নতুন অর্থনীতির বিকাশের পর তাকে স্থায়িত্বের তাগিদে রাষ্ট্রক্ষমতা
দখলের মাধ্যমে বিপ্লব সম্পন্ন করা হয়। নতুন অর্থনীতির আধারে যেমন রাষ্ট্র
ক্ষমতা দখলের কাজ সম্পন্ন হয় তেমনি সংস্কৃতির জগতেও এক বিপ্লবী পরিবর্তন
অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রক্রিয়াটি আলোচনার
মধ্যে দিয়ে আমাদের আলোচনায় ঢুকতে পারি ।
কম্যুনিষ্ট ইস্তাহারের লেখক কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস লেখেন:
" মানব সভ্যতার ইতিহাসে বুর্জোয়া শ্রেণী খুবই বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছে
-------- উৎপাদনের উপকরণের অবিরাম বিপ্লবী পরিবর্তন না ঘটিয়ে এবং তার সঙ্গে
সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্ক ও সমগ্র সমাজ-সম্পর্কে বিপ্লবী বদল না ঘটিয়ে বুর্জোয়া
শ্রেণী বাঁচতে পারে না। "
সমাজ বিবর্তনের একটা স্তরে পুঁজিবাদের ঊষালগ্নে বুর্জোয়াশ্রেণীর প্রগতিশীল
চরিত্র একটা ঐতিহাসিক অনিবার্যতা। এই মূল্যায়ণ ধরে অনেকে পুঁজিবাদকে একটা
শাশ্বত অপরিবর্তনীয় প্রগতিশীল ব্যবস্থা বলে চিহ্নিত করেন। এর কোন বিকল্প থাকতে
পারে বলে ভাবতে পারেন না। এরা সমাজ বিকাশের নিয়মকে অস্বীকার করেন। বিকাশের
নিয়মে বস্তুর অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ও ঐক্যের বিষয়টা উপলব্ধি করেন না। বোঝেন
না বা বোঝার চেষ্টা করেন না যে একটা ব্যবস্থা তার ভ্রুণ অবস্থা থেকে পরিণতি
পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়। সে জন্ম নেয়, বিকাশ লাভ করে এবং
বিকাশের প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত দ্বন্দ্বের সঠিক সমাধান না পেলে শেষ পর্যন্ত ধ্বংস
হয়। এরই গর্ভে জন্ম নেয় নতুন ব্যবস্থা। আজ থেকে একশ বছর আগে রাশিয়ায় সর্বহারা
বিপ্লবের নেতা ভি আই লেনিনের নেতৃত্বে সেখানে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে যে
সমাজতান্ত্রিক সমাজের জন্ম হয় তাই পুঁজিবাদের পতনের বাস্তবতা প্রমাণ করে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তর ব্যাখ্যা করে তার চূড়ান্ত স্তরে একচেটিয়ার
বিকাশকে তিনি ব্যাখ্যা করে দেখান যে পুঁজিবাদের এই স্তরটি একটি চূড়ান্ত
প্রতিক্রিশীল স্তর এবং তার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের মধ্যেই তার পতনের বীজ নিহিত
থাকে। এই স্তরে পুঁজিবাদের গর্ভেই নিহিত থাকে তার ধ্বংসের বীজ আর একই সঙ্গে এক
নতুন সম্ভাবনা। একচেটিয়া পুঁজিবাদের এই স্তরটি হল সাম্রাজ্যবাদ যা পুঁজিবাদের
সর্বোচ্চ স্তর বলে লেনিন দেখান। আজ ভারতের মত দেশে এই সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে
চেপে বসেছে নয়া সাম্রাজ্যবাদের রূপ নিয়ে সেটা বুঝব না যদি পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ
স্তরটাকে বুঝতে না পারি। আমরাও পুঁজিবাদকে আজ প্রগতিশীল একটা ব্যবস্থা হিসেবে
দেখে মারাত্বক ভুল করব। আজকের ভারতে বিপ্লবী অনুশীলনে বিষয়টা বিশেষ
গুরুত্বপূর্ণ।
আবির্ভাব লগ্নে পুঁজিবাদের আধারে ক্রিয়াশীল থাকে ছোট ও মাঝারি মাপের অসংখ্য
প্রতিযোগী শিল্প সংগঠন। ব্যক্তিগত একমালিকী বা অংশীদারি কারবারি। এরা গড়ে ওঠে
কৃষি ও ব্যবসায় দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত পুঁজির সাহায্যে। শিল্পপুঁজিবাদের
আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই বাণিজ্য পুঁজিবাদের আবির্ভাব ঘটে কৃষি, ব্যবসা,
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে কেন্দ্র করে। কার্যত সামন্তবাদের গর্ভে পুঁজিবাদের এই
ভ্রুণ জন্ম নেয়। সামন্ত ব্যবস্থার গর্ভে এই ভ্রুণ কয়েকশো বছর ধরে পুষ্ট হয় ও
শেষ পর্যন্ত প্রসবিত হয়। পুঁজিবাদের জন্ম হয় সামন্ততন্ত্রের তিন পাহাড়কে
সরিয়ে। এই তিনটে পাহাড় হলো ১) রাজতন্ত্র ২) পোপতন্ত্র ও ৩) সামন্ততন্ত্র।
কয়েকশো বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বিবাদের মধ্যে দিয়ে গিয়ে বাণিজ্যবাদের স্তর
পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদের আবির্ভাব ঘটে। পুঁজিবাদের প্রাথমিক স্তর-টা
প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদের স্তর বলে পরিচিত। প্রাথমিক অবস্থার এই স্তরটা
একটা প্রগতিশীল স্তর যদিও এরই মধ্যে তার আগ্রাসী চেহারাটাও মার্ক্স্ এঙ্গেলস
প্রত্যক্ষ করেন। তারা বলেন :
" কালক্রমে বুর্জোয়াশ্রেণী বিশ্ববাজারকে কাজে লাগাতে গিয়ে প্রতিটি দেশেরই
উৎপাদন ও উপভোগে একটা বিশ্বজনীন চরিত্র দান করেছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষুব্ধ
করে তারা শিল্পের পায়ের তলা থেকে কেড়ে নিয়েছে সেই জাতীয় ভূমিকা যার ওপর
ভিত্তি করে শিল্প আগে দাঁড়িয়ে ছিল । সমস্ত সাবেকি শিল্প হয় ধ্বংস পেয়েছে নয়
প্রত্যহ পাচ্ছে। তাদের স্থানচ্যূত করছে এমন নতুন নতুন শিল্প যার প্রচলন সকল
সভ্য জাতির পক্ষেই মরাবাঁচা প্রশ্নের সামিল; এমন শিল্প যা শুধু দেশজ কাঁচামাল
নিয়ে নয় দূরতম অঞ্চল থেকে আনা কাঁচামালে কাজ করছে ; এমন শিল্প যার উৎপাদন শুধু
স্বদেশেই নয় ভূলোকের সর্বাঞ্চলেই ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশজ উৎপন্ন যা মিটত তেমন সব
পুরানো চাহিদার বদলে দেখছি নতুন চাহিদা, যা মেটাতে দরকার সুদূর বিদেশের নানা
আবহাওয়ায় উৎপন্ন। আগেকার স্থানীয় ও জাতীয় বিচ্ছিন্নতা ও স্বপর্যাপ্তির বদলে
পাচ্ছি সর্বক্ষেত্রেই আদান প্রদান, জাতিসমূহের বিশ্বজোড়া পরস্পর নির্ভরতা।
বৈষয়িক উৎপাদনে যেমন তেমনি মনীষার ক্ষেত্রে। এক একটা জাতির মানসিকতা হয়ে পরে
সকলের সম্পত্তি। জাতিগত একপেশেমি সংকীর্ণচিত্ততা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ে ;
অসংখ্য জাতীয় বা স্থানীয় সাহিত্য থেকে জেগে ওঠে একটা বিশ্ব সাহিত্য" (
কমুনিস্ট ম্যানুফেষ্ট)
উপরের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে অর্থনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা
স্বত:স্ফূর্ত ভাবেই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়ে যায়। রাষ্ট্র এই
পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করলেও এই প্রক্রিয়া অনেকটা স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে
কারণ শোষণের সস্কৃতিটা থেকে যায় যা মানুষের মনোনে হাজার হাজার বছর ধরে গেড়ে
বসে থাকে। আত্মকেন্দ্রিকতা যার ভিত্তি, আত্মস্বার্থের দর্শন যাকে পুষ্ট করে।
তারই ছত্রছায়ায় শোষণ ব্যবস্থা টিকে থাকে। সনাতনী ভাববাদের ওপর আঘাত এলেও নতুন
রূপে যান্ত্রিক বস্তুবাদের দর্শনকে আঁকড়ে ধরে সে টিকে থাকে। ভাববাদের এক ইতর
বিশেষ রূপ হলো যান্ত্রিক বস্তুবাদ। প্রাধান্য বাদের নতুন এক দর্শন সৃষ্টি হয়
যা শোষক ও শোষিতের মধ্যে বিভাজনকে সনাতনী চিরস্থায়ী অবশ্যম্ভাবী বিভাজন বলে
মনে করে .
পুঁজিবাদের বিকাশের ধরণটা আর তার সঙ্গে আত্মকেন্দ্রিকতার চূড়ান্ত বিকাশটাকে
ধরতে না পারলে তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংস্কৃতিটা ধরতে পারব না . এর সঙ্গে যুক্ত
আজকের সাম্রাজ্যবাদের যুগের সংস্কৃতি যা গড়ে তুলেছে ভোগবাদ সমরবাদ ও তারই
পরিপূরক হিসেবে আত্মসমর্পনবাদ . একচেটিয়া পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক বিষয় হলো এই
বিষয় গুলো . এদের উৎখাত না করে পাল্টা সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না
পারলে সমাজতন্ত্র চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে পারে না . সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনের
অভিজ্ঞতা সেটাই বলে . আজকের যুগে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে
ভিত্তি এলাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রের নেতৃত্বে সে লড়াই শুরু করে দিতে হয় .
বিপ্লবের পর এই লড়াইটার কথা ভাবা যাবে বলে বসে থাকলে চলে না . এই সাংস্কৃতিক
বিপ্লবের লড়াই নতুন মানুষ গড়ার লড়াই . পুঁজিবাদের গর্ভে পুষ্ট যুক্তিবাদী
মানুষের বিরুদ্ধে আত্মত্যাগী মানুষ গড়ার লড়াই . সাংস্কৃতিক বিপ্লবের এই
তাত্ত্বিক দিকটা বুঝতে গেলে আত্মকেন্দ্রিক যুক্তিবাদী মানুষটাকে চিনে নিতে হয়
কারণ এ লড়াই যুক্তিবাদী তথা চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক মানুষটাকে উচ্ছেদের লড়াই .
একই সঙ্গে বিপ্লবে বিশ্বাসী মানুষের নিজের বিরুদ্ধে নিজের লড়াই কারণ
যুক্তিবাদী মানুষের আত্মকেন্দ্রিক দর্শন আমাদের সবাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে
রেখেছে. এ অতি কঠিন লড়াই .
ধনতন্ত্রের বিকাশ ও আত্মকেন্দ্রিক যুক্তিবাদি মানুষ :
অষ্টাদশ শতকে শিল্পপুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের
আবির্ভাব ঘটে তার শাসন ব্যবস্থা কি হবে কোন মননের দ্বারা অর্থনীতি পরিচালিত
হবে তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়, পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে . মনে করা হয় যে রাজতন্ত্র
নয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে আরো মসৃণভাবে কাজ করার
সুযোগ করে দেবে. গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমেই কেবল দেশের শাসন
তার গণভিত্তি খুঁজে পায় এমন নয়, দেশের অর্থনীতি পরিচালনার এক উপযুক্ত পরিবেশ
সৃষ্টি হয় যেখানে বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ নয়, ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া শৃঙ্খলা নয়, এক
স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত অর্থনৈতিক পরিবেশই পারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে
সবচেয়ে নিপুণ এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে. এই নিয়ন্ত্রণমুক্ত অর্থনৈতিক
ব্যবস্থাই হলো বাজার ব্যবস্থা যেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতারা সার্বভৌম উৎপাদন
ব্যবস্থা থেকে নি:সারিত বন্টন ব্যবস্থা আপনা থেকেই স্বয়ংক্রিয় বাজার ব্যবস্থার
মাধ্যমে উৎপাদনে
সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও সমাজ বিপ্লব
কোন নিদৃষ্ট অর্থনীতির কাঠামোর ওপর গড়ে ওঠে তার সঙ্গে মানানসই একটা
সংস্কৃতি যার মৌলিক উপাদান হলো সমাজ চেতনা শিল্প সাহিত্য চলচিত্র পুজো আচার
আস্তিকতা নাস্তিকতা. এ সবই হল সংস্কৃতির অঙ্গ . এক ধরনের সমাজের অর্থনীতির
আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার উপযুক্ত সংস্কৃতি তৈরী হয় যে সংস্কৃতি
নিদৃষ্ট অর্থনীতিকে মদত করে . আর সমাজবোধ সমাজ চেতনার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা
সংষ্কৃতি ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখতে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রাজনৈতিক উপরিকাঠামো হিসেবে সামরিক রাষ্ট্রশক্তি যতটা শক্তিশালী সাংস্কৃতিক
শক্তি তথা হাতিয়ারটা তার থেকে কম শক্তিশালী নয় . সমাজ চেতনা একটা
প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ ভাঙতে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নতুন সমাজ গড়তে
ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর ঠিক এইজন্যই সাংস্কৃতিক বিপ্লব
ধারণাটা আমাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ ।
অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ জুড়ে সামন্ততন্ত্রের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ঘটিয়ে
প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদ বুর্জোয়া বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় যাকে
শিল্প বিপ্লব বলা হয়। ইংল্যান্ডে এর সূচনা হলেও সারা ইউরোপে তা ছড়িয়ে পড়ে।
শুধু অর্থনীতি নয় এর উপরিকাঠামো রাজনীতি ও সংস্কিতির জগতে এক বিপ্লব সংগঠিত
হয় যার সপ্মর্কে কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস বলে গেছেন বলে আমরা দেখি । মানুষের
চেতনার জগতেও এক মৌলিক পরিবর্তন আসে । অর্থনীতি ও ব্যবসায় যুক্তিবাদী মানুষ ও
তার স্বার্থ সিদ্ধির দর্শনকে রূপ দেওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যেমন
চালু হয় মানুষের জীবনযাপন আচার ব্যবহার শিল্পসাহিত্যে তেমনি ব্যক্তি
স্বাধীনতার কথা বলা হয় যার ওপর দাঁড়িয়ে এক নতুন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে .যুক্তিবাদ
ধর্মীয় ভক্তিবাদের জায়গা দখল করার চেষ্টা করে । কিন্তু নতুন সমাজ যেহেতু নতুন
কায়দায় শোষণকে অব্যাহত রাখে তাই সমাজে শ্রেণীবিভাজন নতুন পদ্ধতিতে টিকে থাকে।
যে সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতা দেখা যায় তা ধনি শোকশ্রেণী ভোগ করে । গরিবরা অনুগত
থেকে যেন নতুন শাসন ও শোষণ মেনে নেয় তার জন্য এক আনুগত্যের দর্শন চালু হয়।
আনুগত্য আর ধর্মের নামে ভক্তিবাদ যার মূল কথা । সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে
যুক্তিবাদ পিছু হটে । প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য শিল্প জগতে প্রযুক্তির
দরকার হয়। সেইজন্য সেখানে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির খণ্ডিত প্রয়োগ দেখা যায় ।
সামগ্রিক সমাজজীবনকে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি বেষ্টন করতে পারে না । বিজ্ঞান
প্রযুক্তির অবাধ বিকাশ সত্ত্বেও তা মানবতার স্বার্থে কাজে লাগে না । মুনাফার
দর্শনের সে লেজুড় বৃত্তি করে । সমাজ জীবনে ভক্তিবাদ তথা অনুগ্রহবাদ আর তার
সঙ্গে পশ্চাদপদ রীতি নীতি চালু থাকে । সে অর্থে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পূর্ণতা
লাভ করে না । এই অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও বুর্জোয়া বিপ্লব ও তার সঙ্গে পুঁজিবাদ
ইতিহাসে প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছে সন্দেহ নেই ।
শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপে রেনেসাঁ ঘটে চলে যা কার্যত সাংস্কৃতিক
বিপ্লব . এই বিপ্লব শোষণের গোড়া ধরে টানে না .শোষণটা টিকে থাকে . উৎপাদিকা
শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের বৈরিতামূলক দ্বন্দ্বটা নতুন রূপ পায়. বরং শোষণটা
নতুন ও আরো তীব্র ভাবে অব্যাহত থাকে . তাও কার্ল মার্কস পুঁজিবাদকে তৎকালীন
পরিপ্রেক্ষিতে প্রগতিশীল ব্যবস্থা বলেছেন. মানব সমাজের ইতিহাসের একটা স্তরে
এটা প্রগতিশীল কারণ পুরোনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামন্ত তান্ত্রিক
উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদিকা শক্তি বিকাশে যখন অক্ষম হয়ে উঠেছিল তখন বুর্জোয়া
বিপ্লব সেই বাধা দূর করে, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটে. কিন্তু পুঁজিবাদের
অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আবার উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদিকা শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব
এমন এক স্তরে পৌঁছয় যার সমাধানের একমাত্র পথ আবার এক বিপ্লব. সমাজতন্ত্র গঠন .
তার সঙ্গে নতুন এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব যা শোষণহীন শ্রেণীহীন সমাজকে মদত করে
.সেটা না হলে আবার পশ্চাদ অপসারণ কারণ আত্মকেন্দ্রিকতাকে কেন্দ্র করে শোষণের
বীজটা টিকে থাকে . এই স্তরে লড়াইটা আরো তীব্র . রাষ্ট্র টিকে থাকে যেটা কাম্য
নয়. এই সংগ্রামে জয়ী হলে সমাজ আমাদের কাঙ্খিত সাম্যবাদের স্তরে পৌঁছতে পারে
যখন রাষ্ট্র নিজেই উবে যায় .রাষ্ট্র নয় সমাজ উপকরণের মালিক হয় . এক নতুন
অর্থনীতি তার সঙ্গে নতুন মানুষকে নিয়ে এক শ্রেণীহীন সমাজ গড়ে ওঠে . পুঁজিবাদের
সংকট একে অনিবার্য করে তোলে .তবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এটা ঘটে না. সচেতন মানুষের
অবিরাম আত্মত্যাগের পথে এই লড়ায়ের মাধ্যমে সেই স্তরে পৌঁছতে হয়. ইতিহাসের
স্তর পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে . দাস ব্যবস্থায় অভস্ত হয়ে যাওয়া মানুষ আজকের
স্তরের মানব সভ্যতাকে যেমন কখনো অনুমান করতে পারে নি তেমনি আজকের প্রযুক্তির
স্তরে আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদের স্তরে আগামী এই কাঙ্খিত সমাজকে অনুমান করা
আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন.লেনিন বা মাওএর মত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন
মানুষরা ই পারেন সেটা করতে.এর জন্য দরকার কঠিন অনুশীলনের. চেতনার জগতে
যুক্তির সঞ্চয় ও বিজ্ঞান চর্চ্চার মাধ্যমে সেটা বুঝতে হয়. চেতনার সেই
মহাস্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হয় . সেজন্য সংস্কৃত বিপ্লবকে চেতনার মহাস্ত্র
বলা চলে :
মহাস্ত্র
জমা আছে জেনো
আমাদের ভাণ্ডারে সে অস্ত্র ,
শ্রম যুক্তি মনন অভিজ্ঞতায়
গড়ে তুলেছি সেই মহা মন্ত্র
উজাড় করে দিই যা আছে যার
চিনে নাও তাকে, থেকো না
সময়ের অপেক্ষায় আর,
সে অস্ত্রে সজ্জিত তুমি আমি
ক্রুশে বিদ্ধ হয়েও আমরা বাঁচি
ত্রিশূল আমাদের বিঁধতে পারে না
আণবিক বোমা পরাস্ত সে অস্ত্রে
তলোয়ারের ধার কাটে না
আমরা যে সজ্জিত সৈনিক সে বস্ত্রে
আমি আজ বিদ্রোহী সন্ত্ৰাসবাদী
শত্রুর বুকে ত্রাস আমি
আমি আজ বিবাদী ;
বলি আমি জনে জনে
মহাস্ত্র জমা সবার ভাণ্ডারে,
সে অস্ত্র আমার আলিঙ্গনে
সে নিরব প্রেম আমার
সশস্ত্র লড়াই তার মননে ,
তার প্রেমে বলীয়ান আমি
সে আমার হাতিয়ার
কানে কানে কথা কয়
সে আমার প্রত্যয়,
যুক্তির তলোয়ারে শত্রু ছিন্ন ভিন্ন
ডরি না আর শত্রুরে
আমি শত্রুর বুঁকে এঁকে যাই পদচিহ্ন,
এসো বন্ধু হাতে হাত রাখো
চিনে নাও আমার তোমার সে মহাস্ত্র
আমাদের চেতনা আমাদের মনন
আমাদের জীবন আমাদের চলন
আমাদের বিশ্বাস
সেই মহা মন্ত্র আমার তোমার ,
সেই আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস
সে অস্ত্রে বলীয়ান সকলে বন্ধু
শান দাও সে অস্ত্রে সবার
'পাড়ি দিতে হবে সিন্ধু '
চেতনার জগতের অস্ত্রকে শানিত করে শত্রুকে আঘাত করার কাজটা করতে হয় সাংস্কৃতিক
বিপ্লবের মাধ্যমে পূরণ আত্মকেন্দ্রিক ধ্যানধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা
সংস্কৃতির জায়গায় গড়ে তুলতে হয় সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় গড়ে ওঠা আত্মত্যাগের
সংস্কৃতি যা শোষণহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দিতে পারে। লেনিনের
নেতৃত্বে সোভিয়েত গড়ে তুলে যৌথ স্বার্থের এক মনন গড়ে তোলার সক্রিয় চেষ্টা দেখা
যায়। সোভিয়েত রাশিয়া বলতে বিভিন্ন ভূখণ্ডের যান্ত্রিক ঐক্যকরন বোঝায় না। ধর্ম
বর্ণের উর্দ্ধে উঠে এক সোভিয়েত চেতনার উন্মেষ বোঝায় যা গড়ে ওঠে সম্পত্তির যৌথ
মালিকনা মেহনতের মর্যাদা নারী স্বাধীনতা যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে . যে
সোভিয়েত সংবিধান তৈরী হয়েছিল তা সোভিয়েত চেতনায় পুষ্ট এক সমাজতান্ত্রিক সমাজ
গঠনের কথা বলে। এই প্রক্রিয়ায় সমাজতন্ত্রের উচ্চতর সাম্যবাদের স্তরে সমাজকে
এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। 'যতটা পার দাও আর যতটুকু প্রয়োজন নাও' - এর
এক দর্শন চালু করে যার ওপর নির্ভর করে নতুন এই সাম্যবাদী সংস্কৃতি . অর্থনৈতিক
গঠনের সঙ্গে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এক সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার কথা
বলা হয় যেটা সম্ভব চলতি শোষণভিত্তিক আত্মস্বার্থের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে। এ এক
বিপ্লব, সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যেখানেও বলপ্রয়োগ দরকার হয় কারণ বিপ্লবের পর
পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তাদের আত্মস্বার্থে গড়ে ওঠা সংস্কৃতিকে হাতিয়ার
করে ফিরে আস্তে চায়।
হাজার হাজার বছর ধরে পুষ্ট হওয়া এই সংস্কৃতি পার্টি আমলা নেতা মেহনতি মানুষের
মধ্যে জেঁকে বসে থাকে। তাকে উচ্ছেদ করতে হয়। ক্রুশ্চেভ ব্রেজনেভ চীনের তেঙ
শিয়াও পিঙরা এই চিন্তার ধারক ও বাহক। এদের মাধ্যমেই লেনিন স্তালিন মাওদের
বিরুদ্ধে চক্রান্ত চলে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী শক্তির মদতে। রাশিয়ায় এরা
জয়লাভ করে। পার্টির অভ্যন্তর থেকেই বিপদ ঘনিয়ে আসে। সাংস্কৃতিক জগতের
দুর্বলতাকে হাতিয়ার করে রাশিয়ায় সোভিয়েতের চীনে তেঙ সিয়াও পিঙের নেতৃত্বে
প্রতিবিপ্লবী অভ্যুথান রুখতে মাও সদর দপ্তরে কামান দাগার ডাক দেন। তাতে ছাত্র
যুবকদের তরফ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব এগিয়ে
যায়। তেঙ পিছু হটে । কিন্তু সে সময়ের অপেক্ষায় থাকে। উপযুক্ত সময় বেছে নিয়ে সে
আবার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে দলের মধ্যে সমাবেশিত করে। মাওয়ের মৃত্যুর পর সে
জয়লাভে সমর্থ হয়। চীন তার বিপ্লবী চরিত্র হারায়। এই তীব্রতম লড়াই চলার কালে
মাও নতুন মানুষ গড়ার ডাক দিয়েছিলেন। মাওয়ের শিক্ষাকে হাতিয়ার করে নকশালবাড়ির
পরবর্তী লড়াইয়ে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে ছাত্র যুবকদের গ্রামে গিয়ে গরিব
মানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার লড়াইয়ের উদাক্ত আহবান জানানো হয় সিপিআই এম এলের
তরফ থেকে। চলতি শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জগতের এই লড়াই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের
অঙ্গ যা সম্ভব হয় চেতনার সেই মহাস্ত্রকে আরো ধারালো করে। আজ ভারতে যে সব
অঞ্চলে বিপ্লবী ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়েছে, ছত্তিশগড়ে জনাতনা সরকারের মত ভ্রুণাকারে
হলেও বিপ্লবী সরকার গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে সেখানে জনযুদ্ধের অংগ হিসাবে
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।
মনে রাখতে হয় যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের এই লড়াই এক কঠিন লড়াই। শুধু বাইরের শত্রু
নয় ঘরের শত্রু এমন কি নিজের বিরুদ্ধে নিজের এই লড়াই চেতনার জগতের শত্রু অনেক
বেশি শক্তিশালী।
------------------------------------------------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন