গ্রামের প্রসঙ্গ উঠলেই যাঁদের মনে নিরালা, শান্ত প্রকৃতির কথা মাথায় আসে, গ্রামে হঠাৎ এলে তাঁরা ভড়কে যেতে বাধ্য। হ্যাঁ ঠিকই, এখানে অসংখ্য গাড়ির হর্নের আওয়াজ নেই, নেই কারখানার সাইরেনের শব্দও। কিন্তু যা আছে, তা হৃদয়-চমকানিয়া।
গ্রামে এখন যেকোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে ডিজে সাউন্ড সিস্টেমের দাপট। মোটর ভ্যান বা ট্রাক্টর-এর ডালায় সাজানো থাকছে গোটা দশেক শব্দ-দানব বক্স ও পঞ্চাশাধিক মাইক সেট! প্রায় দশ লক্ষ টাকা দামের এ সেট যখন পূর্ণ শক্তিতে বাজতে থাকে, তখন মাতাল না হয়ে এর ধারে কাছে যাওয়াটাই এক মোক্ষম শাস্তি। ভয়ংকর আওয়াজে দমবন্ধ পরিবেশ তৈরি হয়। কান ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে অনেকক্ষণ পর্যন্ত।
এমন যান্ত্রিক নির্যাতনকেই ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে একদিনের জন্য ভাড়া করে আনেন খেটে খাওয়া যুবকেরা। যুবকরা বললাম এই কারণেই, এ শব্দ-তেজ সহ্যের ক্ষমতা মধ্যবয়সী ও প্রৌঢ়রা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেন যে! কানের পর্দা বিকল হয়ে অনেকেই বধির হয়ে যান। মদ ও শব্দের যৌথ অত্যাচারে শ্রমিক মানুষটির যৌবন হয়ে পড়ে ক্ষণস্থায়ী। দশ বারোজন যুবকের চাঁদা তুলে ভাড়া করা শব্দ-মচ্ছবে সব উপার্জন উড়ে যায় এক রাতেই।
বেশ কয়েক বছর যাবৎ গ্রামের প্রধান ইভেন্ট শ্মশান কালী পূজা। প্রায় প্রত্যেক গ্রামে একটি করে শ্মশান আছে। এই কালী ঠাকুরের পুরোহিতদের রয়েছে নির্দিষ্ট এলাকা বিন্যাস। তাঁর এলাকায় কোথায় কবে পূজা হবে, তা তিনি ঠিক করে দেন। সে নির্ঘণ্টের অন্যথা হওয়ার উপায় নেই। নির্দিষ্ট দিনে শ্মশান পরিষ্কার করে ফুল আলোয় তা সাজিয়ে ফেলেন ভক্তরা। এর জন্য রসদের যোগান দেন গ্রামবাসী, পথচারী ও জুয়া খেলার আসরগুলি। বসে যায় হরেক দোকানের পসরা। মনোহারি, মেহেন্দি, আইসক্রিম, ঘুগনি, পাঁপড়, বাদাম ও মাদকের অঢেল প্রদর্শন ও বিপননে এক রাতের জন্য শ্মশান হয়ে ওঠে উন্মুক্ত শপিং মল। এবং সমগ্র গ্রামটির পরিবেশ পাল্লা দিতে থাকে নাইট ক্লাবের পরিবেশের সঙ্গে। রাত যত বাড়ে, শব্দ তেজও বাড়ে তত। এক পাড়ার বক্স সেট পাল্লা দেয় অন্য পাড়ার সঙ্গে। কেমন সে প্রতিযোগিতা? ধরা যাক, মিদ্দে পাড়া ও মাঝি পাড়ার একতলা বাড়ির সমান উঁচু শব্দ-দানবদুটি হাজির হলো একটি রাস্তার মোড়ে। মুখোমুখি। এরপর বাজতে থাকল তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতায়। এদের মাঝে গিয়ে বিচারক যুবকরা যন্ত্র দিয়ে মাপলেন শব্দ-তেজ। তারপর রায় দিলেন, কার বক্স বাজছে জোরে!
এমন নেশা-টইটম্বুর স্ফুর্তিতে ঘুম উড়ে যায় বাকি গ্রামবাসীদের। বৃদ্ধরা এক রাতের নরক যন্ত্রণা ভোগ করেন। শিশুরা কেঁদে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এই যন্ত্রণা মুক্তির জন্য আইন আছে। আছে আইন রক্ষক পুলিশও। WHO নির্দেশিকা মতে ষাট ডিসিবেলের বেশি মাত্রার শব্দই কানের পক্ষে ক্ষতিকর। দেশের লিখিত আইনেও রাতে পঁয়তাল্লিশ ও দিনে পঞ্চান্ন ডেসিবেলের উপর শব্দ প্রচার নিষিদ্ধ। এবং রাত নটার পর আবাসিক এলাকায় উচ্চৈস্বরে মাইক বাজানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ,এসব কথা ডিজে বক্সের শব্দ-মাতালদের বলতে গেলে তারা এমন ভাব করেন, যেন ভিনগ্রহীদের বার্তা শোনানো হচ্ছে!
পুলিশকে ফোন করলে তাঁরা ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবস্থা নিতেও সক্রিয় হন। তবে হালে পানি পান না। উন্মত্ত জনতার মারকুটে, নাছোড় মানসিকতার জন্য তাঁদের উদ্যোগে ভাঁটা পড়ে। রাজনৈতিক নেতারাও এ বিষয়টি স-চেতন ভাবে এড়িয়ে চলেন। তাঁরা জানেন, খেটে খাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ যুবকদের চটানোর অর্থ ভোট ব্যাংকে বড়সড়ো ফাটল ধরানো। পরিবর্তে ভোটের আগে, পরে তাঁদের মদ ও ডিজে স্ফূর্তির ব্যবস্থা করে দিলে নিশ্চিন্তে থাকা যায় অনেকটা। যে উপাচারে যে দেবতা সন্তুষ্ট তাকে তাই দেওয়াটাই তো বুদ্ধিমানের কাজ।
তবে এ বিষয়ে কাজের কাজ হতে পারে একটি সহজ পদক্ষেপে। লক্ষ্য করে দেখা যায় গেছে শ্মশান কালী পুজোতে সাউন্ড সিস্টেমগুলো বাজতে থাকে পূজামন্ডপ থেকে বেশ দূরে ; উল্টোমুখী হয়ে। যাতে পূজার এলাকাটি শব্দের সরাসরি অত্যাচার থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকে, তাই এই নির্দেশ দেন পূজার পুরোহিত ' সভাকর 'মশাই। তাঁর নির্দেশ, উপদেশকে ভয়ে ও শ্রদ্ধায় ভক্তি করেন আপামর কালীভক্ত। একমাত্র তিনি বললেই কমতে পারে সাউন্ড সিস্টেমের তান্ডব। তিনি নির্দেশ দিলে ডিজে বক্সের পরিবর্তে ব্যান্ড পার্টি, তাসা পার্টি, ঢোলকদল ও সানাইয়ের সুরমুচ্ছর্নায় তৃপ্তি পেতে পারে গ্রামবাসীরা। গ্রামবাংলাও মুক্তি পেতে পারে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ও অত্যাচারের হাত থেকে।
==============================
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন