Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গল্প ।। 'যকাসুর' ।। আলাপান রায় চৌধুরী



 
যকাসুর
 

আলাপন রায় চৌধুরী

( মিস্টরি হান্টার সত্য-সিম্মি সিরিজ-এর গল্প)


জায়গাটা রবি নদীর পশ্চিম দিকে - যতদূর চোখ যায় ঘাসে ভরা এলাকা, আর তার পরে সারি সারি টিলা পাহাড়। পাঠানকোট জেলার মাধবপুর টাউন থেকে কিছুটা এগিয়ে এসে বাস থেকে নেমে অনেকটা হেঁটে এসে এই জায়গাটা। রবি নদীর ওপরে বাঁধটাও কাছেই এখান থেকে।  সত্য আর সিম্মি একটা নতুন কেসের সূত্রে একটা সাইট দেখতে এসেছে- প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষ পাওয়া গেছে এখানে প্রাচীন এক জনপদের। পাঠানকোট জেলার হেডকোয়ার্টারে সত্যদের নতুন বাড়ি থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে এখানে পৌঁছেছে ওরা। সাইটটার দিকে এগোতে এগোতে সত্য বলল, "জায়গাটা একদম মাইথনের মত, তাই না?"

চারিদিকের মনোরম পরিবেশের ছবি তুলতে তুলতে সিম্মি জিজ্ঞেস করল,"হ্যাঁ? কিসের মতো?"

"মাইথন-মাইথন ড্যামআমাদের ওখানে। ঘুরতে গেছো কখনো?"

"না, মাইথনটা আমার যাওয়া হয়নি গো।"

সত্য ব্যাকপ্যাক থেকে এবার জলের বোতলটা বের করল। সিম্মি বলে উঠলো,"এই দ্যাখো, এখান থেকে ড্যামটা বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে!"

সত্য জল খেতে খেতে আড়-চোখে সেই দিকে তাকালো। তারপর জল গিলে বলল, "হ্যাঁ তবে হাইওয়ের ওপরের ভিউইং পয়েন্টটা বেশি ভালো।"

"অফকোর্স...! আরে, ওই দ্যাখো, ওটা কি?"

"আরে, তাই তো। ওটা কি, কি জানি!"

আরেকটু এগোনোর পর কৌতূহল-উদ্রেককারী জিনিসটার ব্যাপারে সত্য বলে উঠলো, "ওটা প্রাচীন ড্যাম হতে পারে- ওই সাইটটারই অংশ হয়তো; মানে জনপদের অংশ।"

"কোনো বোর্ডও দেখছি না; নাহলে শিওর হওয়া যেত।"

"সেই, হয়তো আমি ভুল করছি- মডার্ন ড্যামটা দেখে এই স্ট্রাকচারটা কেউ দামি ভাবছি যদিও ড্যাম হওয়াটা অসম্ভব না কারণ এই সাইটটা যে যুগের বলা হচ্ছে সেই যুগে এসব অঞ্চলের লোক নদীতে বাঁধ দেওয়া ভালোভাবেই জানতো।"

"আচ্ছা আচ্ছা, এটা আগে পড়িনি"

"আমিও ঠিক জানতাম না খান্না স্যার বলছিলেন একবার!"

"ও আই সি!"

"স্যার খবর দিয়েছেন- আজকে বা কালকে আসতে পারেন উনি"

"খান্না স্যার? পাঠানকোটে? ওয়াও!"

"ইয়েস ডিয়ার!"

"আমার খুব ইচ্ছা ছিল নার সাথে দেখা করার। জানোই তো!"

এরকম কথা বলতে বলতে সাইটটার একদম সামনে চলে এলো ওরা তারপর চারিদিকটা একবার ঘুরে দেখল

সত্য পিঠের ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে হাতে নিল। সিম্মি বলে উঠলো,"দ্যাখো, কত বড় দেওয়ালটা! এটা কি বন্যা বা সুনামি থেকে রক্ষা করার জন্য শহরটাকে?"

"মনে হচ্ছে; তবে এত বড় দেওয়াল এরকম দেখিনি আগে এ.এস.আই.-এর ইন্টারনাল রিপোর্টও তাই বলছে- এই দ্যাখো!", বলে রিপোর্টের কাগজে একটা স্কেচ আর একটা লেখা সিম্মিকে দেখালো সত্য।

"এ তো মনে হচ্ছে হাতি বা কোন প্রাগৈতিহাসিক জন্তুকে আটকানোর জন্য তৈরি। বা শত্রুদের বিরুদ্ধে শহরের রক্ষা করার জন্য- কি জানি!"

"রিপোর্টটা কি কিছু বলছে?"

"না, শুধু বলছে যে এটা সেকেন্ড ফেজে তৈরি।"

"সেটা কত আগে?"

"ওই চার-পাঁচ হাজার বছর বলছে।"

"আর ফার্স্ট ফেজটা কত পুরনো?"

"প্রি-ফাইভ থাউজেন্ট বলছে। মাটি খুঁড়ে বাড়ি বানাতো তখন লোকে।"

"তারপর এখানেই শহর তৈরি হয়।"

"হ্যাঁ, আর, উমম্... আরেকটা ফেজ বলছে - মধ্যযুগে। এটা লাস্ট ফেজ।"

"বাবা, মধ্যযুগ! এর মাঝে কেউ থাকত না?"

"সেটা রিপোর্ট বলছে না, বুঝলে।"

"বা হয়তো অন্য লেয়ারগুলো নিয়ে কাজ করার সুযোগ পায়নি এ.এস.আই.-এর টিম।"

"তা হতে পারে। তারা তো ভয়ে এখানে কেউ ফিরতেই রাজি নয়।"

"আচ্ছা এখানে ঢোকার দরজা বা রাস্তাটা কোথায়? কিছু দেখতে পাচ্ছ?"

"না, কিছু তো চোখে পড়ছে না। এটা মাউন্ড তো নয়,চারদিকে তো দেওয়াল বেরিয়ে আছে। এ.এস.আই. এটুকু খুঁড়ে রেখেছে।"

"সেটাই তো- দরজাটা কোথায়? গুপ্ত দরজা দিয়ে ঢুকতো নাকি লোকে?"

অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন দরজার কোন হদিস পেল না ওরা, তখন ড্রোন উড়িয়ে সাইটের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল। তারপর রবি নদীর পাড়ে এসে ড্রোন-এর ফুটেজ চেক করতে লাগল সত্য আর সিম্মি।

"দেওয়ালটা তো বিশাল চওড়া দেখছি! এরম দেওয়াল শুধু এই তল্লাটে কেন, কোথাও আছে কি? আমার তো জানা নেই"

"থাকলেও হয়তো বিরল না হলে খবর হয়ে যেত"

"তাহলে আপাতত যা আমরা পেলাম- একটা বিশাল লম্বা আর বিশাল চওড়া দেওয়াল"

"আর দেওয়াল যার কোনো দরজা নেই"

"কেউ সিল করে দিয়েছিল হয়তো শহরটাকে অতীতে"

"বা পাঁচিলের ওপর দিয়ে যাতায়াত করতো!"

"পাঁচিলের উপর দিয়ে- WTH!"

"হ্যাঁ, কেন নয়? মাটির তলার পিট-ডুয়েলিং থেকে যেমন মানুষ সিঁড়ি ব্যবহার করে বেরতো সেরম, যখন শহর তৈরি করল তখন দুর্বল কাঠের দরজা না রেখে মই দিয়ে শহরের বাইরে যেত হয়তো"

"তোমার হাইপোথিসিস যদি ঠিক হয়, তবে এটা ভাবতে হবে যে কিসের এত ভয়?"

"আর ৫০০০ বছর আগের সেই ভয়ের কারণ কি এখনো আছে?"

"দেওয়াল দিয়ে তো আর ভূত-প্রেত আটকানো যাবে না"

"ওহি তো!"

"যা খবর পেলাম, এখান থেকে .এস.আই.-এর টিম ভূত-প্রেতের ভয়ে পালিয়েছে"

"কিন্তু..."

"আচ্ছা সাইটের ভেতরের ফুটেজটা একটু জুম করো তো"

সিম্মি জুম করল ফুটেজটা।

"হ্যাঁ, এবার দ্যাখো- ওই দ্যাখো চাপ চাপ রক্তের ছোপ!"

"রক্তের ছোপ- তাইতো! ভূতের কেস হলে এত রক্তক্ষয় হতে পারে কি?"

"কি যে ঘটেছে এখানে ঠিক দেখো কয়েকটা গর্তও রয়েছে"

"ওগুলো হয়তো .এস.আই.-এর লোকরাই খুঁড়েরেছিল! কি?"

" আচ্ছা হুম…"

"আর কিছু পাওয়ার আশা আছে কি এই মুহূর্তে?"

"একবার .এস.আই.-এর লোকদের সাথে কথা বলতে পারলে মন্দ হয় না!"

"এখানে একদিন রাতেও এসে ভালো করে অনুসন্ধান করতে হবে"

"সামনের দিন একটা ল্যাডার নিয়ে আসব যদিও ভেতরে কিছু নেই!"

"কি কি ইকুইপমেন্ট সাথে আনতে হবে তার একটা লিস্ট বানাবো আজ বাড়ি ফিরে"

"ঠিক হায়, আপাতত এই অবধি; স্যান্ডউইচ-গুলো আমাদের ডাকছে!"

এই কথায় দু-জন একটু হাসলো। তারপর রবি নদী আর তার চারদিকের অপরূপ পরিবেশ উপভোগ করতে করতে সেদিনের লাঞ্চটা সেরে ফেলল ওরা।

 

সেদিন বিকেলে সত্য দরজা খুলতে খুলতে "আসুন, আসুন স্যার!" বলে উঠলো।

সত্যদের পাঠানকোটের ঠিকানায় এই প্রথম কোন অতিথি এলো, আর তিনি স্বয়ং শখের মিষ্ট্রি-হান্টার মিস্টার খান্না। সত্য তার খান্না স্যারকে নিয়ে গিয়ে বসালো তাদের ছোট্ট বসার ঘরটায়।

"স্যার কিছু নেবেন?" সত্য জিজ্ঞেস করল।

"আপাতত একটু জল দাও, তারপর দেখা যাবে।"

সত্য জল এনে দেওয়ার পর খান্না স্যার কাজের কথা শুরু করলেন, "তোমার ওপরওয়ালার থেকে খবর পেলাম যে তুমি মাধোপুর এলাকায় ভূত খুঁজতে যাচ্ছো!"

"হা হা, হ্যাঁ স্যার ভূত বা দুষ্কৃতি বা অন্য কিছু- জানিনা। আমায় যেটা বলা হয়েছে সেটা হল ভূত-প্রেতের উপদ্রব। গেছিলাম আজকেই।"

"ও আচ্ছা, তুমি একবার চলে গেছো অলরেডি। ভালো!"

"অবশ্য রাতে এখনো যানি। তৈরি হয়ে যেতে হবে! ভূত হলে আমাদের ইকুইপমেন্টে ধরা পড়বে কিছু না কিছু।"

"এটা প্রথম বার নয় যে ভূতের ভয়ে কোন এক্সক্ল্যাভেশন বন্ধ হয়েছে।"

"মাটির নিচ থেকে কোনো কঙ্কাল পাওয়া গেলে শ্রমিকরা অনেক সময় ভাবে যে কোনো প্রাচীন জাদু বা অভিশাপের প্রভাবে তাদের অমঙ্গল হবে!"

"প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র খোঁড়ার জন্যও লোক পাওয়া যায়না অনেক সময়ে এই কারণে- মানে ওই ভূত-প্রেতের ভয়ে! ডঃ শিন্ডে বোধ হয় একবার বলেছিলেন…"

"হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি একবার পড়েছিলাম স্যার, যে ভারত-পাকিস্তানের তাম্রযুগের শহরগুলো বা অন্তত কোনো কোনো শহরে এই কারণেই আর পুনর্বাসন হয়নি- স্থানীয় লোকে ভয় পেতো ভুত-প্রেতের, অমঙ্গলের"

"আর তাই কয়েক হাজার বছরে কেউ আর থাকার কথা ভাবেনি- ঠিককিন্তু অসুরদের কি আমরা ভূত-প্রেতের মধ্যে ধরতে পারি?"

"অসুরদের? অসুর কেন স্যার? অসুর বলতে তো... প্রাচীনকালের বলছেন তো?"

"হ্যাঁ, তাদের কথাই বলছি। আমি জানতে পেরেছি যে ওটা ভূত নয়, অসুর বা অসুরের বেশে মানুষ। ওই জন্যই আমি তড়ি-ঘড়ি এলাম- যাতে তোমার হেল্প হয়।"

"আমার বন্ধু ডক্টর আলুওয়ালিয়া আর্কিওলজিস্ট। যে টিমটা এক্সক্যাভেশনের দায়িত্বে ছিল উনি সেই টিমে ছিলেন। উনি যেটা বললেন সেটা তোমারও জানা উচিত। এই কেসে কাজে লেগে যেতে পারে সেটা।"

"হ্যাঁ স্যার। তাহলে তো খুবই ভালো হয়! সরকারিভাবে বলা হচ্ছে যে সাইটটা সাময়িকভাবে বন্ধ। কিন্তু সেটা কথার কথা। ভুতের আতঙ্ক না ঘুচলে কাজটা যে শুরু হবে না, সেটা শুধু ভেতরের লোকরাই জানে।"

"হুম্, সেটাই। যেটা আমি তোমায় বলবো, সেটা শোনার পর এটা নিয়ে আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে।"

"আচ্ছা, উনি এই ব্যাপারটা আপনাকে বললেন কেন?"

"আমি এগুলো নিয়ে চর্চা করি সেটা উনি জানেন, তাই। ওরা সবাই অবাক আর শকড সেই রাতের পর। ওদের মনও ব্যাখ্যা খুঁজছে!"

"সরকার তাহলে আসল ব্যাপারটা জানে?"

"দ্যাখো, আলুওয়ালিয়াদের টিমের কেউ তো খুলে বলেনি সরকারকেকিন্তু অসুরের গুজবটা উপরমহলের কানে গেছে নিশ্চয়ই।"

"গেছে বলছেন, হুম...!"

"বেঙ্গল টাইগারের সাথে তো দেখা হল। পাঞ্জাব দি শেরনী কাহা হ্যায়?"

"ও একটু ফার্মার্স মার্কেটে গেছে স্যার। চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।"

"আচ্ছা আচ্ছা। আসল কথায় আসি তাহলে। রঞ্জিত সাগর ড্যাম তৈরির জন্য অনেক খোঁড়াখুঁড়ি করতে হচ্ছে, জানোই তো।"

"হ্যাঁ, স্বাভাবিক- একটা ড্যাম তৈরি করতে গেলে তো হবেই। তখনই তো ওই আর্কিওলজিকাল সাইটটার হদিস মেলে।"

"হুম্, ওই শহরটার হাড়-পাঁজরা বেরিয়ে আসে কিছুটা- যা কিছু ড্যাম তৈরীর সময় পাওয়া গেছিল তা থেকে জানা যায় যে জায়গাটা ৪-৫০০০ বছরের পুরনো।"

"আর তারপরে ওটা খোঁড়ার সিদ্ধান্ত নেয় এ.এস.আই."

"সেই টিমের সদস্য হয়েই আলুওয়ালিয়া আর বাকিরা গেছিলেন। যাইহোক,প্রথম কয়েকদিন দিনের বেলা সার্ভে করে ওরা সাইটটার‌। সেই ক'দিন কাছের টাউন মাধোপুরে ছিল ওরা। এবার যখন ওরা ক্যাম্প বানিয়ে সাইটে থেকে কাজ চালানো সিদ্ধান্ত নিল, তখনই হল সমস্যা।"

"ভূতের উপদ্রব স্টার্ট হলো? মানে ওই অসুরের?"

"হ্যাঁ, যদিও একটা নয়, অনেকগুলোর।"

"ওহ বাবা!"

"রাতের অন্ধকারে অসুররা সাইটের ভেতরে ওদের ক্যাম্প আক্রমণ করে। টীমের কয়েকজন আহত আর রক্তাক্ত হয়। পালানোর সময় টর্চের আলোয় যেটুকু দেখে ওরা তা হল এই- বিরাট বিরাট চেহারার অসুররা- তাদের মুখে সাদা রং বা ভস্ম জাতীয় কিছু; গা খালি, আর মাথায় শিং! শট পুটের বলের সাইজের পাথর দু-হাতে দু-টো করে ছুঁড়ছে এক-একজন।"

"গল্পকথায় আমরা যে অসুরকে পেয়েছি, -তো একদম হুবহু সেরম মনে হচ্ছে!"

"অতিপ্রাকৃতিক কিছু হতে পারে- উড়িয়ে দিচ্ছি না। আবার কেউ হয়তো চায়না যে কাজটা এগোক- তাও সম্ভব।"

"এখন তো রাতে কেউ ভয়ে পাহারাও দিচ্ছে না। কি যে হবে সাইটটার।"

"আপনি যে ব্যাপারগুলো বললেন সেগুলো এর সাথে সম্বন্ধিত কিনা জানিনা, তবে এখানে আসার পর রুটিন এনকোয়ারি করতে গিয়ে একবার এক ট্রাক ড্রাইভার-এর থেকে একটা কেস শুনেছিলাম।"

"কিরকম?"

"সে নাকি রাত্রিবেলা ওই জম্মু-পাঠানকোট হাইওয়ে ধরে আসছিল। তো অটল ব্রিজ পেরিয়ে সে নাকি অসুর দেখেছিল।"

"অসুর? কিরকম অসুর?"

"বলল যে টিভিতে মহাভারতে যেরকম দেখেছে সেরকম নাকি! হেডলাইটের আলো স্পষ্ট দেখেছে। রাস্তা পার হচ্ছিল।"

"আচ্ছা, মহাভারতের কোন অসুর?"

"ওই বকাসুর স্যার। ভীম যাকে মারবে।"

"এটা আমি চোখের ভুল বা বহুরূপী বলে উড়িয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু দু-জন লোক ভুল দেখলো?"

"হ্যাঁ, আর আলাদা আলাদা সময়ে। কেউ কারোর কথা জানেও না।"

"তার মানে এটা মানুষের, মানে কোন দুষ্কৃতী বা প্রাঙ্ক-বাজদের কাজ না মনে হয়।"

"আরেকটা ব্যাপার কি জানেন?"

তখনই বাইরে থেকে দরজা খোলার শব্দ হলো "ওই সিম্মি চলে এসেছে স্যার"

সিম্মি রান্নাঘর হয়ে ছোট বসার ঘরে আসতেই সত্য মিস্টার খান্নার সাথে সিম্মির পরিচয় করিয়ে দিল।

"ওহ্ হাই খান্না স্যার! আপনার কথা অনেক শুনেছি!" হেসে বলল সিম্মি

মিস্টার খান্না একবার দ্রুত সত্যর দিকে তাকিয়েই সিম্মির দিকে ফিরে বললেন, "তোমার সাথে দেখা করার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।"

সিম্মি বসল। খান্না স্যার কিছুক্ষণ সিম্মির সাথে পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বললেন। সিম্মিও পাঞ্জাবিতেই উত্তর দিল প্রতিবার। তবে তার বেশিরভাগই সত্যর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে যে সেটা বুঝতে পেরে আবার হিন্দিতে ফিরে এলেন।

সত্য এবার বলল, "আমরা নতুন কেসটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। একটা অসুর অ্যাঙ্গেল পাওয়া যাচ্ছে।"

"অসুর?" সিম্মি বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল

সত্য তখন খান্না স্যারের সাথে যা আলোচনা হয়েছে সেটা অল্প কথায় সিম্মিকে বুঝিয়ে বলল, "পরে সব বলছি তোমায় ডিটেলে।"

মিস্টার খান্না বললেন, " দ্যাখো পাঞ্জাবের প্রাচীন ইতিহাস যেটুকু জানি আমি তাতে আমরা দেখি দশারাজন যুদ্ধ হয়েছিল এই রবি নদীর কাছেই।"

"দশারাজন যুদ্ধ মানে যে নির্ণায়ক যুদ্ধের পর ভারত দেশের জন্ম হয় ভরতের দেশ ভারত"

"হ্যাঁ, অনেকে মনে করে যে এই যুদ্ধে যারা হেরেছিল তারা পশ্চিমে মধ্য প্রাচ্যে সরে যেতে বাধ্য হয় তাদের নামই হয়ে গেছিল 'অসুর'"

"আচ্ছা আচ্ছা কিন্তু তাদের কি ওই গল্পের বকাসুরের মতন দেখতে ছিল?"

"গল্পের বকাসুরের কথা শুনে তো মনে হয় সে নরখাদক ছিল; গুহায় থাকতো"

"নরখাদক বলতে?" সিম্মি জিজ্ঞেস করল

"ক্যানিবল" মিস্টার খান্না এক কথায় বললেন

সিম্মি মাথা নেড়ে বোঝালো যে এবার সে বুঝেছে "প্রস্তর যুগের পরেও ক্যানিবাল ছিল, হুম!" বলল সিম্মি

এর উত্তরে খান্না স্যার কিছু বলার আগে সত্য বললো, "হ্যাঁ, তখনো ছিল, আর এখনো আছে তখন আরো বেশি ছিল"

"ওকে, কুল!"

সত্য আরো বললো, "আচ্ছা দশারাজন-এর অসুরদের সাথে বকাসুরের সম্পর্ক নেই কোন তাহলে।"

"হয়তো নেই, কারণ যে কোন নেগেটিভ জিনিস বা অপোসিং ফোর্সকেই অসুর বলা হত সেই যুগে যদিও নট নেসেসারি যে সেটা বাস্তবে নেগেটিভ" মিস্টার খান্না যোগ করলেন

"আচ্ছা তাই নরহত্যাকারী ক্যানিবালও যেমন অসুর, আবার সেই যুদ্ধের বিরোধীপক্ষরাও অসুর"

"আর বিজয়ীরাই ইতিহাস লিখে এসেছে!" খান্না স্যার যোগ করলেন

সিম্মি জিজ্ঞেস করল বিষ্ময় নিয়ে, "এটা মহাভারতের একচক্র নগর নয় তো? বকাসুর যে শহরকে অ্যাটাক করতো।"

"কিন্তু সেই যুগের বকাসুর এই যুগে আসবে কি করে?" সত্য বলল

"একচক্রনগর না হলেও দশারাজন যুদ্ধের আগে এই শহরটা অসুরদের হাতে থেকে থাকতে পারে" বললেন মিস্টার খান্না

"সব জায়গায় অসুরদের মাথায় শিং দেখি আমরা - এই শিং নিশ্চয়ই ন্যাচারাল নয়" সিম্মি বলল

সত্য বললো "না হর্নড হেলমেট বোধ হয়। বা জন্তু-জানোয়ারদের খুলিও হতে পারে। আগে ওরকম পরতো লোকে।"

"যদিও কিছু ক্ষেত্রে মানুষেরও সিং গজিয়েছে, এরম দেখা গেছে ওটা আবারেশান বা এনোমালি কিন্তু .এস.আই.-এর টিম বা তোমার ওই ট্রাক ড্রাইভার যা বলছে সেটা একদম যেন গল্পের পাতা বা টিভির পর্দা থেকে উঠে এসেছে" মিস্টার খান্না বললেন

সিম্মি বলল, "কিন্তু স্যার, ওই প্রাচীন অসুরদের ভূত কি হতে পারে এরা? তারা কি পাথর ছুড়তে পারে?"

"পোলটারগাইস্ট বলে এক ধরনের ভূত হয় তোমরা জানো নিশ্চয়ই তারা তো জিনিসপত্র ছুড়তে পারেই"

সত্য-সিম্মি মাথা নাড়লো, মিস্টার খান্না বলে চললেন, "তাকে অবশ্য দেখা যায় না। এদের তো দেখা গেছে! হুম, মিস্টিরিইয়াস!"

সিম্মি বলল, "হয়তো ওই অসুরদের সমাধি আছে এই সাইটে; ওদেরই শহর ছিল হয়তো। তাই রাতে কেউ ওখানেই থাকুক সেটা হয়তো পছন্দ করছে না ওদের আত্মারা।"

"ঠিক এই ভয়েতেই অনেক শ্রমিকরা প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্রে বা সমাধিক্ষেত্রে কাজ করতে চায় না!"

সিম্মির উত্তরে সত্য বলল, "তাও বিগ ফুট পাথর ছোঁড়ে শুনেছি। ভূত বা একটোপ্লাজম এরম নিজ মূর্তি ধারণ করে পাথর ছোঁড়ে- এটা শুনিনি।"

"যাইহোক, দ্যাখো কি পাও আমি আরো কিছু জানলে জানাবো আশা করি কিছুটা সাহায্য করতে পারলাম"

"হ্যাঁ, দেখা যাক স্যার বিদেশী শক্তি বা কারোর দূরভিসন্ধি আছে কিনা" বলল সিম্মি

"হ্যাঁ ঠিক, এটাই আমারও চিন্তা!"

"স্যার রাতে ভাববো কিভাবে এগোনো যায় এখান থেকে" বলল সত্য

সিম্মি এবার অনুরোধ করে বলল, "স্যার, কিছু খেয়ে যান- মাক্কি দি রোটি, ওর সরসো দা সাগ হায়"

"বহুৎ বহুৎ শুকরিয়া বেটি, পার ফির কাভি"

"আচ্ছা, ফির লাস্যি লিজিয়ে না ভেসকে দুধ কা হ্যায় রুকিয়ে জারা"

"ঠিক হে, যাব কাহি রাহি হো তো লে হি আও" স্মিত হেসে বললেন মিস্টার খান্না

"তুমি খাবে?" সত্যর দিকে তাকিয়ে  হালকা ভুরু উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো সিমি

"না বাবা, এখন না!" স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলল সত্য

সত্য কি উত্তর দেবে সেটা সিম্মি অনুমান করেছিল- তাই একটু হেসে সিম্মি ওদের ছোট ফ্রিজের দিকে গেল। তখন কিছু একটা মনে পড়ায় মিস্টার খান্না বললেন, "ও হ্যাঁ, কিছু ছবি নিয়েছি আমি ডক্টর আলুওয়ালিয়ার থেকে- ওগুলো জনসমক্ষে আনেনি ওরা এখনো। তোমাদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। ছবিগুলো রাখো, যদি এগুলো কোন কাজে লাগে..."

"আমি পরশু বিকেল অবধি পাঠানকোটেই আছি কোন দরকার হলে এই ঠিকানায় চলে এসো" এই বলে মিস্টার খান্না একটা চিরকুট এগিয়ে দিলেন সত্যর দিকে

"ওখানে কথা বলা যাবে তো স্যার?"

"হ্যাঁ হ্যাঁ, পাঠানকোটে কি কথা বলার জায়গার অভাব নাকি?"

"ওখানে একটা বড় পার্ক আছে সেখানে চলে যাব দরকার হলে"

"বাই স্যার, এন্ড থ্যাংক ইউ" একটু হেসে বলল সিম্মি

"বাই সিম্মি বাই সত্য"

 

সত্যরা সেদিন রাতে সিলমোহরের ছবিগুলো দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন কিছু পয়েন্ট নোট করল ছবিগুলোর উপর- বেশ কিছু চমকপ্রদ জিনিস চোখেও পড়ল ওদের। তাই সেদিন বিকেলেই মিস্টার খান্নার পাঠানকোটের ঠিকানায় গিয়ে ওনার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিল সিম্মি-সত্য। বিকেলে মিস্টার খান্নার সাথে দেখা করে ওনার উল্লিখিত নিরিবিলি পার্কটাতে গেল ওরা। সেখানে একটা বেঞ্চে বসে কথাবার্তা শুরু করল ওরা।

"স্যার সিলমোহরগুলোয় কি লেখা আছে সেটা জানা গেলে আরো সুবিধা হতো হয়তো।" সত্য বলল।

"আমার পিক্টোগ্রাফ-এর মত মনে হলো লেখাগুলো, স্যার" সিম্মি বলল।

"আচ্ছা, আই সি!"

"আচ্ছা স্যার সিলমোহরগুলোয় কি লেখা আছে সেটা কিভাবে জানা যাবে?" এবার জিজ্ঞেস করল সত্য।

"উমম্, এটা জানার কোন উপায় নেই; আলুওয়ালিআরাও ওগুলো পড়তে পারেননি।"

"ওহ, নো!" সিম্মি বলল, "আর কি করা যাবে!"

"স্যার, সিলমোহরের ছবিগুলো থেকে অদ্ভুত কিছু জিনিস পাওয়া গেছে। তবুও প্রশ্নটা থেকেই যায় যে এরা কারা যারা ওই সাইটে হাঙ্গামা করেছে। যদিও ছবিগুলোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ না সেটা।"

"কি ব্যাপার বল তো?" মিস্টার খান্না বেশ কৌতূহলের সাথেই জিজ্ঞেস করলেন।

"আর ওখানে দেওয়াল এত বড় আর চওড়া কেন সেটাও অনুমান করা যাচ্ছে এখান থেকে।" সত্য বলার আগেই বলল সিম্মি।

"ও আচ্ছা, তাই নাকি? ওখানে দেওয়াল খুব বড়!"

"হ্যাঁ স্যার আমরাও অবাক হয়েছিলাম প্রথমে তাই। কিন্তু এই দেখুন স্যার।" বলে সত্য ফোনের গ্যালারিটা খুলে সিলমোহরের ছবিগুলো বের করল।

"এই, এই দেখুন স্যার, এখানে এই ছবিটায় মনে হচ্ছে যেন একজন পাথর ছুঁড়ছে" সত্য বলল।

"আর স্যার ওদিকে ওটা দেওয়ালের মতো লাগছে। মাথায় শিং-টাও লক্ষ্য করুন স্যার।" সিম্মি যোগ করল।

"আরে, তাইতো! আশ্চর্য! অসুর! পাথর ছুঁড়ছে অসুরটা। আমেজিং!"

"হ্যাঁ, আরো আছে স্যার। এই দেখুন এই ছবিতে কেমন একটা টিউব বা টানেলের মধ্যে দেখানো হচ্ছে এদের।" সত্য বললো।

"আর পরেরটায় দেখুন, শিং-ওয়ালা লোকরা নৌকায় বসে আছে।" সত্য বলার আগেই বলে দিল সিম্মি

"অষ্টনীশিং এন্ড ওয়ান্ডারফুল! কোন ভাষা নেই আমার!"

"স্যার এগুলো সত্যিই হাজার হাজার বছর আগের শিলমোহর তো?"

"হ্যাঁ, রেডিও কার্বন ডেটিং করেছে এ.এস.আই.ওই জন্যই ওই জায়গাটা এক্সকাভেট করবে ঠিক করে এ.এস.আই."

"আচ্ছা।"

"কিন্তু এসবের থেকে কি ইমপ্লায়েড হয়? এরা তো আর হিমাচলের জর্জ ক্লার্কের মতো ছায়া নয়।" মিস্টার খান্না বললেন।

"হ্যাঁ, তাই বাস্তবে এক্সিস্ট করে না বলে উড়িয়েও দেওয়া যায় না।" বলল সত্য।

"আচ্ছা এই শিলমোহরের কথা কি আমরা ছাড়া কেউ জানে স্যার? এনি আইডিয়া?" সিম্মি জিজ্ঞেস করল।

"হয়তো না, কিন্তু জানলেও তারা কি অসুর সেজে এসে ভয় দেখাবে? পাথর ছুঁড়বে?" মিস্টার খান্না বললেন।

সত্য বললো, "হ্যাঁ, অসুরই সাজতে যাবে কেন? অনেক কিছু তো সাজার আছে।"

সিম্মি বললো,"সেটাই! ভূতের ভয় দেখানো তো সোজা। হাজার একটা উপায় আছে!"

"আর জম্মু থেকে ফেরার পথে ওই ট্রাক ড্রাইভার পাজি যে অসুরকে দেখেছিলেন, সেটাই তো ব্যাপারটাকে অন্য মোড় দিচ্ছে।" বলল সত্য।

"আজকের যুগে পাঞ্জাবের বুকে এরম অসুরের প্রাদুর্ভাগ হয়েছে যে, এটা ছোট থেকে কোনদিন শুনিনি! এই দু-টো ঘটনাই শুনলাম শুধু। যাক গে..." মিঃ খান্না বললেন।

"কাল না হয় আমরা স্পটে যাব- রাতে যাব- অসুর হোক বা যে-ই হোক, ওরা যদি আবার হামলা করে তাহলে ধরা পড়ে যাবে ওদের খেলা।" সিম্মি বলল।

"ঠিক আছে, যেও, তবে সাবধানে যেও তোমরা!"

"স্যার, আপনিও চলুন আমাদের সাথে। প্লিজ। ইট ইজ এ রিকুয়েস্ট!" সিম্মি বলল।

সত্য বললো, "স্যার আপনার আশেপাশে থাকলে আপনার থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি। ট্রেনিংয়ের সময়ের মতো।"

"কিন্তু সিনিয়র সিটিজেন হওয়ার পর কি অসুরদের পাথরের মার সামলাতে পারবো?" হাসতে হাসতে বললেন মিস্টার খান্না।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সত্য আর সিম্মিও একটু হাসলো। মিস্টার খান্না আরো বললেন "আই এম এ রিটায়ার্ড ম্যান নাও, অ্যাজ ইউ বোথ নো। এমনিতেও তোমাদের ডিপার্টমেন্টের লোক নই। ঠিক আছে আন-অফিসিয়ালি জয়েন করবো তোমাদের।"

"তবে কি স্যার কাল বেলার দিকে বেরোবেন?" সত্য জিজ্ঞেস করল।

"না, একটা কাজ করি আমরা। প্রথমেই সাইটে রাত কাটাবো না; আগে ক্যামেরা লাগাতে হবে।"

"মোশন সেন্সিং ক্যামেরা বলছেন?" সিম্মি বলে উঠলো।

"হ্যাঁ, নাইট-ভিসান-ওয়ালা, কারণ যত উপদ্রব তো রাতেই।" মিস্টার খান্না বললেন।

"ক্যামেরাতে কিছু ধরা পড়লে ভালো। না হলে..." সত্য বললো।

"দ্যাখো, ক্যামেরাতে অনেক সময় সুপার ন্যাচারাল জিনিসপত্র ধরা পড়ে যায়।" মিস্টার খান্না বললেন।

"ইন এনি কেস, ক্যামেরাতে কিছু রেকর্ড হলে আমরা একটা আইডিয়া পাব।" সিম্মি যোগ করল।

"ইয়েস। শত্রুর ব্যাপারে আগে একটা আইডিয়া নিয়ে গেলে ভালো হবে।" বলল সত্য।

"ওই জন্যই এই পরামর্শটা দিলাম তোমাদের।" বললেন মিস্টার খান্না।

"ঠিক আছে, ডান স্যার! কাল গিয়ে হেডকোয়ার্টার থেকে কিছু ক্যামেরা নিয়ে আসবো।"

"পাঁচটা এনো অন্তত। আমরা পরশু যাব তাহলে একবার। আমারও দেখা হয়ে যাবে সাইটটা।"

 

ক্যামেরা লাগানো হল- ওরা ঠিক করলো যে অন্তত ৫-৬ দিন সময় দেবে। তাই হল। ষষ্ঠ দিনে ক্যামেরাগুলো খুলে আনলো ওরা। কিন্তু পরের দিন সারাদিন ধরে ফুটেজ ঘেঁটেও উল্লেখযোগ্য কিছুই পেল না ওরা। অষ্টম দিনে মিস্টার খান্না এলেন সিম্মিদের বাড়িতে। সব শুনে উনি বললেন, "তাহলে এই ক-দিন ওরা সাইলেন্ট আছে বা ক্যামেরাতে হয়তো ওই অদৃশ্য দুষ্কৃতীরা ধরাই পড়েনি!"

"ওরা যদি আকাশ থেকে এসে থাকে?" সিম্মি বলল।

"ভেরি গুড পয়েন্ট সিম্মি। কিন্তু সেটা হলেও কোন ক্যামেরাতে সামান্য কিছুও ধরা পড়ল না!" মিস্টার খান্না বললেন।

সত্য বললো, "আমার কিন্তু একটা সহজ ব্যাপার মনে হচ্ছে- ওই অসুররা এসেছিল এ.এস.আই.-এর লোকদের ওখান থেকে তাড়াতে, আর সফলভাবে উচ্ছেদও করতে পেরেছে।"

সিম্মি এর উত্তরে বললো, "হ্যাঁ একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে ওখানে গিয়ে থাকলে এক যদি এই রহস্যের সমাধান হয়।"

"যা বলেছ তোমরা, তবে তার আগে তোমাদের জিজ্ঞেস করি, এর মধ্যে কিছু জানতে পেরেছ কি তোমরা?"

"কি ব্যাপারে স্যার?"

"মানে, ওই সাইটটার ব্যাপারে আর কিছু স্থানীয়দের থেকে?"

"না স্যার, আমরা এর ব্যাপারে কিছু কথা বলিনি লোকজনের সাথে।"

"আচ্ছা, বলতে পারতে। ঠিক আছে। কোন ব্যাপার না। কারণ আমি খোঁজ খবর করে একটা দারুন ব্যাপার জানতে পেরেছি।"

"কি স্যার?"

"বলছি, যদিও কেসের অগ্রগতিতে এটা কতটা হেল্প করবে জানিনা। তোমরা যকের ধন-এর নাম শুনেছো? সত্য শুনে থাকবে!"

"যকের ধনটা কি? আর যক টাই বা কি?" সিম্মি জিজ্ঞেস করল।

"হ্যাঁ আমি জানি স্যার।" এই বলে সিম্মিকে সংক্ষেপে সত্য বলে দিল যকের ধন কাকে বলে।

"সবকিছু শোনার পরে সিম্মি মিস্টার খান্নার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, "তাহলে এই সাইটটা যকরা আগলে রেখেছে?"

"একজন ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন জেমস হডসন বলে; ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোক। উনি দেড়শ বছর আগে পাঠানকোটে আসেন। কোন একটা কাজে এখানে এসে উনি ওই জায়গাটার ব্যাপারে জানতে পারেন। মধ্যযুগে নাকি লোকের বিশ্বাস ছিল যে ওখানে গুপ্তধন আছে-এটা উনি শোনেন এবার এই বিশ্বাসের পিছনে কারণ কি তা জানি না। হয়তো ওই এলাকায় গিয়ে অসুরদের তাড়া খেয়ে বিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল এনিওয়ে, গুপ্তধনের লোভে কিছু লোকজন জোগাড় করে তিনি ওই এলাকায় যান- মানে যেখানে সম্প্রতি সাইটটা পাওয়া গেছে সেখানে গুপ্তধন খুঁজতে সময় লাগে- দিন- সপ্তাহ-মাস-যা- লাগুক, তিনি লোকজন নিয়ে ওখানে থাকার সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু যেদিন প্রথম খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেন সেই রাতেই..."

"যকরা আক্রমণ করে?" কৌতূহলের সাথে জিজ্ঞেস করল সত্য

"হ্যাঁ, ঠিক তাই এই 'দিন লোকজনের সাথে কথা বলে, লাইব্রেরী ঘুরে, আর নেট ঘেঁটে এগুলো জেনেছি"

"প্রথমে ছিল ভূত- তারপর অসুর- আর এবার যক!" সত্য বললো

"ওই যকাসুর আর কি" মিস্টার খান্না একটু হেসে বললেন

ওরাও একটু হাসলো। তারপর মিস্টার খান্নার থেকে অনুমতি নিয়ে সিম্মি উঠে সাময়িকভাবে একটু ভেতরে গেল।

সত্য বলল, "স্যার, তাহলে তো যা সিম্মি বলল, আমাদের গিয়ে থাকতে হবে। আপনিও আসবেন তো? সেই নিয়ে একটু প্ল্যানিং করে নেব তাহলে।"

"হ্যাঁ হ্যাঁ"

"আমার মেইন কনসার্ন আসলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা স্যার- মানে সাইটে গিয়ে যদি আমরাও অ্যাটাকড হই"

"মনে হচ্ছে প্রতিপক্ষ অলৌকিক সেটা হলে তাকে কিভাবে আটকানো যাবে আমার জানা নেই কিন্তু যদি কয়েকজন মাত্র মানুষ হয়, দেন কিছু ফাঁদ পেতে রাখলেই তাদের কাবু করা যাবে"

"ওকে, কাল বা পরশু যবেই যাই, রাতের আগে ওগুলো ওখানে বিছিয়ে ফেলতে হবে আমাদের"

"ভোর ভোর বেরিয়ে যাব"

".এস.আই.-এর তিনটি ভুয়ো আইকার্ড লাগবে ওটাই আমাদের গেট পাস"

"তোমার ডিপার্টমেন্ট আমায় আই কার্ড দেবে না তোমরা পাবে"

"স্যার তাহলে আপনি...?"

"আমি শ্রমিক সেজে থাকবো বা রাঁধুনি হা হা! চিন্তা নেই"

"হা হা, আচ্ছা! দুটো টেন্টও আনতে হবে; বাকি একটা লিস্ট করে নিই আজ"

"আমিও বাড়ি ফিরব না; ওই ঠিকানায় যাচ্ছি ওখানে থেকে যাব তবে হ্যাঁ..."

"কি স্যার?"

"তোমার ওপরওয়ালার থেকে পারমিশন নিতে হবে তোমায় না হলে হবে না"

"আপনার যাওয়ার ব্যাপারে?"

"ইয়েস"

", ওকে এটাও লিস্টে থাকলো দেন স্যার হোপিং..."

"হুম... আমারও ভালই লাগবে গেলে"

"আচ্ছা ভালো কথা স্যার, মেশিন কি লাগবে?"

"মেশিন মানে ঘোড়ার গাড়ি?"

"হা হা হা, হ্যাঁ স্যার! ওটাই"

"নিতে পারো, তবে..."

"খুব দরকার না পড়লে ইউজ করব না স্যার"

"ইয়াহ!"

সেদিন সত্যদের বাড়িতেই ডিনার করে বেরোলেন মিস্টার খান্না।

 

দু-দিন পরের কথা। ওপরওয়ালার থেকে অনুমতি নিয়ে, সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করে এ.এস.আই.-এর লোক সেজে রবি নদীর পশ্চিম পাড়ে সাইটটাতে আবার হাজির হলো ওরা। প্রথমে সাইটের চারদিকে মোশন সেন্সিং ক্যামেরাগুলো বসিয়ে নিল পুনরায়। যেহেতু সাইটে কোন দরজা নেই, তাই কোলাপসিবল ল্যাডার আর স্ট্যাটিক রোপ-এর সাহায্যে লম্বা পাঁচিল পেরিয়ে একে-একে সাইটে ঢুকলো ওরা, আর সাথে মালগুলো এক-এক করে সাইটের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। তারপর ক্যাম্প দু-টো খাটিয়ে সাইটের ভেতরেই আস্তানা করল সত্যরা। তিনজনে মিলে যুক্তি করার পর সাইটের এক কোনায় ক্যাম্পগুলো খাটানো হল, যাতে সবচেয়ে সুরক্ষিত থাকা যায় আর দরকার পড়লে বেরিয়ে সহজে পালানোও যায়। ফাঁদও পেতে ফেলল ওরা। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল সব কিছু করতে করতে। সাথে কয়েকদিনের খাবার আছে। আর আজকের জন্য রান্না করা খাবারই নিয়ে এসেছে ওরা। সাইটে রান্না করার প্রয়োজন হলো না সেদিনের মত। রাতে প্রত্যেকে ৪ ঘন্টা করে ঘুমালো আর বাকি সময়টা পালা করে পাহারা দিল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেই রাতে কোন রকম উপদ্রব হলো না! পরের দিন সকালে পুলিশ এসে হাজির হলো। ওরা জানতে পেরে গেছে! সত্যরা অবশ্য এরম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছিল। কিভাবে জেনেছে কথা বলার সময়, সেটাও বলল- এরা পেট্রোল পার্টি; সত্যরা রবি নদীতে জল আনতে যাওয়া-আসার পথে কাছের পূর্ব দিকের টিলাগুলোর একটা থেকে এরা ওদের দেখেছে। তবে এ.এস.আই.-এর আইডেন্টিটি কার্ড আর সত্যদের অভিনয়ের কাছে সাধারণ পুলিশের বুদ্ধি হার মানল!

নদীর জলে আনন্দ করে স্নান করলো ওরা তিনজন। ফ্ল্যাশ ফ্লাডের সম্ভাবনা নেই বছরের এই সময়ে- সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে ওরা; তাই চিন্তা নেই! বাকি দিনটা নির্বিঘ্নে কাটলো। রাত এলো, রাতের রান্নাও হল। খেয়ে-দেয়ে আবার পালা করে রাত জাগতে শুরু করলো ওরা। যে যখন রাত জাগছে, তার কাছে তখন পিস্তল থাকছে। রাত তখন দু-টো বাজে- পাহারায় মিস্টার খান্না। আচমকা একটু খুট-খাট শব্দ পেয়ে সজাগ হয়ে উঠলেন খান্না স্যার। কিন্তু শব্দের উৎস সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে সত্য-সিম্মিদের ডেকে তুললেন না। রাত অন্ধকার হলেও উনি অনুভব করলেন যেন কে বা কারা নাদের দিকে এগিয়ে আসছে। টর্চ জ্বাললেন না তিনি; শুধু পিস্তলটা তৈরি রাখলেন। গেরিলা কায়দায় ফাঁদ পাতাই ছিল প্রত্যাশিত আততায়ীদের আশঙ্কায়তবুও সতর্ক থাকা- সাবধানের মার নেই একজন হঠাৎ সেই ফাঁদে ধরা পড়ে আর্তনাদ করে উঠলো। আরেকজন তাকে বাঁচাতে যেতেই মিস্টার খান্না টর্চ জ্বালিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, আর লোকটার পা লক্ষ্য করে একটা গুলি চালিয়ে দিলেন। গুলিটা পা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল, কিন্তু পা চেপে বসে পড়লো লোকটা! এইসবে সত্য-সিম্মির ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি নিজেদের টেন্ট থেকে টর্চ হাতড়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা। তিনজনের টর্চের জোরালো আলোয় দেখা গেল আরো একটা লোক বাকি দু-টো লোকের পিছনে পাথর হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের দুজনের হাতেও পাথর ছিল। তাদের হাত থেকে তা আগেই পড়ে গেছে। পিছনের লোকটার পা লক্ষ্য করে মিস্টার খান্না গুলি করলেন- প্রথম গুলিটা ফস্কে যাওয়ায় আবার গুলি করলেন- কোনটাই লোকটার পায়ে লাগলো না, তবে যেটা লাভ হলো সেটা হলো এই যে লোকটা পাথর ফেলে পিছনে ফিরে দৌড়াতে শুরু করল আর সাইটের সেই চওড়া আর উঁচু দেয়ালের একটা ফাটলের মধ্যে দিয়ে পিছনের ঘুটঘুটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। মিস্টার খান্না আর সত্য তাড়া করে গেল। এই ফাঁকে সিম্মি ভিতরের দু-জন দুষ্কৃতির ওপর নজর রাখছিল। ওই অন্ধকার আর ফাঁকা জায়গায় বিশেষ সুবিধা করতে পারল না ওরা।

"যাগ্গে, ভেতরে চলো সত্য। সিম্মি একা ওদিকে!" মিস্টার খান্না বললেন।

"হ্যাঁ স্যার, দু-জনকে তো পাওয়া গেছে অন্তত।"

ধরা পড়া দু-জন লোকেরই ভালো চেহারা- ছয় ফুটের কম-বেশি উচ্চতা। এর মধ্যে দ্বিতীয় লোকটা আহত অবস্থায়ও সিম্মির ওপর সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ মল্লযুদ্ধ চলার পর সিম্মি তাকে মাটিতে চিৎ করে ফেলল। লোকটা আহত না হলে লড়াইটা হয়তো এতটা একপেশে হতো না! তারপরেও লোকটা বাঁ-পাটা এক হাত দিয়ে চেপে ধরে ওঠার চেষ্টা করায় সিম্মি তার মাথায় একটা গাট্টা বসিয়ে দিল! মাথা বলা অবশ্য ভুল হবে- একটা শিং ওয়ালা প্রাণীর মরা মাথার খুলি নিজের মাথায় পরে আছে লোকটা। গরু বা মহিষ জাতীয় জীব মনে হয়। ফাঁদে পরা লোকটার মাথায়ও তাই। দু-জনেরই খালি গা আর কোমরের নীচে ধুতি জাতীয় কিছু পরা। একজন গুলি খেয়ে কাতরাচ্ছিল, আরেকজন ফাঁদে পড়ে গজগজ করছিল।

ক্যাম্পের দিকটায় গিয়ে মিস্টার খান্না এদিকের আহত লোকটার দিকে পিস্তল উঁচিয়ে ধরে বললেন, "ওয়েল ডান, সিম্মি! ওই দেখো সত্য ফাঁদে কে ধরা পড়েছে!"

সিমি তার স্যারকে ধন্যবাদ জানালো। সত্যর মুখ দিয়ে আপনা-আপনি চাপা স্বরে বেরিয়ে এল, "অসুর!" আনমনা হয়েই সে আরো বললো, "আমার গ্রীক পুরাণের মিনোটরের কথাও মনে পড়ছে।!"

সিম্মি বলল, "ওই আর একটা লোক- সে কোথায় গেল?"

"দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে পালিয়েছে।"

"দেওয়ালের ফাঁক?"

"হ্যাঁ, ওই ওখানে একটা ফাটল বা ফাঁক কিছু একটা তৈরি করেছে এরা।"

"আমরা করিনি- ওটা গুপ্ত দরজা!" আহত লোকটা বলে উঠলো আঞ্চলিক পাঞ্জাবী ভাষাতেই।

ফাঁদে পড়া লোকটা জোর গলায় তাকে চুপ করতে বলল। মিস্টার খান্না একটু কড়া সুরে বলে উঠলেন, "দ্যাখো অসুররা কথাও বলছে! একদম চুপ! না হলে কিন্তু মেরে পুঁতে দেবো এখানেই!"

সত্য মাটিতে পড়ে থাকা লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, "হিন্দি জানো তুমি?"

লোকটা এবার কিছু বলতে রাজি হলো না।

মিস্টার খান্না পাঞ্জাবীতে বললেন, "যদি ভালো চাও তো মুখ খোলো! তাহলে তোমার কোন ক্ষতি করবো না আমরা।"

লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকায়, মিস্টার খান্না সত্যর দিকে তাকিয়ে একটা ইশারা করলেন। সত্য সঙ্গে সঙ্গে লোকটার পায়ে ক্ষত লক্ষ্য করে একটা লাথি চালালো!"

লোকটা জোরে আর্তচিৎকার করে উঠে এবার কাতরাতে কাতরাতে বলল, "বলছি!"

মিস্টার খান্না আরও একটা ইশারা করলেন। তাতে সাড়া দিয়ে সত্য এবার দড়ি নিয়ে এলো টেন্টের ভেতর থেকে। সিম্মিকে ফার্স্ট এইড কিট আনতে বললেন মিস্টার খান্না। লোকটাকে প্রথমে ভালো করে বেঁধে ফেললো সত্য। তারপর ফার্স্ট এইড কিট দিয়ে তার শুশ্রূষা শুরু করলো সিম্মি। সেই ফাঁকে ফাঁদে-পড়া লোকটাকে বের করে তাকেও বেঁধে ফেলল সত্য আর খান্না স্যার। দু-জনেই তাতে বাধা দেওয়ায় অবশ্য তাদের প্রথমে অজ্ঞান করে নিতে হলো।

সত্য বলল, "স্যার এদের যদি সঙ্গী-সাথী থাকে তাহলে তারা দলবল দিয়ে এসে হাজির হলে আমরা তাদের ঠেকাতে পারবো না। ওই লোকটা যদি খবর করে দেয় গিয়ে..."

"ঠিক বলেছ! আর এদের পেট থেকে সত্যি কথা বার না করা অবধি পুলিশ ডাকাও ঠিক হবে না।" মিস্টার খান্না উত্তরে বললেন।

"সেই। আমরা হাতের কাছে যা যা আছে তা নিয়ে বেরিয়ে যাই আপাতত।" বলল সত্য।

"হ্যাঁ, এদের দু'জনকে আপাতত গাড়ির পিছনে বসিয়ে নেব।" বললেন মিস্টার খান্না।

"কাল সকালে আমরা এসে বাকি জিনিসপত্র নিয়ে যাব। আপনাকে আর আসতে হবে না স্যার।" বলল সিম্মি।

 

লোক দুটোকে নিয়ে সত্যরা নিজেদের বাড়িতে ফিরলো রাতের অন্ধকারে। সেখানে ভোরবেলা তাদের জেরা করা শুরু করল ওরা।

সত্য রাগী স্বরে জিজ্ঞেস করল, "তোমরাই কি কিছুদিন আগে ওই সাইটে হাঙ্গামা চালিয়েছিলে?"

"হ্যাঁ, চালিয়েছিলাম, আর তাতে আমাদের কোন আক্ষেপ নেই।" প্রথম লোকটা বলল।

"বাহ! কথা শোনো!" মিস্টার খান্না বলে উঠলেন।

"সেই দিন আরো লোক নিয়ে এসেছিলাম আমরা। আজ ভাবলাম তিন জনের জন্য তিনজনই যথেষ্ট।"

"আমরা যে তিনজন তোমরা জানলে কি করে? ফলো করছিলে নাকি আমাদের?" সত্য জিজ্ঞেস করল।

"না, আমরা রোজ সকালে জায়গাটার উপর নিয়ম করে নাজের রাখি কাছের একটা টিলা থেকে।" দ্বিতীয় লোকটা বলল এবার।

"কে পাঠিয়েছে তোমাদের এবার বলতো?" জিজ্ঞেস করল সিম্মি।

"আমাদের সরদার পাঠিয়েছেন।" দ্বিতীয় লোকটা বলল।

"সরদার? কেন? হোয়াই?" মিস্টার খান্না জিজ্ঞেস করলেন।

"এটা আমাদের জায়গা- আপনারা এখানে ঢুকবেন কেন?" প্রথম লোকটা বলল এটা।

"দ্যাখো এটা সরকারের জায়গা! তোমাদের সর্দারের নয়!" সত্য বলল।

"না, এটা আমাদের জায়গা! আমাদের পূর্বপুরুষদের!" প্রথম লোকটা দাবি করল।

"তোমাদের এই সরদারটি কে শুনি?" সিম্মি জিজ্ঞেস করল।

"আমরা মেলুয়া উপজাতির লোক। আমাদের সর্দার।" দ্বিতীয় লোকটাই বলল।

"মেলুয়া উপজাতি! কোথাকার লোক তোমরা?" সত্য জিজ্ঞেস করল।

"এই পাঞ্জাবেরই।" প্রথম লোকটা বলল।

"পাঞ্জাবে এরকম কোন ট্রাইব আছে বলে তো শুনিনি।" মিস্টার খান্না বললেন।

"আমিও জানি না।" বলল সিম্মি।

"আমরা সাধারণ লোকের সাথে মিশে থাকি বলে শোনেননি।" প্রথম লোকটা বলল এবার।

"আচ্ছা, তোমাদের জায়গা বলছ কেন এটা?" সত্য জিজ্ঞেস করল।

"এটা আমাদের পবিত্র জায়গা কারণ এখানে আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন।" প্রথম লোকটাই বলল।

"কতদিন আগের কথা বলছো?" মিস্টার খান্না জিজ্ঞেস করলেন।

"দশ রাজার আমলের।" দ্বিতীয় লোকটা বলল।

"দশ রাজা! এরা কারা? কাদের কথা বলছ?" মিস্টার খান্না আবার জিজ্ঞেস করলেন।

"আমরা সেটা জানি না। আমরা যা শুনে বড় হয়েছি তাই বললাম।" দ্বিতীয় লোকটা বলল।

"ঠিক আছে, গভমেন্টের সাথে তোমাদের আলোচনা করতে হবে এটা নিয়ে।" মিস্টার খান্না বললেন।

"হ্যাঁ, যদি সত্যিই ওটা তোমাদের পবিত্র জায়গা হয়, তাহলে গভার্নমেন্ট ভেবে দেখবে" সত্য বললো

"যদিও খননকার্য হয়তো থামবে না কারণ জায়গাটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে" যোগ করলেন মিস্টার খান্না

"জানি আমরা তাই জন্যই তো কাজটা বন্ধ করে দিতে চাইছিলাম" প্রথম লোকটা বলল

"আমরা চাই ওখানে কেউ হাত না দিক আমাদের অনুষ্ঠান হয় ওখানে" বলল দ্বিতীয় লোকটা

"কিরকম অনুষ্ঠান?" সিম্মি জিজ্ঞেস করল

"কিছু বিশেষ তিথিতে রাতের অন্ধকারে এখানে আমরা জড় হই" দ্বিতীয় লোকটা বলল

", এই ব্যাপার! ওই ট্রাক ড্রাইভার তাহলে এদেরই কাউকে দেখেছিল" মিস্টার খান্নার দিকে ফিরে বলল সত্য

"-তো সিক্রেট সোসাইটির মতন ব্যাপার-স্যাপার" সিম্মি বলে উঠলো

"হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন আমরা আমাদের আসল পরিচয় আপনাদের সমাজের থেকে গোপনই রাখি" প্রথম লোকটা বলল

"দ্যাখো, তোমরা যা-যা বলছ সেটা ভেরিফাই করার জন্য আমাদের তোমাদের ট্রাইবের ডিটেলস দরকার- বাকিদের ব্যাপারে জানা দরকার" মিস্টার খান্না বললেন

"দুঃখিত, আমাদের মন্ত্রগুপ্তি আছে বাকি সদস্যের ব্যাপারে কোন ব্যক্তিগত তথ্য দিতে পারবো না" প্রথম লোকটা বলল

"স্যার, মনে হচ্ছে এরা সহজে মুখ খুলবে না আবার বল প্রয়োগ করতে হবে" সত্য বলল

"না সত্য, দাঁড়াও!"

"কিন্তু কেন স্যার?" সিম্মি জিজ্ঞেস করল

"যদি এদের কথা সত্যি হয় তাহলে? না জেনে ওদের গায়ে হাত তোলাটা ঠিক হবে না!"

"তাহলে এখন এমন কাউকে দরকার যে লোকাল হিস্ট্রি খুব ভালো জানে" সত্য বলল

"ডক্টর আলুওয়ালিয়া কে বলবেন? ঠিক হবে সেটা স্যার?" সিম্মি জিজ্ঞেস করল

"আর কোন উপায় আছে কি? এতেই যদি এক কাজ হয়" সত্য বলল

"আলুওয়ালিয়া আমার বন্ধু ওকে দিয়েও মন্ত্রগুপ্তি করাতে হবে" মিস্টার খান্না বললেন

"ঠিক আছে স্যার অ্যাজ্ ইউ সে" সত্য বলল

"কাল ওদের উপর নজর রেখো তোমরা আমি গুরদাসপুরে যাব; বাড়িতে ডাকবো আলুওয়ালিয়াকে"

"ওকে স্যার আমরা ওদের উপর নজর রাখবো আর এক ফাঁকে গিয়ে বাকি মাল-পত্রগুলো সাইট থেকে নিয়ে আসব" বলল সিম্মি

"হ্যাঁ, এখন আমরা একটু বিশ্রাম নিয়ে নি, চলো তার আগে ওদের একটু জল-খাবার দাও" বললেন মিস্টার খান্না

"ওদের হেলমেটগুলো ভেতরে নিয়ে আসি কাল- পরশু ওগুলো ওপরওয়ালাকে দেখাবো" বলল সত্য

"ওগুলো গাড়িতেই রেখেছো?"

"হ্যাঁ, পিছনে আছে স্যার আনছি" এই বলে সত্যর জায়গায় সিম্মি গেল সেগুলো আনতে

 

পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় মিস্টার খান্নার গুরদাসপুর-এর বাড়ির বসার ঘরের সোফাতে বসে তার মুখে সব শুনে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে উঠলেন ডক্টর আলুওয়ালিয়া,"মেলুয়া উপজাতি? উমম্..."

"হ্যাঁ, যা শুনছিস।" শান্ত স্বরে বললেন মিস্টার খান্না।

"সে কি! এরা এখনো আছে বলে তো জানতাম না!"

"ওদের বাস কোথায় ছিল?"

"ওরা তো যতদূর জানি, ওই এলাকাতেই থাকতো।"

"মানে রবি নদীর পশ্চিম পাড়ে?"

"হ্যাঁ, ওখানে, ওই এলাকাতেই। তাই তো জানি।"

"তারপর?"

"তবে সে মধ্যযুগের ব্যাপার। তারপর ওই জায়গাটা জবরদখল হয়।"

"আচ্ছা।"

"কিন্তু বেশিদিন থাকেনি দখলে।"

"ওই যকের ধনের ব্যাপার নাকি?"

"হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই ওটাও জানিস তাহলে!"

"ব্রিটিশরাও তো গেছিল ধনের সন্ধানে।"

"হ্যাঁ, মধ্যযুগে যারা ওই জায়গাটা দখল করেছিল তারা মাটি খুঁড়ে কিছু জেমস্টোন-ফোন পায়।"

"ওগুলো কি ওই সাইট থেকে পায়?"

"এখন তো আমার তাই মনে হয় জনপদটা আবিষ্কার হওয়ার পর।"

"তাহলে যক হলো এই অসুররাই। ওরাই আক্রমণ করত যারা ওই এলাকায় যেত তাদের। সেই থেকেই ধনের সন্ধানের সাথে দু'য়ে-দু'য়ে চার করে ওই যকের গল্পের উৎপত্তি আর কিলোকে ভাবতো অসুররা গুপ্তধন পাহারা দেয়।"

"ওদের জায়গা হাতছাড়া হওয়া ওরা আগেও মেনে নেয়নি, বুঝলি!"

"আলবাত!"

"আর আজও মেনে নিচ্ছে না। আমাদের টিমকে সেই জন্য আক্রান্ত হতে হল!"

"হুম, হাডসন সাহেবকেও পিছিয়ে আসতে হয়েছিল উনিশ শতকে।"

"ইয়েস, হাডসন যকের ধনের লোভে খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়ে গেলে হয়তো আরো আগেই পাওয়া যেত শহরটা।"

"যাইহোক, এখন যে পাওয়া গেছে এতে ইতিহাসের বিরাট উপকার হল।"

"হ্যাঁ, অবশ্যই। শহরও পাওয়া গেল; তারপর ওখানে একটা ভাঙ্গা বাঁধও পাওয়া গেছে নদীর ধারে।"

"আচ্ছা আচ্ছা। ওটাও প্রাচীন?"

"হ্যাঁ, ওই শহরটার সমসাময়িক। দশরাজন যুদ্ধের গল্পে একটা বাঁধ ভাঙ্গার উল্লেখ আছে। কি জানি এটা সেটাই কিনা!"

"আচ্ছা একটা কথা বলতো, দশরাজন কথাটার মানে কি দশ রাজার যুদ্ধ? দশ রাজার আমল?"

"হ্যাঁ হ্যাঁ, দশ রাজা ছিল ভরতদের বিরুদ্ধে ওই গৃহযুদ্ধে ট্রাইবাল রাজা সবাই"

"কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? মধ্যযুগের এই মেলুয়া উপজাতির লোকরা কি সেই যুদ্ধে ছিল নাকি? সে তো বহুকাল আগের কথা!"

"ছিল হয়তো। ঋগ্বেদ তো ওরাল ট্রেডিশন-এরই অংশ ছিল এক কালে। অনেক পরে লেখা হয়, রামায়ণ-মহাভারতের মতোই। চারণ কবিদের ব্যাপারটা তো জানিসই- তারাই বংশানুক্রমে মনে রাখত সব।"

"শ্রুতি আর স্মৃতি।"

"হ্যাঁ, এক্সাক্টলি। এই ট্রেডিশনটা সব দেশেই ছিল মোটামুটি। আর ট্রাইবাল কমিউনিটিদের এই ওরাল কাহিনীগুলো যে কত পুরনো তা ওরা নিজেরাও জানেনা! চলে আসছে যুগ-যুগ ধরে!"

"হ্যাঁ, সেটা ঠিক। একদম!"

"ঋক বেদের এই ভরত বা ওদের জোটের গোষ্ঠীরাও তো এককালে পাহাড়ি ট্রাইবাল ছিল। তারপর ক্ষেত-খামার করে, বাণিজ্য করে, ফুলে-ফেঁপে ওঠে! তারপর শুরু হয় এলাকা বিস্তার"

"ক্ষমতা দখলের লড়াই!"

"হুমম…! এই যে আজ আমরা ভাবি যে অসুর মানেই মাথায় শিং- তথ্য-প্রমান কিন্তু ইঙ্গিত করছে যে এই ভারত গোষ্ঠীরাও এক কালে শিং পরতো!"

"হা হা! তাহলে শিং খসে গেল? জাতে উঠেছে বলে?"

"হতে পারে…"

"সালা মাই তো সাহেব বন্ গায়া! মনে আছে গানটা?"

"হা হা হা! দিলীপ কুমার তো?"

"হাঁ!"

"অসুররা কিন্তু শিং-এর ট্রেডিশন ছাড়েনি- সেই যুগেও না, আর এখনো না!"

"পরবর্তীকালে সুরদের হলো মুকুট, আর অসুরদের চিহ্ন হয়ে গেল শিং!"

"সেই; আজকে তো লোকে ছোট থেকে সেটাই জানে- শিং মানেই ইভিল"

"তাহলে তুই নিশ্চিত যে এই উপজাতি এতটাই পুরনো?"

"ওখানে তো পিট্-ডুয়ালিংস পাওয়া গেছে সাইটের আরলিয়েস্ট লেভেলে। ওদের তৎকালীন সর্দারই হয়তো ওই দশ রাজার এক রাজা ছিল"

"এটা শহরকেন্দ্রিক জনপদটা তৈরি হওয়ার আগের ঘটনা তাই তো?"

"হ্যাঁ। ওই বাঁধটা না ভাঙ্গলে দশ রাজার জোট হারতো না, আর আমাদের দেশের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো।"

"বাঁধটা কি হড়কা বানে ভাঙ্গলো?"

"ওই রবি উপত্যকায় তা- হয়ে থাকবে মনে হয়!"

"নদী তো ওদের প্রাণ ছিল! অবিভক্ত পাঞ্জাবের শ্রী-বৃদ্ধির রসদ…"

"ছিল, কিন্তু নদী শক্তিশালী হলে যেমন ভালো, তেমন সমস্যাও! সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যাকার মানুষ সম্ভবত সেই যুগে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পায়!"

"তাই বাঁধ তৈরির প্রয়োজন আর প্রযুক্তি…"

 

"৬০০০-এর বেশি লোক মারা যায় সেই বানে, ঋগ্বেদ অনুযায়ী"

"অসুরদের?"

"ইয়েস! বন্যার জলে ভেসে  গিয়ে বা ডুবে গিয়ে মহেঞ্জদরোর মত…"

"৬০০০+ ফিগারটা ঠিক হলে তো বিশাল!" বলতে বলতে চোখ একটু বড় করলেন মিস্টার খান্না

"ইন্দ্র, গড অফ থান্ডার এন্ড রেইন!"

"সেই যুদ্ধ-জয়ের দিনের পর থেকে হয়তো ভরতদের কাছে ইন্দ্র-দেবের মহাত্ম আরো বেড়ে গেছিল!"

"স্বাভাবিকভাবেই, ভরতরা বা ওদের জোটের কেউ..."

"এক মিনিট, ওয়েট। ভরতরা বলছিস ভরত তাহলে একজন না? মানে সম্রাট ভরত...?"

"না, ভরত একটা উপজাতি। তাদের প্রথম রাজাকেই আমরা পুরাণের সম্রাট ভরত বলে চিনি। তারপর থেকে পুরো উপজাতি আর তাদের গোষ্ঠীকে তাকেই সবাই ভারত বলে চিনতো।"

"ওহো, এই ব্যাপার!"

"ইয়েস, ডিয়ার ফ্রেন্ড!"

"দশ রাজার যুদ্ধ কি এই সম্রাট ভরতের সময়ের ঘটনা?"

"না, তখন ওদের রাজা ছিল সুদাস। মেলুয়াদের সরিয়ে হয়তো শহরটা বানিয়েছিল পূর্বদিক থেকে আসা ওই ভরতগোষ্ঠী। তাই একটা সময়ে আমরা দেখি যে পিট ডুয়ালিং থেকে প্রপার শহর তৈরি হচ্ছে।"

"আর এই অসুররা পশ্চিমে চলে গেছিল?"

"হ্যাঁ, তথ্য প্রমাণ থেকে সেরকম মনে করে অনেকে। কারণ পূর্বে যাওয়ার উপায় ছিল না। যাদের চোখে এরা 'অসুর' ছিল সেই ভরতদের শক্ত ঘাঁটি ছিল সরস্বতী অঞ্চল। ওদের রাজধানীও বলতে পারিস। তো নিরুপায় হয়ে ওরা আরো পশ্চিমে সরে যায়।"

"ওহ, সরস্বতী অঞ্চল বলতে হিমাচল-হরিয়ানার দিকে সরস্বতী নদীর কথা বলছিস?"

"হ্যাঁ, যেটা একেবারে শুকিয়ে গেছে এখন। তবে মধ্যযুগেও ওটাতে জল ছিল কিছুটা হলেও। এখনো কিছু কিছু অংশে জল থাকে বছরে মাস তিনেক।"

"খরস্রোতা সরস্বতী এভাবে শুকিয়ে গেল! আর মেলুয়ারা?"

মেলুয়া উপজাতি হয়তো যাযাবর হয়ে গেছিল যুদ্ধের পর।"

"হ্যাঁ হ্যাঁ, হতেই পারে। তবে পাথর নিয়ে যদি ভরতদের তৈরি ওই শহর আক্রমণ করে থাকে ওরা, তাহলে আলাদা ব্যাপার। সিলমোহর থেকে তো সেরকমই মনে হচ্ছে।"

"আচ্ছা, তাই নাকি? তুই দেখেছিস?"

"হ্যাঁ, দেখিস ছবিগুলো। আমার মনে হয় ওই দেয়ালটা রবি নদীর বন্যার জন্য না, অসুরদের পাথর ছোঁড়া থেকে শহরকে বাঁচানোর জন্য তৈরি। ওই জন্য তো কোন প্রবেশ দ্বারও নেই, শুধু একটা গুপ্ত দরজা ছাড়া।"

"গুপ্ত দরজা? বলিস কি! হ্যাঁ, আজকের যুগের ওই মেলুয়ারায সেটা খুঁজে বের করেছে; তোরা সাইটে কাজ করেও খুঁজে পাসনি! আমরাও জানতাম না।"

"ওহ বাবা! এ তো কেঁচো খুঁড়তে কেউটে!"

"হ্যাঁ, পুরো ব্যাপারটাই সেরম।"

"এই দেখ না, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাহায্যে যাদের হারিয়ে আর সরিয়ে ভরতরা শহর বানালো, কালের অমোঘ নিয়মে একটা সময়ে সেই ভরতদেরও সেই শহর ছাড়তে হলো!"

"আচ্ছা আচ্ছা,কেন হঠাৎ?"

"জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রধানতঃ।"

"আজকে আমরাও তো এই ক্লাইমেট চেঞ্জ এর ফলে ভুগছি। হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ!"

"ট্রু। ওরাও ভোগ করেছিল। মানুষ ছিন্নমূল হয়েছিল, অনেকে যাযাবর হয়েছিল।"

"গ্রাম, ফাঁকা জায়গা, পাহাড় বা জঙ্গলের দিকেও চলে গেছিল নিশ্চয়ই?"

"গেছিল বৈকি। নদী আর সমুদ্রপথেও বেরিয়ে গিয়েছিল।"

"আচ্ছা আচ্ছা, কত বিচিত্র ইতিহাস! কত কিছু অজানা!"

"হুম..., আমি অনুমান করছি, শহর খালি হওয়ার পরেই হয়তো ওরা ফিরে আসার সুযোগ পায় এই অঞ্চলে।"

"কিন্তু এরা কি তারা? ওখানে জলবায়ু পরিবর্তনের পরও কি কোন মানুষের উপস্থিতি ছিল?"

"দ্যাখ, বড় শহর ছিল না, বা সেরম সেটেলমেন্ট প্যাটার্ন পাইনি আমরা কোন।"

"সেই তিনটে ফে ছাড়া কোন বড় জনবসতি হয়নি? বা তার প্রমাণ মেলেনি?"

"না, কিন্তু দ্যাখ, জলবায়ু পরিবর্তনের পরেও ওখানে হিউম্যান প্রেসেন্স ছিলই, তার প্রমাণ পেয়েছি আমরা। সাইটে হিউম্যান অ্যাক্টিভিটি চলতোই। এটা হয়তো মেলুয়াদেরই কাজ- পবিত্র ভূমিতে অনুষ্ঠান করতো হয়তো ওরা। আর থাকত আশেপাশেই। স্মল স্কেল পেরিসেবেল ট্রাইবাল সেটেলমেন্ট।"

"তুই এতটা শিওর হচ্ছিস কি করে?"

"কারণ মধ্যযুগে মেলুয়ারা ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগে অবধি ওরা যে অন্তত দুই হাজার বছর ওই অঞ্চলে ছিল, সেটা আমরা বিভিন্ন বিদেশি পর্যটকদের পুঁথি-পত্র থেকে জানতে পারি।"

"আর মধ্যযুগ অবধি থাকে- পুনরায় ছিন্নমূল হওয়ার আগে অবধি আই সি!"

"ইয়েস..., মধ্যযুগে ওদের উচ্ছেদ করে ওখানে একটা বড় জনবসতি তৈরি হয়।"

"হয়তো তার আগে যারা যারা বসতি স্থাপন করতে এসেছে তাদের ওরা পাথর ছুঁড়ে তাড়িয়ে দিয়েছে!"

"বা যারা আসতোও তারা জানতো যে এটা ওদের এলাকা; তাই ঘাঁটাতো না ওদের।"

"টাইম ইজ সাচ এ লেভেলার! আশ্চর্যের ব্যাপার এটাই যে, এত উত্থান-পতনের পরেও আজও ওরা নিজেদের আইডেন্টিটি হারায়নি- মূল স্রোতের মাঝে থেকেও।"

"ঠিক এটাই হয়তো পাঁচ হাজার বছর ধরে চলছেকসিলেন্ট এক্সাম্পল অফ কালচারাল কন্টিনুইটি!"

"এই কালচারাল কন্টিনিটি- তো আমরা আমাদের দেশে সর্বত্রই দেখি- এমনকি সমাজের মূল স্রোতেও"

"রাইট! যা হাজার হাজার বছরের পুরনো অনেক সময়ে বলা মুশকিল হয় কত পুরনো!"

"পাথর ছোঁড়ার ব্যাপারটাতেও কিন্তু কালচারাল কন্টিনিউইটি! পাথর সেই যুগ থেকেই মানুষের সাথী"

"যা বলেছিস, খান্না!"

"পুরাণ কাহিনী সেই অসুররা আজও আমাদের মধ্যে রয়েছে! কে ভেবেছিল?"

ডক্টর আলুওয়ালিয়া মাথা নেড়ে বললেন, "তাই মনে হচ্ছে…! আচ্ছা শোন, ওদের ভাষার ব্যাপারে কিছু জানতে পারলি?

"না, ওদের নিজস্ব আলাদা কোন ভাষা আছে বা ছিল কিনা সেটা জিজ্ঞেস করিনি রে"

"ওকে..."

মিস্টার খান্না কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললেন, "তবে শোন্, এসব কাউকে বলিসনা- এটা আমার অনুরোধ!"

"এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা কাউকে বলবো না, এটা ভেবে খারাপ লাগছে কিন্তু তুই বলছিস যখন বারবার..."

"হুম, প্লিজ ভাই...! বলার সময় এলে আমি নিজেই বলবো তোকে না হলে এটা ঘরের বাইরে যেন না বেরোয়!"


মিস্টার খান্না পাঠানকোটে গিয়ে সব জানান সত্য আর সিম্মিকে। এরপর যা হয়েছিল তা বিস্তারিতভাবে বলার অনুমতি অন্তত এই মুহূর্তে নেই আমার। তবে এটুকু বলতে পারি যে সত্যরা এটা যাচাই করতে সফল হয় যে আটক হওয়া দুই 'অসুর' সব সত্যি কথাই বলছিল। তাদের দু-জনের আজানতেই তাদের মারফত তাদের উপজাতির আরো কিছু সদস্যের খোঁজ পায় সিম্মিরা। অসুরদের কোন সাজা হয়নি। বরং ভারত সরকারের কাছে খবর পৌঁছানোর পর সরকার সেই মেলুয়া উপজাতির সব জীবিত সদস্যদের খুঁজে বের করার পরিকল্পনা নেয়, এবং তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে অনুমতি নিয়েই তাদের বর্তমান ভারতের ট্রাইবের তালিকায় সরকারিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে হ্যাঁ, রবি নদীর পশ্চিমের ওই প্রত্নক্ষেত্রে কোন অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেয়নি সরকার; শুধু ওখানে অবাধ যাতায়াতের অনুমতি পায় তারা। খননের কাজ আবার শুরু করে এ.এস.আই.। সাইটটার আরেকটু দক্ষিণ-পশ্চিমে একটা জায়গাকে সংরক্ষিত উপত্যকা হিসেবে ঘোষণা করে মেলুয়াদের হাতে প্রদান করেছে সরকার।

 

সমাপ্ত
=====================   
 
 
নাম: আলাপন রায় চৌধুরী। 
ঠিকানা: দমদম, কলকাতা- ৭০০০৬৫।

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩