ইচ্ছেরা ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের অনুভূতিমালা
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
'ইচ্ছেরা ছুঁয়ে যায়' কবি সাথি রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কোন গভীর তাড়নায় একজন কবি কবিতা লেখেন এর উত্তর বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হলেও প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের যে রোমাঞ্চ, যে আবেগ ও উদীপনা তা কমবেশি সকলের ক্ষেত্রেই সমান। সাথি দীর্ঘ সময় ধরে কাব্যচর্চার সাথে সংযুক্ত থাকলেও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে তাঁর তীব্র অনীহা, অথচ সাহিত্যের এক গর্বিত উত্তরাধিকার তাঁর রক্তে ও মজ্জায়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি তিনি। সংস্কৃতির অঙ্গনে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ছন্দের অসামান্য কারুকাজ তিনি রপ্ত করেছেন শৈশব থেকেই। এই কাব্যগ্রন্থে জীবনের আলোড়িত সত্তার ভেতর থেকে প্রাত্যহিক দ্বন্দ্ব সংঘাত, প্রেম- জটিলতা, ক্ষুদ্রতা-উদারতা, সংগ্রাম এবং বিচ্ছিন্নতার নিরলস ভাবনা বারবার আবর্তিত হয়েছে। ' বালুচরে ফোটে না তো ফুল/ কাঙাল হৃদয় আজ হয়েছে আকুল' এই আকুলতাই তাঁর গতিজাড্য। তাই ধ্যানলীন চৈতন্যের ভেতর অস্তিত্বের সুপ্তি ও জাগরণচিহ্ন নিয়ে জীবনকে এঁকেছেন তিনি। যে জীবন নিরালম্ব আলোকলতা নয়। যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে যন্ত্রণাময় দাহ এবং অগ্নিশুদ্ধ অমৃতের স্বাদ। সাথির কবিতার ভেতর অমানবীয় সংঘাত আছে এই সংঘাত রিক্ততার প্রতিভু নয়, বরং যা স্বপ্নসন্ধানী অন্তর্মুখী যাত্রা।
১
আমার কাছে একটা নদী আছে
গতিহীন, শব্দবিহীন
আমার পারাপারে, দুই পাড়ও আছে
মধ্য আকাশে অসীমে বিলীন... ( বহমান)
২
মেঘের আঁচলে
রাতের কাজলে
চাঁদ লেপ্টে আছে।
তবু, রাত আসে না
আমার ভাঙা জানালার কাচে ( গোলাপ কাঁটা)
৩
দূর থেকে দেখেছো তুমি
শুকনো নদী
আর
ঝরাপাতার ছবি
তপ্ত দুপুরে
পুড়তে দেখেছি আমি
সীমাহীন
অজস্র অনুভূতি ( দহন)
৪
রাত পোহালেই ভোরের আলো
আরও একটা দিন
আঁধার আমার কাটবে
বাড়ছে মৃত্যু ঋণ। ( ঋণ)
৫
ভালোবাসার রঙিন খামে
আজও চোখে বৃষ্টি নামে। ( দিনরাত্তির চেনা অসুখ)
ইন্দ্রিয়ানুভব বস্তুজগত থেকে ইন্দ্রিয়াতীত চেতনার গভীর কক্ষ স্পর্শ করেছে তার চিন্তা। মানবমনের প্রসারনশীল সীমার মধ্যে জেগে উঠেছে আলোকিত অনুষঙ্গ। তাই তিনি লেখেন-' সরিয়ে দিচ্ছি, উড়িয়ে দিচ্ছি, পুড়িয়ে দিচ্ছি শোক/ চোখ দুটো তোর সাফল্যের নীরব সাক্ষী হোক' সাথির কিছু প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কবিতা পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে ' ইচ্ছেরা ছুঁয়ে যায়' তার সেই ভাবনাবলয় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বলা যায়, তিনি তাঁর সৃষ্টিতরঙ্গ থেকে অনেকদূর সরে এসেছেন সাম্প্রতিক ভাবনায়। অনেক পরিণত হয়েছে তাঁর চিন্তার ভাস্কর্য। শৈল্পিক প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়েছেন শব্দব্যবহারের ক্ষেত্রে। ফলে মেদবহুল একঘেয়ে ও পুনরাবৃত্ত শব্দ-সম্বন্ধের সাবেবিকানা থেকে সরে এসে সচেতন ভাবেই দখল করেছেন আধুনিক শিল্পসার্থকতার ক্ষেত্রভূমি। শব্দ আর অনুভবের এক আশ্চর্য আত্মীয়তায় ভরে উঠেছে তাঁর ভাবনাদুনিয়া।
১
যে সময় চলে গেছে
যত্নে, তাকে লিখে রাখি
নিত্য খাতার পাতায়
যে সময় আসার আগেই
চলে যাবে দিগন্তে
তাকেও বুঝি লিখে নেবো
মেঘ ভাঙা ধারায় । ( সময়)
২
সব ছবিই জলে ধোয়া
রঙিন হোক বা সাদাকালো
নীরব হোক প্রেম বা উচ্চারিত
লুকিয়ে লুকিয়েই মানায় ভালো ( জলছবি)
৩
অভিমানের রাত পাহারায়
জেগে থাকি ছদ্মবেশে
ঝলসে যাওয়া পূবের আল
চাঁদকে লুকায় ভালোবেসে ( কাজললতা)
৪
ভাঙা আয়নায় মুখ দেখে দেখে
হইনি কখনো ক্লান্ত
প্রত্যেক টুকরোয় দেখেছি আমি
জীবনের আদি-অন্ত। ( দর্শন)
অস্তিত্বের নিরবচ্ছিন্ন রূপান্তরের কথা স্মরণ করিয়েই শোককে প্রত্যাখান করা যায়।চূর্ণ করা যায় মায়াজগতের যাবতীয় শৃঙ্খলা। নিসর্গলীন বোধের অন্তর্দীপ্ত প্রবাহে এবং নান্দনিক প্রভায় আলোকিত হয়েছে অন্তহীন অখণ্ড জীবনের বিচ্ছুরণ । দহনের প্রতিটি নীরবতার ধ্বংসকালীন অনুরাগকে ভাঙচুর করে তছনছ করে উঠে এসেছে মাতৃস্তন্যের সেই অতলান্ত শৈশব – ' ও পাড়ে সময়ের হাতছানি/ এ পাড়ে স্মৃতির বালুচর,/ মধ্যবর্তী নদীপথে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে/ তুমি-আমি আর ফেলে আসা নুড়ি পাথর' সময় এবং চিরকালীন সত্যের দ্বিরালাপকে এভাবেই চিহ্নিত করেছেন সাথি।কুহকের ভেতর অবভাসের ভেতর নিমজ্জিত দিশাহীনতা থেকে এভাবেই সত্যশ্রয়ী এক দিগন্তের উন্মোচন । জীবন এবং জগত সম্পর্কে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বিষয়এর নির্মোক মোচন করে মানব আর প্রকৃতির রহস্য , মহাবিশ্বের ক্রিয়াপ্রকরন সহ সমস্ত দার্শনিকতার প্রতিপ্রশ্নে প্যান্থেইস্টিক ভাবনার বলয়টির শরণ নেওয়াই কি তাহলে মানুষের নিয়তি- ' পর্দার আড়ালেও আমি/পর্দা উঠলেও আমি-/ মুখ-মুখোশের রঙ্গমঞ্চে/ কাঠামোটাই ভীষণ দামি' । সত্যের ছদ্মবেশে যা চোখের সামনে আসবে, মোহ তৈরি করবে তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে জীবনে গ্রহন করতে হবে। এই জিজ্ঞাসার নাম আত্মজিজ্ঞাসা। আপাতরুদ্ধ দানবীয় রূঢ়তার নির্মোক ভেঙে স্বপ্ন উপযোগী আত্মানুসন্ধান – 'অবসরে নয়, উৎসবেও নয়/ সমাপ্তিতে উৎসটুকু খোঁজাই জীবন ' ।
শব্দের প্রগলভতা নয় সাথির জোর তাঁর অনুভবভিত্তি।জীবনের প্রতিটি চেতন অচেতন মুহূর্ত জুড়ে জুড়ে সংশ্লিষ্ট জিজ্ঞাসার নিরসনই তাঁর কাজ।তাঁর চিন্তাবিশ্বে "আলোর ঢেউয়ে ভাসুক যতই/ রাতের হাওয়া অবিরত-/ জ্যোৎস্নামাখা আকাশ জানে /চাঁদ কতটা অবনত" নম্রতার এই আলোকমিতি তাঁর ইচ্ছেকে অনেকদূর নিয়ে যাবে।
=========================
ইচ্ছেরা ছুঁয়ে যায়।। সাথি রায়।। দি সী বুক এজেন্সি।। প্রচ্ছদ- রাজদীপ পুরী। মুল্য- ১৫০ টাকা।।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন