মায়ের স্বপ্নভঙ্গ
মিঠুন মুখার্জী
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ছোট্ট আফরিনা তার মাকে বলে--- "মা, আমরা কি দেশে ফিরতে পারবো না!! আমার স্বপ্ন কি পূরণ হবে না?" মা খাদিজা বিবি কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন--- "এই পরিস্থিতিতে কিভাবে যে মাতৃভূমিতে ফিরে যাব, কে জানে। দেশে তোর বাবার ও দিদির চোখের জলে দিন কাটছে।" খাদিজা বিবির মাতৃভূমি হল ভারতবর্ষ। কলকাতার পার্ক সার্কাসের একটা বস্তিতে মোহাম্মদ সালেম তার বউ খাদিজা বিবি ও দুই মেয়ে আফরিনা ও কারিনাকে নিয়ে একপ্রকার সুখেই বাস করতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে খুলনা জেলায় ভাইয়ের বাড়িতে বড় মেয়ে করিনার বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে গিয়েছিলেন তারা। তাছাড়া অনেকদিন ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়া হয়নি। দেশভাগের সময় ভাই আবু হোসেন পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। তারও জন্মস্থান কলকাতা। সপ্তাহখানেক পর মোহাম্মদ সালেম বড় মেয়ে কারিনাকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন। সপ্তাহ দুই পরে খাদিজা বিবি ও আফরিনাকে বর্ডার পার করে দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন মোহাম্মদ সালেমের বড় শালা আবু হোসেন। খাদিজার দাদার খুলনা জেলায় বেশ পতিপত্তি ছিল। অনেকেই তাকে সমীহ করে চলতেন। তিনি সেখানকার একজন বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তবুও বোন ও বোনঝিকে বর্ডার পার করে দিতে পারেননি।
সপ্তাহখানেক যেতে না যেতে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদের অত্যাচার চরমে ওঠে। বাংলাদেশের মুসলিম ও হিন্দুদের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে তারা। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়, নারীদের উপর পাশবিক অত্যাচার শুরু করে। তারা শিশুদের উপর অত্যাচার করতেও পিছুপা হয়নি। খাদিজা বিবি আফরিনাকে নিয়ে আবু হোসেনের বাড়ি থেকে পালিয়ে একটা বড় ধান ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়েছিলেন। নিজের চোখে তারা দেখেছিলেন দাদা ও দাদার তিন ছেলেকে গাছের সঙ্গে পিচমোড়া করে বেঁধে নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছিল সেনাবাহিনী। শেষমেষ সকলের সামনে খাদিজা বিবির বৌদি ও ছেলের বউদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছিল জানোয়াররা। ফিরে যাওয়ার সময় গুলি করে সকলের নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছিল। আফরিনার চোখ দুটি হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন খাদিজা। দুচোখ বেয়ে ঝরে পড়েছিল অশ্রুধারা। ভয়তে সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল তাদের। নিজেদের জীবনের কথা চিন্তা করে দাদার ভিটেতে আর তারা ফিরে যান নি। কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তবে কথায় বলে-- 'রাখে হরি মারে কে'। এক হিন্দু চাষী ধানক্ষেত থেকে তাদেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে জানতো না খাদিজা বিবি ও আফরিনা মুসলমান। সেই চাষী দূর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অত্যাচার দেখতে দেখতে হঠাৎ ধান ক্ষেতের একটা জায়গা নড়তে দেখেন। তিনি বুঝতে পারেন প্রাণভয়ে কেউ হয়তো ধানক্ষেতে লুকিয়ে আছে।
তাদের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর খাদিজা বিবি সম্পর্কে সব খবর নেন সে। তারপর বলেন--- "বোন, আপনারা এখানে নিরাপদ নন। আপনাদের ঘন্টা খানিক পর আমি আমার মামাতো বোনের বাসায় দিয়ে যাব। আপনারা কাউকে বলবেন না যে, আপনারা এদেশের মানুষ নন। আমাদের এদেশের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যেও আপনাদের দেশের মীরজাফরের মতো মানুষও আছে। তারা যদি জানতে পারে আপনারা হিন্দুস্থানের মানুষ, আর সেই খবর পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদের কানে যায়, তবে আপনাদের বিপদ আছে। আমার বোন যেখানে থাকে সেখানকার সন্ধান কেউ জানেন না। তাছাড়া আত্মরক্ষার জন্য ওর কাছে অস্ত্রশস্ত্রও আছে। পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হলে আমি আপনাদের বর্ডার পার করে দেব।" খাদিজা বিবি ওই আগন্তুক কৃষককে বিশ্বাস না করে পারেন না। সে তাকে বলেন--- "আমি যে আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দেব তা বুঝে উঠতে পারছি না। আমি ভেবেছিলাম, এ দেশের মানুষ মানুষের দুঃখ বোঝে না। কিন্তু আপনাদের দেখে আমার সেই ভুল ধারণা ভেঙ্গে গেল। আমি চিরকাল আপনাকে মনে রাখবো ভাইজান।"
এদিকে বাংলাদেশের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির কথা শুনে মোহাম্মদ সালেম ও তার বড় মেয়ে কারিনার মনের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কোনোভাবে মোহাম্মদ সালেম, বউ ও ছোট মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারেন না। আল্লাহর উদ্দেশ্যে করিনা বলে--- "হে আল্লাহ, আপনি আমার বোন ও মাকে রক্ষা করবেন। এরকম পরিস্থিতি হবে আমরা আগে জানলে ওদেরকেও সঙ্গে নিয়ে চলে আসতাম। ওদের কিছু হয়ে গেলে আমরা মরে যাব।" এরপর করিনা কাঁদতে থাকে। মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। পাত্রপক্ষের পরিবারের সদস্যদের এই ঘটনা জানানো হয়। তারা পরিস্থিতিকে মেনে নেন।
খাদিজা বিবির দু-চোখে দুই মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। বড় মেয়ে কারিনার মহা ধুমধাম করে বিয়ে দেবেন তিনি। বস্তিতে থাকলেও অর্থনৈতিক অবস্থা তাদের খুব খারাপ ছিল না। করিনার বিয়ের পর তারা পার্ক সার্কাসে একটা বাড়ি করার চিন্তা করেছিলেন। আফরিনার স্বপ্ন ছিল দিদির বিয়েতে বন্ধুদের সঙ্গে খুব আনন্দ করবে। নতুন জিজুর সঙ্গে খুব মজা করবে। দিদির হাত ধরে নতুন জিজুর বাড়িতে যাবে।" কিন্তু সবটাই স্বপ্ন থেকে যায়, বাস্তবে তা পূরণ হয় না।
এদিকে ওই চাষী তার বোনের কাছে খাদিজা বিবি ও আফরিনাকে রেখে আসেন। বোনকে বলেন---"এনাদের সাবধানে আগলে রাখিস। আমাদের দেশের অতিথি। হিন্দুস্তান থেকে ভাইয়ের বাড়ি এসেছিলেন। ভাই আমাদের আবু হোসেন ভাইজান। তারা সকলে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে প্রাণ দিয়েছেন। যে করে হোক এদের হিন্দুস্থানে পাঠাতেই হবে। নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এদের রক্ষা করবি।" বোনের বাড়ি যাওয়া থেকে শুরু করে ফেরার পথ পর্যন্ত আবু শেখ নামে একজন পশ্চিম পাকিস্তানের এদেশীয় গুপ্তচর চাষীকে লুকিয়ে লুকিয়ে নজরে রাখে। আবু শেখ বুঝতে পারে এই চাষী কারোকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। সে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদের কাছে এই খবর পাঠায়। সেনারা খবর পেয়ে প্রথমে ওই চাষীর বাড়ি যায়। তার উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। তার পা দুটো বন্দুকের বাট দিয়ে ভেঙে দেয়। চাষীটি যন্ত্রণায় ছটফট করে। জলের মাছকে ডাঙায় রাখলে তার যেমন অবস্থা হয়, চাষীরও তেমনি হয়েছিল। এরপর আবু শেখকে নিয়ে কয়েকজন সেনা হিন্দু চাষীর বোন ভবানীর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তাদের রাস্তায় দেখে একজন যুবক ভবানীকে তাড়াতাড়ি গিয়ে জানায়। ভবানী আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে খাদিজা ও আফরিনাকে সঙ্গে নিয়ে বর্ডারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তারা বর্ডারের উদ্দেশ্যে যায়। এদিকে আবু শেখ ও সেনারা এসে দেখেন সেখানে কেউ নেই। অনেক খুঁজেও কোথাও কাউকে পাওয়া যায়না। সেনারা তাদেরকে না পেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় আবু শেখ দেখে উনানের আগুন তখনও গনগন করছে। সে বুঝতে পারে এখান থেকে ভবানীরা বেশিক্ষণ পালায়নি। পাকিস্তানের সেনাদের সামনে বিষয়টা তুলে ধরে। এরপর আবু শেখ সেনাদের নিয়ে বর্ডারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ভবানী বর্ডারের নিকট এসে উপস্থিত হন। ভবানী খাদিজা বিবি ও আফরিনাকে বলেন---"আপনারা তাড়াতাড়ি তারকাঁটা পার হয়ে ভারতের মাটিতে প্রবেশ করুন। এখন আশেপাশে কোনো সিকিউরিটি নেই। তাছাড়া পাকিস্তানি সেনারা যেকোনো মুহূর্তে এখানে এসে উপস্থিত হতে পারেন। বিপদ আমাদের পায়ে পায়ে।" ভবানীর কথা শুনে আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে খাদিজা বিবি ছোট মেয়ে আফরিনাকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বর্ডারের নিকট যাত্রা করলেন। যেতে যেতে খাদিজা বিবি ভবানীকে বলেন--- "আপনার কাছে আমরা চিরকাল ঋণী হয়ে রইলাম। কপালে থাকলে আবার দেখা হবে। আপনি ভালো থাকবেন। খুব সাবধানে থাকবেন।"
খাদিজা বিবি মেয়ে আফরিনাকে তারকাঁটা দিয়ে নোম্যান্সল্যান্ডে প্রবেশ করিয়ে নিজে একটা পা তারকাঁটার ভেতরে দিয়েছেন, এমন সময় একটা শব্দ। খাদিজা বিবি চিৎকার করে মাটিতে পড়ে যান। তার চিৎকার শুনে ভবানী পিছনে তাকিয়ে দেখেন, আবু শেখ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন সেনাকে নিয়ে তাদের দিকে আসছে। তাদের মধ্যে একজন সেনা খাদিজাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছুড়েছিলেন। সেই গুলি খাদিজা বিবির পিঠে বিদ্ধ হয়। মাটিতে পড়ে গিয়ে খাদিজা বিবি আফরিনাকে বলেন---"তুই পালিয়ে যা মা। আমার চিন্তা করতে হবে না। বাবাকে বলিস দিদির বিয়ে যেন খুব ধুমধাম করে দেন।" আফরিনা মাকে পড়ে যেতে দেখে কান্না করে ওঠে ও মায়ের দিকে ফিরে আসতে যায়। কিন্তু সেই মুহূর্তে মার কথা শুনে খুব তাড়াতাড়ি দৌড়ে ভারতের সীমানায় প্রবেশ করে। তার দু-চোখে জল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। এদিকে বন্দুকের গুলির শব্দ শুনে ভারতীয় জওয়ানরা কয়েকজন ছুটে আসেন। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদের দেখে বুঝতে পারেন, কোনো ব্যাপার ঘটেছে। আফরিনাকে দেখে তাকে আটক করেন। তারা তার কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে, সে সকল জাওয়ানের সামনে তার মার গুলি লাগার ঘটনাটি জানায়।
এদিকে ভবানী পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের দেখে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান। পাকিস্তানি জাওয়ানরাও বিএসএফদের দেখে বর্ডারের দিকে আর এগোয় না। অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে কিছুক্ষণের মধ্যে খাদিজা বিবি মারা যান। পূর্ব পাকিস্তানের বর্ডারে এই ঘটনা ঘটায় ভারতীয় জাওয়ানরা তৎক্ষণাৎ কিছু করতে পারেন না। আফরিনার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে জাওয়ানরা তাকে তার বাবা ও দিদির কাছে নিয়ে যান। তার কাছে তারা সব শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। করিনার বিয়ে দেওয়ার যে স্বপ্ন মা খাদিজা বিবি দেখেছিলেন তার সেই স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। আফরিনা ও করিনা মাতৃসুখ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়। করিনা কান্না করতে করতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বলে--- "হে আল্লাহ, আপনার এ কি বিচার? আমাদের এত বড় ক্ষতি আপনি করতে পারলেন!! আমাদের স্বপ্ন যিনি পূরণ করত তার স্বপ্নই অপূর্ণ থেকে গেল।" এরপর করিনা সারা জীবনে আর কখনো বিয়ে করার কথা মুখে আনেনি। আফরিনাকে মানুষ করতে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিল সে।
=================
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
পিন-- 743252
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন