বর্ষা কাব্য এবং রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য
সৌম্য ঘোষ
বর্ষাসুন্দরী ঋতুরানী। বর্ষার আবেদনে তাই মহাকবি কালিদাস থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এবং কতশত কবির মন উদ্বেলিত। বর্ষা তাই হয়ে উঠেছে কবিতার ঋতু, কবিদের ঋতু, আবেগের ঋতু। গুরু গুরু মেঘের দামামা বাজাতে-বাজাতে বর্ষা রানী আসেন। অঙ্গশোভায় তার জলদ মেঘের চাদর। বসন্তের যেমন আছে রাগ বসন্ত বাহার, তেমনি বর্ষার আছে মেঘমল্লার। আর আছে বিস্তৃত প্রকৃতির প্রান্তরে ঘনসবুজ শ্যামলিমা।
বর্ষায় কবিগুরুর কল্পনার জগতে হারিয়ে যান। তাঁর কথাতেই বলি --- ভরা পুকুর, আমবাগান, ভিজে কাক ও আষাঢ়ে গল্প মনে করুন। আর যদি গঙ্গার তীর মনে পড়ে, তবে সেই স্রোতের উপর মেঘের ছায়া, জলের উপর জলবিন্দুর নৃত্য, বনের শিয়রে মেঘের উপর মেঘের ঘটা, পিছল ঘাটে ভিজে ঘোমটায় বধূর জল তোলা, ... কিংবা মনে করুন,
বিস্তীর্ণ মাঠে তরঙ্গায়িত তৃণের উপর পা ফেলে ফেলে বৃষ্টিধারা দূর থেকে কেমন ধীরে ধীরে চলে আসছে দ্রুত। ('বর্ষার চিঠি', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে অনুসরণ)।
যেমনভাবে কালিদাসের সাহিত্য 'মেঘদূতম্' কাব্যে বর্ষাসুন্দরীর কাব্যগাথা অপরূপ ধরা পড়েছে। ঠিক তেমনি,রবীন্দ্রনাথের গানে গানে প্রতি ছত্রে ছত্রে ঋতুরাণী বর্ষা ধরা দিয়েছে স্নিগ্ধ শ্যামল সুন্দর রূপ। কালিদাসের 'মেঘদূতম্' কাব্যে যেমন বর্ষার সমস্ত অন্তর্বেদনা নিত্যকালের ভাষায় লেখা হয়েছে তেমনি রবীন্দ্র সাহিত্যে এবং সংগীতেও বর্ষাসুন্দরী এসেছে এক অনির্বচনীয় কবিত্বে।
আমার বালক বয়সে কবিগুরুর এই বর্ষার সঙ্গীতটি শিশুমনে গভীর কল্পনার ছোঁয়া দিয়ে যেত।
আমার মা গাইতেন আর আমি মুগ্ধমনে শুনতাম:
"মন মোর মেঘের সঙ্গী
উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে।
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সংগীতে
রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম..."
বর্ষার আবেদন চতুর্মুখীন। বর্ষার অপরূপ দৃশ্য যেমন আমাদের মনে কুহক জাগায় এর ঠিক উল্টোদিকে বিষাদও এনে দেয়। বর্ষা যেমন নতুন শিহরণে জাগরিত করে, আবার ডুবাতেও পারে তার উদারতায়। বর্ষার এই চতুর্মুখীনতার কারণেই বোধহয় অন্যান্য ঋতুর থেকে এর গ্রহণযোগ্যতা আর গুরুত্ব বেশি। যার মায়াবী রূপ আমাদের মোহিত করে, আন্দোলিত করে, শিহরিত করে। যার দর্শনে আমাদের হৃদয়-মন পুলকিত হয়। বিশেষ করে বর্ষার উথালি-পাথালি ঢেউ আমাদের হৃদয়- মনকে সিক্ত করে। কখনো আমরা হারিয়ে যাই স্বপ্নলোকে, আবার কখনো বা প্রিয়ার দর্শন লাভের জন্য আমরা উদগ্রীব হয়ে উঠি। আবার কখনো বা প্রিয়তমার বিচ্ছেদ ব্যথায় বর্ষার বৃষ্টির মতো চোখের জল ঝরতে থাকে আমাদের কপোল বেয়ে। তখন যেন মনের অজান্তেই আমাদের অবুঝ মন গেয়ে ওঠে-
"এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়-
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায় ॥" রবীন্দ্রনাথ (বর্ষার দিনে)
বর্ষা নিয়ে কালিদাস রচনা করেছেন বিখ্যাত মহাকাব্য (মেঘদূতম্)। মেঘকে সেখানে বন্ধু বলা হয়েছিল। অথচ একজন ফরাসি কবি যাকে আধুনিক কবিতার জনক বলে কেউ কেউ অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন-
"বিরক্ত বর্ষার মাস অবিরল সমস্ত শহর
অফুরন্ত পাত্র থেকে ঢালে তার ঠাণ্ডা অন্ধকার।" -(অনুবাদ) বুদ্ধদেব বসু।
বর্ষাকে নিয়ে লেখা হয়েছে প্রচুর প্রেম ও বিরহের কবিতা। এ জন্যই বর্ষাকে বিরহের কাল বলা হয়। বৈষ্ণব কবিদেরকেও বিরহের সঙ্গে বর্ষার একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে দেখা যায়। পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাজন বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস আর বিহারীলালের কবিতায় বর্ষা এসেছে একাধিকবার। বিদ্যাপতির বিরহের কবিতায় বর্ষা ও বিরহ একাকার হয়ে গেছে, যা নতুনত্ব পায় মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতায়। সেখানে বর্ষা এসেছে রাধিকার প্রেমকে উসকে দেবার জন্য। বিশেষ করে অভিসার আর বিরহ পর্বে এ বর্ষা যেন প্রেমানলে ঘৃতের ছিটা। বৃষ্টির বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে রাধার কণ্ঠে বেজে উঠেছে-
"এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইলো বাটে।
আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে
দেখিয়া পরান ফাটে।" (চণ্ডীদাস)
অন্যত্র রাধা বলেছেন ----
"এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দির মোর।" -(বিদ্যাপতি)
কবিশ্রেষ্ঠ রবি ঠাকুরের সাথে বর্ষার নিবিড় যোগ। তাঁর কবিতায় বর্ষার এতো রকমের বর্ণনা বোধকরি পৃথিবীর আর কোন কবির লেখনীতে স্থান পায়নি। তিনি যখন গেয়ে উঠেন-
"হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচে রে, হৃদয় নাচে রে।
শত বরণের ভাব-উচ্ছ্বাস
কলাপের মতো করেছ বিকাশ
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে।
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচে রে ॥"
রবীন্দ্রনাথের 'মেঘদূত' কবিতায় এসেছে বিদ্যুৎ চমকের কথাও-
"আজি অন্ধকার দিবা, বৃষ্টি ঝরঝর,
দুরন্ত পবন অতি-আক্রমণে তার
অরণ্য উদ্যত বাহু করে হাহাকার।
বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি মেঘবার
খরতর বক্র হাসি শূন্যে বরষিয়া ॥"
বর্ষায় ব্যাঙ ডাকে, ডাহুক ডাকে, বিরহীর হৃদয় ফেটে যায়। শ্যাম বিনে যে আর দিন কাটে না। শ্যামকে নিয়ে বিরহার্তি বর্ষাকালে যেন শ্যামেরই শ্যামল শরীরের আভা। রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে আবাহন করেন এভাবে-
"এসো শ্যামল সুন্দর,
আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা
বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে ॥"
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর কবিতায় বর্ষাকে এনেছেন প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসেবে। বর্ষার প্রকৃতি আর মানব প্রকৃতি এখানে একাকার। যার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন দেবতাগণও। 'বর্ষকাল' কবিতায় তা ফুটে উঠেছে এভাবে-
"গভীর গর্জন সদা করে জলধর,
উথলিল নদ-নদী ধরণী উপর।
রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে,
দানবাদি দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে।" -(বিবিধ কাব্য)
বর্ষা-কেন্দ্রিক গানে নজরুল কালিদাসের মেঘদূতম্ কেন্দ্রিক বিভিন্ন ইমেজ এবং রাধা-কৃষ্ণ কেন্দ্রিক কাজরী ও ঝুলনের আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন।
উত্তর ভারতের কাজুরী ও ঝুলনের ঐতিহ্যকে বাংলায় এনে রাধা-কৃষ্ণকে নতুনরূপে উপস্থাপন করেছেন নজরুল। নজরুলের জনপ্রিয় কাজরী:------
" শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এল না/কাজরীর কাজল মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া/ সেকি ফেরার পথ পেল না মা পেল না। রাধা-কৃষ্ণ আসবেন এ বর্ষায়। তারা দোল খাবেন। তাদের জন্য ঝুলন বাঁধতে হবে। রাধাভাবে ভাবিত সখীরা তাই গাইছেন বাঁধলো বাঁধলো ঝুলনিয়া।/নামিল মেঘলা মোর বাদিরয়া/ চল তমাল তলে গাহি কাজরিয়া/ চললো গৌরী শ্যামলিয়া।"
ঐশ্বর্যের ঋতু, অকৃপণ ঋতু, সমৃদ্ধির ঋতু বর্ষা। আমাদের মোহিত না করে পারে না। তাই সিক্ত হৃদয় উদ্বেলিত হয়, বর্ষা ঝরে কবির কলমে। অবিরাম, অবিরাম সে ধারা।
'গীতবিতানে' গুরুদেবের ১১৫টি বর্ষা সংগীত আছে। বর্ষায় বর্ষা-সঙ্গীত ছাড়া বাঙালির হৃদয় যেন "কালিদাসের মেঘ বিহীন মেঘদূত কাব্য"। বর্ষা এলেই বাঙালির মন গুনগুনিয়ে ওঠে,
"পাগল হাওয়ার বাদল দিনে,
পাগল আমার মন....."
প্রেয়সী ছাড়া জলদ মেঘ যেন অসম্পূর্ণ।
প্রেয়সীর কাজল কালো সজল চোখের সঙ্গে তুলনা:
"হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে সেই
সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে।"
কিংবা,
"শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথ
যামিনী রে কুঞ্জপথে, সখি, কৈসি
যাওব অবলা কামিনী রে।"
বর্ষাকে কবি আহ্বান করেছেন এইভাবে,
"এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে
এসো করো স্নান নবধারা জলে...."
আবার ঝড়ের রাতে ব্যঞ্জনাময় উপস্থাপন----
"আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরাণ সখা বন্ধু হে আমার......"
বর্ষার সঙ্গে ময়ূরের নাচের সমন্বয় অবধারিত ভাবে চলে আসে মনে। বর্ষাকে শুধু মানুষ নয় সমগ্র প্রকৃতি প্রেমে মনে ভালোবাসায় আপন করে নেয়।
সমগ্র প্রাণীকুলের বর্ষা কামনার রূপ ধরে পুলকিত মনে প্রেম সঞ্চার করে। তাই কবির কলমে ----
"হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচে রে
শত বরণের ভাব উচ্ছ্বাস
কলাপের মত করেছে বিকাশ,
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া
উল্লাসে কারে চাহিয়া......"
শ্রাবণ রাতে ভরা বর্ষায় মন সঙ্গী খোঁজে।
মিলনের বৃথা প্রত্যাশায় ভরা বর্ষার এই মায়াবী সন্ধ্যায় বা নির্জন রাতে কেবলই পথ চাওয়ার ব্যাকুলতা। ব্যথিত হৃদয় বৃষ্টির মর্মর ছন্দে ভাষা খুঁজে বেড়ায় -----
" আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে,
জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগে না..."
=========================
লেখক --- অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ।
চুঁচুড়া।
_______________________________
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন