কর্কট-ক্রান্তি
সুশান্ত পাত্র
বর্ষাকাল বিশেষ পছন্দের নয় গোকুলের। এই সময়টাতে তাকে অনেকগুলো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। যখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ধারা নেমে আসে, তার ঘরের খড়ের চাল ভেদ করে ঝরঝর করে জল পড়তে থাকে। উঠোন জুড়ে খেলা করে সোনা ব্যাঙ, বিছে, ইঁদুর, কেন্নোরা। নদীর জলে ভাঁটা প্রায় নামতেই চায় না, ফলে উপার্জন বন্ধ হয়ে আসে। পেটে টান ধরে। কাজকর্ম থাকে না। সেঁতিয়ে ওঠা মাটির দাওয়ায় বসে তখন সে কেবল তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।
দুদিন অবিরাম বৃষ্টির পর আজ একটু ধরণ দিয়েছে দেখে সকালবেলাতেই পান্তা খেয়ে কাজে বেরোচ্ছিল গোকুল। দুদিন বসে বসে কাটল। আজ না বেরোলে সংসারের চাকা ঘুরবে না। বারান্দার বেড়ার গায়ে ঝোলানো থাকে একটা লোহার শিক, তার পাশেই নাইলনের ব্যাগ। জিনিস দুটো নিয়ে বেরোবার মুখে যমুনা ডাকল।
— কিছু তো বললে না। কি ভাবলে?
গোকুল আকাশ দেখছিল মুখ উঁচু করে। আবার ঢালবে কিনা তাই বোঝার চেষ্টা করছিল। যমুনার কথা কানে গেলেও মনে গেল না।
সে আলগোছে বলল, কিসের কি ভাবব?
যমুনা খানিকটা হতাশ হয়ে বলল, কালই তো বললাম। দুলির ব্যাপারে কি করবে?
গোকুলের মনে পড়ে গেল। দুলি মানে দোলন, তার বড়ো মেয়ে। তার এখন সাতমাস চলছে। সাধ দিতে হবে।
সে একটু অসহিষ্ণু ভাবে বলল, অত ব্যস্ত হোস কেন? আরও কদিন যাক।
যমুনা গোকুলের কথা শুনে গালে হাত দিল। বলল, আর দেরি করা যায়? সাতমাস চলছে। এরপর লোকে কি বলবে?
গোকুল বলল, এই বৃষ্টির মধ্যে আনবি কি করে? একটু বৃষ্টি হলেই ঘর ভাসছে।
যমুনা বলল, তা সে নাহয় না আনলাম। ওদের ওখানে গিয়ে না হয় সাধ দিয়ে আসব।
গোকুল একটু থতিয়ে গেল। বলল, হবেখন, সবে তো সাতমাস।
যমুনা এবার উষ্মা প্রকাশ করল, সমাজের কিছু নিয়ম আছে তো, নাকি? এরপর হুট করে যদি ডাক্তারে সীজারের দিন দিয়ে ফেলে? আজকাল তো শুনি আট মাসে, ন মাসে হরদম সীজার হয়ে যাচ্ছে। তখন লোকের কাছে মুখ দেখানো যাবে? পুরুষ মানুষ এমন বেয়াক্কেলে হলে সংসার চলে?
গোকুল চিন্তায় পড়ে গেল। বলল, দেখি ওবেলা মধুদারে বলে কিছু আগাম যদি পাওয়া যায়।
লোহার শিক আর নাইলনের ব্যাগ নিয়ে গোকুল হনহন করে নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করল। নদীতে এখন ভাঁটা। জোয়ার বাড়লে গর্তগুলো জলে ডুবে যাবে। তখন আর কাঁকড়া ধরা যাবে না। গোকুলের জীবিকা হল কাঁকড়া ধরা। হাঁটু ঝুলের হাফ প্যান্ট পরে, গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি চাপিয়ে সে লোহার শিক হাতে নদীর ঢালে ঢালে ঘুরে বেড়ায়। নদীর তীর বরাবর বুনো গাছের ঝোপ। ক্যাওড়া, করঞ্জ, গামা, বাইন গাছের সারি নদীর ঢালে ঢালে গজিয়ে উঠেছে। জোয়ারের জলে এদের অর্ধেক ডুবে যায়, আবার ভাঁটায় জেগে ওঠে। এদের গোড়ায় গর্ত করে বাস করে কাঁকড়া। গোকুল এইসব গর্তে লোহার শিক ঢুকিয়ে দেয়। লোহার শিকের মাথাটা ইউর মতো বাঁকানো। ঐ খাঁজে আটকে গর্তের বাইরে টেনে বের করে আনে কাঁকড়া। জয়গোপালপুরের মধুদা মানে মধুসূদনের আড়তে বিক্রি করে দেয়।
গোড়ালী ডোবানো কাদামাটি ভেঙে নদীর ঢালে কাঁকড়ার গর্ত খুঁজতে খুঁজতে গোকুল নিজের কথা ভাবছিল। কাঁকড়ার মতোই ভাগ্য তাকে যেন দশটা দাঁড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। বাস্তুটুকু ছাড়া জমি নেই তার, যদি থাকত চাষ করত। ঘরের চাল ফুঁড়ে জল পড়ে। সারাবার ক্ষমতা নেই। একটা পুকুর যদি থাকত মাছ চাষ করত। শিক্ষা নেই, তাই ভদ্র সভ্য কোন কাজ জোটে না। দুই মেয়ে। বড়ো মেয়ে দুলির বিয়ে দিল আতাপুর। জামাই মেয়ে নিয়ে চলে গেছে ক্যানিং। ওখানেই বাসা ভাড়া করে থাকে। রাজমিস্ত্রির কাজ করে। ছোট মেয়ে ফুলি নাইনে পড়ে। জোয়ারের নদীর মতো ফুলে ফেঁপে উঠছে। দু'চার বছরে তার বিয়ের কথা ভাবতে হবে। ছেলে নেই গোকুলের। যদি থাকত, বল-ভরসা হতো হয়তো। সমস্যাগুলো গোকুলকে ঘিরে কাঁকড়ার মতোই দশ পায়ে কিলবিল করে। গোকুল সমাধানের পথ পায়না। তাই বেশি ভাবেনা সে। নদীর ঢালে নেমে কাঁকড়া ধরতে শুরু করে। গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কাঁকড়াগুলোকে লোহার শিক দিয়ে টেনে টেনে বের করে আনে। গর্তের বাইরে বেরিয়ে কাঁকড়াগুলো মোটা দাঁড়া দুটো উঁচু করে জলের দিকে দৌড় লাগায়। গোকুল তাদের পিঠ চেপে ধরে শিক দিয়ে। কাঁকড়ার পিঠ চেপে ধরলে তারা অসহায়। কিছুই করতে পারেনা। তখন সে সবাধানে মোটা দাঁড়া দুটো ধরে ব্যাগে ঢোকায়। এরাই তার বেঁচে থাকার পারানি। কাঁকড়াগুলো ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, বেঁচে থাক, বেঁচে থাক। মরা কাঁকড়ার কোন দাম নেই। বিক্রি হয় না। তাই সে বলে, বেঁচে থাক, তোরা বেঁচে থাক।
বেঁচে থাকার জন্যই গোকুল বালি নদীর পলি-কাদা ভাঙতে থাকে। এই নদীই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। আজ বেশিরভাগ গর্তই খালি। বর্ষার জল পেয়ে সব নদীতে নেমে গেছে। তবুও দুটো তিনটে কাঁকড়া টেনে বের করে ফেলল। সাইজ খুব ভালো নয়। টেনেটুনে বি গ্রেডে ঢোকানো যাবে। দুলির সাধ দিতে হবে। এই প্রথম সে দাদু হবে। তেমন কোন আনন্দ হচ্ছে না ভাবতেও। শুধু মনে হচ্ছে এককাঁড়ি টাকা দরকার এখুনি।
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এসে পড়েছে গোকুল। এদিকটায় গ্রাম নেই। মাঠ। মাঠ ডিঙিয়ে গেলে পড়বে ধুচনে খালি। বড়ো বড়ো ক্যাওড়া গাছে ঢাকা নদীর বাঁধ। জোয়ার ফিরে গেছে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলছে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ। দেখতে দেখতে নদীর গর্ভ পূর্ণ হয়ে উঠবে। গোকুলের ব্যাগ প্রায় খালি।
কোমরে হাত দিয়ে একটু জিরিয়ে নিল গোকুল। কাদামাটির হাবড় ঢেলে এগোনো সহজ নয়। পায়ের আঙুল চেপে রাখতে হয় মাটিতে। অনেকক্ষণ হাঁটলে ব্যথা করে আঙুলগুলো। হাফ প্যান্টের পকেট থেকে বিড়ি বের করে একটা ধরাল গোকুল। জোরে টান দিয়ে দিয়ে ফু করে ধোঁয়া ছাড়ল। টাকা দরকার। অনেকগুলো টাকা।
যমুনাকে বলেছে বিকালে মধুদার থেকে ধার করে এনে দেব। গোকুল জানে ওটা শুধু কথার কথা। মধুসূদন টাকা ধার দেবার পাত্র নয়। একেবারে মক্ষিচুষ একটা। যখন কাঁকড়া মাপা হয় শকুনের মতো তাকিয়ে থাকে। একটু এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই। এ গ্রেডের মালগুলো বি গ্রেডে ফেলে দেওয়ার ধান্ধা শুধু। মধুসূদন তাকে টাকা ধার দেবে না। আরও কয়েকটা বড়ো বড়ো টান দিয়ে বিড়ি ছুঁড়ে ফেলে দিল গোকুল।
তখনই সে গর্তটা দেখতে পেল। ক্যাওড়া গাছের গোড়ায়, ডালপাতার আড়ালে। ছোট ছোট ডালগুলো ভেঙে গর্তের মুখটা পরিষ্কার করে নিল সে। কোমর নিচু করে আস্তে আস্তে লোহার শিকটা ঢুকিয়ে দিল গোকুল। একটা পরিচিত ট্রাং আওয়াজ উঠে এল শিক বেয়ে। আছে। শিকে টান লেগেছে। সে টানতে লাগল। লোহার শিক বেরিয়ে আসছে একটু একটু করে। বেশ ভারি। বড়ো মাল। গোকুল খুশি হয়। একটা সাইজের কাঁকড়ার দাম ভালো। আরও যদি ঘিলু ভরা হয়।
টানতে থাকে গোকুল। কাঁকড়া এগোচ্ছে একটু একটু করে। মাটি কামড়ে পড়ে আছে ব্যাটা। গর্তের মধ্যে কাঁকড়া জোর ধরে খুব। কিন্তু সেও গোকুল। আজ বিশ বছর কাঁকড়া ধরে খায়। সুড়সুড় করে টেনে টেনে বের করতে থাকে সে। আর একটু বাকি। গোকুল শিক টানছে। আটকে গেল। গোকুল টানল আবার, আসছে না। প্রচন্ড জোর লাগিয়ে কাঁকড়া আটকে রয়েছে। যতই টানছে কাঁকড়া নড়ছেই না।
—- ধুত্তোর। শিক চেপে গর্তের মুখে উঁকি দিল গোকুল। একটা শ্যাওলা মাখা পিঠ চোখে পড়ল।
উরি শালা! একি সাইজ রে! কুড়ি বছরে এতবড়ো কাঁকড়া সে চোখে দেখেনি। এতো রাজকাঁকড়া রে! গোকুল অনেক চেষ্টা করে আরও কয়েক ইঞ্চি এগিয়ে আনতে পারল। দাঁতে দাঁত চেপে সে টানছে। ঘেমে গেছে গোকুল। তবুও বেরোচ্ছে না। জোয়ারের জল উঠে আসছে।
— নাহ্, হাত লাগাতে হবে। হেব্বি জেদি।
নিজেকে নিজেই বলল কথাগুলো। বাম হাতে শিক ধরে গর্তের ভিতরে কাঁকড়ার পিঠ চেপে ধরল। তারপর সাবধানে ডান হাত ঢোকাল গর্তের মুখে। কনুই অব্দি ঢুকিয়ে সে চেপে ধরল কাঁকড়ার পিঠ। হাত দিয়েই বুঝল, সে যত বড়ো ভেবেছিল, তার থেকেও অনেক বড়ো কাঁকড়া। এটা বেচেই দুলির সাধের শাড়ি হয়ে যাবে। পিঠ চেপে টানতে গিয়ে বুঝতে পারল গর্তের মুখের থেকে কাঁকড়া বড়ো। তাই বেরোচ্ছে না।
— ব্যাটাকে লম্বা করে বের করতে হবে। কাঁকড়াটাকে সে গর্তের মধ্যে লম্বা করে ঘোরাতে চাইল। তখনি বিপত্তি ঘটে গেল। ডান হাত দিয়ে ঘোরাতে গিয়ে লোহার শিকের চাপ ঢিলে হয়ে গেল। যেই পিঠের চাপ কমল অমনি দাঁড়া উঁচিয়ে গোকুলের কব্জি কামড়ে ধরল কাঁকড়া।
উফ্! গোকুল হাত ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইল, পারল না। সজোরে কামড়ে ধরেছে কাঁকড়া। গর্তের বাইরে হাত টেনে বের করতে চাইল গোকুল। পারল না। তখনই বুঝতে পারল, গর্তের নীচের থেকে আড়াআড়ি চলে গেছে গাছের একটা মোটা শিকড়। গর্তের মধ্যে এই কাঁকড়া নিজেই বন্দি হয়ে আছে। হয়তো বহুকাল নিজেই আটকে আছে নিজের গর্তের মধ্যে। গোকুল আবার টানল। অপরিসর স্থানের মধ্যে সে না পারছে হাত বের করতে, না পারছে কাঁকড়াকে ছাড়াতে। যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে চিৎকার করে উঠল গোকুল। হাত বেয়ে গরম তরল স্পর্শ টের পেল এবার। হাত কেটে রক্ত ঝরছে। হাত মুচড়ে, ঘুরিয়ে কাঁকড়ার দাঁড়া ভেঙে ফেলার চেষ্টা করল সে। কিছুই হল না। দানবাকৃতির কাঁকড়া যেন মরণ কামড় দিয়ে ধরে আছে।
সেই নির্জন নদীর ঢালে এক অমানুষিক লড়াই শুরু হল। গোকুল আপ্রাণ চেষ্টা করেও হাত ছাড়াতে পারছে না। গর্তের মুখ লাল হয়ে উঠল তার রক্তের ধারায়। কাদা মাটির উপরে হাঁটু ভেঙে অর্ধেক উপুড় হয়ে পড়েছে গোকুল। বাম হাত দিয়ে মাটি ঠেলছে সে। অনেক রক্তক্ষরণের ফলে তার শরীর ক্রমে নিস্তেজ হয়ে আসছে। গলগল করে ঘাম হচ্ছে। চিৎকার করতে করতে গলা শুকিয়ে গেছে। মাথা ঝিমঝিমিয়ে উঠছে।
হঠাৎ পায়ে ছলাৎ করে জলের স্পর্শ পেল গোকুল। চমকে মুখ ফিরিয়ে দেখল জোয়ারের জল বাড়তে বাড়তে তার পা ছুঁয়ে ফেলেছে। বর্ষায় জোয়ার ফেরে দ্রুত। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জলে ডুবে যাবে সে। অসহ্য যন্ত্রণার প্রবাহ বইছে শরীর জুড়ে। ফিকে হয়ে আসছে চোখের দৃষ্টি। তবুও শরীরের সমস্ত জোর একত্রিত করে হাত টানতে শুরু করল গোকুল। জোয়ারের জল বেড়েই চলল নদীতে।
==============
সুশান্ত পাত্র
চিত্তরঞ্জন সরণী,
হৃদয়পুর,
বারাসাত,
কলকাতা – ৭০০১২৭
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন