বই - 'দ্য হ্যাণ্ডমেইড'স টেল'
লেখিকা - মারগারেট অ্যাটউড
দুরাশায় বাঁচে মন — একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে
---পারিজাত
কখনও ভেবে দেখেছেন, 'সত্য' কথাটির অর্থ কি? অনেক সময় অনেক গল্পের
শুরুতেই দেখা যায় উল্লেখ করা হয়েছে - 'সত্য ঘটনা অবলম্বনে'। আমার
প্রশ্নও হাঁটা পথ দুরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু ওখানেই - আদৌ কি কোনো গল্প
কোনোদিন সত্য ব্যতিরেকে লেখা সম্ভব? প্রতিদিনকার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা,
অঘটন - এসব থেকেই তো জন্ম নেয় গল্প - যার পাতায় পাতায় সত্য কথা বলে
চলে নিরন্তর: কেবলমাত্র এক অবিচ্ছেদ্য যবনিকার আড়াল সামনে ধরে।
তবু 'গ' 'ল' আর 'প' এর যোগফলকে ঠিক আবার সত্যি বলে মেনে নিতেও দ্বিধার
সৃষ্টি হয় - তবে যে গল্প প্রবন্ধের সীমাবদ্ধতায় আটক হয়ে যায়। লেখকের
কল্পনা, ভাবনা, বোধ, বিচার নিরিখে একই ঘটনা অনেকের হাতে অনেকরকম করে ধরা
দিতে পারে। সেখানে সবই সত্য হয়তো, তবু তারাই অবার খানিকটা রটনা, গুজব বা
খামখেয়ালিপনা ব্যতীত কিছুই নয়।
এতকথা কেন আসছে কোনো বইয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে তার কারণ অবশ্যই বলব, তবে আগে
কিছুটা গল্পের মূল চরিত্রের সঙ্গে পরিচয়টা সেরে ফেলা যাক। একসাথে কিছুটা
পথ চললে তখন না হয় দৃকপাত করা যাবে প্রকৃত সত্য বা কল্পনার চরিত্রায়নে!
'দ্য হ্যাণ্ডমেইড'স টেল' — এর যথার্থ বাংলা করা প্রকৃতপক্ষে আমার সীমিত
পরিসরের জ্ঞানের সামর্থ্যের অনেক বাইরে। এটি এক নারীর আত্মকথন যাকে
বাকিরা 'অফ্রেড' বলে সম্বোধন করে। 'অফ ফ্রেড' — অর্থাৎ 'ফ্রেড' নামের
কোনো কর্তাব্যক্তির বংশরক্ষার কাজে নিয়োজিত দাসী এই ভদ্রমহিলা - তা থেকেই
উঠে আসে তাঁর একমাত্র খাতায় কলমে তুলে ধরা আইনি পরিচয়। এ নামের আবর্তের
বাইরে কথিকার প্রকৃত পরিচয় গোপন থেকে যায় আগাগোড়াই।
ইতিমধ্যে বাইবেলের আদর্শে সমাজ সংস্কার করার দাবি জানানো একদল কট্টর সেনা
গিলিয়াড সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছে সমস্ত আমেরিকা জুড়ে। মেয়েদের
সমস্তরকম অধিকার যেমন চাকরি করা, পড়াশোনা করা, পুরুষদের সঙ্গে
মেলামেশা,পছন্দসই পোষাক পরা, মাাদকদ্রব্য গ্রহণ করা ইত্যাদি থেকে খারিজ
করে তাদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছে শুধু বিভিন্ন শ্রেণীতে। তাদের সকলকেই
আপাদমস্তক ঢাকা আলখাল্লায় মুড়ে ফেলতে হয়েছে নিজেদের ধর্মযাজকদের
নির্দিষ্ট কড়া নিয়মাবলী পালনের প্রথম পাঠের স্মরণে। এক একটি রঙ এক একটি
শ্রেণীর পরিচয় প্রদান করে। নীল, অর্থাৎ সেনাধ্যক্ষের স্ত্রী, সাদা অর্থাৎ
তাদের বা উচ্চ বংশজাত মেয়ে, সবুজ অর্থাৎ বাড়ির চাকরবাকর, ডুরে অর্থাৎ
নিচু জাতের রমণী এবং রক্তের মতো লাল অর্থাৎ হ্যাণ্ডমেইড, যার বাংলা
প্রতিশব্দ খুঁজে বের করা আগেই বলেছি, আমার সাধ্যের বাইরে।
বছর তেত্রিশের এই রমণী খুব এলোমেলো অগোছালো ভাবে ঠিক যেন মাঝখান থেকে
শুরু করে তার বিদ্ধস্ত বিবরণী। যেখানে এক বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল বিল্ডিংয়ে
বয়স্কা কিছু মহিলার তালিমে এক এক করে সমস্ত জাগতিক আশা ভরসা ত্যাগ করে
তারই মতো আরো অনেক মেয়ে অন্যের সন্তান প্রসবের জন্য নিজেদের শরীর এবং
মনকে কঠিন ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলছে। যেখানে কোনো ধর্ষিতা রমণী নিজেরই
'স্বেচ্ছাচার' এবং 'অনিয়ম'কে দায়ী করে শাস্তি দেয় নিজেকে। কেউ আবার
যেকোনো উপায় চাইছে সুস্থ সন্তান জন্ম দিয়ে 'কলোনি'র ভয়াল রেডিও অ্যাক্টিভ
বর্জপদার্থ পরিষ্কারের দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে, কেউ পালিয়ে গিয়ে
নিজেকে প্রতি রাতে বিক্রি করে হলেও পতিতালয়ের সামান্য খোলামেলা পরিসরকেই
স্বর্গ বলে বিশ্বাস করছে, আবার কেউ বা সব ঠিক ভূল পাপ পুণ্যের হিসাবনিকাশ
গুলিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।
আমাদের কথিকা মাঝেমাঝে এসব ফেলে পুরোনো পূর্ব গিলিয়াড সময়ে যেতে সমর্থ
হয়েছে স্মৃতির ভয়াবহতাটুকুকে সম্বল করে। সেখানে তার সুখের সংসার রয়েছে,
স্বামী, মেয়ে রয়েছে, বৃদ্ধা তবু স্বাধীন ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী মা রয়েছে,
আর রয়েছে তার নিজস্ব যথাযথ শিক্ষা এবং অর্থ উপার্জনের ক্ষমতা। অনেকটা
আজকালকার সমাজের আমাদের চেনা দৃশ্যপট, তাই না? যেমনভাবে আমরা ছোট ছোট
সুখগুলোতে বাঁচি, এ যেন তারই চেনা প্রতিরূপ।
হঠাৎ একদিন সেখানেই স্বপ্নভঙ্গ হয়। ঘুম থেকে উঠে আশপাশে চোখ বোলাতেই মনে
পড়ে, সব 'সত্যি' তো আজ 'মিথ্যা' হয়ে গেছে। অন্য একদল অজানা সমাজ
সংস্কারক সেনাবাহিনী ঢুকে পড়ে আমেরিকার রাজপথে, শুরু হয় ধর্মের নামে
মিথ্যা জোরজুলুম, অত্যাচার, ধরপাকড়। সব মেয়েদের চাকরি চলে যায় বা ব্যবসায়
তালা ঝুলে পড়ে রাতারাতি, ডিভোর্সিকে বিয়ে করার 'অপরাধ'এ স্বামী মেয়েকে
সরিয়ে দিয়ে তুলে এনে জোর করে হ্যাণ্ডমেইড বানানোর প্রশিক্ষণকেন্দ্রে
পাঠানো হয় নামহীন সেই কথিকাকে।
বিভিন্ন রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার ফলে সেনানায়কদের অনেকেরই সন্তানধারণের
ক্ষমতা লোপ পেয়েছে ততদিনে। তবে যেহেতু ধর্মের দোহাই দিয়ে ধরে নেওয়া হয়েছে
পুরুষেরা নপুংসক হতে পারে না, তাই প্রতিটি সেনাধ্যক্ষের বাড়িতে তার
'বন্ধ্যা' স্ত্রীর পরিবর্তে পাঠানো হয়েছে সন্তান উৎপাদক এই লাল আলখাল্লা
পরিহিতা রমণীদের। নির্ধারিত দু বছর সময়ের মধ্যে সন্তান জন্ম দিতে না
পারলে আরও দু জায়গায় তাকে সুযোগ দেওয়া হয়, যার শেষে অবশ্য তাদের পাঠিয়ে
দেওয়া হয় কলোনীর বিষময় বীভৎসতার মাঝে মৃত্যু উপত্যকায়।
কোনোরকম যৌন উদ্দীপনার ফসল এক্ষেত্রে হতে পারেনা তাদের সন্তানেরা।
হ্যাণ্ডমেইডের জরায়ু সমেত শরীরটুকুকে কেবল ব্যবহার করা হবে, এমনটাই থাকে
লিখিত দস্তুর। তারা তাই প্রকৃতপক্ষে রক্ষিতা নয়, বলা যেতে পারে একটা ধারক
বা পাত্র মাত্র যেখানে বীজ রোপণ করা হয় নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়েই।
'সেরিমনি' বা 'অনুষ্ঠান' এর দিন নীলবসনা বৈধ স্ত্রীর পেটে মাথা রেখে শুয়ে
থাকা লালবসনা তরুণীর সাথে নিছকই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন সেনাধ্যক্ষ
— সেখানে মন বা শরীরী আবেদনের প্রবেশ ভীষণভাবে নিষিদ্ধ। এর অন্যথা হলে
সকলের সামনে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে রমণীটির, তাকে
নিছক সেনানায়কের ব্যতিক্রমী কাম চরিতার্থে আজ্ঞাবহন করতে হয়ে থাকলেও।
সবই জানা আমাদের কথিকার, তবু তার ভাগ্যগত হেরফের হতেই থাকে প্রতিনিয়ত।
কোনটা তার দেখা প্রকৃত সত্যি, কোনটা তার ভাবনা, কোনটা তার নিছক আশা,
প্রত্যয়, কোনটা কেবলই প্রলাপ — সবসময় তা বুঝে ওঠা যায়না। এক রোজকার জীবনে
যখন হঠাৎ করেই ভয়ঙ্কর ছন্দপতন ঘটে, তখন ছোট ছোট আপাত সাধারণ জিনিস যেমন
বাগানে হলুদ ড্যাণ্ডেলিয়ন ফোটা, নিত্য নতুন শব্দ মনে করে 'স্ক্র্যাবল'
খেলা, আলমারির গায়ে লিখে যাওয়া আগের পরিচারিকার আঁচড়েও প্রাণ খোঁজা,
ডিমের হলুদ কুসুমে জীবনদর্শন করা, সাধারণ পুরোনো মেয়েলি ম্যাগাজিন হাতে
ঘেঁটে উদ্দীপ্ত হওয়া — এসবই যেন কিছুতেই মরতে দেয়না শেষ হয়ে যাওয়া
জিয়নকাঠিকে। দুরাশায় বাঁচে মন — একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
"একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে।" (সংগৃহীত)
সব কি ঠিক হয়েছিল, জানা নেই। যেমন মাঝখান থেকে শুরু হয়েছিল জীবনী, তেমনই
মাঝবরাবর থেমেও গেছে কথা। শেষমেশ কি হয়েছিল মেয়েটির, সেকি পালাতে পেরেছিল
অন্য দেশে, জন্ম দিতে পেরেছিল 'অবৈধ' কিন্তু তার ভালোবাসার নতুন কোনো
ফসলকে? নাকি কলোনী বা পতিতালয়ের আঁধারে বসেই ক্যাসেটে লিপিবদ্ধ করেছিল সে
তার বিক্ষিপ্ত ঘটনাবলী? নাকি এসবই কল্পনাপ্রসূত, গল্প — যার উপর সত্যির
লেশমাত্র পড়েনি কোথাও, কখনও?
স্রষ্টা মারগারেট অ্যাটউড এ বিষয়ে কোনো আলোকপাত করেন না আর শেষে গিয়ে।
যদিও ভবিষ্যতের একটুকরো সুন্দর ছবি আবার এঁকে দেন তিনি যা সত্যিই পাঠকের
মনেও তখন প্রবল ভাবে কাঙ্ক্ষিত। আসলে, স্বপ্ন দেখতে আমরা কে না ভালোবাসি
বলুন তো? সত্যি যখন আঁধারের ঘেরাটোপে হারিয়ে যায়, এই গল্পই তো আবার
জীবন্ত করে তোলে তাকে। আবার গল্প যেখানে ইতি টেনে দেয় কাব্যগাথাকে অলীক
বলে, সত্য সেখানে আবডালে দাঁড়িয়ে চোখ মোছে বইকি! আজ যা মিথ্যা, বানানো,
কাল কি আদৌ তা সত্যি হয়ে যেতে পারেনা? আর অমন দূর্দিনে এমনতর 'সত্যিকারের
গল্প'ও কি আর খুব অপ্রাসঙ্গিক থাকবে? মনে হয় না। ঠিক পথেই চলছি তো আমরা?
কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে না তো? আধুনিক সভ্যতার অভ্যন্তরে এখনও কোথাও লুকিয়ে
নেই তো ধর্মান্ধতার শক্ত বাঁধন যা আসলে ক্রমশঃ পিছিয়ে নিয়ে চলেছে আমাদের
- অথচ আমরা নেশাগ্রস্তের মতো কিছু টেরই পাচ্ছি না?
কে জানে আর ক পা হাঁটা বাকি আজকের সমাজের এমন নামহীনের দলে নাম লেখানোর
আগে? কে জানে, এই জীবনচক্র আদতে কতটা সত্যি কতটা গল্প? আসলে সবটাই তো
আমাদের উপর - আমরা কতখানি উপলব্ধি করতে পারছি আজকের সমগ্র সমাজের নিরন্তর
বয়ে চলার গাথা। বুঝতে পারছি, নারী পুরুষ বা ঈশ্বরবাদ সব নয়, আগে বড়
বেশি করে এমন অসময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের মানুষ হওয়া প্রয়োজন।
আলোচনায় - পারিজাত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন