বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা # হেমচন্দ্র কানুনগো
আলোচক: নির্মলেন্দু কুণ্ডু
কোন দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে জানার জন্য কয়েকটি গ্রন্থ আকর
হিসেবে কাজ করে৷সেই গ্রন্থ যখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে,তখন তার গুরুত্ব আরো
বেড়ে যায়৷সেরকমই একটি গ্রন্থ হল হেমচন্দ্র কানুনগোকৃত 'বাংলার বিপ্লব
প্রচেষ্টা'৷এই গ্রন্থটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত
হয়েছিল ১৯২৮ নাগাদ৷তারপর এটি নবরূপে প্রকাশ করে চিরায়ত প্রকাশনী৷
গ্রন্থটির মূল উপজীব্য হল স্বদেশী আন্দোলন ও তৎপরবর্তী কালে বাংলায়
গড়ে ওঠা বিপ্লবী আন্দোলন৷গ্রন্থকার স্বয়ং বিপ্লবী দলভুক্ত ছিলেন৷কাজেই
একনজরে দেখলে এটাকে বিপ্লববাদের কীর্তিজ্ঞাপক গ্রন্থ বলে মনে হতে
পারে৷তবে বইটি পড়তে পড়তে চমকে উঠতে হয়৷আত্মসমালোচনা বলতে যা বোঝায় এই
গ্রন্থটি প্রকৃতপক্ষে তাই৷
গ্রন্থকার তাঁর নির্মোহ ও বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে নিজ দল
যুগান্তর তথা তৎকালীন গুপ্ত সমিতির অসার কার্যপ্রণালী ও সংশ্লিষ্ট
নেতাদের দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন৷কিছু সাংকেতিক নাম,যেমন-ক
বাবু,গ বাবু (প্রবন্ধগুলি লেখার সময় উক্ত নেতারা জীবিত ছিলেন বলে তাঁদের
জনসমক্ষে হেয় না করা ও ব্রিটিশদের কাছে পরিচয় গোপনের উদ্দেশ্যে এরূপ
নামকরণ হয়েছিল) বা বারীণের মতো (যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা তথা ঋষি
অরবিন্দের ভাই বারীন্দ্রনাথ) নেতাদের কল্পনাপ্রবণতা,অতিরিক্ত
আধ্যাত্মিকতা,বাগাড়ম্বর ও আত্মসর্বস্বতাকে ঘোরতর আক্রমণ করা হয়েছে এই
গ্রন্থে৷তাঁদের অপরিণামদর্শিতার কারণেই যে সহজেই মুরারীপুকুর ও সংলগ্ন
এলাকা থেকে অতি সহজে পুলিশ বোমার কারখানা ও গুপ্ত সমিতির নেতাদের বামাল
গ্রেপ্তার করতে পেরেছিল,তা এখানে পরিষ্কার হয়েছে৷বিপ্লবী বন্দীদের অহেতুক
বীরের মর্যাদা দেওয়ার বদলে তাঁরাও যে রক্তমাংসের মানুষ,তা বোঝানো
হয়েছে৷ঘরশত্রু বিভীষণের মতো এসব তথাকথিত দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কিছু
বিপ্লবী যে 'চাচা আপন প্রাণ বাঁচা' নীতি অবলম্বন করে ব্রিটিশ পুলিশের খবর
প্রদানকারী হয়ে গিয়েছিলেন,সেই লজ্জাকর ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয় এই
গ্রন্থ৷আবার ক্ষুদিরাম,সুশীল সেন,সত্যেনের কিছু নির্ভীক মানুষেরও সন্ধান
পাই,যাঁদের কাছে স্বদেশসেবার ন্যূনতম মাহাত্ম্যও ছিল৷ধর্ম বিশেষত
হিন্দুয়ানি যে কীভাবে সে সময়কার বিপ্লববাদকে প্রভাবিত করেছিল,তারও প্রমাণ
পাওয়া যায় যখন দেখি বিপ্লবী দলে অস্ত্রশিক্ষার থেকেও অধ্যাত্মবাদ বেশী
গুরুত্ব পাচ্ছে৷সমকালে ব্রিটেন ও ফ্রান্সে কীভাবে গুপ্ত সমিতি পরিচালিত
হত এবং ধরা পড়া বিপ্লবীদের ব্রিটিশ সরকার কী অসহনীয় অবস্থার মধ্যে রেখে
বিচারের নামে প্রহসন করে শাস্তি দিত—তারও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ গ্রন্থটিতে
আলোচিত হয়েছে৷
তবে গ্রন্থকার কিছু জায়গায় দার্শনিকতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন,যা
বর্ণনাবহুল৷ভাষার ওপর তাঁর দখলদারী ঈর্ষণীয়,তবে চলতি ভাষায় কথার এত
'জাগলারি' অনেক সময় সাধারণ পাঠককে একটু অসুবিধায় ফেলবে৷
এতদসত্ত্বেও তৎকালীন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষ্য হিসেবে গ্রন্থটি বিশেষ
তাৎপর্যের দাবি রাখে৷সাধারণ গড়পড়তা দলীয় কার্যপ্রণালী ও সাফল্যের খতিয়ান
প্রকাশের বদলে এখানে বিপ্লববাদের অকাল ব্যর্থতা ও তার কারণগুলোকে নির্মোহ
দৃষ্টিতে তুলে ধরা হয়েছে৷সে যুগের ইতিহাসের আলোচনায় সমালোচনামূলক উপাদান
হিসেবে গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিসীম৷
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন