গল্পগ্রন্থ- আইরিনদের চিলেকোঠায় বুলডোজার ভাঙছে জোছনা রং
লেখক- অমিতকুমার বিশ্বাস
প্রকাশক- অভিযান পাবলিশার্স
----------------------------------------------------------------------------------------------
দশটি ভিন্নধর্মী নিরীক্ষামূলক গল্পের সংকলন
পিয়ালী মজুমদার
নিতান্ত কাকতালীয় বলে কি কিছু হয়?
হয় বোধ হয়। যেমন আমার স্বেচ্ছা-নির্বাসনের পাশে ' আইরিন'।
ভাঙা আয়নায় মুখ দেখা যায় না, নতুন করে গড়েপিটে নিতে হয় তাকে। আর এই ভাঙা
গড়ার মাঝে প্রয়োজন হয় একটু বিরতির। বিরতির গায়ে বাষ্প জমে, ভাঙা- আমি (
পড়ুন আয়না) র ভেতর ওঁত পেতে থাকে নতুন করে হয়ে ওঠা আর না হয়ে উঠতে চাওয়া
চিৎকারগুলো.. তীব্র কথা-কাটাকাটির মধ্যেই চলতে থাকে খোঁজ.. খোঁজ এক
অত্যাশ্চর্য বিনির্মাণের, স্বতন্ত্র কথাকাজের.. আর ঠিক সেই সময়েই
অপ্রত্যাশিত উপহারের মতো ফ্রেমে ঢুকে পড়ে 'আইরিন'...চাহিদা এবং যোগানের
মাঝখানে ঝুলতে থাকা এক টালমাটাল সাঁকো সেলাই করতে করতে... ঢুকে পড়েন
অমিত। অমিতকুমার বিশ্বাস। নিঃশব্দেই। তার সহজাত খ্যাপামি, অননুকরণীয়
স্টাইল, তীব্র ছুরির ফলার মতো আক্রমণাত্মক অথচ ঝরঝরে গদ্যভাষায় বুনে তোলা
দশটি ভিন্নধর্মী নিরীক্ষামূলক গল্প নিয়ে.... যার পোশাকি নামই ' আইরিন'।
হ্যাঁ, ' আইরিনদের চিলেকোঠায় বুলডোজার ভাঙছে জোছনা- রং'।
আইরিন আমার কাছে আসলে এক জার্নি। আমার স্বেচ্ছা-নির্বাসনের ঘেরাটোপের
সমান্তরালে এক পায়ে চলা পথ। দীর্ঘ, আলো-আঁধারি শালবনের মধ্য দিয়ে।
পথপ্রদর্শক অমিত। তার হাতে ক্যামেরা। হাঁটতে হাঁটতে তিনি পথিককে নিয়ে
ফেলেন এক অনন্ত সর্ষেবনের ভিতর... বৃষ্টি নামে। অ্যাসিড বৃষ্টি। আসলে
তীরের ফলায় বিদ্ধ ক্ষতচিহ্ন শরীরে নিয়েও অনন্ত পুলকে সর্ষেবন পেরিয়ে
যাওয়ার নাম ' আইরিন'..। এই মনস্তাত্ত্বিক দোটানার ভেতর ছিটকে ওঠে
বুলডোজার ভাঙা আশা- নিরাশা, স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের মাটি.. তবু ফিকে হয়
না জোছনার ক্যানভাস.. চশমার কাচ মুছে আরো একবার সামনে তাকাই... চোখের
সামনে ক্যামেরার লেন্স মেলে ধরেন অমিত.. পাঠক লেখক আদান-প্রদানে একটু
একটু করে স্পষ্ট হয় সব।
ভেসে ওঠে এক চা-বাগান... দূরে.....
যেখানে প্রকৃতি ছবির মতো সুন্দর, অকৃপণ.. আর তার খাঁজে খোঁজে ঝুলে থাকা
অস্থিসার জীবন, আপাত-সরল কিংবা স্থূল যে নামেই ডাকা হোক না কেন, আসলে সে
মরীচিকা।
সেই সমান্তরাল যাপনের কথাই তুলে ধরেছেন অমিত প্রথম গল্প, ' কফিনের
অভ্রান্ত ডানা, গোডো আর লাল পিঁপড়ের গল্প' তে।
এই গল্প ভুবন, রফিক, আর জোসেফের। ভিনরাজ্যে ক্রমাগত নানারকম মানিয়ে
নেওয়ার পরীক্ষার মধ্যেই ধর্মভেদ, জাতিভেদ আর পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে
পারাটাও যে টিকে থাকার গল্পে খুব বড় পরীক্ষা, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে
দেখিয়েছেন অমিত। এই গল্প আসলে বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, বিশ্বাসহীনতার ট্রাপিজ
বেয়ে বিপজ্জনক খেলা খেলতে খেলতে পৌঁছে যাওয়া সেই চরম প্রশ্নের কাছে, '
ব্রুটাস, তুমিও? '
পাশাপাশি এই গল্প নিরীহ, বঞ্চিত, ব্যবহৃত অসম দেশি চা শ্রমিকদেরও, যারা
প্রয়োজনে পশু হয়ে উঠতেও দ্বিধা করে না। আসলে ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী
চিরকালই গদ্যময়, তা কবি অনেক আগেই বলে গিয়েছিলেন.. তাই আমাদের বুঝে নিতে
হয় সব ধারাবাহিকই আদি অনন্তকালের ধারা বহন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয় সময়ের
কাছে... লাল পিঁপড়েরাও একদিন সারি ভেঙ্গে ছত্রভঙ্গ হয়। হয়ত একদিন ফিরেও
আসে ছন্দে। কিন্তু সেই সাময়িক ছত্রভঙ্গে খানখান হয় মানুষ এবং
সম্পর্ক।একদিকে যেমন মুঠোর ভেতর জমে ওঠে মানবতা, অন্যদিকে মুঠো খুলে ঝরে
পড়ে অসহায় বন্ধুতা।
মানুষকে বড়ো নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গীতে তার লেখায় তুলে ধরেন অমিত।
প্রেডিক্টেবিলিটির সমস্ত ছক ভেঙে যে শেষপর্যন্ত একা এবং অন্তহীন।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে দু চোখ খুলে দেখে যেতে হবে নরকের খুব নীচুতলার দৃশ্য।
একাত্তরের বধ্যভূমি থেকে দৌড়তে দৌড়তে, সীমান্ত পেরোতে পেরোতে, 'বাক্স
কাঁধে আইসক্রিম বিক্রি করা হাবাগোবা ছেলেটি' থেকে চুলে টেরি কাটা গগলস
পরা ভ্যানচালক ' গুরু' তে পরিবর্তিত হতে হতে, সমস্ত পড়ে যাওয়া থেকে উঠে
দাঁড়িয়ে আবার পড়ে যাওয়ার অলৌকিক বৃত্ত সম্পূর্ণ করতে করতে যেমন দেখেছিল
পাঁচুগোপাল। মৃত মাছের মতো। ফ্যাকাশে দু চোখ মেলে.. এই পূতিগন্ধময়
পৃথিবীর ওপপর বিছিয়ে দেওয়া জ্যোৎস্নার শবদেহ..।
পাঁচুগোপাল। ওরফে গুরু। তাকে নিয়েই অমিতের দ্বিতীয় গল্প, ' জোছনার
শববাহকেরা ঘুমিয়ে পড়েছে'।
সমাজের নিচুতলার মানুষের গল্প বড়ো যত্নে, বড়ো মুন্সিয়ানার সঙ্গে বলেন
অমিত। গুরুর গল্পও বলেছেন। হয়ত আরো একটু বেশি যত্নে, অনেকখানি যন্ত্রণা
দিয়ে এঁকেছেন এই আধা কল্পনা, আধা বাস্তব চালচিত্র।
প্রান্তিক মানুষের জীবনে কোনো সিঁড়ি থাকে না... থাকে না ওড়বার মতো কোনো
আকাশ.. অমিতের ভাষায়, ' মিথ্যের রুপোলি জল চোখে ঝাপটা দিতে দিতে ঘুম
থেকে ওঠা মানুষগুলো মিথ্যের আলোছায়ার মধ্যেই নিজেকে হারাতে চায় কিছুক্ষণ।
আর একদিন ভুলে যায়, তারা সত্যিই হারিয়ে গেছে।' আর এই হারিয়ে যাওয়ার ভেতর
জীবন পাহারা দেয় দ্বিমুখী স্বপ্নের দরজাগুলি। যার একদিকে নিশ্চিন্তে ঘুম
কুড়োয় লাইনপাড়ের সুখ মুহূর্তরা, যেখানে ' সুর, জোছনা, অশ্রু- মিলেমিশে
একাকার'
অন্যদিকে, মৃত্যুর ছায়া ঘন হয়ে আসে ভুলে ভরা মস্তিষ্কে- প্রলাপের মতো
স্বপ্ন হাতড়ায় গুরু, ফুরিয়ে আসার মতো দুটো ডালভাত আর শুকতলার মতো দুটো
ঠোঁট কামড়ে ধরতে চায় ঝুলবারান্দায় নেমে আসা চাঁদের বিষাক্ত সংসার..
হিমশীতল জোৎস্নায় ভিজে যায় ভাঙা স্বপ্নের চৌকাঠ।
যেখানে ঘুম অনিবার্য সেখান থেকে ফেরার কোনো পথ থাকে না... এখানেও তেমন
কোনো পথ রাখেননি অমিত।
রেখেছেন কেবল বিষাদে ডুবে যাওয়ার মতো কয়টি অক্ষর...
" কে বেশি পাগল- কবি না কবিতা?
দরকার নেই সেই হিসেব নেবার
ঘুমোও বাউন্ডুলে, ঘুমোও এবার.... "
ঘুম ভাঙে আবার। অদৃশ্য এক খাঁচার ভেতর থেকে ঘুম ভেঙে ডানা ঝাপটায় আমাদের
যাবতীয় পাখিবোধ। তার ওপারে একটা ' মিসড কল'। তারও ওপারে একটা ' পজ'।
স্নায়ুতন্ত্র বেয়ে নেমে আসা অস্বস্তিরা যেখানে নৈঃশব্দের ভেতর লুকোতে চায়
অনভ্যস্ত ডানার অসাড়তা..
' এই 'পজ' খুব পরিচিত মনে হল। এ অবজ্ঞার, অস্বীকারের, হেরে যাওয়ার 'পজ'।
এই ছোট্ট ' পজ' ক্রমশ দীর্ঘ করছে কোনো এক অজানা শক্তি। বুকের বাঁদিকটা
ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। যেন হাফ ডজন গোল দিয়ে প্রতিপক্ষ মাঠের মাঝখানে
উদোম ফেলে চলে গেছে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে তার। মনে হয় মাথাটা খাঁচার
মধ্যে ঢুকে আছে, আর শরীরটা বাইরে। অথবা মাথার মধ্যে আটকে আছে মস্তবড়
খাঁচা, যার মধ্যে ছটফট করছে কয়েকশো রঙিন পাখি। '
এমনই অনুভূতির মুখোমুখি পাঠককে দাঁড় করায় উল্লাস। অমিতের তৃতীয় গল্প '
খাঁচামানুষ আর পাখিদের নৈসর্গিক উপপাদ্য' গল্পের মুখ্য চরিত্র উল্লাস।যে
আক্ষরিক অর্থেই খাঁচার মানুষ। মায়ের আশঙ্কা ও অতি সচেতনতা তাকে দীর্ঘদিন
বন্দী রেখেছিল দৃশ্যমান এক অতিকায় খাঁচার ভেতর। খাঁচা খুলে বেরিয়ে এসেও
তাকে ঘিরে রাখে অদৃশ্য সেই খাঁচাবেষ্টনী..কিংবা সে নিজেই যাপিত জীবন থেকে
পালাতে চেয়ে খুঁজে নেয় খাঁচার আশ্রয়।
ক্রমশ ভারি হয়ে আসা তার অতীতচারী ডানার একপাশে সীমাহীন নির্লিপ্তির মতো
মুখ গুঁজে পড়ে থাকে সময় ও সম্পর্ক।
স্ত্রী সুষমার সন্তান সম্ভাবনায় অসুখী, পিতার মৃত্যুতে উদাসীন উল্লাস
কিছুটা হলেও মনে করিয়ে দেয় ' আউটসাইডার' এর মিউরসল্টকে। অথচ তীব্র
জীবনবিমুখতা থেকে শুরু হওয়া এই গল্প শেষ পর্যন্ত উড়ানেরই আশ্বাস নিয়ে
আসে। উধাও হয় খাঁচা। জল পড়ে নতুন বীজ সম্ভাবনার শিকড়ে..। অজানা আনন্দে
দুলে ওঠে গল্পের ঘরবাড়ি। জটিল মনস্ত্বত্ত্ব এবং যাদু বাস্তবতার চমৎকার
মিশেলে অমিত আমাদের ধীরে ধীরে নিয়ে যান এমন এক উচ্চতায়, যেখানে অনেকখানি
চড়াই পেরিয়ে হঠাৎ পাওয়া একফালি সমতলভূমির স্বস্তি জীবনের অসমান ভাঁজগুলোর
ওপর টানটান চাদর পেতে দেয় যত্নসহকারে। ঠিক যেমন ফ্যানের একটানা ঘড়ঘড়
শব্দের মতো এবড়োখেবড়ো বোধ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে, আরাম পায় মসৃন অনুভবী
শুশ্রূষায়।
এই গল্পের আর এক অন্যতম চরিত্র সুষমা, যে উল্লাসের মতো আত্মবিস্মৃত,
অগোছালো মানুষের বিপরীতে দাঁড়িয়ে টানটান তুলাদন্ডে ভারসাম্য রক্ষা করে
মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনে জীবনের গতি, তার চরিত্র চিত্রণে হয়ত লেখক আরো একটু
যত্নবান হতে পারতেন,পাঠক হিসেবে এমনটা মনে হয়েছে কিছু ক্ষেত্রে।
বাকি যা কিছু মুগ্ধতা, অমিতের ভাষাতেই ব্যক্ত করা যাক,
" হাজার হাজার পাখিদের শরীর নিয়ে আজ স্বপ্নগাছে বসে আছে সুষমা। আর তার
হাত দুটো ডানা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ডানাদুটো মেলে দিল আকাশে। উড়ল। খুব। সেও
উড়তে চায়। তারও হাতদুটো ডানা হয়ে হয়ে গেল। ডানা ঝাপটাল। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে
পারছে.. পারছে..!
সে উড়তে লাগল খোলা আকাশে.. সুষমার পাশে..! আর তাদের ডানার প্রবল
ঝাপটানিতে ক্রমশ ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যাচ্ছে খাঁচার সমস্ত উপাখ্যান। "
উড়তে চেয়েছিল আরো একজন। সুদূরপ্রসারী আয়লার থেকে একটি ভাঙা ইস্কুলবাড়ির
দূরত্ব অতিক্রম করতে ঠিক যতটুকু উড়ান প্রয়োজন, তার চেয়ে সামান্যই কিছু
বেশি।একেবারে যে পারেনি তা নয়, কিন্তু একটি পুনর্নির্মাণের গল্পের
আশেপাশে যেমন ভাঙা টুকরোগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, সিলেবাসের বাইরের
এলেবেলে প্রশ্নপত্রের মতো.. তেমন করেই তার স্বপ্নের পালকগুলি ঠিকঠাক একটা
আকাশ পাওয়ার আগেই ডানা খসে ছড়িয়ে পড়েছিল বাস্তবের কঠিন জমিতে।
স্বামীপরিত্যক্তা, গ্রামের স্কুলের পুনর্জীবনদাত্রী হয়েও একটু স্থায়ী
পদের জন্য হাপিত্যেশ করে থাকা ময়নার অবিন্যস্ত পালকগুলি আলতো করে গুছিয়ে
দেওয়ার জন্য তবু একজন অপু ছিল। ছিল গোটা একটা কাশবন। ছিল বৃদ্ধ শ্বশুর
নাসের। আর ছিল ফুরিয়েও না ফুরোতে চাওয়া আশারা।
' তবুও প্রিয়জনহীন এই সংসারে মানুষ কেবল একটা তুলে রাখা লাঙলের মতো, যে
মরচে পড়া শরীরে চেয়ে থাকে পরবর্তী চাষের দিকে'
এইভাবেই ' নির্জন দুপুরে পুকুরের মতো ' মেয়েটিকে গভীর বিষাদ দিয়ে আঁকতে
চেয়েছেন অমিত তার ' ময়নাবিবি' গল্পে।
এই গল্পগ্রন্থের অন্যান্য গল্পগুলি নিয়ে যথেষ্ট পরীক্ষানিরীক্ষা করা হলেও
ময়নাবিবির গল্পটি মূলত আখ্যানধর্মী, আগাগোড়া একতারে বাঁধা।
সমান্তরাল ঢেউয়ের মতন, একদিকে যেমন গ্রাম্য রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা ও
ময়নার প্রতি অবিচারের নগ্ন রূপটি সাধারণ কিছু শব্দ ও দৃশ্যের আঁচড়ে সহজ
আল্পনার মতো স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে গোটা গল্পে একটু একটু করে, অন্যদিকে
ময়না আর স্কুলমাস্টার অপুর প্রগাঢ় সখ্যতায় ফুটে ওঠে চিরকালীন অপু-
দুর্গার কোলাজ।
আর কে না জানে, অপু দুর্গার গল্পে দুর্গারা জীবনে ফেরে না কোনোদিন..
ব্যর্থতার গহীনে ডুবতে ডুবতে হারিয়ে যায় চোখের জলে..
আর অপুরা জেগে থাকে, পাঠকের ভিজে আসা চোখের ভেতর, দেখে,
".. এক আবহমান মানুষ হেঁটে চলেছে সাঁকো বরাবর।
গোধূলির আলো এসে পড়েছে সেথা।
কেউ শাঁখ বাজায়। দূরে।"
অমিতের গল্পগুলি পড়তে পড়তে কেবলই মনে হচ্ছিল, যতই অমিত নিজেকে ' গল্পের
গেরিলা' বলতে পছন্দ করুন, অমিতের মূল সত্ত্বাটি আসলে নির্ভেজাল এক
কবিসত্ত্বা। কবিতার সুগভীর বোধ, চেতনা ও দর্শন গল্পগুলির কানায় কানায়।
তেমনই এক গল্প ' আগুন ও বরফের ছায়াছবি'। যার মুখ্য চরিত্র এক ইঁদুর.. যে
আদৌ বাস্তবে কোথাও নেই.. আছে তার স্যুররিয়াল ইমেজারি, পারিপার্শ্বিক
চরিত্রগুলির মননে এবং যাপনে। এই গল্পের ভেতর সরাসরি ঢোকার কোনো পথ
রাখেননি অমিত, রেখেছেন এক ঘোরানো সিঁড়ি, আর তার দুইপ্রান্তে এক পুরুষ ও
এক নারী। একজন ব্যর্থ প্রেমিক এবং অন্যজন নির্বিকার প্রাক্তন
প্রেমিকা।তাদের চরম বিপরীতমুখী দুটি সত্ত্বার ভেতর যত সাদা এবং কালো,
উচ্চাভিলাষ এবং ব্যর্থতা, স্বেচ্ছাচার এবং হতাশা.. সেইসব কিছুর মধ্যে
একমাত্র যোগসূত্র সেই ইঁদুর, ওঠানামা করে
এক বহুমাত্রিক সম্ভাবনা হয়ে। সে মনের অলিগলি বেয়ে ছুটে বেড়ায়, থামে,
জিরোয়, আবার ছোটে.. মনেরই গভীরে লুকিয়ে থাকার এক হন্তারক সত্ত্বা দ্বারা
নিহত হতে হতেও বেঁচে যায় বারবার, তারপর এক সময় নৈর্ব্যক্তিক দূরত্বে
গিয়ে ফিরে তাকায় জীবনেরই দিকে... অনির্বাণ.. অপরাজেয়.. অচঞ্চল।
পর্দার ওপারে দুলতে থাকে আগুন ও বরফের ছায়াশরীরেরা। নিঃশব্দে, পাশাপাশি..
জীবনক্যামেরা চলতে থাকে, চলতেই থাকে.....
চলতে চলতে ক্যামেরা ঘুরে যায় এক সন্ধ্যাঘেরা বারান্দার দিকে, এক শিশু
সেখানে সুর করে কী যেন আওড়াচ্ছে..
একটু কান পাতি.. শুনি..
" ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি,
রাম- লক্ষ্মণ সঙ্গে আছে করবে আমার কি? "
সাথে সাথে ভূতেরা ছায়া হয়ে মিশে যেতে থাকে অন্ধকারে.. আভাস পায় পাঠক,
আভাস পায় নুনি.. চড়া আলোর নিচে চড়া প্রসাধন, সাপের ছোবল, সমস্ত হিসেব
বুঝে নিতে নিতে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে সন্তান বিটুর অদৃশ্য মুখখানি..
মন্ত্রপূত তাবিজের মতো!
সেই কবে থেকে ভূতেদের তাড়া খাওয়া নুনি, রেলবস্তির আরশোলার মতো শরীর-মন
চেটে যাওয়া ক্ষত আগলানো নুনি.. একদিন খোলাবাজারে বেচে দেয় নিজেকে..
চারপাশে ভূতের নৃত্য আর তাকে ভয় দেখাতে পারে না.. ঢাকা শরীরের অন্ধকার
চেটে খাওয়া ভূতগুলো এখন নিজেরাই উদোম। বে- আব্রু ভগবানও। তাদের যা কিছু
বাড়বাড়ন্ত, সাময়িক স্তব্ধতায় মুখ গুঁজে দেয় ওই সন্ধ্যাঘেরা বারান্দায়..
মুখোশগুলো অর্বাচীন হয়ে পড়ে থাকে.. শিশুর নির্ভীক উচ্চারণে হাওয়ায় মিলিয়ে
যায় ভয়ের সাতকাহন।
' ভূত, ভগবান এবং ' গল্পের এই ভূত এবং ভগবানেরা চিরকালই ছিল আমাদের
আশেপাশে.. ছিল নুনিও..আছে। আরো কত নুনি এঁটো শরীর নিয়ে হারিয়ে গেছে
ভূতেদের জলসায়, তার হিসাব নাই বা করলাম এখন। বরং এই মুহূর্তে আমাদের
থাকুক এক ঘুমের মতো শৈশবে ফেরার রাস্তা.. অমিত যেভাবে বলেছেন.. সুর করে,
সমবেতভাবে, হাতে হাত রাখার আশ্বাসে..
' ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার..... '
অমিতের পরবর্তী গল্প ' অন্ধভূমি সিন্ধুভূমি'। অন্যান্য গল্পের মতো অমিতের
এই গল্পটিও বাস্তবের তেতে ওঠা মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে আগাপাশতলা ঝালিয়ে
নেওয়ার স্পেস তৈরি করে দেয়.. পাশাপাশি একধরণের জার্নির কথাও বলে। এই
জার্নি স্কুলটিচার নন্দিতার স্বতন্ত্র চলার মধ্যে ঢুকে পড়া পারিপার্শ্বিক
বৃহত্তর জার্নি। আমরা প্রত্যেকেই নিজেদেরই অজান্তে নিজস্ব আনন্দ, হতাশা,
প্রাপ্তি, বিরক্তির অংশীদার করে নিই দৈনন্দিন বহমান জীবনপ্রবাহকে ।
সমান্তরাল রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক অচলাবস্থাও সূক্ষ্মভাবে প্রভাবিত করে,
বিক্ষিপ্ত করে চলে আমাদের এই বহমানতাকে। একটা বড় ঝড়কে ঠেকাতে আমরা প্রতি
মুহূর্তে ছোট ছোট ঝড়ের কাছে মাথা নিচু করি, আবার উঠে দাঁড়াই.. আবার নিচু
হই এবং এভাবেই আমাদের জীবন প্রতিনিয়ত এক একটি নিজস্ব যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে
ওঠে, জেতাহারার এই গল্পে
আমাদের প্রতিপক্ষ আমরাই.. যে যার মতো অস্ত্র শানাতে ব্যস্ত। হয়তো এমনটাই
বলতে চেয়েছেন অমিত রূপকধর্মী এই গল্পে, যার শেষ লাইনগুলি বিশেষ
ইঙ্গিতপূর্ণ..
" আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি প্রস্তুত। এবারে কেউ
কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দেবে না। প্রয়োজনে সংঘর্ষে যেতে রাজি সব দল'।
টিভিতে একটা বিস্ফোরণের ফুটেজ ভেসে উঠল।
এদিকে
নন্দিতার মুঠোর মধ্যে রিমোট..
মুঠোটা ক্রমশ শক্ত হচ্ছে.. "
কারণ সন্তানের অধিকার ছেড়ে দেবে না সেও। প্রয়োজনে সংঘর্ষে যাবে।প্রতিপক্ষ
স্বামী অরিন্দম। এভাবেই বড় ফ্রেমের ভেতর নিজস্ব চাওয়া পাওয়া নিয়ে
প্রতিনিয়ত ঢুকে পড়ছে আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত ফ্রেমগুলি..। যুদ্ধ বাইরে।
এবং ভেতরেও।
যুদ্ধ বুবুনও করেছিল। সত্যি নয়, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। রবার্ট এন্ড দ্য
ডেভিলস। আর প্রিয় এই খেলাটা খেলতে খেলতেই কীভাবে যেন সত্যি সত্যি একটা
যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেছিল নিজের চারপাশে তা নিজেও বুঝতে পারেনি।
যেমন বুঝতে পারেনি তার বাবা-মা। অভি ও মোনালিসা।
নিজেদের রোজকার যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার আড়ালে যে একজন প্রতিপক্ষ যোদ্ধা নিজেকে
গড়ে তুলছে ধীরে ধীরে, একদিন সমস্ত হিসেব সুদ- আসল মিটিয়ে নেবে বলে, সে
তথ্য অজানাই রয়ে গেছিল তাদের কাছে।
যেমন আর পাঁচজন শহুরে শিশু প্রায় অচেনায় বেড়ে ওঠে বাবা- মায়ের থেকেও না
থাকার মাঝে, তেমন বুবুনও।
শিশু মনস্তত্ত্ব খুব ভালো বোঝেন সংবেদনশীল গল্পকার অমিত, কারণ তিনি কেবল
এক সুগভীর জীবনদ্রষ্টাই নন, একজন স্কুলশিক্ষকও। ' বুবুন ঘরে ঢুকছে' গল্পে
বুবুনের মনের ওপর তিনি আলো ফেলেছেন বিভিন্ন দিক থেকে...
বুবুনের বেড়ে ওঠা তার কাছে যেন এক বনসাইয়ের বেড়ে ওঠা..
' ঐশ্বর্যে, আভিজাত্যে, ফসলী মাটির স্তন ছাড়া, সুবিশাল আকাশ ছাড়া,
পাখিদের উল্লাস ছাড়া, বৃষ্টির প্রেম ছাড়া।'
আর এই পক্ষাঘাতগ্রস্ত, দিশাহীন, ভালোবাসাহীন জীবনে ধীরে ধীরে জায়গা করে
নেয়, নেশা। ভিখারি ছেলের শুঁকতে দেওয়া আঠার টিউব আর একটা ভিডিও গেম।
রবার্ট এন্ড দ্য ডেভিলস।
তারপর একদিন ছুটে যায় সব ঘোর , পর্দা ফুঁড়ে মাটিতে নেমে আসে রবার্ট..
নাকি বুবুন! ঢুকে পড়ে সাজিয়ে তোলা ঘরে। তার মুখোমুখি দুই ডেভিল..
যুদ্ধশেষ!
মস্তিষ্কের কোষে কোষে এক অজানা ভয় ছড়িয়ে বুবুনের গল্প শেষ করেন অমিত।
সত্যি শেষ? নাকি শুরু!
ক্যামেরা এবার একটু বিশ্রাম চায়। আবার একটু 'পজ'। আর সেই সুযোগে ফ্রেমের
বাইরে ঘুরতে বেরোন গল্পকার। সেখানে গল্প তার পিছু তো ছাড়েই না, উলটে
গল্পের গোরু আকাশে ওড়ার বাসনায় ছুটতে থাকে এক অপরিকল্পিত রাস্তা বরাবর..
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চরিত্রগুলি কুড়িয়ে এনে অসংখ্য কোলাজ বানায়।
রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত কোলাজ.. সমকালীন সমাজ, অবক্ষয়, মৃত্যু, প্রতারণা,
ব্যভিচারের কোলাজ.. তীরের ফলার মতো ক্ষোভ আর তীব্র ব্যঙ্গাত্মক শ্লেষ
দিয়ে তৈরি আমাদের মুখ ও মুখোশের কোলাজ... যার নাম ' গল্পের গরু আকাশে
উড়তে চেয়েছিল'।
যেখানে কোনো এক অমনকে ফেলে কোনো এক শ্রীলা পাড়ি জমায় দূরদেশে, যেখানে
রাস্তার মাঝখানে শুরু হয় প্রকাশ্য চুম্বন উৎসব, আর কোনো এক অন্ধকার
ব্যালকনি থেকে শ্রীলার থেকেও দূরে কোনো এক অজানা দেশে উড়ে যাওয়ার
প্রস্তুতি নেয় এক ফেসবুক মেয়ে, অন্য দিকে আরো দুই মেয়ে পরীক্ষার ফাঁকে
ফাঁকে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা মোবাইল নামক পরিত্রাতার শরণাপন্ন হয়.. আর
শেষমেশ অমন নামক সমাজবিরোধীর গুলিতে খুলি ছিটকে যায় অলিখিত অজানা
শত্রুর..
ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে উঠে এসে সিধু পাগলের মৃতদেহের নিচে জড়ো
হওয়া এইসব কোলাজ, বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকা দৃশ্য গুলিকে পাঠকের মাথায় পেরেক
দিয়ে গেঁথে দেন অমিত.. ক্যাপশন দেন ' ইয়ে মেরা ইন্ডিয়া, আই লভ মাই
ইন্ডিয়া'।
যন্ত্রণা শুরু হয়.. সাক্ষী থাকে এক রক্তমাখা মূর্তি, মহাদেব পাগল আর
বৃদ্ধ শিল্পীর ক্যানভাস জুড়ে উড়তে থাকা কাকেদের বিষ্ঠা।
ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়া এক শহর পাঠকের বুকের ভিতর ডানা গুটোয়.. অন্ধকারে।
আইরিন নামক জার্নিও প্রায় শেষ হয়ে আসে। আমরা হরিপদর মুখোমুখি হই। এই
হরিপদ কে তা স্পষ্ট করে বলেন না অমিত। কিন্তু তার বিশেষ গুণ সম্পর্কে
আমরা খুব স্পষ্টভাবে জানতে পারি, হরিপদর একটাই গুণ ছিল' গল্পটির
মাধ্যমে। আইরিনের শেষ, স্যাটায়ারধর্মী এই গল্পে অমিত বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে
একহাত নিয়েছেন সেইসব মহান শিক্ষককুলকে, যারা টিউশনিকেই জীবনের
ধ্যানজ্ঞানব্রত হিসেবে নিয়েছেন। নিজে স্কুলশিক্ষক হয়েও সমপেশার এই
দুর্নীতিকে নির্ভীকভাবে আক্রমণ করার জন্য অমিতকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারছি
না।
একটি মানুষ, যার মূল্যবোধ পুরোটাই ঝাঁঝরা, জীবনযাপন নর্দমার পোকার থেকেও
ঘৃণ্য, গল্পের শেষ পর্বে এসে সে হঠাৎই বদলে যায় কিংবা যেতে চায়।
হয়ত অন্যায় করতে করতেও একসময় ক্লান্ত হয় মানুষ, ভাবে অনেক হয়েছে, আর নয়।
কিন্তু এখানে সেই ভাবনার পেছনে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাননি অমিত।
এইটুকু সাযুজ্যের অভাব চোখে পড়েছে গল্পে।
বাকি সবটুকুই নিপুণ দক্ষতায়, পাঠকের সামনে স্তরে স্তরে মেলে ধরেছেন অমিত..
যাবতীয় অপরাধের ভার নিতে নিতে থমকে যাওয়া পাঠকমনকে একটু রিলিফ দিয়েছেন
স্বভাবসিদ্ধ আশাবাদী ভঙ্গিমায়।
হরিপদর সাথে সাথে তাই পাঠকও ক্রমশ ভারহীন হয়েছেন, পাপমুক্তির হাসি তাদের
চোখে নিশ্চিন্ত ঘুমের রেশ রেখে মিলিয়ে গিয়েছে মহাশূন্যে....
অমিত এই সময়ের এক সার্থক গল্পকার, মূলধারার বাইরে গিয়ে তার গল্পবলায় পাঠক
একেবারে নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। ছোট ছোট বাক্য, অভিনব ও তীক্ষ্ণ
শব্দ এবং ভাষার ব্যবহার, গল্পের বক্তব্যকে সরাসরি পাঠকের সামনে উপস্থিত
না করে, তাদের নানা রূপকের মাধ্যমে, ঘটনাপ্রবাহের উৎসে নিয়ে ফেলা এবং
গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করা.. অমিতের স্বাতন্ত্র্য এইখানেই।
রাগী, আক্রমণাত্মক এবং নির্ভীক গল্পকার হিসেবেই পাঠক মনে রাখবেন বাস্তবে
মিতভাষী, লাজুক অমিতকুমারকে। তার মনক্যামেরা চলতে থাকুক.. আরো এক
সুদীর্ঘ ভ্রমণপথের খোঁজে। অপেক্ষায় রইলাম এক অন্যতর আইরিনের।
আলোচক-- পিয়ালী মজুমদার
চলভাষ: ৯৯০৩৪৯০২৮৭
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন