আই-সোসাইটি ও 'স্তুতি কবিতা'
জ্যোতির্ময় মুখার্জি
অনেকেই প্রশ্ন করছেন,
আচ্ছা, আই-সোসাইটি ব্যাপারটো ঠিক কী বটেক?
কেন? ও কীভাবে?
ব্যাপারটো একটু বুঝাইয়া বলেন দিকি।
এত্তো সহজে ও অল্পে আমি বুঝাইতে লারবো?
এখন শুধু স্পষ্ট করে আই-সোসাইটির মূল চিন্তন বা উদ্দেশ্য'টা জানিয়ে দিই
আপনাদের, বাকি কথা না'হয় পরেই হবেক।
সাধারণ ভাবে মানুষ দুই প্রকার, ভালো ও খারাপ।
(বাকি ভাগগুলোর প্রয়োজন আছে কী? তুমি হিন্দু না মুসলিম, গরীব ও ধনী
ইত্যাদি ইত্যাদির প্রয়োজন কী? আরে মশাই, আপনি মানুষ, that's enough)
আরো গভীর গিয়ে লক্ষ্য করলে দেখবেন মানুষ আদতে একপ্রকার'ই এবং তা হলো,
ভালো ও খারাপ এনার্জি সমন্বিত একটা চিন্তা স্রোত। একটি মানুষের মধ্যেই
বাস করে ভালো ও খারাপ দুটি মানুষ।
চামড়া, মাংসের কাঠামোটা তো আসলে মানুষ নয়, মানুষ আসলে মানুষ তার চিন্তনে।
যে চিন্তন নিয়ন্ত্রণ করে তার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড।
আই-চিন্তন বলছে (যা আসলে ভারতীয় সংস্কৃতি তথা সাহিত্যের মূল কথা) আমরা
পারি আমাদের মধ্যে বয়ে চলা এই চিন্তা স্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করতে, আমরা পারি
ক্রমাগত নেগেটিভ এনার্জি'কে বিনষ্ট করে, পজেটিভ এনার্জি দিয়ে আমাদের
দৈনন্দিন কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং অবশেষে স্পর্শ করতে সেই সুপ্রিম
পাওয়ার বা এনার্জি'কে।
কী সেই সুপ্রিম এনার্জি?
সুপ্রিম এনার্জি হলো, যা সত্য, যা সুন্দর (যা শিব)।
সম্পূর্ণ পজিটিভ এনার্জি সমন্বিত এক চিন্তাস্রোত।
(ভাবছেন, দূর মশাই, আমি মহাপুরুষ হতে লারবো।
ঠিক, একদম ঠিক, কিন্তু একটু ভাবুন দিকি, লক্ষ্য'টাই সব? আর পথটা?)
আই-সোসাইটির সামগ্রিক কর্মকান্ডের মূল লক্ষ্য হলো, মানুষের ও প্রকৃতির
সামগ্রিক উন্নতি সাধন। মানুষের সাথে প্রকৃতির অকৃত্রিম সম্পর্কবলয়
উন্মোচনের মধ্য দিয়ে, জাগতিক মঙ্গল সাধনা।
ভুল বুঝবেন না, আমি কোনো ধর্মতত্ত্ব আলোচনা করছি না, আবার একদিক থেকে
দেখতে গেলে ঠিক তাই। ধর্ম আসলে ঠিক কী? মানুষের সামগ্রিক মঙ্গল সাধনের এক
পথ, যা কালক্রমে কলুষিত হয়ে পড়েছে নেগেটিভ এনার্জির প্রভাবে।
এই যাত্রাপথে, আই-সোসাইটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে কবিতা'কে (বা
সাহিত্য)। আই-সোসাইটির কাছে কবিতা লেখার উদ্দেশ্য কবি হওয়া নয়, কবিতা
এখানে মাধ্যম মাত্র, মূল উদ্দেশ্য কবিতার মাধ্যমে যিনি কবিতা লিখছেন এবং
যিনি কবিতা পড়ছেন দুজনেরই মানসিক পরিবর্তন সাধন এবং সেই পরিবর্তন ক্রমশ
নেগেটিভ এনার্জি'কে সরিয়ে পজিটিভ এনার্জি'কে গ্রহণ করার বার্তা, যা ক্রমে
ছড়িয়ে পড়বে এক মানুষ থেকে আর এক মানুষে, এক আধার থেকে আর এক আধারে।
অতঃপর বার্তা সাহিত্য।
বার্তা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করার আগে, আসুন আপনাদের একটা ছোট্ট গল্প শোনাই।
গল্পটা যে সময়কার, তখন মানুষ ঠিক 'মানুষ' ছিলো না,ওই হোমো সেপিয়েন্স আর কী।
আহা অবলা জীব!
তা হয়েছে কী, দুটো অবলা মানুষ চলেছে শিকার করতে। ঘন জঙ্গল, ইয়া বড়ো বড়ো
গাছ, লতায় পাতায় সে এক জবরজঙ্গল পরিস্থিতি। একটা মানুষ সামনে আর একজন
একটু পিছনে। পিছনের মানুষটা হঠাৎ লক্ষ্য করলো, সামনের মানুষটার ঠিক মাথার
উপর একটা বিরাট সাপ, ঝুলছে, ছোবল মারবে আর কী…….
এখন প্রশ্নটা হলো, সে কী করবে? বেচারি তো কথা বলতেই পারেনা, তাহলে?
সামনের মানুষটাকে সজাগ করতে সে একটা ঢিল ছুড়লো মানুষটার গায়ে, মানুষটা
ঘুরলো, ছোবল খেলো এবং মরে গেল।
ইস্, অবলা জীবটি যদি সবলা হতো! যদি সে কথা বলতে পারতো!
এই যে হ্যালো...এইদিকে….জঙ্গলে আটকে গেলেন নাকি? আর মন খারাপ করতে হবে
না, ফিরে আসুন ২০১৭ তে…..হা হা হা হা….ভাবছেন কী সুন্দর একটা কল্পনার
জগতে ছিলাম, ঘোরটাই ভেঙে দিলেন। তাইতো?
ধান ভাঙতে শিবের গীত না গেয়ে আসুন এবার বুঝিয়ে বলি, কেন ওই গল্পের আবাহন।
আচ্ছা, ভাবুন তো, মানুষটা যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে তো ওই প্রথম মানুষটা
মরতোনা (মানুষের ভাষার ক্রমবিকাশ'কে দূরে সরিয়ে গল্পের খাতির ধরে নিচ্ছি
কথা বলতে পারে)। সে কী করতো তখন? একটা বার্তা পাঠাতো, সাপ।বসে পড় বা শুধু
একটিই শব্দ, সাপ।
ব্যাস্, ওতেই কাজ হতো।
এবার আসুন আমরা বিশ্লেষণ করি 'শিবের গীত', তাহলেই 'ধান'টা ঠিকঠাক ভেঙে
ফেলতে পারবো আমরা।
পিছনের মানুষটা কী দেখলো? একটা দৃশ্য, সাপ ঝুলছে সামনের মানুষটার মাথার
উপর। প্রকৃতির বুকে জন্ম নেওয়া দৃশ্যটা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে রিসিভ করে
চালান হয়ে গেল মস্তিষ্কে। সৃষ্টি হলো একটা চিন্তা তরঙ্গ, দৃশ্যটার
বিশ্লেষণ হলো, বিশ্লেষিত হয়ে আরো একটি দৃশ্য জন্ম নিলো, সাপটা ছোবল
মাড়ছে এবং মানুষটি মরে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় দৃশ্যটি সাথে সাথে শব্দের মধ্য দিয়ে বার্তা আকারে পৌঁছে গেল
দ্বিতীয় মানুষটির কাছে। শব্দ তথা বার্তা'টা সে গ্রহণ করলো ইন্দ্রিয়ের
মাধ্যমে, চালান করলো মস্তিষ্কে, সৃষ্টি হলো চিন্তা তরঙ্গ, সেখানে
বার্তা'টা বিশ্লেষিত হলো এবং জন্ম নিলো একটি দৃশ্য। ঠিক সেই দৃশ্যটি,
যেটি প্রথম মানুষটার মস্তিষ্কে উৎপন্ন হয়েছিল।
অর্থাৎ আমরা পরিস্কার বুঝতে পারছি, দৃশ্যের জন্ম হয় প্রকৃতিতে,
ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সেই দৃশ্য পৌঁছে যায় মস্তিষ্কে, বিশ্লেষিত হয়, সৃষ্টি
হয় চিন্তন অতঃপর প্রক্রিয়াজাত দৃশ্য বার্তা আকারে প্রেরিত হয় অন্য একটি
মানুষের কাছে এবং সহজেই সে, সেই দৃশ্যের অর্থ ধরতে পারে কারণ প্রকৃতিতে
এমন দৃশ্য সে আগেই দেখে ফেলেছে।
ধরা যাক, আমি বললাম, আম।
এই 'আম' বলার আগে আমার চিন্তনে আমের একটি ছবি ফুটে উঠলো, ছবিটিকে চালান
করে দিলাম শব্দের মধ্যে দিয়ে। আপনি গ্রহণ করলেন এবং 'আম' পড়েই আপনার
চিন্তনে আমের একটি ছবি ফুটে উঠলো।
এখন আমি যদি বলি, 'গিদিম পুলির ছা'?
ভাবছেন তো, এটা আবার কী বস্তু? খায় না মাথায় দেয়?
জানিনা মশাই, আমিও ঠিক জানিনা। কারণ এই শব্দগুলি আমার চিন্তনে সৃষ্ট কোনো
দৃশ্য থেকে জন্ম নেওয়া নয়, এমন কিছু প্রকৃতিতে নেই।
তাহলে কী বুঝলেন?
বার্তা তথা শব্দ আসলে এক মানুষ থেকে আর এক মানুষের মধ্যে দৃশ্যের
আদানপ্রদান। যে দৃশ্যের জন্ম প্রকৃতিতে।
যে শব্দ দৃশ্যের জন্ম দিতে পারেনা, সেই শব্দ অর্থহীন।
আর শব্দের পূর্ণ বিকাশ কবিতা তথা সাহিত্যে।
কবিতা তথা সাহিত্য আদতে চিন্তনের প্রক্রিয়াজাত দৃশ্যকে বার্তাকারে
প্রেরণ। যে বার্তার মাধ্যম শব্দ।
আর যে দৃশ্য প্রকৃতিসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাপেক্ষে চিন্তনে উদ্ভুত।
এতক্ষণে আপনারা নিশ্চিত ধরে ফেলতে পেরেছেন, প্রকৃতির সাথে আমাদের, আমাদের
চিন্তনের সাথে প্রকৃতির যোগসূত্রটা। এটাও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, সাহিত্য
তথা কবিতার সাথে প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক'টা।
অনেকেই মনে করেন, কবিতার সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক'টা আসলে ওই গাছ, ফুল,
পাখি নিয়ে কবিতা লেখা। প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সাহিত্য রচনা।
ব্যপারটা কিন্তু মোটেই তা নয়।
যেমন বার্তা সাহিত্য মানে মোটেই ওই Hi, helo নয়।
কেন নয়?
সেটা তাহলে পরবর্তী পর্যায়েই আলোচনা করা যাবে।
আজ এই পর্যন্তই থাক।
এবং স্তুতি কবিতা
আচ্ছা, স্তুতি কাব্য'টা ঠিক কী বস্তু? খায় না মাথায় দেয়?
দেখুন ব্যপারটা বিশেষ কিছুই নয়, এটাও আদতে কবিতা। হ্যাঁ কবিতা। আলাদা
নাম ধারণ করে কবিতার অবিচ্ছিন্ন ধারা থেকে বিযুক্ত নয়। না ভাষায়, না শব্দ
ব্যবহারে, না আঙ্গিকে আলাদা কিছু দাবি করে না। আমি, আপনি যা লিখি,
যেভাবে লিখি তাই স্তুতি কবিতা হতে পারে যদি তার মধ্যে অবশ্যই লুকিয়ে থাকে
একটা সূত্র : তমসো মা জ্যোতির্গময়
অর্থাৎ, যে কবিতা পড়লে পাঠকের মধ্যে একটা feel good আবেশ সৃষ্টি হয়, যে
কবিতা শান্তি আর আনন্দের বার্তা বহন করে, যে কবিতা ক্রমে অন্ধকার থেকে
আলোর দিকে যাত্রার কথা বলে, যে কবিতা কবি থেকে পাঠকের মধ্যে, মানুষ থেকে
মানুষের মধ্যে ক্রমান্বয়ে চেন রিয়াকশনে পজিটিভ এনার্জির বার্তা বয়ে নিয়ে
যায় তাই স্তুতি কবিতা।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এটা কীরকম কথা হলো? কবি তো জীবনের কথা বলবে, কবিতা
হয়ে উঠবে জীবনের প্রতিরূপ, যেখানে আলো আছে, আছে কালো।
আলো-আঁধারি ছায়ায় লুকোচুরি খেলাটাই তো জীবন, তাহলে কবি শুধু আলোর কথায়
কেন বলবে? কেন দেখবেনা জীবনের অন্ধকারময় দিকগুলো? এটা কি একচোখামি হয়ে
গেল না? এটা তো অসম্পূর্ণ কবিতা বোধ।
এর একটাই উত্তর , তমসো মা জ্যোতির্গময়।
আই-সোসাইটির কবিতা চর্চার মূলে আছে মানুষের আত্মিক ও জাগতিক উন্নতি।
শান্তি ও আনন্দের মধ্যে আনন্দময় জীবন যাপন। এই কবিতা বোধ থেকেই সে বিশেষ
করে বেছে নিচ্ছে সেই কবিতাগুলি, যে কবিতা বহন করে শাস্তি ও আনন্দের
বার্তা। কারণ আই-সোসাইটি বিশ্বাস করে, কবির দায়িত্ব শুধু অন্ধকারের
স্কেলিটান আঁকাতেই শেষ হয়ে যায় না, তার দায়িত্ব অন্ধকারের মধ্যে থেকে
আলোর দিশাটুকু খুঁজে বার করা। কবি আঁকতেই পারে তাঁর কবিতায় বর্তমান
সমাজ-ব্যবস্থার কালো প্রতিচ্ছবি। এই কালো'কে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কবির
নেই, উচিতও নয়। কিন্তু, সেখানেই কবির কলম থেমে যাবে না, সে খুঁজবে এই
কালোর মাঝে আলোর রেখাটুকু এবং সেই আলোর বার্তা ছড়িয়ে দেবে কবিতার মধ্যে
দিয়ে পাঠকের মধ্যে।
বেবি'দা(Amitava Praharaj) কিছুদিন আগে একটা কমেন্টে একজনকে বলেছিল, 'বেশ
বেশ, আলো লেখ, আলো লেখ'
হ্যাঁ, এটাই স্তুতি কবিতা…...
"এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়,
আমার মুক্তি ধূলায় ধূলায়, ঘাসে ঘাসে….."
■ ঋণ স্বীকার : সৌমিত্র রায়
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনভাল লিখা বটেক
উত্তরমুছুন