কবি, তোর কলম কোথায়...
------------------------------------------------------
---- অনিরুদ্ধ সেন
সেই কোন কালে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের
প্রতি নিবেদন ' করেছিলেন, "যশের জন্য লিখিবেন না।তাহা হইলে যশও হইবে
না,লেখাও ভালো হইবে না। লেখা ভালো হইলে যশ আপনি আসিবে।" সাম্প্রতিক
বাঙালি কবিকুলকে এ কথা স্মরণ করানোর মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। বাংলা ভাষায়
কবিতা ও কবি পর্যাপ্ত।এ তো কম গর্বের নয়।প্রতিষ্ঠিত বা অধিকাংশ সংখ্যক
পাঠক যাঁদের চেনে ও পড়ে তাঁদের ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন তোলার প্রয়োজনীয়তা
আজ আছে বলেই বোধ করছি। অপরিচিত বা অপেক্ষাকৃত অল্প পরিচিত কবিদের ক্ষেত্র
প্রস্তুত হলে প্রশ্নটা তাঁদের জন্য ও রাখা যায়।কিন্তু প্রশ্ন হল প্রশ্নটা
কী!
কথাটা হল সমকাল নিয়ে।কথাটা
হল দৃশ্যমান অভিজ্ঞতালব্ধ সাম্প্রতিকতা নিয়ে।অথবা এক লপ্তে বলা
যায়,ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য দৈনন্দিন জীবনের ভাষ্য রচনার দরকারি প্রশ্ন।
যিনি কবি তিনি তো এই শহর,এই গ্রাম, এই ধোঁয়া ধূলোর রাস্তা, ভাত ডাল
আলুসেদ্ধ,সিনেমা টি ভি সিরিয়াল, ব্যাংকের লোন,ধর্ষণ, রাজনীতি,
ধাপ্পা-ছাপ্পা,মৃত্যু সব সবই প্রত্যক্ষ করা একজন সমাজ-মানুষ ? যতই তিনি
ভাব জগতে বিচরণ করুন না কেন,তাঁর ভাব গুলির আলম্বনবিভব তো এই ইন্দ্রিয়
প্রত্যক্ষ সময় ? যিনি সত্যের,
উপলব্ধির,ধারণার,লক্ষ্যের,লালনের,সংবেদের,দর্শনের কাব্য-ভাষ্য রচনার ভার
নিয়েছেন তাঁকে তো আর অন্ধ কালা বোবা অথর্ব বা একান্তই স্নায়বিক রোগী মনে
করা যায় না ? তাহলে সঙ্গত একটি প্রশ্ন ওঠে , বাঙালি কবিবর আপনি এতো লেখেন
কিন্তু এতোটাই না-দেখাকে লেখেন ? দেখাকে লিখতে কি ইচ্ছা করেন না ? নাকি
বাস্তব প্রত্যক্ষ লিপিবদ্ধ করায় আপনার এক জাতীয় অ্যালার্জি আজ প্রকট ?
সেই দৃঢ় শানিত খিপ্র কলমের তীক্ষ্ণ মুখ কি কোনও অদৃশ্য ভয়ে ভীত ? অথবা
ফিসফিস করে বলবেন, 'ওসব লিখলে একটাও অনুগ্রহ জুটবেনা,বুঝেছ বাছা...'
চিলির কবি পাবলো নেরুদাকে অভিহিত করা হয়েছিল People's poet বলে।স্পেনের
গৃহযুদ্ধে মুক্তি সৈনিকের ভূমিকা গ্রহণ করার ফল হিসাবে ও অগ্নিগর্ভ ভাষায়
অত্যাচারের বিরুদ্ধে কবিতা লেখার অপরাধে কবিকে হারাতে হয়েছিল
বাণিজ্যদূতের চাকরি। জারি হয়েছিল দেশের আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তবু
হাসি মুখে থেমে যায় নি নতুন বাণী রচনার কাজ, 'সাধারণের গান'। অবশ্য
ইতিপূর্বে ১৯৩৬-এ ঘটে গেছে স্পেনের কবিতার জগতে চরম আর একটি বিপর্যয়,
ফ্যাসিবাদী ঘাতকের হাতে কবি লোরকার হত্যাকান্ড। প্রকৃতই যারা জনগণের
কবি,সাধারণের কবি,লক্ষ মানুষের কবি, তারা সমঝোতার পথে কখনও কি পা বাড়ান
?
রবীন্দ্রনাথ 'সাহিত্যের বিচারক' প্রবন্ধে একটা শাশ্বত বার্তা
দিয়েছিলেন, "জগতের উপরে মনের কারখানা বসিয়াছে এবং মনের উপরে বিশ্বমনের
কারখানা-----সেই উপর তলা হইতে সাহিত্যের উৎপত্তি।" তাহলে জগতবহির্ভূত
মনের কারখানায় উৎপন্ন করা প্রোডাক্টকে সাহিত্য বলা সমীচিন হবে কি ?
রবীন্দ্র-উত্তর সাহিত্য স্রষ্টাদের একটা সহজ সমালোচনা ছিল, রবীন্দ্রনাথ
প্রত্যক্ষ বাস্তবকে এড়িয়ে লেখালেখি করেন। যদিও সে সমালোচনা যতটা
যুক্তিসঙ্গত তারচেয়ে বেশি হুজুগে। 'আফ্রিকা' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই
একটা প্রশ্ন তুলেছিলেন,যখন সভ্যতাগর্বী ইউরোপীয়দের একটা অংশ আফ্রিকার সরল
মানুষদের উপর দস্যুবৃত্তি করছে তখন ঠিক বিপরীতে তাদের নিজস্ব
স্বদেশভূমিতে বিখ্যাত কবিরা রীতিমতো সৌন্দর্য্য-আরাধনার কাব্য রচনায়
মশগুল। রবীন্দ্রনাথের একেবারেই মনোপূত হয়নি সেদিনের সেই সভ্য দেশীয়
বুদ্ধিজীবীদের দ্বিচারিতা ।মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথ সমকালীন
বিশ্ববন্দিত কবি হয়েও কবির দ্বিচারিতাকে মেনে নিতে পারেন নি।দেশ কাল
সমাজ রাজনীতি কবিরা এড়িয়ে যাবেন, কবিগুরু তা মানবেন কেন ?আর প্রতিষ্ঠান,
রাস্ট্র, ক্ষমতার প্রতি বশ্যতা বা হে হে আলি হয়ে বেড়ানোও তাঁর প্রখর
চরিত্রকে ছোঁয়নি।নাইট উপাধি কেন ত্যাগ করেছিলেন সকলের জানা,বঙ্গভঙ্গের
বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা, জাতিবিদ্বেষের বিপরীতে রাখীবন্ধন উৎসব করা অথবা
বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দেওয়া 'লোকহিত' প্রবন্ধে। 'ঘরেবাইরে' উপন্যাসে
স্পষ্ট করে দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আন্দোলনের সত্য আর মিথ্যের রূপ।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী চরমপন্থীদের সেই ঘোরতর দিনেও 'গোরা'র মাধ্যমে সাহসী
সত্যের যৌক্তিক উপস্থাপন সত্যবাদিতার নির্ভিক সৃজন।
কাজী নজরুল প্রসঙ্গ অবধারিত ভাবে আসবে।১৯২২-এ
'বিদ্রোহী' কবিতার প্রকাশ, ইংরেজ সরকারের রোষানল; ঐ বছরই 'ধূমকেতু'
পত্রিকা প্রকাশ এবং পদে পদে ব্রিটিশ রাজশক্তির ঔধত্যের সমালোচনা।২৩শে
নভেম্বর ১৯২২ ব্রিটিশ পুলিশ নজরুলকে গ্রেফতার করে;১৬ই জানুয়ারি১৯২৩
বিচারক কবিকে একবছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।তার পর একসময় জেলখানার
মধ্যেই নজরুলের অনশন শুরু, যে অনশন ভাঙতে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে তারবার্তা
পাঠান। এসব শুধুইমাত্র ইতিহাস ? নাকি আজকের সাহিত্যসেবীদের কাছে নিতান্ত
'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম' ? সৃজনশীলের দায়বদ্ধতা কি খ্যাতি যশ আর পুরস্কারে
সীমায়িত ?
সুকান্ত বেঁচে থাকলে একদিন তাকেও যে প্রতিষ্ঠান
বিরোধিতার দায়ে অভিযুক্ত হতে হতো না তা কি জোর দিয়ে বলা যায় ? সুভাষ
মুখোপাধ্যায় নির্দিষ্ট রাজনৈতিক-দর্শন নিয়ে অজস্র কবিতা লিখেছেন সত্য
কিন্তু বশ্যতা তো মেনে নেননি। বরং 'মিছিলের মুখ' বদলে যাওয়া যেমন দেখেছেন
তেমনই লিখেছেন। কবি ক্ষমতার কাছে অপ্রিয় হলে কবির সত্যিই তো কিছু এসে যায়
না। জীবনানন্দ কোনও দিন পৌঁছাননি রাস্ট্রক্ষমতার ধারেকাছে।তবু কলম তাঁর
জ্বলন্ত তীর্যক, "তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব---অতিবৈতনিক,/বস্তুত কাপড় পরে
লজ্জাবশত।" আজ যখন ফসফরাসের মতো লিপি-বর্ণ সৃজক শ্রেণি ঠাণ্ডা শীতল ধমনী
নিয়ে পোষ্যের মতো অপেক্ষা করে তখন বুঝতে হয়, "পৃথিবী অচল আজ তাদের
সুপরামর্শ ছাড়া।" একদিন কি এই সত্যিটাই আন্দাজ করেছিলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ
দত্ত, "বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি দেখে,মনুষ্যধর্মের স্তবে/নিরুত্তর,
অভিব্যক্তিবাদে অবিশ্বাসী, প্রগতিতে/যত না পশ্চাৎপদ,ততোধিক বিমুখ অতীতে।"
কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তো থেমে থাকেন নি, লিখেছেন, "সোনার গাছে
চেয়েছিলে হিরের ফুল,/সোনা নিয়েছে ডাকাতে/হিরেগুলো সব অঙ্গার।" শক্তি
আষ্ফালনের ,বিচ্ছিন্নতার পরিকল্পনার দিনে অন্নদাশঙ্কর রায় স্পষ্ট করাতে
চেয়েছিলেন রাস্ট্রের গোপন উপলব্ধি, "দুর্বল ওকে করেছি, হয়েছি/নিজে
দুর্বলতর।" সময়ের ,কালের প্রয়োজনে দৃঢ় হয়ে উঠেছিল কবি অরুণ মিত্রের কলম,
"সাঁজোয়া থাবা বাড়িয়ে সেই বুড়ো জানোয়ার/ছিঁড়তে চেয়েছে
হৃৎপিণ্ড---/বিশ্বাসঘাতী বাঘনখ প্রতিহত---"। চুপ করে যান নি 'মধুবংশীর
গলি'-এর কবি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র। শানিত ভাষা মুক্ত হয়েছে তাঁর
লেখায়।গনদেবতার বিরুদ্ধাচারী শক্তির বিরুদ্ধে নির্ভয় উক্তি, "তোমাকে
দেখেছি বার বার এ শহরে হে দুর্যোধন।/লালসার জতুগৃহে ভস্মীভূত তোমার
চক্রান্ত/এনেছে যুগান্ত।" অথবা আশ্বস্ত করার বাণী, "ইতিমধ্যে প্রস্তুত
থাকো সবাই/যখন অত্যাচারীদের পতন---/চরম পতন হবে।" আজ যখন এই স্বাধীন
রাস্ট্রে মাত্র সাতাশ শতাশ সম্পদ থাকে নিরানব্বই শতাংশের ভাগে,অথচ
অর্থনৈতিক অসাম্যের সেই দেশে এক শতাংশ মানুষ দিব্যি ভোগ করছে একাত্তর ভাগ
সম্পদ।তখন মনে এসে যায় কবি সমর সেনের পংক্তি, "বড়লোকে আস্থা নেই
আর,/দেখেছি দেশের দুর্যোগে/কী উপায়ে কাঁচা টাকা ভাঁড়ু দত্ত
করে।"বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সত্য ভাষনে, "পরস্পরকে নিন্দা করার
উজ্জ্বলতায় নিজের মুখ দেখতে চায় আলো/মিছেই মানুষ নিজের দেশের নিজের দলের
গর্ব করে।" কে ই বা সত্যের লিপিকরণে পিছপা ছিলেন।কবি নীরেন্দ্রনাথ
চক্রবর্তী যেন এ কালের কবিদের সেই মুক বধিরতার গুপ্ত কারণ জানেন, "আমার
সামনে ছিল লোভ।/আমার পিছনে ছিল ভয়।"আর এই দ্বিচারিতা হীন কবি সত্তার শেষ
স্বাধীন কলম কি এখানেই শেষ, "আমি বলতে চাই ,নিপাত যাও/এখনই/বলতে চাই,
চুপ"।কিন্তু যারা বলতে পারেন না শঙ্খ ঘোষ-এর মতো তাদের তো সেই হৃদয়ে
খানখান হয়ে যাওয়া যন্ত্রণা নেই, "কিন্তু বলতে পারিনা, কেননা তার
আগেই/তুমি নিজে/নিজের হাতে ধ্বংস করো আমার ধ্বজা, আমার আত্মা।"
একথা সত্যি যে, কবি তো তার মতো করেই বলবেন।লিখবেন তার
আপন হৃদয়-উৎসার। কিন্তু সময়ের কোনও দাবী কি থাকতে পারে না ? কবির
সত্যপোলব্ধির বিবর্তনও মিথ্যে কিছু নয়।কিন্তু নীরবতা বড়ো ভয়ানক।উদাসীনতা
খুব বড়ো আতঙ্কের।কবি আর লোভী এ দুইএ বিস্তর ফারাক।মনে রাখা তো দরকার ,এই
ভারতবর্ষে একদিন ইংরেজ সরকার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশে চরম বাধা তৈরী
করেছে।মানুষ ভিতরে ভিতরে গুমরে উঠেছে। সংবাদপত্র বা সংবাদ সংগ্রহে এখনও
এই স্বাধীন দেশে পদে পদে নিষেধাজ্ঞা।তবু গৌরী লঙ্কেশ আমাদের আলোকবর্তিকা।
হল কই তেমন প্রতিবাদ, যখন শঙ্খ ঘোষের সাম্প্রতিক তম সত্যানুসারী ভাষ্য
এনে দিলো অপমান।যদিও ঐ তালিকায় সক্রেটিস থেকে গ্যালেলিও কে নেই। মহানেরা
তো চিরটাকাল একই কাজ করে এসেছেন।বারবার সমাজ রাস্ট্রের ভ্রান্তি তাদের
যেমন পীড়িত করেছে,তেমনি প্রখর সৃজনশক্তির জোরে স্রষ্টাও শুধুমাত্র সত্যের
ন্যায়ের তাড়নায় সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বিপরীতে। আর ঐ যে সেই শ্রেণির যারা
শুধু পুষ্পের হাসি হাসবার জন্য সদা বিনীত,মৃদু রহস্যময়, করুণা
প্রত্যাশী----তাদের শীতল সম্ভোগে নির্বিঘ্ন থাকাটা হয়তো অস্বাভাবিক
নয়।হয়তো সেটিও আর এক উন্নততর শোষনের সংস্করণ।
বাংলা কবিতার নির্ভেজাল শক্তি তাই ক্ষয়িষ্ণু বোধ হয় আজ।
দিকে দিকে নব নব সৌন্দর্যের ,প্রেম,প্রকৃতি আর ফুটিয়ে তোলা দেহবাদের
সাধনা সৃজন করে চলেছে বৈচিত্র্যময় কাব্য সমাহার। কিন্তু মানুষ-কবি যদি
ক্রমশ জীবন-অন্ধ, নমনীয়তার প্রামাণ্য প্রাণী হয়ে ওঠে,তবে তাকে আর যাই বলা
হোক সত্য-দর্শনের ভাষ্য নির্মাতা আর বলা চলে না।বাংলা কবিতা তবে অচিরেই
ড্রইংরুম বিলাসের প্লাস্টিক ফুল হয়ে দিনে দিনে সস্তা আর নিস্প্রাণ
বাচালতায় পর্যবসিত হবে। শ্রদ্ধা, শক্তি, দৃঢ়তা আর মুক্তির যে বাণী পথে
জীবন-দর্শন-এর ভগীরথেরা একদিন সুবিরাট গঙ্গা ধারার উৎসারে বিশ্বের
সুমিষ্ট ভাষার উঠোন ভরিয়ে তুলেছিলেন ফসলে আর ফসলে---তার সেই স্রোতস্বিনী
ধারা এই দ্বিচারিতা দোষে শুকিয়ে যাবে একদিন। দিবান্ধ পথিকের মতো সেদিন
শুধু হাতড়ে বেড়াতে হবে সত্য পথের দিশা।সময় কখনও মিথ্যাচারকে ক্ষমা করে
না।
---- অনিরুদ্ধ সেন
বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন