নবান্ন নাটক--আর্থ সামাজিক দিক, সেদিন ও আজ
সম্পা পাল
নবান্ন নাটক যখন লেখা হয়েছিল তখন একদিকে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর
একদিকে আমাদের দেশজুড়ে চলছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে
ভারতছাড়ো আন্দোলন । এর সঙ্গে জুড়েছিল ১৩৫০সালের দূর্ভিক্ষ ।জীবন , সমাজ ,
অর্থনীতি , রাজনীতি কোনো দিকই সেদিন মানুষের বেঁচে থাকার উপযুক্ত ছিল না
। অসংখ্য মানুষ জীবনের তাগিদে পরিনত হয়েছিল উদবাস্তুতে । ভীর জমেছিল
শহরের রাস্তায় । উঠেছিল অন্নের দাবী , প্রানের দাবী । মনুষ্যত্ব সেদিন
ছিল না ।আর্ত , বুভুক্ষু মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল ছিল
পারস্পরিক সহানুভূতি ।
সমাজ ব্যবস্থা ও বৈষম্যেকে সুনিপুণভাবে তুলে ধরে নবান্ন নাটককে পূর্ণতা
দিয়েছিলেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য ।এই নাটকের একই মঞ্চে দেখতে পাই
সমাজের দুই শ্রেণীর মানুষের দুই চরম বিপরীত অবস্থানে দাড়িয়ে থাকা ।
নাটকের প্রধান দৃশ্যে ফুটে ওঠে কলকাতার রাজপথ । সেখানে জীবনযাগরনের দুটো
দৃশ্য একদিকে বিয়ে বাড়ির আনন্দ উৎসব ,আলোর রোশনাই , বিয়ের সানাই, অতিথি
সমাগম, হাজার লোকের আমন্ত্রণ আর অন্যদিকে মন্বন্তর কবলিত মানুষের
হাহাকার আর অবক্ত যন্ত্রণার এক করুণ ছবি যেখানে কুকুর আর মানুষের
খাদ্যের লড়াই । এখানেই উঠে আসে রাধিকা ,কুঞ্জ আর প্রধান নামের চরিত্রগুলো
। ভাগ্যের বিপর্যয়ে একদিন গ্রামের সম্পন্ন কৃষক পরিবারের কুঞ্জ ও
রাধিকাকে দেখা গেলো আলো আধারী ডাষ্টবিনে কুকুরের সঙ্গে উচ্ছিষ্ট ভাগ করে
খাবার ব্যর্থ চেষ্টাকে । আর ওদিকে প্রধানকে দেখা গেলো বিয়ে বাড়ির গেটের
সামনে দুহাত তুলে একমুঠো অন্ন ভিক্ষার করুণ আর্তি । মানবতা বর্জিত সে
সমাজের দেওয়ালে তার আর্তি শুধু ধাক্কা খেয়েছে বারে বার ।কেউ তার আর্তনাদ
শোনেনি । অথচ ডাষ্টবিনে তখন উচ্ছিষ্ট খাবারের ছড়াছড়ি ।একদিন নবান্নের
উৎসবে এদের ঘর ভরে উঠত নতুন ধানে। বিপন্ন এ জীবনে একটা আশার আলো শুধু
বেঁচে উঠেছিল কুঞ্জ আর রাধিকার পারস্পরিক স্নেহ আর মমতায় । কুঞ্জকে
কুকুর কামড় দিলে রাধিকা তার পরনের একমাত্র সম্বল শাড়ি ছিড়ে বেঁধে দেয়
কুঞ্জর রক্তাক্ত হাতে । যন্ত্রণাক্লিষ্ট কুঞ্জ অপলক তাকিয়ে থাকে রাধিকার
দিকে । এভাবেই তারা দুজনে দুজনের কাছে শান্তনা খুঁজে নেয় ।
নবান্ন নাটক লেখার পর ৭০ বছর কেটে গেছে । পরাধীনতার অভিশাপ আমাদের জীবন
থেকে মুছে গেছে । বহু কাঙ্খিত স্বাধীনতা এখন আমাদের জীবনে এসেছে ।এসেছে
দেশের অগ্রগতি ।শুধু
অগ্রগতি নয় সঙ্গে এসেছে প্রযুক্তি । বদলেছে আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থা ।
তবে নবান্ন নাটকের সে চিত্রটা সমাজ থেকে একেবারেও হারিয়ে যায়নি । শহরের
রাস্তায় মাঝে মধ্যেই উঁকি দেয় একটা দুটো এরকমই দৃশ্য । মনুষ্যত্ব তখন
প্রশ্নের মুখে । নবান্ন নাটকের বড়ো কর্তামশাইয়ের মতোই আমরা এখনো মুখ
ফিরিয়ে নেই তারপর যে যার ব্যস্ত জীবনের পথে হেঁটে যাই । আমাদের
মনুষ্যত্ব সেখানে মৃত, কোনো আওয়াজ তোলে না । তারপর যখন বন্যা আসে
গ্রামের পর গ্রামগুলো ভেসে যায় । ভেসে যায় বিঘে বিঘে জমির ফসল । আমরা
শহরবাসী হয়তো সে পরিস্থিতি বুঝতে পারিনা । তবে জীবন সেখানে ভয়ার্ত ।
সেখানেওএকটা অন্নের দাবী ওঠে , প্রানের দাবী ওঠে । ঘর ছেড়ে ওদেরকেও নেমে
আসতে হয় রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে । সব হারিয়ে সেদিন ওরা সত্যিই উদবাস্তু
। আমাদের শহুরে জীবনে তখন শরতের আকাশ আর দূর্গাপুজোর কেনাকাটার আমেজ । কে
কতো সমৃদ্ধ সে প্রতিযোগিতায় আমরা সেদিন মেতে উঠি । এর উল্টো দিকের জীবন
সেদিন কী বিপন্ন সেটা মনুষ্যত্ব দিয়ে বিচার করার সময় তখন আমাদের হয়না ।
অথচ ওরা অন্নের যোগান না দিলে আমাদের ঘরে খাবার আসবে না ।
==========================================
সম্পা পাল, শিলিগুড়ি ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন