কবি জীবনানন্দ সম্পর্কিত কিছু গল্প, কিছু কথা
প্রণব কুমার চক্রবর্তী
"অামাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে, কাজে বড় হবে
মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন
মানুষ হইতে হবে এই যার পণ...." কবিতাটি অাজকাল অার পাঠ্যসূচীতে নেই৷ এক
সময় ছিলো৷ কবির নামটি ইদানিং অপরিচিত হলেও ইনি বাঙলা সাহিত্যের অন্যতম
পথিকৃত্ কবি জীবনানন্দ দাশের মা৷ বাল্যকাল থেকে ছেলেকে কবিতায়
মনোনিবেশ করার জন্য তিনি দেশী -বিদেশী কবিদের কবিতা পড়ে শোনাতেন৷ প্রকৃত
অর্থে একজন গৃহবধূর ওই ধরনের অধ্যাবশায় এবং কাব্য অনুরাগই যে কবির
কাব্যিকমননের জন্ম দিয়েছিলো - সেটা বলাই বাহুল্য৷ জীবনানন্দের কাব্য এবং
সাহিত্যকর্ম নিয়ে বহু অালোচনা হয়েছে; কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কিছু
গল্প, কিছু কথা অাজ আমরা জানবার চেষ্টা করবো৷
কবি জীবনানন্দের পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এবং থানায় রাত্রিবাস :
বাল্যকাল থেকেই কবির পায়ে হেঁটে একা একা ঘুরে বেড়াতে ভালবাসতেন ৷ তাঁর
এইপায়ে হেঁটে পথচলার কথা অামরা বিভিন্ন লেখাতে দেখতে পাই৷ যেমন - "হাজার
বছর ধরে অামি পথ হাঁটিতেছি এই পৃথিবীর পথে "...৷ বলা বাহুল্য , তাঁর এই
একা হাঁটার অভ্যেসটা কবিকে একবার বেশ বিপদে ফেলেছিলো ৷ একদিন গভীর রাত্রে
তিনি কোলকাতার সাদার্ন এভেন্যুর শুনশান রাস্তা দিয়ে একাই হেঁটে যাচ্ছিলেন
৷ হঠাৎ, একটা টহলদারি পুলিশের হল্লা গাড়ি এসে তাঁকে ধরে বসলো ৷ সন্দেহ,
লোকটা নির্ঘাত ক্রিমিনাল ! কোনও অসামাজিক কাজ করতেই এত নিশুতি রাত্রে
একা রাস্তায় বেরিয়েছে ! অফিসার নেমে কী কাজে এবং কোথায় যাচ্ছে জিঞ্জেস
করতেই , জীবনানন্দ কী বলবেন বুঝে উঠতে না পেরে তোতলাতে তোতলাতে বলে উঠলেন
- অামি কবি জীবনানন্দ ৷রূপসী বাংলার লেখক৷
-- লেখক না ছাই ! দারোগাববু হাতের রদ্দা বাগিয়ে বলে ওঠেন - একদম ফালতু
কথা বলার চেষ্টা করবি না ৷ চল থানায় ৷ পেঁদিয়ে ছাল খুলে দেবো ৷ পুলিশের
সামনে মিথ্যে বলা ! বলেই সঙ্গের সেপাইকে বলে - এ্যই ? একে গাড়িতে তোলো ৷
থানায় নিয়ে গিয়ে একটু রগড়াতে হবে৷ নাহলে সত্যকথা কিছুতেই বলবে না ৷ বলা
বাহুল্য, কবিকে সারা রাত থানার লক-অাপে বসে কাটাতে হয়েছিলো ৷ পরদিন সকালে
থানার বড়বাবু থানায় এসে হাজতে কবিকে দেখেই চিনতে পারেন ৷ লজ্জায় গিয়ে
ক্ষমা চেয়ে নিয়ে থানার গাড়িতে করেই ওনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলেন ৷
ভাড়া বাড়ি সাব-লেট দেয়া এবং তাকে উচ্ছেদ করার জন্য গুন্ডার খোঁজ করা :
কোলকাতায় যে বাড়িতে কবি ভাড়া থাকতেন, নিজের অার্থিক অনটনের কারনে বাধ্য
হয়েই তিনি সেই বাড়ির একটা ঘর অন্য একজন মহিলাকে সাব-লেট দিয়েছিলেন৷ ওই
মহিলা একটি বীমা কোম্পানীতে কাজ করতেন ৷ খুব অল্পদিনের মধ্যেই বোঝা যায়,
ওই মহিলার চাল-চলন এবং হাব ভাব খুব একটা রুচি সম্মত ছিলো না৷ প্রায়শ
ওনার কাছে অনেক পুরুষ মানুষ অাসতো এবং বহু রাত্রি পর্যন্ত অানন্দ-ফুর্তি
এবং নাচ - গানা করতো ৷ ব্যাপারটাতে কবির লেখালেখির খুব অসুবিধা হতো ৷
কবি ওই মহিলাকে ব্যাপারটা কন্ট্রোল করার জন্য বারবার অনুরোধ করেও কোনও
লাভ না হওয়ায়, ছুটেছিলেন প্রথমে পুলিশ এবং পরে অাদালতে ৷ কিন্তু, সেখানে
কোনও সাহায্য না পাওয়াজ, কবি খোঁজ করা শুরু করেছিলেন গুন্ডার ! ওই
মহিলাকে গুন্ডা দিয়ে উচ্ছেদ করাবেন বলে ৷ পথে কবিবন্ধু বীরেন্দ্রনাথ
চট্টোপাধ্যায়ের সাথে দেখা ৷উনি সব শুনে হেসে বলেছিলেন - ভায়া ? গুন্ডা তো
অার বাজারী সওদা নয় যে গেলেই কিনতে পারবে ? অার যদি গুন্ডা তোমার অন্দরে
ঢুকে পড়ে, প্রথমে হয়তো মহিলাটিকে উচ্ছেদ করতে পারবে৷ কিন্তু, পরে তো সেই
গুন্ডা তোমার ঘাড়ে উঠে নাচবে, তোমাকেই উচ্ছেদ করে ছাড়বে। ব্যাপারটা তো
ঠিক! জীবনানন্দ খানিকটা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কবিবন্ধুর দিকে তাকিয়ে থেকে
শেষে বলেছিলেন - ঠিক বলেছো ভায়া ৷ ওসব না করাই ভালো ৷
লাজুক স্বভাবের লোক জীবনানন্দ :
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে একবার দু দিন ব্যাপী একটা সাহিত্য
সম্মেলনের অায়োজন করা ছিলো ৷ ওই সম্মেলনের অায়োজক ছিলেন - ডি কে অর্থাৎ
দিলীপ রায় ( দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ছেলে ) ; অার যুগ্ম অাহবায়ক ছিলেন
নীহার রঞ্জন গুপ্ত এবং অাবু সৈয়দ অায়ুব৷ অন্যান্যদের সাথে জীবনানন্দ দাশও
ছিলেন ওই সম্মেলনের অামন্ত্রিত কবি ৷ সবাইকে মাইকের সামনে ঠিক মতো
বক্তব্য রাখতে শেখার জন্য উদ্যোক্তারা অভিনেতা শম্ভু মিত্রকে ভার
দিয়েছিলেন৷ সবাই এসে শিক্ষণ শুরু করলেও জীবনানন্দ এসে পৌঁছাতে পারেননি ৷
কিন্তু, যখন এসে পৌঁছেছিলেন তখনই ফাংশান শুরু হচ্ছিলো৷ ওকেই প্রথমে তুলে
দেয়া হয়েছিলো কবিতা পাঠের জন্য ৷ হাজার খানেক শ্রোতার সামনে বলতে উঠে কবি
বেশ ঘাবড়ে গিয়ে গড়গড় করে প্রায় পাঁচ-ছয়টা কবিতা রিডিং পড়ার মতো বলে ,
মঞ্চ থেকে নেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন - বাববা ৷ বাঁচা গেল ৷ অার
জীবনে কবি সম্মেলনে কবিতা পড়তে অাসবো না ৷
কবির সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার পুরস্কার পাওয়ার পেছনের গল্প :
সালটা ১৯০৫ সাল কেন্দ্রীয় সরকার সেই বছরেই "সাহিত্য একাদেমি
পুরস্কার " চালু করেছিলো ৷ সেই সময় কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রি ছিলেন
অধ্যাপক হুমায়ুন কবির মহাশয় ৷ উনিই বাংলা থেকে জীবনানন্দের নাম সুপারিশ
করেছিলেন পুরস্কারের জন্য ৷ অবশ্য সেই সময় বাংলার অন্যতম দাবীদার ছিলেন
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় মহাশয় ৷ তিনি নিজেও ছিলেন সুপারিশ কমিটির অন্যতম
সদস্য ৷ নাম সুপারিশের ব্যাপারে বেশ ঝামেল হয়েছিল৷ বাধ্য হয়ে হস্তক্ষেপ
করেছিলেন মন্ত্রী মহাশয় নিজেই ৷ বলেছিলেন - এবারে জীবননন্দর নামটাইযাবে
৷ অাসলে ওই সময় পুরস্কারের অার্থিক মূল্য ছিলো ৫০০০ টাকা ৷ এবং সাহিত্য
একাদেমি পুরস্কারের জন্য যে কাব্যগ্রন্থের প্রয়োজন ছিলো, কার্যত সেই
গ্রন্থ কবির বন্ধুরা নিজ উদ্যোগে টাকা তুলে ছাপিয়ে দপ্তরে পাঠিয়েছিলেন
৷ বন্ধুদের উদ্যোগ অার কবির সাহেবের জেদজেদই কবিকে মরনোত্তর সাহিত্য
একাদেমি পুরস্কার পাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিল৷
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ কিন্তু শ্লীলতা অশ্লীলতা এবং ঈশ্বর
নিরীশ্বর বাদের তত্ত্বে বিশ্বাসী না হলেও , মানুষের ভেতরের এক ধরনের
নিয়তিবাদ ওমানুষের ক্ষমতার সীমা এবং শিল্পের অপরিণামদর্শিতায় বিশ্বাসী
ছিলেন ৷ অাসলে, কবি বিশ্বাস করতেন - মানুষের ভেতরের সততা এবং নৈতিকতাকে৷
ঋণ : অাব্দুল মান্নান ,অাশিস সান্যাল , মৃণাল মাইতি , প্রমুখের লেখা
প্রবন্ধ / নিবন্ধ থেকে তথ্য সংগৃহিত ৷
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন