কবি শেখ সামসুল হকের কাব্য শক্তি
ড. নাসরীন সুলতানা
কবি শেখ সামসুল হক পারিপাশ্বিকতা থেকে মোহমুক্তি চেয়ে; নিরাসক্তভাবে
স্বাধীনতার সুখ অনুভবের সংশ্লেষণের সাথে জাগতিক আবিষ্টতার মন্ময়তা কবিকে
সত্যিই স্বাধীনতার সুখ দিয়েছে রমণীয় স্বাধীনতা। রমণীয় স্বাধীনতা
কাব্যগ্রন্থে মুক্তির সাধ পেতে মুক্তির আকুলতা যেমন তীব্রতা পায়নি, তেমনি
মোহ নির্মোহ দৃষ্টিতে ব্যক্তির স্বাধীনতা দেখেছেন। এ যেন অনেকটা ঘুড়ি
খেলা- নাটাই হাতে ঘুড়িকে আকাশে উড়তে দেয়া আবার ঘুড়ির বেশী স্বাধীনতায়
বাধা এ যেন দৃশ্য অদৃশ্য খেলা। স্বাধীন সত্তায় সুখ তীব্রতা ছড়ায় না।
রমণীয় আমেজে বিভোর থাকে। স্বাধীন হওয়াটা বড় গোলমেলে। এ যেন কবি নিজের
কাছে নিজে স্বাধীন। রূপের জগতে মায়ার জগতে মানুষ কি স্বাধীন ? এ যেন কবির
ডুব সাঁতার। কবি কবিতা আলোচনা করলে কবিত্ব শক্তির পরিচয় পাওয়া যাবে।
'হেমন্ত স্পর্শে' কবিতায় বাঁজখাই যাপিত জীবনের রমণীয় শরৎ অসীমতার মাঝে
চিত্রকল্পে কবি হেমন্তের কাব্যময় সন্ধ্যার বর্ণিল রূপময় জগতের খন্ড খন্ড
চিত্র বর্ণনায় হেমন্তের স্নিগ্ধ রূপায়নে প্রাণের অস্তিত্ব যেন ঘোষিত
হয়েছে। আর এ প্রানের স্পন্দনে কবি কালোত্তীর্ণ প্রেমিক বলেছেন :
.................................
বাউল বাতাসে ভূ-তটে ঝুকে পড়ার
দৃশ্য সস্তা দামে ভাল কিছু পাবার
শখ শহরতলীর কৃষ্ণ যুবকের কাছে
মনোহর লাগে বেশ কৃত্রিম নয়
...............................।
'উর্বশী আসে না' কবিতায় ভালোবাসায় প্রাণ শক্তিতে ভরপুর। প্রেমিক মন
মাত্রই অশান্ত অতৃপ্ত। উদ্দাম প্রেমে মাতোয়ারা হতে পারে। বৃষ্টিস্নাত
হলেও প্রকৃতি দূরে সরে যায়, নদীতে যেন সুরের ঐকতান নেই: নিঃশ্বেষিত জীবন
তখনই অতীতের জানান দেয়। তীব্র আলোর ঝলকানীতে মাতোয়ারা জীবনের অবিশ্রান্ত
কলধ্বনি এ বোধ শুধু অপলক ভালোবাসাই এনে দিয়েছে। কবি মাত্রই স্বাধীন। এ
স্বাধীন বিলাসী মন প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়ায় সদা ব্যগ্র জ্যোস্নার প্রথম
প্রহরে। জোনাকীর আলোর নেশায় বিভোর হতে চায় মানুষের কোলাহলে কবি মন :
......................................
কেবল ভালবাসতে জানলে পৃথিবী
সুন্দরের জয় ললিতা দু'হাত ভরা
......................................।
ভালোবাসায় পৃথিবীর সত্য সুন্দর চিরন্তণ রূপ পায়। 'অপেক্ষা' কবিতায় আলোকিত
জগৎ যখন অকৃত এবং অনিবার্য সেখানে জীবনের নানান চড়াই উৎরাই ঘাত-প্রতিঘাত
অনিবার্য। বাধা আমলের সহাবস্থান করেও সুন্দরের সাধনায় অবিচল হলে বর্ণিল
জগৎ শতরূপে মানবীয় শীর্ষে নিয়ে যায়।
প্রকৃতি বিজ্ঞানময়। প্রকৃতি জগতকে নিত্য নতুন প্রাণ দান করে। কবি এ প্রা
কবিতায়। তবু কখনো কখনো একদিকে প্রকৃতিরই নিষ্ঠুরতা, অন্যদিকে প্রকৃতির
সন্তান মানুষ সৃষ্টিকে ধ্বংস, ভালো যা কিছু কখনো বাধাগ্রস্থ করে তোলে।
তাই বলে সৃষ্টিশীল প্রাণ থেমে থাকে না। ঘরে বাইরে নানান প্রতিকূলতাকে জয়
করে জীবন জগতকে অনন্ত অক্ষয় চলিষ্ণু করে রাখে। তাছাড়া আমাদের দেশের
সৃষ্টিশীল মানুষ ত্যাগে, সহিষ্ণুতায়, বীরত্বে বিজয়ের ধারাবাহিকতায় অনন্ত
অক্ষয় :
................................................
অক্ষয় অমর যুগ যুগান্তর আদিত্য প্রত্যয়ে
আকাশ মাটির কণ্ঠে ভাটিয়ালী বিস্তার বিজ্ঞানে।
'সাহস' কবিতায় স্বার্থের দুনিয়ায় লাভ-ক্ষতির হিসাব নিকাশের দর কষাকষিতে
কাঙ্খিত চাওয়া পাওয়া যায় না কখনো কখনো। তাই কবির সরল উক্তিঃ
.............................
যুদ্ধ যুদ্ধ করে সবকিছু
খোয়া যাক সোজা পথ বাঁক
করে লাভ হয় না কখনো
............................।
তাই দৃশ্য -অদৃশ্যের হাতছানিতে অন্ধের সত্য লাভের হাতড়ানো ব্যর্থ চেষ্টা।
তাই জীবন সংসার রণক্ষেত্রে সাহসিকতাই সুন্দরের আলোর দিশা :
...........................
যুদ্ধের কঠিন পথ চলা
পাথর ঘামায় দিক চিহ্ন
সাহস যোগায় কাছে এসে।
কবি দিলওয়ার ক্রোধকে জাতীয় সম্পদ বলে নন্দিত করে বাঙালীর অতীত গৌরবের কথা
স্মরণ করে বাঙালির মহিমান্বিত রূপকে যেন স্মরণ করেছেন। কবি শেখ সামসুল হক
যেন সেই অতীতের বাঙালির শৌর্য সাহস বীরত্বের কথা স্মরণ করে কবিতায়
বর্তমান অরক্ষিত সমাজের কথা মনে করেই অতীতের ছায়া যেন তার কবিতায় ম্লান
মনে হয়। তাই কবি এ অরাজকতার বলহীন জাতীয় ক্ষয়িষ্ণুতার কথা ভেবে ক্ষোভে
ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ স্বৈরনী প্রেমিকাকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে যেন বাঙালির সেই
ক্রোধকে আবার জাগ্রত হবার স্বপ্ন দেখেছেন। হত্যা না হোক চলার সাহস তো
অর্জন করেছেন। এ যেন অতীত বীরত্বের পূর্ণজাগরনের চেষ্টা। এ কবিতাকে আমরা
বীরত্বের রেঁনেসাস বলতে পারি। আর আমরা কতিপয় নষ্ট চরিত্রের দ্বারা বীরের
কীর্তিকে ম্লানতার দিকে নিয়ে যেতে পারি না। রাজনীতির নামে ক্ষমতার লড়াইকে
মোক্ষম সুযোগ লাভের উপায় হিসাবে নষ্ট চরিত্রের দাপট মানবিক জীবন নষ্ট
ভূমিতে অবনমিত হবে; এর জন্য চাই প্রতিবাদ প্রতিরোধ। তাই সাহস সঞ্চয় করে
কবি যেন রেঁনেসাসের সেই অমোঘ বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন :
..................................
কিংকর্তব্যবিমূঢ় নি:শ্বাসের
ভিড়ে অস্থির প্রহর গুণে গুণে
বেঁচে যাবার নাটকে অভিনয়
তবু মন্দের ভেতর ভাল কিছু
এটা চলার সাহস খুঁজে মরি।
'বৃষ্টির প্রার্থনা' কবির সমস্ত জড়ত্ব থেকে মুক্তির আকাঙ্খা। তাপদগ্ধ
হৃদয়ের প্রার্থিত কামনা শান্তির অমিয় ধারায় স্নাত হতে। যেমন করে প্রথম
বৈশাখের জড়ত্ব ঘুচিয়ে দিগবিদিক মাতাল হাওয়ার দাপাদাপির সাথে বৃষ্টির তোড়ে
ভেসে যাওয়া। এ যেন কবির হালকা চালের অশান্তিময় রাজনৈতিক উত্তাপে দগ্ধ
দেশবাসীর শান্তির কামনায় বেমাতাল উচ্চারণ :
....................................
বৃষ্টি ধ্বনি উচ্চস্বরে চিৎকার করে
খুনে লাল হয় হোক বিশ্ব চরাচর।
'মিছিলে শরীক হতে' কবিতায় ধাবমান সময়ের স্রোতে ভেসে চলা জীবনের কালিক
বাস্তবতা। চলমানতা যেখানে জীবনের স্পন্দিত প্রাণের সঞ্চার সেখানে সময়ের
সাথে তাল না মিলিয়ে জীর্ণ জড়তাকে আঁকড়ে ধরা। তাই কবি সময়ের মিছিলের সাথী
হবার প্রাগ্রসর চেতনার বহিঃপ্রকাশ করেছেন এ কবিতায় :
..........................................
জেনেও বসে থাকার মানে নেই
মিছিলে শরীক হতে দেরী করলে ঠকতে হয়।
'বৃষ্টি পাগল' কবিতায় দেখি সমাজ এখন বড় ভন্ডদের হাতে চলে যাচ্ছে। এদের
হাত থেকে সমাজকে শান্তিময় করতে প্রচন্ড আঘাত প্রয়োজন। বৈশাখ যেমন ঝড়ো
তান্ডব এনে প্রবল বর্ষণ ঝরিয়ে দাবদাহের অবসান ঘটায় তেমনি ভন্ডদের কবল
থেকে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া শ্যামলিমা বাংলাকে শ্যামলতায় ফিরিয়ে আনলেই কবির
প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ মন শীতল হবে :
.....................................
কালি ঝুলির বৈশাখ কোথায়
ফিরে এলেই বেঁচে যেত রুদ্র মন।
'যখন বসন্ত' কবিতায় হেয়ালী অস্থির কবি মনকে রঙিন সময় টানতে পারে না। কবি
যে বড় স্বাধীন সত্তার অধিকারী সুখ স্বপ্ন ধরার মধ্যে হলেও কবির নেয়ার
ইচ্ছে খেয়ালী তার সুর রেখে বলেছেন :
...........................................
দেখতে পাইনা বুঝতে পারি অনায়াসে
ভালো লাগে ভালো লাগে না এমনটা
ভেতরে বাইরে চলছে ধুলি ঝড় তুলে
........................................।
'সুখ বসন্ত নিহত নিবাসে' কবিতায় বসন্তের আগমনে কবির পাওয়া যেন কানায়
কানায় পূর্ণ। সুরের মায়াজালে আবিষ্ট কবি। কিন্তু যন্ত্রণাদগ্ধ কবি
সুন্দরের মধ্যে বসন্তের আবিলতায় মগ্ন থাকতে চান :
..................................
একা দাঁড়িয়ে নিজেকে হারিয়ে
বিশ্ব বসন্তে অবাক অশান্ত
................................।
'শীত সময়' কবিতায় ব্যস্ততায় আমরা যেন পরিবেশ প্রতিবেশকে এড়িয়ে চলি।
চারপাশের পরিবর্তন যেন আমরা খুব একটা আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করি না। এ
ঐতিহ্য হারিয়ে আমরা যেন নৈর্ব্যক্তিক হয়ে পড়ছি :
................................................
যোগ বিয়োগ ভাগ গুণের নিয়ম মাফিক
নিত্য অনিত্য বায়ুকলের বাজনা বাজায়।
'ঝাউ তুফানী জীবন' কবিতায় প্রকৃতি বিলাসী কবি জীবনে নানা ঘাত প্রতিঘাতের
মধ্য দিয়ে স্নিগ্ধ সকালের অপেক্ষা সুখের অন্বেষায় মগ্ন থাকেন। প্রকৃতি
নানা প্রান্তে জীবনের আয়োজন করে। পাওয়া না পাওয়ায় হতাশ না হয়ে ইচ্ছে
শক্তির কাছে সমর্পিত হন ঃ
.................................
ইচ্ছের প্রবল বায়ুর চাপকে নিয়ে
একটুও বিচলিত নয় আজ অবধি।
'উর্ধ্বগতি' আত্ম উন্নতির চেষ্টা 'পরিবর্তন' কবিতায় চলার পথে
প্রাত্যহিকতায় ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমরা পরিবর্তিত হয়ে সুন্দরে
বিলীন হই। কবি কখনো কখনো সময়ের কাছে দায়বদ্ধ। সমকালের ঘটনা কবিকে আলোড়িত
করে। 'বিদ্রোহী শাহবাগ' কবিতায় গণজাগরণ কবিকে উদ্বেলিত করে তোলে। কবি
তারুণ্যের জাগরণে আশাবাদী হন। চারদশকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে
বিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামস অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রুদ্ধ ছিল। এ
প্রজন্মই পারে আশা বাণী শোনাতে। তাই বলেছেন :
...................................
স্বাধীনতার চেতনার সূর্যোদয়
শাহবাগ বাজায় দামামা নির্ভয়ে।
'একটি বুলেটের জন্য' কবিতায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালির
সাহসীকতার প্রতিধ্বনি। 'স্বাধীনতা চর হাজীগঞ্জ' মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতায়
সহযোদ্ধার প্রতি বয়ান যেনো মূর্ত হয়ে উঠেছে। লাখো শহীদের আশ্রয় প্রকৃতি
নিজ বুকে দিয়েছে। সমাজ সংসারে যুদ্ধ কখনো শেষ হয় না। কবির নতুন যোদ্ধার
আকুতি :
..............................
জমির বিশ্বাস কর আজকে আমিও তাই
তোর কাছে যেতে চাই
...............................।
যোদ্ধারা কালোত্তীর্ণ একজনের শূন্যস্থান আরেক জন পূরণ করে। এটাই মানবীয়
ধর্ম। এছাড়া 'রমণীয় স্বাধীনতা' কাব্যগ্রন্থে কবির বেশীর ভাগ কবিতায়
সময়োপযুগি বিজ্ঞানকে ধারণ করেছে। কবিতা গুলো আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা
যায় কবি শেখ সামসুল হক সময়, সমাজ, সমকালকে তার বোধ দ্বারা চালিত করেছেন।
যা তার কবি সত্তাকে মানবিকতায় রূপদান করেছে। ফলে তার কবিত্ব শক্তিকে
শাণিত ও সময়োপযুগি করেছে যা সমকালীন আধুনিক। এখানেই তাঁর কাব্য শক্তির
মহিমা প্রকাশিত হয়েছে।
কবি
ও
সহকারী অধ্যাপক, নরসিংদী
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন