বহুরৈখিক কাব্যকৈবল্যে সিদ্ধ কবি কুমারেশ তেওয়ারী
জুবিন ঘোষ
কুমারেশ তেওয়ারী যার বহুরৈখিক কবিতায় তীর্যক শব্দসঙ্গম সমসাময়িক কবিতার
স্থিতাবস্থাকে ভেঙে কলাকৈবল্যের চূড়ান্ত উচ্চতর বাস্তবে উত্তীর্ণ করেন।
এশিয়ার একসময়ের বৃহত্তম সি.সি.আই.এল সাইকেল কারখানার সংলগ্ন কন্যাপুর
গ্রামে আসানসোল শিল্পাঞ্চলে সত্তরের পটসময়ে জন্ম এই কবি তার কৈশোরের
প্রথম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটি দুর্ভাগ্যবশত হারিয়ে ফেললেও সেটাই হয়তো ছিল
এখনকার কবিতার প্রস্তুতি। সি.সি.আই.এল সাইকেল হয়তো হারিয়ে গেছে কিন্তু
স্পোকের নৈপুণ্যে যেভাবে তার দ্বিচক্র পরিশীলিত ব্যাস বজায় রাখতে পারে
ঠিক সেইভাবেই যেন কুমারেশ তার কবিতায় ভাবনা ও কবিতার টোন-টেকনিকগুলোকে
স্পোকের মতোই সাজিয়ে কবিতার গঠনশৈলীকে বহুরৈখিকতার বাহান্ন তীর্থে
অযান্ত্রিক আহ্বান জানান। বাংলার বহু বাণিজ্যিক-অবাণিজ্যিক পত্রিকায় তার
সমসাময়িকদের সংকটের নিমিত্ত হিসেবে বিচরণ করতে করতে ইতোমধ্যেই কবির চারটি
কাব্যগ্রন্থ কবি সম্প্রদায়ে তুমুল হট্টগোল পাকিয়ে ফেলেছে আর সেখানেই কবি
কুমারেশ এতদিনকার প্যানপ্যানে কাব্যধারাকে অধিদমন করে চিরাচারিত
লালিত্য্যের ওভারকোট খুলে আন্ডার-গারমেন্টের বিউটিস্পটকে উন্মোচিত
করেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'নেমে আসা অন্ধকারে' আসানসোলের কৃষ্ণ মৃত্তিকা
প্রকাশনীর থেকে প্রসূত হয়েছিল। সূচনাপর্বেই অন্ধকারের সঙ্গে বেসাত করতে
করতে ডার্কনেসকেই কবির আঁতুড়ঘর করেছিলেন। আলোর ভূমিকা অন্ধকারের
অস্তিত্বভিন্ন অর্থহীন, আঁধারকেই আধার করে লঘুচিত্ত থেকে ক্রমশ বীতশোক
সন্ন্যাসীর মতো নতজানু হয়েছেন পবিত্র তমসায়। পরের কাব্যগ্রন্থ 'জুড়ন
পুকুর' প্রকাশ্যে আসে জানুয়ারি ২০১৩-তে প্রিয়শিল্প প্রকাশনীর হাত ধরে।
পরমাধ্যা মা-কে উৎসর্গ করে এই অসাধারণ কাব্যগ্রন্থটি আটান্নটি কবিতায়
হরিদ্রাবর্ণে হেমন্তবৈরাগ্য ছড়িয়ে দিয়ে যায় আজকের কুমারেশের পূর্বসূরির
সামগ্রিক লক্ষ্মণ নিয়ে। কিন্তু এই কবিতাগুলো বৈচিত্র্যে উচ্চকামী হলেও
নৈপূণ্যে শুরুয়াৎ ভূমিকায় অপেনিং সেরিমনি বলা ভাল। অনেক ভাল ভাল কবিতায়
সমৃদ্ধ জুড়ন পুকুর কাব্যগ্রন্থটি, যেমন 'সাপুড়ে' কবিতায় কুমারেশ লিখছেন
"আর্সেনিকের ছোবল খেতে পারি / গুণ্ডাগর্দি করুক ফোস্কাপোড়া। / বিদ্রোহী
হই ঝাপটানো মুখ দেখে / ফড়িং ডানা মুচড়ে ভেঙ্গে ওড়াও" --- কী অপূর্ব
শব্দের জাগলিং। কুমারেশের স্বতন্ত্র গভীর কথনের আশরীক গন্ধরেণুটি ওখানে
কাব্যমক্ষীর মেহফিলে অতি সঙ্গোপনে সহজেই দৃষ্টি মোচড় করে। একজায়গায়
কুমারেশ আপেলের অলংকরণে ব্যবহার করছেন --- 'আপেলের প্রিয়ংবদা মুখ'। সেই
কবিতার শেষটা ওপেন এন্ডিং-এর অপূর্ব উদাহরণ হিসেবে চিহিত হতে পারে;
সেখানে কবি শেষ করছেন এইভাবে, "এরপর যা কিছু দেবোত্তর দেবোত্তর" যা
চাপল্য বর্জিত মেধার ক্রমিক বিকাশে কনকশালি ধানের মতো সুভাস গাঢ়ত্বমগ্ন
করে। এক রণভূমির প্রস্তাবক হিসেবে 'রণভূমি থেকে' কবিতায় হাতের যাবতীয় তূণ
যেন সাজিয়ে রেখেছেন পাঠকদের জন্য, এই শব্দব্রহ্ম বাণের সামনে নিশ্চল
শরশয্যায় যেতে এমনকি ধীমান পাঠকদেরও আপত্তি দেবে না, কুমারেশ লিখছে,
"রণভূমি থেকে সহসা পালালে / কাপুরুষ তির এসে দেয় বিদ্রুপ চুম্বন? / যুদ্ধ
তো করেছি খুব গৃহস্থ মানুষ / ক্ষতচিহ্ন আশরীর তারই প্রমাণ।" এ যেন কবিতার
চারুশিল্পে বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ঢেলে দিচ্ছেন কবি কুমারেশ। এই যে রণভূমি
কবি কুমারেশ প্রস্তুত করে দিচ্ছেন আগামী তরুণ প্রজন্মের জন্য সেই
শমীবৃক্ষ থেকে অস্ত্র নামিয়ে কুয়ারেশের দেখানো পথে চলাই এখন তরুণদের
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে আকর্ষণ করে কুমারেশের নতুন আঙ্গিকের
অলংকরণের অন্বেষণ যা কিন্তু আসলেই একজন সাধনমগ্ন কবিরই বিশিষ্টতা। পরের
কাব্যগ্রন্থ 'মিরর এফেক্ট' প্রকাশ করে প্রায় চারবছর পরে কবিকে আবার
গ্রন্থভুক্ত করে কবিতা পাক্ষিক প্রকাশনী। এই আয়নার পেছনের পারদের
বৈচিত্র্যও বিবিধ। এই ২৮টি কবিতা কবিকে একটা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যে
রূপপ্রদান করতে সার্বিকভাবে সমর্থ হয়। পোস্টমর্ডান কবিতার প্রথম দশকের
ভাঙাগড়া এই কাব্যগ্রন্থের উপজীব্য হয়ে ওঠে। শব্দের এক অপূর্ব বিনির্মাণে
'শিল্পকলা' কবিতা সত্যই শৈল্পিক হয়ে ওঠে। হৃদয়ের প্রান্তরে ছন্দের
দুন্দুভি --- উপলব্ধ জৈবনিক সত্যতায় শঙ্খে বাদ্যে এখানে যেন অভিষেক হয়েছে
কবির। ব্যতিক্রমী বিশেষণে উঠে আসছে নতুন কলমের অভিব্যক্তি, কবি লেখেন,
"পাহাড় থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে আসে যে পাথর/ তার কোনো টার্মিনাস নেই অতবা
ব্যালকনি" (মেটাফর); অথবা মিরর এফেক্ট কবিতায় "একটি কাচ তখনই আয়না হয়ে
ওঠে / যখন তার পিঠে সেঁটে রাখা হয় তুষ্ট রেডঅক্সাইড" এ-তো সেই
শব্দার্থেরই উন্নতি, আদি অর্থ পরিহার করে অন্য সৌন্দর্যে উঠে আসা
বাচ্যার্থ। এই কবিতা কোনও বিশেষ স্পেসের কবিতা নয়, বরং পার করে যাচ্ছেন
বহুরৈখিক সফর। অবশ্য বহুরৈখিক হলেও মূল বৈশিষ্ট্য হলেও ভেতরে থাকে
সাঙ্কেতিক মনবেদনা, স্মৃতিভাষ্য যা নিঃশব্দ জলধারাকে আহ্বান করে পরিশেষে
বৃত্ত সম্পূর্ণ করে স্মার্ট উচ্চারণ। 'ট্রেকিং রুট' কবিতায় কমলেশের
পঙ্ক্তি "কোয়ান্টাম তত্ত্বের দিকে উড়িয়ে দিচ্ছি কবুতর / আর দেখছ কীভাবে
জ্বলে ম্যাগনেট" পড়লেই বোঝা যায় কবির চিরাচরিত কাব্যধারার বিপরীতমুখী
স্রোতের অঙ্গীকার করেই মাঠে নেমেছেন। মিরর এফেক্টের পাশাপাশি একই বছরে
কবি কুমারেশের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ 'ব্যালেরিনা ও নকশি কাঁধায় নষ্ট গন্ধ'
যাকে প্রসূতি যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয় প্রতিভাস প্রকাশনী। তবে এই
কাব্যগ্রন্থটির ব্লার্বে যে যে কথাগুলো লেখা হয়েছে সেটা যেন দায়সারা গতে
বাঁধা বলেই মনে হল। আরও মনোযোগী পর্যবেক্ষণ ব্লার্ব থেকে পাঠকরা আশা করে।
কুমারেশের কবিতা আলট্রা মেটাবলিক, তার স্বাদু প্রকৃত কবির মানসিক
ভিত্তিভূমি তৈরি হতে যে সব ক্যামিক্যাল প্রয়োজন তার সবটুকুটাই রয়েছে এই
তরুণ কবির করতলগত। বেশ কিছু শব্দ প্রতীক হয়ে আসে। কমলেশের কবিতাকে
বিন্য্যাস থেকে বিযুক্ত করে দেখা কঠিন। এমন কবিতার সঙ্গে মাটির অনায়াস
সাঁদ হয়তো করে নিতে পারে না সাধারণ পাঠক মন কিন্তু জৈবনিক দিনগত বিশ্বাস
যেন অবিশ্বাসী দুঃস্বপ্নের মতো চাপা পড়া চেতনাকে প্রলেপের অন্তরালেও
স্পর্শ করে অকাতর। সেই বহুরৈখিক চরাচর পাড় ভাঙে-গড়ে কবির মননে, উপলব্ধ
সত্যের প্রমত্ততায় সমৃদ্ধ হন কবিতা পাঠক, স্যুরলিয়েলিজমের সূক্ষ্ম টাচে
দোলা লাগে প্রস্তাবিত নকসি কাঁথায় যা বেঁচে থাকার নস্টালজিক দৈনন্দিন
তাড়নাতেও দুলে ওঠে। তবে প্রতিভাসের এই বইতে চন্দ্রবিন্দুর পজিশনে অনেক
ভ্রান্তি রয়েছে, যেমন কাঁথায় শব্দটি অভ্রতে লিখতে গেলে চন্দ্রবিন্দু পড়বে
আকার এর উপরেই, কিন্তু ছাপার অক্ষরে বিশেষ করে একটি বিখ্যাত প্রকাশনীর
ক্ষেত্রে আকারের উপর চন্দ্রবিন্দু পড়াটা বাজে ভুল। বইয়ের ভেতরের পাতার
প্রথম নামপৃষ্ঠাতেই বইয়ের নামেতেই এই ভুল চক্ষুপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এরপর ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩ পাতায় পাতায় চন্দ্রবিন্দুর ভুল। সারা বইতে কোনো
বানান 'কোনো' কিন্তু ৩৩ পৃষ্ঠায় সেই বানান 'কোনও' বানান। এমনকি ৫০
পৃষ্ঠায় একই কবিতায় দুইরকম 'কোনও' এবং 'কোনো'। প্রুফ রিডার কি ঘুমিয়ে
ঘুমিয়ে প্রুফ দেখছিলেন? ৫৮ পৃষ্ঠায় 'নয় অনুগত' কবিতার শেষে তিন ধরনের
যতিচিহ্ন একসঙ্গে বসেছে। এটা কুমারেশের ক্যালমা ধরে নিলাম কিন্তু তাতে
কিছু বাড়তি উপার্জন বা ভাবোদয় ঘটল না পাঠক মনে। এইটুকুই ধরে নিলাম
যতিচিহ্ন এখানে কবির অনুগত হয়নি। যাইহোক 'ব্যালোরিনা ও নকশি কাঁথায় নষ্ট
গন্ধ' কাব্যগ্রন্থে কুমারেশের যেটা সবচেয়ে বেশি ভাল লাগল যে সমগ্র
কাব্যগ্রন্থে মাত্র তিনটে 'মতো' শব্দের ব্যবহারে সরাসরি উপমা। মানে
সরাসরি উপমাকে বর্জন করার কুমারেশের সচেতন প্রয়াসটা এক্ষেত্রে নজর কাড়ল।
আয়না কবিতায় কবি লিখছেন "ভেঙে পড়ার মুহূর্তে আগে আয়না লুফে নিচ্ছে
প্রতিবিম্ব / আমার ভেঙে গেলে কীভাবে বাইসনের লড়াই / দেখতে দেখতে দৃষ্টি
ফেরানো আন্তরিক হরিণীর দিকে", 'পোট্রেট' কবিতায় "বেড়ালের থাবার ভেতরে যে
কোনো পাখিকে দেখলেই / ভাবতে বসি মেটাবলিজম্ ধীরে করার প্রসেস" --- দেখা
যাচ্ছে প্রতিটা কবিতার সূচনা পদটিতে মনুষ্যাতীত সত্যের আকর প্রোথিত
রয়েছে। এইভাবেই শিল্পের বোধস্পর্শ মুগ্ধতা এনেছে কবির লেখনী নিঃসৃত
উপস্থাপনায়... একরৈখিক বহুকালীন লালিত্যময় উপস্থিতির তন্তুজাল কেটে
বেরিয়ে এসেছেন তিনি যার ভাব বিস্তার অমেয়। আসলে কুমারেশের সার্থকতা তিনি
বোধকে পাহাড়চূড়ায় না নিয়ে গিয়েও বোধকে আমাদের পরিমণ্ডল থেকেই সাম্যক
চিনিয়েছেন কেবলমাত্র বিচ্ছিন্ন বস্তু ও ভাবনার চিত্ররূপময়তার সাহায্যে যা
খুব একটা সহজ নয় যেকোনো কবির কাছেই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন