ছড়ার সাতকাহন
সাবানা সিরাজ
বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম ও প্রাচীন শাখা হল ছড়া সাহিত্য । 'ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি' গোছের লোকায়ত ছড়া গানেই বোধ করি বাংলা শিশু সাহিত্যের সূচনা । প্রায় দেড়শো বছরের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে ছড়া সাহিত্যের নানা উৎকর্ষতা ও বিকাশ লক্ষণীয় । বাংলার লোকসমাজে তখন ছড়াই ছিল ভাব প্রকাশের এক মাধ্যম । সেহেতু লোকসাহিত্য নামে ও ছড়ার বিশেষ পরিচিতি । অনেকে আবার বলেছেন ছড়া শিশুদের ' খেলা মেলার কাব্য '। তাই সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো ছড়া সাহিত্যের অবদান কোন অংশে কম নয় ।ছড়া স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত হয়ে অক্ষরের কারুকার্যে বিমূর্ত ব্যঞ্জনধারী শব্দে মূর্ত বা শ্রুতি শিল্প হয়ে ওঠে । অনেকটা আবার মানুষের মুখে মুখে ঝংকৃত ঝংকারময় পদ্যও বটে । শিশু সাহিত্যের এই অন্যতম শাখা ছড়ার অন্যতম প্রধান দাবি হল ধ্বনিময়তা ও সুর ঝংকার। এক্ষেত্রে পদের অর্থময়তার প্রাধান্য গৌন। তাই তো বিভিন্ন ছড়াকার অক্ষরের ছন্দে তালে এমন অনেক আজগুবি চিত্র কান্ড কারখানা তুলে ধরেন যা পাঠকমনকে এক অনাবিল ভালোলাগায় ভরিয়ে দেয় । বর্তমান সমাজের নানা রকম জটিল পরিস্থিতি বিভিন্ন সময় শিশু মন কে বিচলিত বিভ্রান্ত করে । অত্যধিক পড়াশুনার চাপ কিংবা নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির একাকিত্ব শিশু মনের অনেক সুপ্ত ইচ্ছা কে গ্রাস করে । শিশু কিশোর মন তাই বাস্তবের রুক্ষ মাটি ছেড়ে প্রতি নিয়ত উড়ে যেতে চায় । কল্পনার জগতে । ছড়া সাহিত্য এই শিশু কিশোর মনের সুগভীর চিন্তা ভাবনার এক ফসল । ছড়া সাহিত্য কেবল মজার চিত্র কল্পেই শিশু মনকে রোমাঞ্চিত করে না এটি তাদের শিক্ষা লাভের প্রাথমিক পথটুকু অতিক্রম করায় খুব সহজেই । ছড়া সাহিত্যের অন্তমিল বা পদের অবস্থান কে আধুনিক সাহিত্যিকরা অনেকেই লঘু করে দেখেন । তা সত্ত্বেও ছড়া সাহিত্য তার রহস্যময়তা নিয়ে শিশু সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হিসেবে সমাদৃত থাকবে এমন প্রত্যাশা বোধকরি অনুচিত নয় । 'ছড়া ' শব্দের বুৎপত্তিতে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতপার্থক্য বিশেষ লক্ষণীয় । অনেকে মনে করেন ছড়া সংস্কৃত মূল শব্দ । আবার কেউ বা দেশজ শব্দ হিসাবে চিহ্নিত করেন। নগেন্দ্রনাথ বসুর (বিশ্ব কোষ )মতে ছড়া সম্পূর্ণ দেশজ শব্দ । সুকুমার সেন মহাশয়ের ও এই একই বক্তব্য । ছড়ার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মত প্রতিমত বিস্তার আদান প্রদান হলেও এর নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি । ঊনিশ শতকের শেষের দিকে ছড়ার তথ্যমূলক ও তত্ত্বগত আলোচনার সূত্রপাত ঘটে । বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ কে আদি ছড়া বলা যায়। এটি স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত । আধুনিক কালে লোক ছড়া সংগ্রহ শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে । তিনি তাঁর সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে এটি জনসমক্ষে প্রথম প্রকাশের উদ্যোগ নেন । তিনিই সুকুমার রায়ের ছড়া সংকলিত করে ছড়ার গ্রহণ যোগ্যতাকে অনেক খানি মজবুত করেন । যে গুলিকে ছেলে ভুলানো বা মেয়েলি ছড়া নামে অভিহিত করে এ সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত ঘটান । রবীন্দ্রনাথের 'ছিন্ন পত্রাবলী'র পত্র বিচিত্রায় তিনি উল্লেখ করেন, ' ছড়ার একটা স্বতন্ত্র রাজ্য আছে । সেখানে কোন আইন কানুন নেই -মেঘ রাজ্যের মতো '। ছড়া সাহিত্যের নবযুগের প্রবর্তক হলেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার । যোগীন্দ্রনাথের অসামান্য কীর্তি ' হাসিখুশি '। ছড়ার সাহায্যে শিশুদের বর্ণ পরিচয় করানোর এক অভূতপূর্ব দলিল । যোগীন্দ্রনাথের হাসিখুশি'র ৩৩ বছর পর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন 'সহজ পাঠ '। খুকমনির ছড়া' (১৮৯৯)ও যোগীন্দ্রনাথের আরও একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি । সেখানে রয়েছে ৪১০ টি ছড়া। এই বইয়ের ভূমিকায় রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী লিখেছেন, 'যোগীন্দ্রনাথ সরকার মহাশয় বঙ্গালীর মধ্যে এই ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম পথ প্রদর্শক'। সুকুমার সেন বলেছেন সর্বকালের আদিম কবিতার বীজ হল ছড়া । লোক সাহিত্য আলোচনা প্রসঙ্গে বিচিত্র সাহিত্য গ্রন্থে তিনি বলেন, 'লোক সাহিত্যের যে শাখাটি অন্তঃপুরের আঙিনা স্নিগ্ধ ছায়া বিস্তার করেছে তা ঘুম পাড়ানি ও ছেলে ভুলানো ছড়া । এই ছড়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে সর্বদেশের সর্বকালের আদিম কবিতার বীজ । বাণীর প্রথম অঙ্কুর । আদি মানব জননীর কন্ঠের অর্থহীন ছড়ার টানা সুর ছন্দের জন্ম দিয়েছে ছেলে ভুলানো ছড়া কবিতাই । তবে তার নির্মাণরীতি সাধারণ কবিতার থেকে আলাদা । সাধারণ কবিতা লেখবার সময় কবির কল্পনা বিচরণ করে ভাব থেকে রূপে, রস থেকে ভাষায় । ছড়া কবিতায় লেখকের কল্পনা যায় রূপ থেকে রসে এবং তাতে রূপের ও ভাবের মধ্যে, ভাষা ও রসের সঙ্গে কোন রীতিসিদ্ধ যোগাযোগ বা সঙ্গতি আবশ্যিক নয় '। ১৩৫১ বঙ্গাব্দ এ মহম্মদ নাসিরুদ্দিন তাঁর 'সওগাত ' প্রত্রিকায় তাঁর মতামত কে এভাবে তুলে ধরেন ,' মধ্যযুগের কাব্য সাহিত্যের আলোচনা ক্রমে সেই যুগের বৈশিষ্ট্য বর্জিত অথচ প্রকৃতসাহিত্যের উপাদান সমন্বিত একটি সাহিত্য শাখার নাম করা যাইতে পারে -তাহা ছড়া ও গ্রাম্য গীতিকা'।
অন্নদাশঙ্কর রায় ছড়ার রূপ বিচারে বলেন, ' পুরাতন ছড়া যেন একটা ভাঙ্গা আয়নার জোড়া দেওয়া একরাশ টুকরো । একটাকে আর একটার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপায় নেই । কতকগুলি টুকরো বেমালুম হারিয়ে গেছে। কতকগুলি ভুল জায়গায় বসান হয়েছে । সেইজন্য সেই আয়না দিয়ে আমরা অতীতের মুখ দেখতে পাচ্ছিনে। পাচ্ছি একরাশ ইমেজ। কিন্তু ধ্বনি মোটামুটি ঠিকই আছে । ছড়া মুখে মুখে কাটবার জিনিস, লেখনী মুখে রচনা করবার জিনিস নয় । লেখনী তাকে ধরে রাখতে পারে, কিন্তু চোখ দিয়ে পড়ার জন্য নয়, কান দিয়ে শোনার জন্য । কান যদি বলে এ ছড়া নয় তবে এ ছড়া নয় । এ পদ্য।' ছড়া এক চিত্র শিল্প এবং সঙ্গীত শিল্প এই দুই ভাবে ব্যখ্যা করেঠেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । লোক সাহিত্য সংক্রান্ত বিভিন্ন রচনায় ছড়ার বিজ্ঞান সম্মত বিচারের জন্য দিকপাত ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ । তিনি ডাক ও খনার বচন এবং মন্ত্রের সাথে ছড়ার তুল্যমূলক আলোচনায় বলেন,'ছড়ায় উপদেশ নাই, চিত্র আছে।' ছড়ার বিষয় সব ক্ষেত্রে শিশুর বোধগম্য না হলেও তার ছন্দ দোলা, শ্রুতিমাধুর্য ছোটদের অনাবিল আনন্দ দেয়। আসলে ছোটরা ছড়ার দোলদুলুনি ছন্দকে যতটা ভালোবাসে ততটা তার অন্তর্নিহিত অর্থ কে নয় । তাই আজগুবি উদ্ভট ছড়া গুলি কে ছোটরা তাদের কল্পনার রঙে রাঙিয়ে একান্ত নিজের করে নেয় । অর্থের দুরুহতা সেখানে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না ।অবশ্য সুর তাল ধ্বনির সঙ্গে যদি অর্থের সাযুজ্য ঘটে তবে তো সোনায় সোহাগা। ছড়া তার সজীবতায় চিত্রময়তায় নিজেকে মনোহারী করে তোলে ।
আসলে সময়ের প্রবহমানতায় পরিপার্শ্বিক দেশ কাল সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেলেও শিশু চরিত্রের বিশেষ পরিবর্তন ঘটে না। তাদের স্বভাব ,বৈশিষ্ট্য ,আন্তরিক চাওয়া পাওয়া আশা ভালোবাসা, হাসি কান্না এসব যেন চিরন্তন । তাই তাদের কাছে গ্রাম বাংলার লোকজ ছেলে ভুলানো ছড়া গুলি আজও অত্যন্ত গুরুত্ব নিয়ে বিরাজমান । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, 'এই স্বাভাবিক চিরত্বগুনে ইহারা আজ রচিত হইলে ও পুরাতন এবং সহস্র বৎসর পূর্বে রচিত হইলেও নূতন ।' এই চিরন্তনতা আছে বলেই প্রাচীন ছেলে ভুলানো ছড়া গুলি আজও বাংলার শিশুদের কাছে সমান চিত্তাকর্ষক হয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে যোগীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব বিশেষ উল্লেখ্য । তিনিই প্রথম বাংলার গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা মা ঠাকুমার মুখে মুখে রচিত এমন সব স্নিগ্ধ, নির্মল ছড়া গুলিকে সস্নেহে উপহার দিয়েছেন বাঙালি শিশুর হাতে । এক্ষেত্রে তিনিই পথিকৃৎ বলা যায় ।
সভ্যতার সেই আদি হতে মানব জীবন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর । আর মানুষের বেঁচে থাকার রসদে নানা উৎসব অনুষ্ঠান মানব জীবনের এক অনন্য সুর লহরী বয়ে আনে । তাই আশা আকাঙ্খা স্বপ্ন কে বাঁচিয়ে রাখতে নানা মহৎসব পালিত হত ।যেমন -জাপানে চেরি ফোটার উৎসব , ইতালির ব্যটল অফ দ্য অরেঞ্জস । বাংলার হালখাতা বা পহেলা বৈশাখ । জীবন ও মৃত্যুর মাঝে মৈত্রী বন্ধনের এক পূন্য মন্ত্রই হল উৎসব। সংস্কৃতিকে ভালোবাসে এদেশের আত্মদর্শনের উদারতায় বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলনের ভাবধারায় পালিত হয় আজও ছড়া উৎসব। এ উৎসব শুধু এপার বাংলা নয় , দুই বাংলায় আজও সমান ভাবেই উদযাপিত হয়ে আসছে । যা অতি মনোমুগ্ধকর । 'দুই বাংলার ছড়া উৎসব ' এমনই একটি ছড়া উৎসব যা ২০০০ সালে শুরু হয়ে ১৮ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে কবি গুরুর শান্তিনিকেতনে । যেখানে দু বাংলার খ্যাতিমান নবীন প্রবীণ ছড়াকার সংস্কৃতি জন উপস্থিত থেকে ছড়া সাহিত্যের মেঘে ঢাকা তারাকে সাহিত্যাকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রতে পরিনত করেন।
সাবানা সিরাজ
ঘুটিয়ারী শরীফ , পোস্ট বাঁশড়া,
থানা -জীবনতলা
জেলা- দঃ ২৪ পরগনা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন