ধারনাতীত এক সমুদ্র শঙ্খ
*****************************************
শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস
যেভাবে কবিকে পড়ছি, যতবার পড়ছি,ঠিক ততবারই চোখবন্ধ করলে ভেতরে এক আলোড়ন!.....
পরিচয়? কেন পরিচয় চাও প্রভু?
ওই ওরা বসে আছে অন্ধকার বনচ্ছায়ে সকলেই ঋদ্ধপরিচয়?
বনে ভরে আগুনকুসুৃম--
আপন সোপানে কারা জলস্রোতে দেখেছিল মুখ?
বুকে জ্বলে আগুনকুসুম--
আমি যে আমিই এই পরিচয়ে ভরে না হৃদয়?
কেন চাও আত্মপরিচয়?....
কবি শঙ্খ ঘোষের জাবাল সত্যকাম কবিতাটির কিছুঅংশ তুলে ধরলাম পাঠকের জন্য।
এমন অন্ধকার দিনেইতো শঙ্খ ঘোষকে পড়তে হবে, আর কবি শঙ্খ ঘোষ যখন আক্রান্ত
হন, তখন সারা বাংলার কাব্যভুবন আক্রান্ত হয়ে যায়,একথা নির্নিমেষে বলার
সময় এসেছে আজ।
কবিতার একটি অন্যভুবন আছে।সেই বিশ্বলোক ও গ্রহতারকাখচিত আকাশে আছে রহস্য।
আছে কিছু জটিল উপদ্রব! যেমন গরীব,অসংবৃত ও যুধ্যমান।
কবি শঙ্খ ঘোষের গদ্য সংগ্রহ এমনই এক যুধ্যমান বই, যা তার প্রিয় ফুলদিকে
উৎসর্গীকৃত। কে এই ফুলদি, প্রসঙ্গক্রমে তিনি আসবেন। কিন্তু হতে পারতো
বইটির নাম গদ্য সমগ্র। অথচ তা না হয়ে বইটির নাম হলো গদ্য সংগ্রহ। কেন, তা
পাঠকের বিষয় হলেও একক ভাবে পাঠকের ওপরে না ছেড়ে,আমাদের কঠিন গদ্যময় জীবন
যে, পা তুলছে, আর পা ফেলছে, এবং এভাবেই শেষদিন পর্যন্ত একটা গোটা জীবন
হয়ে উঠছে বিচিত্র এক সংগ্রহশালা, যে সংগ্রহশালার প্রতিটি পদ্যই আসলে কঠিন
গদ্যের পাদপীঠ, যেখানে এক কঠিন আঁধারে কবিতার ব্রতী কবি শঙ্খ ঘোষ তার
গদ্যের আগুনপ্রদীপ জ্বালিয়ে একটার পর একটা তার সংগ্রহকে পাঠকের জন্য
সযত্নে লালিত করে বইটির নাম দিলেন গদ্য সংগ্রহ।এটুকুই কবি শঙ্খ ঘোষের
পাঠকের ভূমিকা,এই যে, সে গদ্যসংগ্রহ নামক মন্দির অথবা মসজিদের
দ্বারোদঘাটন করবে।
প্রায় প্রতিটি দেশের মত আমাদের দেশেও শাসক আজ নিশ্চুপ! এই যে পা তোলা,এবং
পা ফেলা! আর তুলতে ফেলতে আমাদের চলমানতা! এই চলমানতা বিরামহীন এক
চলন্তিকা! তবে কি পা তুলতে এবং ফেলতে গিয়ে যে পরিসর ফাঁকা হয়ে যায়, তা কি
শুন্য? না পাঠক! পৃথিবীর কোন শূন্যস্থান শূন্য থাকেনা।
এষ উপনিষদীয় ভাষায়--
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণম-উদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণম-আদায় পূর্ণমেব-অবশিষ্যতে।।
পা ফেলতে ফেলতে এই যে এগিয়ে যাওয়া সামনের দিকে! আরো
প্রত্যক্ষ, আরো আঘাত, সংঘর্ষের ভেতরে চলমানতা! এরকম ভাবেই কবি শঙ্খ ঘোষের
প্রতিটি কবিতার ফুলেল মুহূর্ত থেকে কাব্যরূপ ফুলের জন্ম হয়, আর আপামর
বাংলার কবিতাপ্রেমীদের কাছে তার সৌরভ পৌঁছে যায়, সে এক অপরূপ গন্ধ সমীরণ!
কলমের অপর নাম যদি দায় হয়,তবে সে দায় স্বীকার করতে কলম ধরতেই হবে। আর কলম
লিখবে মানুষের গভীর মর্মস্থল থেকে উৎসারিত দূঃখমিশ্রিত ধ্বনী, যা আসলে
অসংবৃত গরীব যুধ্যমান জীবনের সংলাপ।
বাংলা যতদূর বিস্তৃত, ততদূর রবীন্দ্রনাথ, এও যেমন সত্য, আবার বাংলার
যতদূর সুখ, যতদূর দূঃখ, যতদূর আনন্দ,ব্যাথা,রক্ত- ততদূরই কবি শঙ্খ ঘোষ।
কবি তার গদ্য সংগ্রহের" পা তোলা পা ফেলা"তে অকপট স্বীকারোক্তি করে
বলেছেন- সকলেই একদিন খেলাচ্ছলে শুরু করে কৈশর। তার মধ্য থেকে জেগে ওঠে
শরীর, তার নিজের অগোচরে। প্রগলভ সে ভাবনায় অন্যসকল কবিদের মত কবি শঙ্খ
ঘোষেরও খাতার পাতা ভরেছিল ছন্দ মেলানোর এক তুচ্ছ আনন্দে।
জোয়ার ও ভাঁটা, এই দুই যেন পৃথিবী ও চাঁদ, কিম্বা পৃথিবী ও
সূর্যের মতই জীবনের আলোআঁধারীর দ্বৈত চারণভুমি। কবি শঙ্খ ঘোষ যেন, সেই
চারণভুমিতে বিচরণশীল এক সত্যদ্রষ্টা! প্রতিটি মানুষের মত কবির জীবনের
ভুবন হলো কাব্যময়। ওপাড় বাংলার পদ্মা তীর থেকে বাবার হাত ধরে আগত এপাড়
বাংলায় গদ্য লিখতে ভয় পাওয়া এক কিশোর পথ হাঁটছেন শহর কোলকাতায়। বাবা
চেনাচ্ছেন, এটা রামমোহনের বাড়ি! ওটা জোড়াসাঁকো! আর পথের ধারের কাটা ফল!
ওসব খেওনা যেন...
এইসব ছবিময় বাংলার আনাচকানাচ ধরে এগোতে এগোতে কবির কৈশর আর যৌবন একদিন
মুখোমুখি হয় ভীরুতার সঙ্গে। এই ভীরুতা প্রসঙ্গে কবি তার কবিতার মুহূর্তের
এক জায়গায় বলেন- কোলকাতা খুলে দিলো সাম্প্রতিকের দরজা।একদিনে নয়,দিনে
দিনে! সেখানেও ছিলো বহিরাগত ভীরুতা! জানা ছিল না কোন্ দিকে
পথ।প্রেসিডেন্সি কলেজের পেছন বেঞ্চ থেকে সামনের দিকে টান দিয়েছিলো
যারা,তারা কবি ছিল না কেউ, ছিল কবিতার প্রেমিক।তাদেরই হাতে উপহার পেয়ে
একদিন আধুনিক কবিদের পৃথিবীতে পৌঁছে গেছি কখন! কবির মনে পড়ে আজও ছমছমে
অজানা এক গুহার সামনে সেই মুগ্ধতার কথা!
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় আলো আর আঁধার বিষয়ক। অর্থাৎ
আনন্দ ও ব্যাথার কথা।
কবি বলছেন তার কবিতার মুহূর্তে-- আমাদের চেয়ে বড় যারা,তাদের দিকে তাকিয়ে
মনে হলো কোথায় যেন এক নিয়মবৃত্ত আছে,যেন না-লেখা এক কানুন মেনে চলেন
অনেকে, কবিতা যেন ভাগ হয়ে আছে মুখ না- দেখা দুই শিবিরে। কি নিয়ে লেখা হবে
কবিতা? কবি শঙ্খ ঘোষ নিজের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে নিজেই উত্তর দিয়েছেন-
তবে কি আমার বাইরের পৃথিবী নিয়ে?
এই ভীরুতা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিলো অনেকটাই! তবে আধুনিক জীবন আর কবিতার
জগৎ, যার কোন চিহ্ন জানা ছিলো না কবির, সেই কবি, যিনি তার একান্ত
অনুষঙ্গের প্রিয় ফুলদির সাথে বন্ধুত্ব,বই, রবীন্দ্রস্মৃতিকথা নিয়েই
কাটাতেন, সেই কবিকে বৃহত্তর কোলকাতা যেন তার আগল খুলে দেখালো, বললো
দ্যাখ, কাকে বলে বাইরের পৃথিবী!
কবি তার কবিতার মুহূর্তে বলছেন- এমনসময়ে এসে পৌঁছালো ' কৃত্তিবাস '
পত্রিকা,তরুনতম কবিদের মুখপত্র হিসেবে ঘোষনা করা হলো তার নাম। সমস্ত
তরুনদের সাথে লিখতে ডাক পাওয়া কবি শঙ্খ ঘোষ লিখলেন 'যমুনাবতী'।
যমুনাবতী কবিতার প্রেক্ষাপটে টমাস হুডের সেই বিখ্যাত
কবিতা soweto প্রসঙ্গে কবি বলেন পীড়নের চেহারা সর্বদেশে এক। এ প্রসঙ্গে
হুডের কবিতাটি আফ্রিকার এক কিশোরীর পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়া কাহিনী নিয়ে
রচিত। ট্রান্সভালের এক শহর শোয়েটো। সেখানে পাঠ্যপুস্তকে বলপূর্বক চাপিয়ে
দেওয়া হচ্ছে আফ্রিকান ভাষা।প্রতিবাদ উঠলো। স্কুল ইউনিফর্ম পরা
অল্পবয়সীদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালো।বারো বছরের একটি মেয়ে, পুলিশের
গুলিতে মৃত্যু বরণ করবার পূর্বমুহূর্তে আর্তধ্বনী করছে! ভেঙে যাচ্ছে তার
মুখের শব্দ- so- we- to.. so- we, আর অসমাপ্ত ওই we, ধ্বনীতে শেষ হয়ে
যায় নিবিড় এই কবিতা। কবি শঙ্খ ঘোষ আগেই বলেছেন পীড়নের চেহারার
আন্তর্জাতিকতার কথা।
সাল ১৯৫১. জলপাইগুড়ি জেলা শহরে স্বাধীনতার চার বছর পর সেই পুলিশের
গুলিতেই প্রাণ হারালো ভুখা মিছিলে অংশগ্রহণকারী একটি মেয়ে। অপরাধ?
স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু খাবার আসেনি।অতএব হাকিম সাহেবের আস্তানা ঘেরাও।
পুলিশের কর্ডন ভাঙা মেয়েটি লুটিয়ে পড়লো। আর কবি শঙ্খ ঘোষ ভাবলেন, আজও এই
খবর! ওয়ান মোর আনফরচুনেট! ' the bridge of sighs'-এর প্রথম লাইনটা মাথার
ভেতর ঘুরপাক খেতে আরম্ভ করলো। জন্ম হলো যমুনাবতী কবিতার।
নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে....
কবিতাটি ছাপা হয়ে যাবার পরেরও স্মৃতি আছে কবির জীবন
পাত্রে ধরা।১৯৫৩ সাল। এক সাহিত্য মেলায় দুই বাংলা হাজির। স্থান,
শান্তিনিকেতন।সেই মেলায় ছাত্রপ্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত কবিও। কবি সুভাষ
মুখোপাধ্যায় কৃত্তিবাসের অন্য কবিদের কবিতাংশের সাথে যেই না পড়তে শুরু
করেছেন যমুনাবতীর কিয়দংশ, ওমনি প্রায় ঝাঁপ দিয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের
কবিতা রুচি ও কবিতার বিচারবোধের তীব্র সমালোচনা করে উঠলেন কবি বুদ্ধদেব
বসু...
কবি শঙ্খ ঘোষ তার কবিতার মুহূর্তে আক্রমণের রূপ বিচার প্রসঙ্গে বলেন-
সেদিনও যেমন কবিতা আক্রান্ত হলো, উল্টো দিকে আবার এমনও হয়, তুচ্ছ
হাহাকারের লেখা! কেউ বলেন, জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া, নিজেকে নিয়ে বেশি
ভাবা! এপ্রসঙ্গে কবির সংযোজন- আমরা অনেক সময়ই নিজের কথা ভাবি।এই যেমন
কোলকাতার বাস! যারা চাপেনি তাদের ধারনা নেই কোন। গন্তব্য আসার আগে থেকে
দাঁড়িয়ে একটু একটু করে গেটের দিকে এগোতে থাকা। কবিরও, এমনই এক দিনে গেটের
কাছে দন্ডায়মান ব্যাক্তি--' অত ঠেলছেন কেন মশাই?' 'দেখতে পাচ্ছেন না
দাঁড়িয়ে আছি'?
জন্ম নিলো অবিশ্বাস্য একটি কবিতার। নাম- ভীড়
........ আরো কত ছোট হব ঈশ্বর
ভীড়ের মধ্যে দাঁড়ালে!
আমি কি নিত্য আমারও সমান
সদরে, বাজারে, আড়ালে?
এমনই সব কবিতার মুহূর্ত থেকে আসে দ্বিজন্মের কথকতা। কবিতা সংগ্রহে একে
একে জমা হতে থাকে ঘুমিয়েপড়া অ্যালবাম, জার্নাল, সময়ের ছবি। এইসব
মনিমুক্তের সংগ্রহ আমরা, কবিতার পাঠকেরা পড়বো, আর বাঁচবার তীব্র আকাঙ্খার
মধ্যে বয়ে যাওয়া ভয়ের তরল স্রোত, জলের মধ্য থেকে উঠে আসা একটা অসহায়
উচ্চারণ : আমার ভয় করছে, এমনই ভয়াল ভয়াভয়তার মধ্যে আমাদের বর্তমান ওয়েভ
ওয়াল ভরিয়ে দেবো এই মর্মে, " বাংলায় আক্রমণ আর আক্রান্ত পাশাপাশি চললেও
আমাদের সমাজ, আমাদের সচেতনতা দিয়ে আমরা কবিতার অবয়ব তৈরি করবো, আর তা
হবে--
নীচে কালো স্রোত
ক্রমে আরও ফুলে ওঠে,ফেঁপে ওঠে।
মাঝে মাঝে এক- একটা ঢেউয়ের হাত
যেন কোনো জলমগ্ন শয়তানের
রোমশ থাবার মতো পাঁচিলের দিকে ছুটে যায়
হঠাৎ লাফিয়ে উঠে
সারিবদ্ধ ছায়ামূর্তিগুলির একটিকে
পেড়ে আনে।"
ঋণ স্বীকার :
১। গদ্যসংগ্রহ (২), দে'জ পাবলিশিং।কবি শঙ্খ ঘোষ।
২। এষ উপনিষদ।
sharmistha biswas
no2, govt colony
po. mockdumpur
dist malda
pin code 732102
phone no, 9474475193
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন