‘নিরুওর প্রশ্নের দ্রাঘিমা’
কবি বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশক বার্ণিক।বর্ধমান
প্রচ্ছদ দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায়
দাম ১০০ টাকা
দ্রাঘিমা পেরিয়ে
রত্নদীপা দে ঘোষ
আহা! দ্রাঘিমা ...
অক্ষরেখার অন্তরালে নিঝুম-কবির ঝমঝম বিবৃতি। কবি বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের
সদ্য নির্মাণ ' নিরুওর প্রশ্নের দ্রাঘিমা' ... এই কাব্যগ্রন্থকে শুধু
নির্মাণই বা বলি কি করে? এ যে নির্মাণের অধিক নির্বাণ ... কবিসত্তার নতুন
এক পরিধি পেরনো কবিতার বাস্তুহোম।
'দমকল
আমার মালিন্য মোছো, দাহ' ...
এই বাক্যটি কবির প্রবেশপথ এবং কবিতার তোরণ-দুয়ার। জানালার বর্ণ এবং
গড়ন-পরিচিতি। কবি জানেন, পৃথিবী ঘুরছে কবিতারই কক্ষপথে, চোখের জ্যামিতি
খুলে দিচ্ছে বহুমাত্রার দৃশ্যসাধন... কবিতা আমরা পড়ি কেন? কবিতা কি কবিকে
পড়ে কখনো? পাঠককেও পড়ে? খুব জানতে ইচ্ছে করে ... আর এই ইচ্ছের রোদ খুলে
দিয়েছে এই কাব্যগ্রন্থের সূর্য এবং সূর্যমুখীর যৌথ সমান্তরাল।
এই কাব্যগ্রন্থটি জুড়ে কবিতার শৈশব, দুই বিনুনির দুষ্টুমিঠে। তরুণ
হাতেখড়ির মুখ। ঘামতেলের জমজমাট। যুবতীর গল্পনীল। অল্পসবুজ মেদুর যুবক
বৃক্ষ আর তার জল্পনা। কবিতা সুসম মাত্রাবণ্টনে শিল্পময়। প্রাচুর্যময়
স্থাপত্যের ঐশ্বর্য ...
'কতখানি দূরে সরে গেলে তুমি নীরব হয়ে যেতে পারো?
পায়ের নীচে আবর্জনা জমছে
মাথার ওপর নীল রঙের আকাশ
চুরি করে নিচ্ছে সিন্ডিকেট হাত।''
এই পংক্তিগুলি হৃদয়ের হীরক থেকে উদ্বেলিত কবিমানসের ক্রোমোজোম। কোরকের মগ্নঅতীত।
নীল আকাশ আর সিন্ডিকেট হাত ... এই দুটি পার্থিব হসন্ত আর বিসর্গে
উচ্চারিত কবির স্টেমসেল। কোষ বোঝাই অক্ষর নিয়ন্ত্রিত " চিৎকার ও বমি"।
কবি যখন উগড়ে দিচ্ছেন ঘুমরুমালের ধুলোবালি বাস্তব সমাজের বৃষ্টিস্বচ্ছ
আবার ঠিক তখনি স্বপ্নের মতো কয়েক দলা কিছু উঠছে আসছে কলমতৃপ্তির আস্বাদ
জুড়ে...
'তবু বৃত্ত বড় হয়, বড় হয়
চুপসে যায় বেলু, ফেটে যায় হাওয়ার তাণ্ডবে।'
ঠিক ভাবেই শিবিরের হাওয়া বদলে দিলো ভাষার আবহাওয়া। জলবায়ুর বাতাস গ্যালো
পাল্টে। যাবতীয় অক্ষরেখা দ্রাঘিমার কণা পাল্টে যাচ্ছে খুব দ্রুত। এক
উপকূল থেকে অন্য নদীতে আক্রান্ত হচ্ছেন কবি... কবির চরিত্র তো এমনি হওা
উচিত। কবি জ্বলবেন। কবি নিভবেন। আবার জ্বল্বেন। কবির ঘনত্ব যাবে বেড়ে।
কলমে দীর্ঘটা আরও বেড়ে যাবে। কবির ঐশ্বর্য রোদজলের অপারে নিঃশ্বাস নিতে
শিখে যাবে দ্রুত। এই কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে ঠিক এই ঘটনাটি ঘটেছে।
শব্দের পিউপা ফেটে জন্ম নিয়েছে ডানার লার্ভা।
'মৎস্যগন্ধার আলো; ফুটে উঠেছে স্নানপথে প্লাবনের পথে। হোমাগ্নি রোপণ
করতে গিয়ে কবি পাঠকের জন্যে বের করে আঞ্ছেন কবিজন্মের নৌকো এবং নাব্যতা।
গানের চোখদুটি উৎস হতে উচ্চারিত সামগ্রিক ভ্রমণবৃত্তের কোপার্নিকাস।
ভাবনার দুরন্তে ভেসে উঠেছে... ভাবনার সলিল।
' উন্মুখ চৌকাঠে স্বনির্ভর পায়ের আকুতি।
বাঁকা আল্পথ ধরে তুমি কি এসেছ নিরাময়?''
কী দুর্দান্ত এই আকুতি। বেদনার কী অপূর্ব তুরপুন। কবি এখানে বসেছেন
কবিতার দ্বাদশ সমান্তরালে। তিনি যেন
' বোবা ফেরিওয়ালা
শুভেচ্ছা আঙুলে মায়া বিপণী'
ফুলসিম্ফনির দুর্দান্ত পাপড়ি। আসন পেতে বসে আছেন স্বয়ং কাব্যগ্রন্থটি।
গ্রন্থনার সর। পুরিয়ায় মেতে উঠছে ধান্যশ্রী অরূপের তুমুল আরণ্যক। কবি
ডেকে নিলেন চাঁদকে। চাঁদ ডেকে নিলো পৃথিবীকে। পৃথিবী ডাকলো পৃথিবীর
নিজস্ব বাতাসের তোরণকে।
তোরণ মাতিয়ে দিল রোদপূরণের পৌর্ণমাসী। সম্ভাবনার অমরা যোগাভ্যাস। এই
কাব্যগ্রন্থটি পাঠককে জানিয়ে দিল, কবিতা আসলে একপ্রকার যোগাভ্যাস। উত্তম
যোগমুদ্রিত এবং মন্দ্রিত কথাকলির চার-চারটে পাখি। পাখিদের উড়ে যাওয়া।
পাখিমুক্তির পালক। কবিতা মানুষের পালকপিতা এবং মাতাও বটে। কবি বিপ্লব
গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন সকল সম্ভাবনের জলপরি। রূপকথা। কথারূপ।
কাব্যরূপ ঘূর্ণিজ্বর।
কবি বুঝিয়ে দিলেন শব্দের সাথে অক্ষরের ধুনুচি-বিবাহ। নৃত্যের সরোদ।
কবেকার তিনটি রঙবোঝাই চারুকলা আজ দ্যাখা দিলো 'রোদের মলাট' । আমরা যারা
পাঠক তারা শুনতে পেলুম প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরোনো বৃক্ষ রোপণ কবিতা
জুড়ে রোপণের জলোচ্ছ্বাস। জ্যতিমেরুর হাঁটাচলা। চড়ুইভাতির "বেদখল
সাদাপাতা" ...
কবি খুলে দিলেন পাহারা। কবি খুলে দিলেন যারপরনাই রাতের জন্মান্তর। অসীম
মজ্জা আর তরঙ্গঅণুর লেখাগুলি। নিজস্ব নির্মাণের ক্ষয়গুলি বদলে গেল বুকের
কেন্দ্রীয় নিমন্ত্রণে। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিল পাঠক।পাঠকের আবর্তনে আরও
বেশি স্বরে স্নায়ুময় হয়ে উঠলো তোলপাড়ের বনমৃত্তিকা।
"গাছপালা
এবং রক্তের গভীরে পুষে থাকা নদী।"
কবি ডাক দিলেন বিন্দু সিন্ধুর কবিতামানুষকে।
' এসো
অনুভবনিপুণ আলো"
কবির এই ডাক এমন মর্ম বিজড়িত এবং আন্তরিক বেদান্তসহ যে একে স্বয়ং ঈশ্বরও
অস্বীকার করতে পারেন না। এই ডাক আসলে একটি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে লেখা
একটি আশ্চর্য হাতচিঠি। এই চিঠি হয়েছে রক্তের গভীরে, নাভির নাব্যতায়।
চরাচরের কাতরতায়। এই চিঠির রঙ অলৌকিক গার্হস্থ। এই চিঠির আয়তন মৃদু
চেহারার অনন্য ক্যানভাস। তাবং মোমরঙে জারিত এই চিঠি কবির হাতে লেখা
কবিতার পত্র পুষ্প এবং পত্রাঞ্জলী।
এই চিঠি পড়ে বিপন্ন হই আমরা। প্রতিধ্বনির দোলায় দুলতে থাকি রীতিমত।
কাঞ্চনে কিংশুকে মালাবার হৃদয়ে জ্বলে ওঠে ধ্রুবতারার দীপক। মৃগশিরা
নক্ষত্রের নির্বাসন আমাদের কাঁদায়। কবিতাগুলি আমাদের কাঁদতে শেখায়।
কবিতার অন্তরতম গানগুলি আমাদের শোনায় 'মৌসুমী বাতাস"।
কবিতার বাচনভঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে ' নীল জুতো খুলে ফেলেছে আমপাতা''…
কাব্যগ্রন্থটি জুড়ে কেবল চকমকির দিল। দিলরুবার বুনন। ব্যথাকণ্ঠের নীল।
শিল্পবোধ ...
কবি বইলেন দাঁড়। কিন্তু নিজে ভাসলেন না। কবি বললেন। কিন্তু তিনি নিজে
শুনলেন। কবি বাঁধলেন। কিন্তু তিনি নিজের হাতে সেই বন্ধন খুলে দিলেন না।
বরং মাতিয়ে রাখলেন পাঠকে। এমনকি কবিতা দিয়ে কবিতাকেও রাখলেন মাতিয়ে। সেই
মাতন পৌঁছে গেল কত সহজে। সহজিয়া বাদলের বাউল ধরে, একতারার চোখ লক্ষ্য করে
কত অশ্রুঘোড়ার ঢল নামলো সৌরসকালের মঞ্জিলে, প্রতিমায় ...
কবি শোনালেন গতি এবং স্থিতি জাড্যের সফল উপপাদ্য। জ্যামিতিও বুঝিয়ে দিলেন
পরিমিতিবোধের জটা ভেদ করে। আমাদের সামনে এখন এক সুবর্ণ-অবসর। স্বপ্নের
জানালা। পবন ঘেরা শুভকাল। রাঙামাটির দরজা। কবিতার দরজা খুলে দিচ্ছে
মৌ-পিপাসা। ছায়ায় – মায়ায় বেজে উঠছে আয়নার আকৃতি। লতানো বিদ্যুৎ। আঁচলের
ঝড়াপাতা।
মেঘলন্ঠনের এইসব কবিতাগুলি ... কাব্য বন্ধনে, করবীকারকের ভেতরে বিন্যস্ত
হয়ে রইলো কবি-অন্তরের মনকপোত। চড়ুই-উদ্যান ... চিরকালের প্রশ্নগুলি ...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন