# 'বালাই ষাট'
# সুজয় চক্রবর্তী
# আকাশ প্রকাশন
# মূল্য - ৯০টাকা
বালাই ষাট --- জীবন যন্ত্রণার প্রতিবাদী উত্তরণ
সুকুমার সরকার
-----------------------
প্রাগৈতিহাসিক জীবন যন্ত্রণার ছবি দিয়ে সুজয় চক্রবর্তীর 'বালাই ষাট'
অণুগল্প গ্রন্থটির শুরু। শুরুর গল্পটির নাম 'বেঁচে থাকার গল্প'।
গল্পের শুরুবাদ, গল্পের শেষবাদ, সেই চিরন্তন একটিই বাদ, তা হল, বাঁচা
মরার সংগ্রাম। আর তার মাঝখানে খেলে গেছে জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাতের
নানান আঁকাবাঁকা পথ পরিক্রমা। এযেন আস্ত একটি মানব সভ্যতার যাত্রাপথ। যার
শুরু পাহাড়ের ঝর্ণা ঝরা থেকে পাহাড় সমতল পেরিয়ে মোহনায় সমুদ্রে মিশে
যাওয়া।
শুরুতে বেকার ফুলেশ্বরের বেঁচে থাকার জন্য এসিডে দগদগে ঘা সৃষ্টি, আর
শেষে মামনি খাতুনের অন্তিম ঠিকানা মৃত্যুর পর দেহদান। দুটো ঘটনাই
ভিন্নভাবে সমাজের দুটি কদর্য চিত্র তুলে ধরেছে। একটিতে অর্থনৈতিক
সংগ্রাম-বৈষম্য; অন্যটিতে সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প! আর এই সমাজ চিত্রের
বোঝা নিয়ে প্রবাদ বাক্যের মতো এগিয়ে চলেছে 'বালাই ষাট'এর নৌকা। সেদিক
থেকে নামকরণও সার্থক। নৌকা এগিয়ে চলুক! আর সেই ফাঁকে আমরা দেখে নিই জীবন
নদীর দু'পাড়ের চালচিত্র।
জীবন এখানে গতানুগতিক নয়, গতানুগতিকতার মধ্য থেকে একটু ভিন্ন ধরনের। একটি
ভিন্ন চিন্তার দার্শনিক ভাবনা। দ্বিতীয় গল্প 'মাংস'-এ আমরা তাই দেখি
মানুষ, পশু, পাখি, উদ্ভিদ সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার নব্যমানবতাবাদী নোতুন
এক ভাবনা! কিন্তু পুরনো ধ্যানধারণার জীর্ণ পৃথিবীতে নোতুন ভাবনা যে কেবলই
মোচড় দেয় ভাড়াটে ঘরের মতো, ভাড়াটে শরীরে। অভাবী সংসারে বাড়ি ভাড়া দেবার
মতো, বুলু নামের এক গৃহবধূ নিজের শরীর ভাড়া দিয়ে স্বামী সন্তানের পেটের
খিদে মেটায়। অসুস্থ স্বামীর পা ভালো হলেও ভাড়াটে শরীরকে ভাড়াটিয়াদের হাত
থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে না বুলু। তাই সে স্বামীর কথার প্রত্যুত্তরে বলে, '
যে বাড়ি একবার ভাড়া দিয়া শুরু হয়, ফাঁকা থাকলি ভাড়াটে ঠিক খোঁজ নিয়ে চলে
আসে'( ভাড়াটে বৃত্তান্ত)। কত সুন্দর শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন আর ভাষার
কারুকার্য। এযেন নদীর গতিপথ ধরে সভ্যতা এগিয়ে চলা। চলার পথের বাঁকে বাঁকে
গুহাচিত্র, লিপিচিত্র, ভাস্কর্য --- কত কিছু। দু:খ যন্ত্রণার সংগ্রামী
জীবন নাট্যের মধ্যে আবার এক চিলতে স্মৃতির ঝিলিক খেলা করে মা'র হাতের
ঘুঁটে দেওয়ার দেওয়ালটুকু। 'ওটুকু থাক' গল্পে লেখক দেখিয়েছেন গ্রামের
মায়েরা কিভাবে মাটির দেয়ালে ঘুঁটে দিতেন ---- 'যেখানে সর্বত্র মায়ের
হাতের স্পর্শ লেগে আছে।'
'বালাই ষাট' প্রবাদপ্রতিম গল্প কথা। প্রবাদে আছে, ' আমার কথাটি ফুরলো,
নটে গাছটি মুড়লো।' কিন্তু সুজয় চক্রবর্তীর অণুগল্পের 'নটে গাছ' মুড়োয় না,
গল্পও ফুরোয় না। সরকারি ফ্রি প্যাকেটের পালং শাকের বীজ অনেক গল্পের
অবতারণা করে। রাজনীতির দাদাগিরির নানান চালচিত্র তুলে ধরে। যে চালচিত্রে
'ভোলা'রা ভোট দেবার যন্ত্র হয়, গণ্যমান্যদের আপ্যায়নের খোরাক হয়, কিন্তু
নিজেরা 'নিমন্ত্রণ' পায় না। এমনই এক নিষ্ঠুর চিত্র আঁকা আছে 'নেমন্তন্ন'
গল্পে।
গল্পগুলো সবই অণু। 'কথায় কথায়' গল্পের 'আসা-যাওয়া' চলে। যেখানে পেটের
দায়ে ভাসুরের মুখে স্তনের বোঁটা গুঁজে দেবার মতো কদর্য সমাজ চিত্রও আঁকা
আছে।
সমাজের খুঁটিনাটি কোনও কিছুই সুজয় চক্রবর্তীর নজর এড়ায়নি। যেখানে 'সন্তান
বাৎসল্য' থেকে 'তালাক', 'রূপান্তর', 'যোগসূত্র', 'আনুগত্য', 'সম্পর্ক',
'টোপ', 'শব্দব্রহ্ম' কোনও কিছুই বাদ যায় না। সবকিছুর অণু-পরমাণু বিশ্লেষণ
---- অনেক তত্ত্বকথার কচকচানিতে নয়, কতগুলো সহজসরল সত্য উচ্চারণের মধ্য
দিয়ে। যে সত্যের নাম জীবনসত্য। যে জীবন এগিয়ে চলে নদীর মতো এঁকেবঁকে ----
ভিন্ন ভিন্ন জীবন যন্ত্রণা, হাসি-কান্নার চালচিত্র সঙ্গে নিয়ে।
অণুগল্পের চরিত্র বৈশিষ্ট্যটি ঠিক রেখে প্রায় প্রতিটি অণুগল্পই বহমানতা
ঠিক রেখে চলেছে। বিষয় বৈচিত্র্যে সবগুলি গল্পই হয়তো বহু বিচিত্র চিত্র
ফোটাতে পারেনি। অনেক সময় একই ভাবনা বিভিন্ন গল্পে ঘুরপাক খেয়েছে। তবে
গল্প বলার মুন্সিয়ানা পাঠককে রস উপভোগ থেকে বঞ্চিত করেনি। প্রতিটি গল্পই
সুখপাঠ্য। নিটল নির্ঝরের মতো এগিয়ে নিয়ে যায় পাঠককে।
শুধু গল্প বলার ঢঙ নয়, সমাজ মনস্তত্ত্ব তুলে ধরতেও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয়
আছে সুজয়ের গল্পে। বিশেষ করে তারঁ 'গন্ধ' গল্পটি একটি মনস্তাত্ত্বিক
চাবুক। যা শপাং শপাং করে সুনীলবাবুদের পাছায় মারতে থাকে। আসলে ' বোটকা
গন্ধটা তার শরীর থেকেই বেরিয়ে আসছে(গন্ধ)। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের
আরেকটি গল্প 'খাদ্য'। সপ্তর্ষিদের কুনজর থেকে বাঁচতে অদিতিদের কখনও কখনও
ভিক্ষুকরাও অস্ত্র হয়ে ওঠে। তারই নিপাট গল্প 'খাদ্য'।
তবে ঐ যে প্রথমেই বলেছি, জীবননদীর মতো গল্প বাঁক নিয়েছে এক একটি ভিন্ন
পথে। তারই একটি অনুপম চিত্র 'পথ' গল্পটি। গল্পটিতে সমাজতত্ত্বও আছে,
মনস্তত্ত্বও আছে। সমকামী স্বামী স্ত্রীকে প্রশ্ন করে--- 'কোথায় যাচ্ছ?'
--- ' যেদিকে বিষমকামী মেলে।'( পথ) সমাজ-মানসিকতায় আরও একটি চাবুক! সমকাম
দোষের না হলেও, বিষমকামীর সঙ্গে সমকামীর বিয়েটাতো পুরনো ধ্যানধারণার
চাপানো মানসিকতা। সমকামিতাকে লুকনোর চেষ্টারই এমন পরিণতি। সে চিত্র খুব
সুন্দরভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন সুজয় চক্রবর্তী।
অনিচ্ছাতেই নাগরদোলায় চড়ে যেমন অনেকেরই মাথা ঘোরে, তেমনই এক মাথা ঘোরার
মতো গল্প সুজয় চক্রবর্তীর 'নাগরদোলা'। গল্পটি পড়ে আমারও অল্প মাথা ঘুরে
উঠেছিল। একেবারে জটিল মনস্তাপের অণুগল্প। দক্ষ শিল্পীর মতো কয়েকটি রৈখিক
টান। তাতেই ফুটে উঠেছে বিমূর্ত কতসব ভাবনা। কতশত সমাজ-মানসিকতা। সুজয়
চক্রবর্তীর এই গল্প ভাবায়। মাঝেমাঝে বোধহয় সবাইকে এমনই 'নাগরদোলা'য় উঠে
জীবনের ভিন্ন ভিন্ন চিত্রগুলি দেখা দরকার। নইলে 'দুর্বাশার শাপ' থেকে
বাঁচতে যতই 'অর্ঘ' দিই না কেন, 'আফসোস' একটি থেকেই যাবে। জয়ারা স্বামী
শাশুড়ির অত্যাচারে গায়ে আগুন দেবে, আমরা পাশের বাড়িতে থেকেও কিছু করতে
পারবো না।
এমনই সমাজের নানান যাপন চিত্রের ছবি এঁকেছেন সুজয় চক্রবর্তী। কবিতায় নয়,
গল্পে। অণুগল্পে। প্রতিটি গল্পের গীতি মাধুর্য গল্পগুলিকে আলাদা গতি
দিয়েছে। আলাদা আলাদা বাঁকের সৃষ্টি করেছে। কখনও বা সেই বাঁক ছোটছোট কোনও
চরের সৃষ্টি করে, যেখানে চিকচিক বালির দানায় আয়নার মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে
প্রতিবাদের চিত্র।
'কাপড়ের আঁচলটুকু দিয়ে মেয়ের বুকটা ঢেকে দিল সে। মুখ খুললো, আয় মা, আমার
হাত ধর।' পম্পার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা শক্ত করে ধরলো সবিতা। চারপাশের
মানুষগুলোকে তার যেন হায়নার মতো মনে হচ্ছে। পাশে ফটিকও নেই।
ঘর-গেরস্থালির আজ প্রায় সবই হারিয়ে গেছে। কিন্তু মা-মেয়ে কিছুতেই ইজ্জত
হারাতে রাজি নয়। অন্তত প্রাণ থাকতে '( ইজ্জত)
----- এই প্রতিবাদী ভাবনাতেই সুজয় চক্রবর্তীর গল্পের নৌকা সমুদ্রে মিশে
যায়, যে সমুদ্রের নাম অণুগল্পের উত্তরণ। জীবনের উত্তরণ।
** 'বালাই ষাট' # সুজয় চক্রবর্তী # আকাশ প্রকাশন # মূল্য - ৯০টাকা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন