...এবং অস্পৃশ্য হাত: অপূর্ব পাঠ
তনুশ্রী পাল
সার্থক অণুগল্প রচনা কঠিন সাধনালব্ধ বিষয়ই বটে। আকারে ক্ষুদ্র বলেই তার
দায় বেশি।অর্থাৎ ছড়িয়ে ছিটিয়ে শাখা-প্রশাখায় কাহিনী বিন্যাস করে
রসগ্রাহী পাঠককে তুষ্ট করার সুযোগ অণুগল্পের আদৌ নেই। পরিসর তার স্বল্প
,বহু চরিত্র বা বিশাল প্রেক্ষাপটে গল্প তো লেখা যাবেনা। প্রতিটি শব্দ
,চরিত্র সুনির্দিষ্ট ও সুপ্রযুক্ত হওয়া চাই । অণুগল্পের আকৃতি ছোটোই
হবে কিন্তু এই স্বল্প আয়োজনটুকু সার্থক করে তুলতে হবে গল্পকারকে। সুতরাং
প্রতিপদেই তার পরীক্ষা ।খুব দক্ষ শিল্পী ছাড়া কাজটি নেহাতই কঠিন ।
বড়গল্পকে চেপেচুপে ছোট আকার দিলেই সে অণুগল্প হবে না।বিদগ্ধ পাঠকের চোখে
তা ধরা পড়ে যাবে। বেশি ভার অণুগল্প নিতে পারেনা ,অতিকথনে উদ্দেশ্য তার
ব্যর্থ হয়ে পড়ে। অণুগলপে গল্পটি থাকতেই হবে ,খুব কম শব্দে বিশেষ কথাটি
বলতেই হবে। উপমা দেওয়া যেতে পারে এ ভাবে, ক্ষুদ্র জলাধারে বৃহৎ আকাশের
রূপটুকু প্রতিবিম্বিত হওয়াই চাই।
আজ্কাল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অজস্র অণুগল্প ছাপা হচ্ছে। এখন ভাবার বিষয়
সেগুলি সবই কি সার্থক অণুগল্প হয়ে উঠছে?পাঠক বিচার করবেন। হ্যাঁ মোট
সাইত্রিশটি গল্পে সাজানো একটি অণুগল্প গ্রন্থের পাঠ অনুভবটুকু প্রকাশ
করতে গিয়ে এই কথকটি বলতেই হ'ল। লেখক বিপ্লব গঙ্গগোপাধ্যায় নামটি বাংলা
সাহিত্য জগতে একটি বিশিষ্ট ও পরিচিত নাম। তাঁর "" ...এবং অস্পৃশ্য
হাত''এই অণুগল্প সংকলনটির পাঠ অনুভব জানাতে গিয়ে উপরোক্ত কথাগুলো বলতে
হ'ল।অণুগল্প লেখা যে বিশেষ ধারার সাহিত্যকর্ম সেটি যথাযথ উপলব্ধি করে
গ্রন্থেটির মুখবন্ধে লেখক স্বয়ং একটি কঠিন সত্য উচ্চারন করেছেন
-""...শব্দ এবং ভাবনার যথাযথ ব্যবহার ছাড়া যা লেখা সম্ভব নয়।এখানে চরিত্র
আঁকার কোন সুযোগ নেই। আছে শুধু গল্পের নির্যাস ,যার ফ্লেভার দীর্ঘস্থায়ী
।'' পাঠক হিসেবে এ গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি গল্পই সার্থক অণুগল্প হয়ে
উঠেছে এটুকু বলতে কোনও দ্বিধা নেই আমার।
স্বল্প পরিসরে এক অসাধারণ প্রতিবাদের গল্প " দধীচি '
-রাষ্ট্রযন্ত্রের অবিচারে পুলিশের গুলিতে নিহত সুখদেব মান্ডির ভীত
সন্ত্রস্ত গ্রাম জেগে উঠছে। মাত্র দুটি অমোঘ বাক্যে লেখক সে প্রতিবাদ
জীবন্ত করেছেন ,"...সাত গাঁয়ের জনতা দেখে সুখদেব মান্ডির হাড় থেকে বেরিয়ে
আসছে একটা তীরের ফলা।ইস্পাতের চেয়েও কঠিন তাদের মুখ।' হতদরিদ্র মানুষের
ভয়ংকর খিদের গল্প "উড়ন্ত স্বপ্নের লিরিক ' -"খিদে মোচড় দিচ্ছে
পেটে।নিরন্ন স্লেটের মধ্যে বিক্ষুব্ধ অক্ষর ।' খিদের এমন নিরীহ কাব্যিক
কিন্তু কঠিন উপমা কমই পড়েছি! "বেঁচে থাকা' গল্পে মেরুদন্ডের ঋজুতা হারিয়ে
,মালা আর মানপত্রের ভিড়ে হারিয়ে যেতে না চাওয়া আপোষ হীন এক কবির কথা
;মুগ্ধ করে রাখে। বাবা ,সমীরণ বাবুর ছাত্র ,মোবাইল রাজু ,কণ্ঠস্বর
,পথবাতি অপূর্ব সব সংবেদনশীল পরিপূর্ণ নিটোল গল্প।অবশ্যই সার্থক
অণুগল্পের বৈশিষ্ট শরীরে ধারণ করে।এই অণুগল্প সংকলনের প্রতিটি গল্পই
অসাধারণ মনে হয়েছে আমার । আজকের অজস্র অণুগল্পের (!) ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার
মতো আদৌ নয়। নিঃসন্দেহে বলতে পারি এই ক্ষুদ্রকায় গ্রন্থটি পাঠককে অবশ্যই
তৃপ্ত করবে।সার্থক সুরচিত গল্পগুলোই বলে দেবে অণুগল্প প্রকৃতই কেমন হ'তে
হবে।শুরুতে "অণুগল্প আজও আমার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ '-এই বক্যে
মুখবন্ধ লিখেছেন বিপ্লব গঙ্গগোপাধ্যায় ।বলতে চাই হ্যাঁ এ চ্যালেঞ্জ আপনি
জিতেছেন।ছাপা ,মেঘ অদিতির আঁকা প্রচ্ছদ সব মিলিয়ে চমৎকার বইটি পাঠকপ্রিয়
হবে বলেই আমার বিশ্বাস ।
#...এবং অস্পৃশ্য হাত।। বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় ।।
তনুশ্রী পাল । বাবু পাড়া ।রাউত লেন।জলপাইগুড়ি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন