ঐতিহ্য চিনেছিলাম হাত ধরে
খুব ছোট তখন। জীবন বলতে পরিবার, খেলা, পড়া, খাওয়া, আবৃত্তি, সাঁতার। বেকারত্ব বা প্রেম কোনটাতেই ব্যথা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিলনা।
পুজো এলে নতুন জামা, ঠাকুর দেখা, হৈ-হুল্লোড়। পাড়ার মন্ডপ দাপানো আর শহরের বড়বড় পুজো মন্ডপে ঢুঁ মারা ছাড়া কোন কাজ নেই। সামনেই মামা বাড়ি। দাদু-দিদার কোলে ঝাঁপিয়ে সেইসব গল্প করতাম। যেন বিশ্বজয়ের কথা বলছি। দিদার তৈরি নাড়ু আর দাদুর তৈরি আমসত্ব উপঢৌকন পাচ্ছি। আর পকেট বোঝাই হচ্ছে ফুচকা-আলুকাবলি-ঘুগনি-চকোলেট-আইসক্রিম বা পটকা কেনার টাকায়। এমনই একদিন দাদু বলল, চল আজ তোকে অন্য ধরণের ঠাকুর দেখাব। দাদুর লুনা তখন রথ। আমি অর্জুন। হাতে তীর-ধনুকের বদলে ক্যাপ ফাটানো বন্দুক। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ সারথী। সারা শহর ঘুরে পুরনো পাড়া ও প্রাচীন পুজো চেনালো গল্প করতে করতে। প্রথম দেখলাম ঠাকুরের ইয়া বড় বড় টানা টানা চোখ, সিংহ কেমন ঘোড়ার মতো। একচালায় সব ঠাকুর। রঙগুলোও আলাদা কেমন। অবাক হতাম। দাদু হাসত, ইতিহাস-ঐতিহ্যের গল্প বলতো।
এভাবেই চিনেছি শহরের মল্লিক রাজ বাড়ির পুজো বা কর্ণেলগোলার বিপ্লবীদের পুজো। ঘুরে দেখেছি পুরনো
পাড়ার পুজো। সেবার থেকে অনেকগুলো বছরে ষষ্ঠী বা সপ্তমীতে আমার একার অধিকার ছিল দাদুর শহর পরিক্রমায়। বড় হচ্ছি। বন্ধু বাড়ছে। আরও বড়। প্রেম। দিনগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল। পুরনো পুজো বান্ধবীসুখদের সাথে ঘুরেছি কখনও। ২০১৪ সাল। দাদু একবার অসুস্থ হল। মনে পড়ল ছেলেবেলা। হঠাৎ হাজির হয়েই বললাম, চল ঠাকুর দেখব। আমার তখন স্কুটি। দাদুকে নিয়ে চলছে পরিক্রমা। সমস্ত শহুরে নতুন নামকরা মন্ডপ ঘুরে দাদুকে নিয়ে ঘুরছি পুরনো অলিগলি। দাদুর মুখে ততক্ষণে বাচ্চাদের মত হাসি। বলল, আমার দাদু হতে চাস! সব দেখে ঢুকে পড়েছি বল্লভপুর। তারক দা (পাইন) গুটখার প্যাকেট, বিড়ি, সিগারেট দিয়ে দেবী মূর্তি তৈরি করেছে। দাদুকে দাঁড় করিয়ে ছবি তুললাম মোবাইলে। দাদুর পাশেই লেখা ' তামাকজাত দ্রব্য বর্জন করুন' বললাম, এবার এসব ছেড়ে দাও না দাদু। উত্তর এল ছাড়ব। তুই কবে ছাড়বি? এইটুকু বয়স থেকেই। দাদু জানল কি করে?! লজ্জায় চুপ আমি। এড়ানোর হাসি দিয়ে ফের ঘোরা শুরু।
২০১৫ সালে দাদু খুব অসুস্থ। নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পেয়েছে ১৫ দিন মতো। দুর্বল। মামাবাড়ির সবার সাথে দাদু-মা - আমি। শেষ একসাথে ঠাকুর দেখা।
দাদু আর নেই। নেই ঐতিহ্য
চেনানোর মানুষ। আমি আজও ঢুঁ মারি পুরনো অলিগলির প্রাচীন পুজোয়। সে শিখিয়েছিল পুরনোকে। আমার শহরকে।
=============================
নাম- নিসর্গ নির্যাস মাহাতো
ঠিকানা- মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
বার্তালাপ: ৮৩৭৩০৩৯০৮৩