Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

ভ্রমণকাহিনি: ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়





অতীতের রাজগৃহ আজকের রাজগীর



((ফিরে দেখাঃ যে কোনো অতীতের ঘটনা অতীতে শেষ হয়ে যায় না। অতীত ছাড়িয়ে তার রেশ বর্তমান এমন কী ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয়। আমরা অবশ্যই জানি বর্তমান বা ভবিষ্যতে অতীত বড় দামি একটি বিষয়। অতীতের বিচার হয় ভবিষ্যতের কষ্টিপাথরে। অতীত যদি অতীতেই শেষ হয়ে যেত তবে ইতিহাস আর কেউ পড়ত না। মহেঞ্জোদর, হরোপ্পা বা নালন্দার ধ্বংসস্তুপ নিয়ে কেউ আর ভাবতে বসত না। এই ভ্রমণকাহিনীটি আজকের নয়। ২০০০ সালের অর্থাৎ প্রায় কুড়ি বছর আগের। এই ২০ বছরে রাজগীরের সামাজিক চিত্র হয়ত পরিবর্তিত হয়েছে অনেক কিন্তু নালন্দার ইতিহাস নয়। আর সেই কারণেই এই ভ্রমণকাহিনী আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি। আর একটা সুবিধাও আছে। তখনকার অর্থনৈতিক চিত্র খানিকটা আঁচ পাওয়া হয়ত যেতে পারে এই পুরোন ভ্রমণকাহিনী দিয়ে। ))

টাইম মেশিন বলে একটা কথা আছে যার সাহায্যে বর্তমান থেকে অতীতে যাওয়া যায়। একথা আমাদের জানা ছিল। তবে একটা লাক্সারি বাসে চড়েও যে তা করা যায় তা আমাদের এই ভ্রমণের আগে পর্যন্ত জানা ছিল না।
জি-টি-রোড ছেড়ে বাস যখন উঠল এসে প্রশস্ত আলো ঝলমলে দুর্গাপুর রোডের মসৃণ পিঠে তখনও কিন্তু মনে বেশ চিন্তা ছিল। হাতে ছিল মাত্র সাড়ে তিনদিন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে বিস্তৃত এক কর্মসূচী সম্পাদনের গুরুদায়িত্ব বুকে জাগাচ্ছিল একটা কম্পন। মনের অসংখ্য জানলায় হাত নেড়ে যাচ্ছিল অসংখ্য অনিশ্চিতের সম্ভাবনাগুলি।
চার ঘন্টা পরে রাত প্রায় সাড়ে দশটায় পানাগড়ে গিয়ে ক্লান্ত গাড়িটা নিল ক্ষণিক বিশ্রাম আর যাত্রীরা একটা চটির মধ্যে সেরে নিল তাঁদের নৈশ আহার।
আবার আধঘন্টার মধ্যেই গাঝাড়া দিল বাসটা। বিরতিহীন এই নৈশযাত্রার মধ্যেই চলল আমাদের তন্দ্রামাখা ঘুম আর কখনও বা জেগে উঠে আগত স্থানটির পরিচিতি লাভের জন্যে ঔসুক্য। কখনও দূরবিস্তৃত ফাঁকা মাঠ, কখনও বা সন্নিকটস্থ ঘন জঙ্গল ভেদ করে দু'চোখে তীব্র সন্ধানী আলো জ্বালিয়ে এগিয়ে চলল একগুঁয়ে বাসটা।
রাত কেটে গেল- কচি ভোরটা এক চপল শিশুর মত খেলে বেড়াতে লাগল আমাদের চোখের সামনে। বাসটা তখন রাজগীরের পাহাড়ী পথটা ধরে ফেলেছে। চড়াই-উৎরাই আর হেয়ার পিন বাঁকের মুহুর্মূহ আক্রমণে অ্যাক্সিলারেটর আর ব্রেকে পা আর স্টিয়ারিং-এ হাত রাখা ব্যতিব্যস্ত ড্রাইভারের পাশের জানলা দিয়ে আবিষ্কার করি সহসাই এক মহাবিস্ময়কে। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে তখন উঠে পড়েছে স্নিগ্ধ লাল রঙের একটা গোলা। লাল আবির ছড়িয়ে মাঘী শুক্লা-পঞ্চমীর সূর্যোদয় আমাদের রাজগীরের মাটিতে জানাল সাদর আমন্ত্রণ। এরপর ক্রমে বয়েস বেড়ে যাওয়া সূর্যটা আমাদের পাশে পাশে চলতে চলতে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল সেই পাহাড়ী পথটায়।
তখন বেলা প্রায় পৌনে নটা। ডানদিকে রোপওয়ে যাওয়ার পথটাকে খানিক অপেক্ষা করতে বলে আমরা এগিয়ে গেলাম রাজগীর শহরটার দিকে। মিনিট পনেরর মধ্যেই বাসের যাত্রা হল শেষ। এবার শুরু হল আস্তানা খুঁজে নেওয়ার তোড়জোড়। আগে থেকে বুকিং করার সূত্রে সহজেই আসীন হওয়া গেল যে যার ঘরে। এবং সাড়ে দশটার মধ্যে প্রত্যেকের প্রাতঃকৃত্যের হল সমাপন।
মধ্যাহ্ন ভোজের পরে জড় হওয়া গেল ধর্মশালা রোডের মোড়ে। এখানে শহর দর্শনের প্রধান যানবাহন হল টাঙ্গা। রিক্সা যদিও আছে তবু তা এই পাহাড়ী রাস্তার পক্ষে একটু অনুপযুক্ত বলে আমাদের মনে হল। জনপ্রতি পঁচিশ টাকার বিনিময়ে নির্দিষ্ট হল (২০০০ সালের হিসেবে)।  
যাত্রার শুরুতেই এক বিপত্তি। গাড়ির আনাড়ি সওয়ারীদের এলোমেলো বসায় ভারসাম্যহীনতার জন্যেই হোক বা পাহাড়ী পথের অসাম্যতার জন্যেই হোক ঘোড়াটা যেন চিঁ হিঁ হিঁ করে ডেকে সূচনা করল এক বিদ্রোহের। ফলে যাত্রীরা পপাত ধরণী তলে। আর বিদ্রোহ করে উঠল এক যাত্রীও। যে টাঙ্গায় এমন বেয়াড়া ঘোড়া থাকে সে টাঙ্গায় সে চড়বে না। অনেক করে বুঝিয়ে তাকে রাজি করিয়ে আবার আমাদের যাত্রা হল শুরু।   
জরাসন্ধর রাজধানী অতীতের রাজগৃহ ছিল এক সমৃদ্ধ নগরী। গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীর জৈন উভয়ের সঙ্গেই অতীতের এই উন্নত শহরের ছিল আত্মীক যোগাযোগ। টাঙ্গা যে রাস্তা দিয়ে চলল তার বাঁ পাশে পড়ে জীবকের বনানী-সমৃদ্ধ বিস্তৃত আমবাগান। নামে আমবাগান হলেও প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল ভেষজ উদ্ভিদের এক বিশাল বাগিচা। জীবক ছিলেন মগধরাজের পারিবারিক চিকিৎসক। পথে পড়ল রাজা বিম্বিসারের জেলখানা যার ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে জড় করা কতগুলো পাথর ছাড়া আর কিছুই নয়।
রাজগীরের এক প্রধান আকর্ষণ হল রোপওয়ে। গৃদ্ধকূট পাহাড়ের ওপর থেকে যার যাত্রা শুরু আর সাড়ে সাত মিনিটের ব্যবধানে রত্নগিরি পাহাড়ের চূড়ায় যার মধ্যাবস্থান। যে পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে বুদ্ধের মন্দির আর বিশ্বশান্তি স্তুপ। এমন মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ পাওয়া সত্যি সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। রোপওয়ে চড়ে যে একবার এই মন্দিরে এসেছে উঠে, সেই বুঝি চেয়েছে বারংবার আসতে। এমন পরিবেশ মানুষকে নিয়ে যেতে সক্ষম এক মহাশান্তির জগতে। দিগন্তবিস্তৃত সেই ভাবরাজ্যে প্রায় বিলীন হতে বসেছি—কিন্তু সময় বলে যে একটা জিনিস হাতঘড়িতে টিকটিক আওয়াজের মধ্যে দিয়ে আপন অস্তিত্ব জাহির করতে লাগল, তার জন্যেই ফিরতে হল আবার বাস্তব জগতের দো্রগোড়ায়। চক্রাকার রোপওয়ের পরবর্তী সাড়ে সাত মিনিটটা হল আবার গৃদ্ধকূট পাহাড়ে ফিরে যাবার।
রোপওয়েতে চড়ার একটা ভারি আনন্দ আছে। এই অপার আনন্দ যে কখনও চড়ে নি, কিংবা ভয়েতে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে তারা কেউ উপভোগ করতে পারে নি। পাহাড়ের গা বেয়ে আকাশপথে ডানা মেলা একটা পাখির মত মনে হচ্ছিল নিজেকে। ঠিক তেমনই হালকা তেমনই মুক্ত। পাহাড়ের পাষাণ-কঠিন গাত্রদেশ কিংবা অতল খাদ-গহ্বর অথবা চারপাশের সুসজ্জিত সুউচ্চ শৃঙ্গরাশি মনের মধ্যে ভয়ের  ভাব যতই সৃষ্টি করছিল তার চেয়ে বেশি সৃষ্টি করছিল অভিযানের আনন্দ ম্পন্দন। পাহাড় ঘেরা রূপকথার রাজ্যে মেঘের মধ্যে দিয়ে যেন ভেসে চলেছি কোন এক হৃদয়েশ্বরীর সন্ধানে—কুচবরণ কন্যার সুখস্পর্শ কল্পনায় চোখ বুজে ফেলি কোন সুনিবিঢ় মুহূর্তে। দেখা মেলে যেন রাজকন্যার বন্দিকারী কুৎসিত-দর্শন দানবের। কোষ থেকে বার করি বিশালকায় তরবারি—ঝনৎকারের তীক্ষ্ণ আওয়াজে হঠাৎ-ই চোখ খুলে যায় আমার। দেখি গিয়ারে গিয়ারে ঘর্ষণের আওয়াজ।
রোপওয়ে ধরে আমরা ততক্ষণে নেমে এসেছি বাস্তবের মাটিতে। তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে দিই সারা মুখে। এই চাপাতে যেমন মজা আছে তেমনি মজা আছে এই চাপা দেখাতেও। আমরা মাটিতে নেমে যাবার পরও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি সার সার তারের ওপর দিয়ে আসা-যাওয়া মুক্ত খাঁচাগুলোর দিকে। এই আসাযাওয়ার খরচ জনপ্রতি মাত্র পনের টাকা (২০০০ সালের হিসেবে)।
ফেরার পথে জৈনমন্দির, শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ, আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম শেষ করে একেবারে প্রায় সন্ধ্যার মুখোমুখী উষ্ণকুন্ডের কাছে। জুতো খুলে ঢুকতে হবে। মোজা খোলাও দরকার না হলে ভিজে যাবে। উষ্ণকুন্ড বেশ গভীর। সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়। সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে নিচে। অনেকেই স্নান করছে। আমাদের কারোর তখন স্নান করার প্রয়োজন ছিল না তাই বাইরে বেরিয়ে এসে আবার টাঙ্গায় চড়ে বসি।
পরের দিন খাওয়া দাওয়া করে বাস ছাড়ার কথা দুপুরে। গন্তব্য হবে নালন্দা আর পাওয়াপুরী। কিন্তু অকারণ আলস্যে বেলাটা কাটিয়ে দিতে মন চাইল না। টাঙ্গা ভাড়া করা হল জনপ্রতি হিসেবে দুটো স্পট অর্থাৎ জাপানী মন্দির আর মিউজিয়াম দেখার জন্যে। জাপানী মন্দিরের যথেষ্ট আকর্ষণ বৈশিষ্ট থাকা সত্ত্বেও বলব মিউজিয়ামটিকে কেউ যেন অবহেলা না করেন। যথেষ্ট সময় নিয়ে এই প্রদর্শনীশালাটি ঘুরে দেখা ভাল। মহাবীরের জীবনী নিয়েই মূলত এই প্রদর্শনী তবু এত সুন্দর কারুকার্য বেশ ভাল লাগে।
ফিরে এসে চান-খাওয়া। সেরে আবার বেরিয়ে পড়া গেল নালন্দার পথে। রাজগীর থেকে মাত্র দশ বার কিলোমিটারের ব্যবধানে নালন্দা। বাঁ দিকে অতীতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে একটি ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছু নয়। গাইড ছাড়া ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ অনেকটা নুন ছাড়া ভাত খাওয়ার মত। পেট ভরলেও মন ভরে না। পা দুটোকে চালিয়ে ভ্রমণ করছি বটে তবে কৌতূহল মিটছে না। তাই গাইডের সঙ্গে চুক্তি করে নেওয়া গেল। চল্লিশজনের বাসভর্তি যাত্রীর জন্যে দক্ষিণা মাত্র চল্লিশ টাকা (২০০০ সালের হিসেবে)।
যা হোক প্রদর্শকের হিন্দি সুরারোপিত বাংলায় শুরু হল আমাদের নালন্দা পরিভ্রমণের পরিদর্শন-বক্তৃতা। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ-এর স্মৃতি বিজড়িত আচার্য শীলভদ্রের নালন্দা সত্যই এককালে ছিল বিশ্বের বিদ্যালয়। প্রায় সারা পৃথিবীর এক মহাবিস্ময়—বিপুল এক জ্ঞানভান্ডার। দশ হাজার ছাত্র আর দেড় হাজার শিক্ষকের থাকার ঘর, অধ্যয়নের ঘর এমন কী বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার পর্যন্ত। আটফুট চওড়া দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ঘরগুলি ছিল প্রাকৃতিক শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। গরমের সময় ঠান্ডা আর শীতের সময় গরম আরামদায়ক ঘরগুলোর দরজার পরিবর্তে ছিল বিশাল বড় বড় হুড়কোর ব্যবস্থা। ওই হুড়কো বন্ধ থাকলেই ধরে নিতে হত ঘর বন্ধ আর ভেতরে যাওয়া মানা। কঠোর অনুশাসনের মধ্যে ছিল তখনকার ছাত্রজীবন। বিস্ময়ের এক মহাঘোরের মধ্যে দিয়েই সিঁড়ি বেয়ে উঠলুম একেবারে ওপরে। ধ্বংসস্তূপের একেবারে শিখরে। বিশাল এক ইতিহাসকে দেখে নেওয়া গেল পাখির চোখে। সত্যিই চমৎকার। আমাদের ভারতবর্ষ যে অতীতের এক পৃষ্ঠায় সারা পৃথিবীকে জ্ঞানালোকে আলোকিত করত এই গর্বটুকু মনের মধ্যে পুরে নিয়ে ফিরে চললাম।  
এবার উল্টোদিকের সংগ্রহশালায়। নালন্দা ধ্বংসস্তূপ খননের ফলে যা কিছু মূর্তি, তৎকালীন ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র, বাসনপত্র ও আরও নানা সামগ্রী রাখা আছে এই সংগ্রহশালায়। কিছু মাথায় ঢুকল কিছু ঢুকল না। ইতিহাসের ছাত্র নই। তবে রসায়নের ছাত্র হিসেবেও জানি অতীতের সঙ্গে বর্তমানের বিক্রিয়ায় যে ভবিষ্যৎ তৈরি হয় তাতেও থাকে অতীতের ছাপ, অতীতের বিষয়, অতীতের বিস্ময়, অতীতের শিক্ষা। 'ইতিহাস নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটায়'-এই বক্তব্যই ইতিহাস পাঠের সার্থকতা উপলব্ধি করায়। এ কথা অনস্বীকার্য যে ঐতিহাসিক এই বিখ্যাত ধ্বংসস্তূপটিতে না এলে বোধহয় বুঝতেই পারতাম না ইতিহাসের পরমাণু বিস্ফোরণ কাকে বলে। নগ্নচোখে অদৃশ্য অতিক্ষুদ্র এক পরমাণুর ততোধিক ক্ষুদ্র কেন্দ্রক বিদীর্ণ হয়ে সৃষ্টি হয় বিশাল পরিমাণ পারমানবিক শক্তি। তুলনায় এই নালন্দা তো অতি স্পষ্ট রূপে দৃশ্যমান। খনন কার্যটিকে যদি কেন্দ্রক বিদারণ হিসেবে ধরা যায় তো অতীত নালন্দার এই ধংসস্তূপ অতি অবশ্যই তুলনীয় সেই পারমানবিক মহাশক্তির সঙ্গে যা বলে দিচ্ছে কী বিশাল এক কর্মকান্ড আর জ্ঞানভান্ডার ছিল অতীতের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিকশিত এই মহাশক্তিটি শুধু আমাদের মন্ত্রমুগ্ধই করে না, অতীতের এই জ্ঞানভান্ডারটির আলোকোজ্জ্বল এক রূপ উপস্থাপিত করে আমাদের বোধবুদ্ধির সমীপে।
এখানে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। সূর্য প্রায় দিকচক্রবালের কাছাকাছি। ঘড়িতে পাঁচটা বাজতে আর কুড়ি মিনিট। পৌঁছেছি  পাওয়াপুরি। মন্দিরগুলো এক এক করে বন্ধ হয়ে যাবে পাঁচটার সময়। অতএব পড়ে গেল হুড়োহুড়ি। টাঙ্গা আর অটোর সঙ্গে দর কষাকষি। কিন্তু এই দুই বাহনই প্রায় সমান ভাড়া দাবি করছে দেখে আমরা এই খানাখন্দ ভরা এবড়োখেবড়ো পথে অটোকেই বেছে নিলাম। তারপর সেই অটোচালকের রণকৌশলের ওপর নির্ভর করে আর পৈত্রিক প্রাণগুলোকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে এগিয়ে চলি। এটা রাস্তা নাকি পাথরে ভরা চন্দ্রপিষ্ঠ ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। তবে একটা কথা বোঝা যাচ্ছিল যে দুপুরে যা খেয়েছিলুম সেগুলো সব এমন হজম হয়ে গেছে যে পেটের ভেতরে কোথাও খুঁজে পাওয়াই দুস্কর।
এখানকার জৈন মন্দিরগুলি অপূর্ব। তবে অপূর্বতম বোধহয় বিশাল সরোবরের মধ্যে বসান জলমন্দিরটি। জলপুরী নামে যা অভিহিত। অজস্র তামরসশোভিত এই সরোবরে পাতা যত দেখেছি ফুল তত পাইনি। নানা জাতের পাখিরা পদ্মপাতার ওপর দিয়ে গটগট করে হেঁটে যাচ্ছে এ দৃশ্য ভারি মনোহর।
অস্তগামী সূর্যের ছটায় ভগবান মহাবীর জৈনের শ্বেতাম্বর মূর্তিটি এখানে অর্থাৎ সরসিজ মধ্যস্থ এই শ্বেতপাথরের প্রাসাদে এক অনাস্বাদিত মহাপ্রসাদের মত লাগল। মহাবীরের পবিত্র পুতাগ্নি স্থাপন করা হয়েছে এখানে। আবশ্যিকভাবেই মাথা নিচু করে ঢুকতে হয় এখানে কারণ সাড়ে তিনফুট দরজা দিয়ে ঢোকার কৌশল ঐ একটাই। ঠিক তার পেছনে রয়েছে মহাবীরের পদচিহ্ন। মন্দির থেকে পাড়ে যাওয়ার চমৎকার সেতুপথ দিয়ে মানসিক প্রশান্তি নিয়ে যখন ফিরে চলেছি তখন গোধূলিলগ্নের স্নিগ্ধ লাল সূর্যটা ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে অস্তাচলের কন্দরে।  
আজকের মত ভ্রমণ শেষ করে খেয়ে নেওয়া গেল। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। এবার রাজগীরের পথে। কাল ভোর ছটায় বাস ছাড়বে। কালকে যাব বুদ্ধগয়া। হোটেলে ফিরে খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া গেল।
ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠে চান। করতেই হল কারণ কাল সারাটা দিন আমাদের পথে অর্থাৎ বাসের মধ্যেই থাকতে হবে। ভোর সাড়ে ছটাতেই বাস যেন তোপধ্বনি করে যাত্রাশুরুর ইঙ্গিত দিল। বাসে ওঠার আগে চা বিস্কুট খাওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে বাসে জলখাবার দেওয়া হবেআজ ঠাসা প্রোগ্রাম। তাই উদরেও তো কিছু ঠেসে দিতে হবে।
এবার চলেছি বৌদ্ধগয়ার পথে। গয়াকে না ডিঙ্গিয়ে বৌদ্ধগয়া যাওয়ার উপায় নেই। গয়া একটি হিন্দু তীর্থ। আবার প্রেতযোনি থেকে উদ্ধার পাওয়ার পীঠস্থানও বটে। পরিব্রাজক বা পর্যটক যেই হোক না কেন গয়া ভারতের বুকে একটি অতি উল্লেখযোগ্য স্থান। ঐতিহাসিক আর পৌরাণিক তো বটেই।
অন্তঃসলিলা ফল্গু নদীর তীরে বাসটা যখন দাঁড়াল তখন বেলা প্রায় নটা। রুটি কলা আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে ব্রিজটার পাশে দাঁড়িয়ে ধ্যান দিই নদীর ওপারে 'গয়া' নামক প্রেতমুক্তির ও পিন্ডকরণের সেই স্থানটির প্রতি। গয়ায় পিন্ড দেওয়ার স্থান দুটি। একটি স্বাভাবিক মৃত্যুর অন্যটি অপঘাতমৃত্যুর যা প্রেতশীলা নামে অভিহিত।
প্রাকৃতিক দৃশ্য বড়ই মনোহর। পঞ্চসতীর অন্যতমা সীতার শাপে ফল্গু হয়েছে অন্তঃসলীলা। ধু ধু বালিখাতে বালির অন্তর দিয়ে বয়ে চলেছে নদীর চোরাস্রোত। ইতিহাসকে মাটি ফুঁড়ে উঠতে দেখেছি রাজগীরে। এখানে পূরাণ যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে- রামায়ণের কত কাহিনী উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে চিন্তার বাতায়ন পাশে। অভিশপ্ত ফল্গুনদী এখানে ঢুকেছে বালির অভ্যন্তরে। অস্তিত্ব শুধু তার চোরাস্রোতের মধ্যে দিয়ে। বাল্মিকী সৃষ্ট নায়িকা সীতার শত দুঃখের ভারে ভারাক্রান্ত মন নিয়েই উঠে বসেছি বাসে। বাস ছেড়েছে আর আমরা ছেড়েছি গয়াকে।
বেলা দশটার মধ্যেই পৌঁছে গেছি বৌদ্ধদের ধর্মক্ষেত্র ও পীঠস্থান বুদ্ধগয়ায়। বাসটা দাঁড়াল থাই মনাস্টারি বা থাইল্যান্ডের মন্দিরের গা ঘেঁষে। রাস্তার এক পাশে। রাস্তা এখানে খুব চওড়া আর মসৃণ ও পরিষ্কার। আজ আর কোনও হোটেলে ওঠার সময় নেই। ঠাসা এই ভ্রমণসূচীতে উদর পূরণেরও একটা আবশ্যিক পর্ব রাখতে হয়। একটা স্কুল চত্বরে ব্যবস্থা হল রান্নাবান্নার। আমাদের সঙ্গে ক্যাটারিং গিয়েছিল। তাই তারাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল এই কাজে।
আমরা চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। এখানে অনেক মন্দির। সুন্দর আর সুদৃশ্য। পায়ে হেঁটে ধীরে সুস্থেই চলেছি মন্দির দেখতে। শান্ত আর শান্তির এক ক্ষেত্র। যা কিছু কথা সবই পর্যটকদের। উত্তরের দিকে হাঁটা দিই। প্রধান দ্রষ্টব্য মহাবোধি মন্দির। এর চত্বরটা যেমন বিশাল তেমন বিশালত্ব এর উচ্চতায়।  
সেদিন মেলা উপলক্ষে সমাগম হয়েছিল বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বির। বিরাট মেলা বসেছিল মন্দির প্রাঙ্গনে। শত সহস্র ভক্তের মিছিলের মধ্যে দিয়ে সংকীর্ণ পথটুকু করে নিয়ে কোনরকমে আমরা ঢুকে পড়লাম ভেতরে। অর্থ মূল্যের বিনিময়ে ক্যামেরায় ছবি তোলার অনুমতি পাওয়া যাবে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হল। বলাই বাহুল্য এখানে দেবতা স্বয়ং বুদ্ধদেব। সৌম্য মূর্তিটি দর্শন করে আমরা বেশ প্রীত হলাম। বিগ্রহ দর্শনের পর মন্দির প্রদক্ষিণ। ভাস্কর্যের চমৎকার এই মহা নিদর্শনটি মনে রাখার মত। মন্দিরের পাশে পাশে দেওয়ালে জ্বলছে শত শত প্রদীপ। ভক্তের দল প্রদীপ সাজাতে ব্যস্ত। অনেক ভক্তকে দেখা গেল দন্ডী খাটতে। আবার কয়েক জন মিলে পাঠ করছে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আর শৃংখলা লক্ষণীয় ছিল।
মন্দির প্রদক্ষিণ সেরে পায়ে পায়ে এসে পৌঁছলাম বিখ্যাত সেই বিশাল বোধিবৃক্ষের পদতলে। এই সেই বোধিবৃক্ষ যার নিচে তপস্যা করে গৌতম 'বোধিত্ব' অর্জন করেছিলেন। এর বিশালতা এক মুগ্ধ –বিস্ময়ে দর্শন করার মত।
ভীড় কাটিয়ে অতিকষ্টে সেখান থেকে তিব্বতীয় মনাস্টারি। মন্দিরগুলি সবই অলংকরণের বৈশিষ্টে উজ্জ্বল। শুধু মন্দিরই নয়, এখানের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হল দুশ কুইন্ট্যালের ধর্মচক্র যা শুধু ঘুরেই চলেছে। কিন্তু সেই ধর্মচক্রে হাত ছোঁয়ানোর পুন্যকর্মটুকু সারার আগেই মন্দির হয়ে গেল বন্ধ। ব্যস্ততায় হয়ত বলতে ভুলে গেছি বারটা থেকে দুটো পর্যন্ত এখানকার সব মন্দির বন্ধ থাকে।
এরপর তো আস্তে আস্তে সব মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে। দুটোর পর আর আসা যাবে না। কারণ তখন আমাদের খাওয়া আর ফিরে যাবার তাড়া। তাই হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। আমরা কয়েকটা অটো ভাড়া করে উঠে পড়লাম।
চীনা মনাস্টারি দেখে অটো থামল থাই মনাস্টারিতে। অভাবনীয় স্থাপত্বকলার অচিন্তনীয় এক প্রদর্শনী। মনে হল যেন দেখে যাই আর দেখে যাই। কিন্তু এই মন্দির-নগরীতে মন্দিরের আর শেষ কোথায়? কিন্তু হাতঘড়ির ঘূর্ণায়মান কাঁটা বলে দিচ্ছিল সময়ের একটা শেষ আছে।
এরপর একে একে ভুটানি মন্দির, জাপানী মন্দির। আর এরই পাশে যা দেখলাম তা বোধহয় অবর্ণনীয় অত্যাশ্চর্যতায় ভরা। স্থাপত্যের পরে ভাস্কর্যের এই চমকপ্রদ নিদর্শনে শুধু অভিভূতই নয়, একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম। আশি ফুট উঁচু বিশাল ধ্যানরত বুদ্ধমূর্তি। একটা মাত্র পাথর কেটে কেটে এটি নির্মিত হয়েছে। মাঝে কোথাও জোড় নেই, নেই কোনও ফাটলও। আগে যা দেখেছি সব কিছু যেন নিস্প্রভ হয়ে গেল এই দৃশ্যে। কেন না আগের সব কিছুর মধ্যেই ছিল আড়ম্বরের আয়োজন আর প্রাচুর্যের প্রকাশ। কিন্তু বিশাল এই মূর্তির উপাদান শুধুই এক তাল পাথর। একটা সামান্য ছেনি আর হাতুড়ি যে জড় এক খন্ড পাথরে এমন ভাবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, এ মূর্তি না দেখলে তা বিশ্বাস করা খুব কঠিন। সুতরাং বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে অনেকটা সময় ব্যয় করে ফেললাম এই বিস্ময়-শিলাটি ভালভাবে অবলোকন করতে।
খাওয়ার পরে সামান্য বিশ্রাম। দুপুর তিনটে নাগাদ বাস ছাড়ল। বিদায় বুদ্ধগয়া, বিদায়। রাজগীরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে যেমন নিয়েছি কৌতূহল মেশান আনন্দটাকে, বুদ্ধগয়ার ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও নিয়ে চললাম পরিপূর্ণ একটা হৃদয়কে। ইতিহাস, পুরাণ, ধর্ম আর দর্শন—একই অঙ্গে এত রূপ দেখি নি তো আগে। তাই সারাটা পথ রোমন্থন করে চললাম সদ্য শেষ হয়ে যাওয়া ভ্রমণের এই স্মৃতিটাকে। রাত্রি শুরুর তমসাচ্ছন্ন বাসযাত্রার মধ্যে চিন্তাচ্ছন্ন যে মনটাকে আবিষ্ট আর একাত্ম করে দিয়েছিলাম রাত শেসের আর এক সূর্যোদয় জাগিয়ে দিল তাকে। বলল, হে পর্যটক, ওঠো, জাগো। শক্তি সঞ্চয় কর। এক ভ্রমণের সমাপ্তি দিয়ে সূচনা কর আর এক ভ্রমণের ইচ্ছেটাকে।
ঘড়িতে তখন ভোর ছটা। 
 ================================================

 DR. ARUN CHATTOPADHYAY
181/44 G.T.Road (Gantir Bagan)
P.O.Baidyabati
Dist. Hooghly(PIN 712222)
Mobile 8017413028
Mobile 8017413028
                   

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩