এক অন্য অন্নপূর্ণার গল্প
সৌভিক দে
উনিশ শতকের শুরুর দশকগুলিতে ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসাবে অনেকেরই নেওয়ার স্পর্ধা ছিল না। রক্ষণশীল সমাজে নারীরা জল মেপে চলতে একপ্রকার প্রায় বাধ্যই হতেন। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) অনুসারে, এই মুহূর্তে ভারতে লিঙ্গ বেতনের ব্যবধান ২৭ শতাংশ। ২০২৩ সালের চিত্রটা যদি এমন হয়, তাহলে তখন ভারতীয় মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থানের কার্যকারিতা কেমন হতে পারে, তা কিন্তু সহজেই অনুমেয়। এরপরও সেই সময় কিছু মহিলা তাঁদের কাজের মাধ্যমে পুরুষতন্ত্রকে ভেঙে ফেলার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। তাঁদের ইতিহাস লেখা অন্য শৈলীতে। তেমনই একজন ব্যতিক্রমী নারী অন্নপূর্ণা দত্ত। তখন পুরুষদের মধ্যেই স্টুডিয়ো ফটোগ্রাফি সীমাবদ্ধ। অমন সামাজিক অবস্থার সমান্তরালেই কিন্তু অন্নপূর্ণা দত্তের ফটোগ্রাফি।
প্রাণীবিজ্ঞানী ফটোগ্রাফার জন জর্জের কন্যা ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী আনা অ্যাটকিনসের ক্যামেরা হাতে দক্ষতার কথা অনেকেরই জানা। বেশ কিছু ব্রিটিশ মহিলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু মুহূর্তই ছবি তুলে রেকর্ড করে রাখতেন। সে-সব তাঁদের জীবন ও ইতিহাসের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। অলিভ এডিস হলেন প্রথম মহিলা, যাঁকে ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে যুদ্ধক্ষেত্রে ছবি তোলার জন্য প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯০০ সালের প্রথম দিকে ছবি তুলতেন ক্রিস্টিনা ব্রুম। নিজেকে 'প্রেস ফটোগ্রাফার' বলে ডাকতেন। ১৮৬৮ সালে সেকেন্দ্রাবাদে লালা দীনদয়াল তাঁর স্টুডিয়ো 'লালা দীনদয়াল অ্যান্ড সন্স' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯২ সালে লালা দীনদয়ালেরই উদ্যোগে চালু জেনানা স্টুডিয়ো। ওই সময় কিছু ভারতীয় মহিলা শিক্ষক, নার্স, ডাক্তার হিসাবে পেশায় আসতে শুরু করছিলেন। কিন্তু ক্যামেরায় ছবি তোলাকে লোকজন মূলত টাইম পাস হিসাবেই দেখত।
পর্দাঘেরা পালকিতে চড়ে ধনী-সম্ভ্রান্ত বংশের নারীরা স্টুডিওতে ছবি তুলতে যেতেন। সেই আবদ্ধ স্টুডিওর আলোকচিত্রীও নারী। ভারতে প্রথম পেশাদার নারী ফটোগ্রাফার হচ্ছেন মিসেস ই. মায়ার। তিনি ওল্ড কোর্ট হাউজ স্ট্রিট কর্নারে নারীদের জন্য স্টুডিও খুলেছিলেন। এটাই সম্ভবত ভারতবর্ষে প্রথম জেনানা স্টুডিও। প্রথম ভারতীয় নারী ফটোগ্রাফার হিসেবে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের তৃতীয় স্ত্রী মহারানী মনমোহিনী। ঊনবিংশ শতকে ঠাকুরবাড়ির একজন নারীকেই ফটোগ্রাফি করতে দেখা গেছে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়দা সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে প্রথম ফটোগ্রাফার নিয়ে এসে হইচই ফেলা মহিলা জ্ঞানদানন্দিনীই। কলকাতার সুপরিচিত 'বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড স্টুডিয়ো'-তে ফটোগ্রাফির শিক্ষা জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর। ইন্দিরা দেবী ও তাঁর পতি প্রমথ চৌধুরীর একটি ছবি তুলেছিলেন ফটোগ্রাফার দেবলীনা সেন রায়। ছবি পেয়ে খুশি হয়ে ইন্দিরা দেবী দেবলীনাকে চিঠি লিখেছিলেন। এ চিঠিতে তিনি তাঁর মায়ের ফটোগ্রাফিচর্চার কথা উল্লেখ করেছিলেন— "আমার মা প্রায় শতাধিক বৎসর আগে বার্ণ অ্যাণ্ড শেফার্ড-এর কাছে ছবি তুলতে শিখে বাড়ির এমন সব লোকের ছবি তুলেছিলেন যাদের অন্য কোনও ছবি নেই বা হবার সম্ভাবনা ছিল না।" ঊনবিংশ শতকে বাঙালি নারীদের মধ্যে প্রথম ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলেন সরোজিনী ঘোষ। তিনি এমনকি তিনি নিজস্ব স্টুডিও ও ফটোগ্রাফিক স্টোর খুলেছিলেন। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি অমৃতবাজার পত্রিকায় সরোজিনী ঘোষকে নিয়ে 'লেডি ফটোগ্রাফার' নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এতে লেখা হয়, "৩২ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের মহিলা আর্ট স্টুডিওর সুদক্ষা হিন্দু মহিলা শিল্পীর কাজ দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি।" সিদ্ধার্থ ঘোষ 'ছোবি তোলা'য় লিখেছেন, "তিনি তাঁর দেশের পুরুষদের হাতে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতার যোগ্য ছিলেন।"
তবে অন্নপূর্ণা দত্ত প্রথম বাঙালি নারী, যিনি ফটোগ্রাফিকে জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে। তার পিতা অম্বিকাচরণ মিত্র ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক। ১২ বছর বয়সে অন্নপূর্ণার বিয়ে হয়েছিল আইনজীবী উপেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। তাঁর স্বামীরও পছন্দের বিষয় ফটোগ্রাফি। অন্নপূর্ণার প্রেরণার বীজ তিনিই। শুরুতে শখ করেই ফটোগ্রাফি শিখেছিলেন। ১৯২০-র দশকে, একজন ফটোগ্রাফার হিসাবে অন্নপূর্ণা দত্তের প্রতিভা সামনে আসে। সংসারের খরচ জোগাতে পুরোদস্তুর একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার হিসেবে বাস্ত ছিলেন ১৯৩০ থেকে ১৯৪০-এর দশকে। তিনি কোনও স্টুডিও খোলেননি, নিজের বাড়িতে কাজ করতেন। তবে ছবি তুলতে বাইরে (নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে) যেতেন। এমন একটি সময়ে তাঁর এই ভূমিকা, যখন মহিলারা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কাজ করবে এমন ভাবনা পরিচিত ধাঁচের বাইরে। ধাঁচা ভাঙা এক নারী অন্নপূর্ণা দত্ত। তিনি তৎকালীন ধনী ভারতীয় পরিবারের অন্দরমহলে প্রবেশ করে তোলেন সেখানকার মানুষের অন্তরঙ্গ প্রতিকৃতি। সে-সব আলোকচিত্রে গার্হস্থ্য জীবনের সারমর্ম প্রতিফলিত। ছবি ডেভেলপ, প্রিন্টিং, ফিনিশিং— সব এক হাতে করতেন। স্ব-উদ্যোগেই মুদ্রিত এই ফটোগ্রাফগুলিতে মুসলিম অভিজাতদেরও উপস্থিতি ছিল। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হাসান সোহরাওয়ার্দী, কবি জসিমউদ্দীন এবং প্রখ্যাত গায়ক আব্বাস উদ্দিন আহমেদের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের ছবি তোলেন। ক্যামেরাবন্দি করেন হিজাব পরিহিত মুসলিম মহিলাদের ছবি। মহিলাদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় অনুভূতি ফটোগ্রাফির আগে নয়, বরং তাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে তাঁদের যাপনের অঙ্গ হিসাবে, এমনই বিশ্বাসে বিশ্বাসী অন্নপূর্ণা দত্ত। সেকারণেই জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে আলোকচিত্র গ্রহণের কাজ করতে পেরেছিলেন। নিজের ছেলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি অবসর নিয়েছিলেন। উপমহাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, কবি সরোজিনী নাইডুর একটি ছবি তুলেছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী।
অন্নপূর্ণা দত্তের সবচেয়ে আইকনিক চিত্রগুলির মধ্যে একটি স্ব-প্রতিকৃতি, যা তাঁর প্লেট ক্যামেরার পাশে তিন-চতুর্থাংশ প্রোফাইলে বন্দি করা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, লেন্সের ক্যাপ ধরে আছেন তিনি। তাঁর লাবণ্যময়ী দৃষ্টি ফ্রেমের বাইরের দিকে। চোখমুখে আত্মবিশ্বাস। নিজের বাড়ির স্টুডিয়োতে নিজেই এই ছবি তুলে তা মুদ্রণও করেন তিনি। ছবিটি বর্তমানে তাঁর ছেলে অমরেন্দ্রনাথ দত্তের সংগ্রহে রয়েছে। এহেন ছবিওয়ালি তৎকালীন তরুণ-তরুণীর কাছে ছিলেন আদরের 'ফটোগ্রাফার মাসিমা'। অন্নপূর্ণা দত্ত ফটোগ্রাফির ইতিহাসে চির উজ্জ্বল নাম। ক্যামেরা হাতে নেওয়া অন্নপূর্ণা দত্তের সেই স্ব-প্রতিকৃতি 'স্বাধীনচেতা নারী'র একটি আইকনিক চিত্রও বটে।
তথ্যসূত্র—
১.) India and It's Visual Cultures : Community, Class and Gender in a Symbolic Landscape; Lettmann, Birgit (2017); Sage Publications India Private Limited.
২.) ফটোগ্রাফির আদিযুগ ও বাঙালি মহিলা ফটোগ্রাফারের কাহিনি,
prohor.in (19/08/2023).
৩.) How Indian Photography Pioneer Annapurna Dutta Broke Gender Barriers Using Her Lens, Vaaswat Sarkar (
homegrown.co.in).
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন