Featured Post
নারীর দ্রোহ ও প্রতিবাদ : 'নিষিদ্ধ লোবান' উপন্যাসের আলোকে ।। মোরশেদুল আলম
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
নারীর দ্রোহ ও প্রতিবাদ : ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসের আলোকে
মোরশেদুল আলম
সারসংক্ষেপ : মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তীকালে আবির্ভূত হয়েও স্বাধীনতা-উত্তরকালে যে-সব ঔপন্যাসিক বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের সুবিস্তৃত অঙ্গনে একইভাবে দীপ্তিবান, তাঁরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনার সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বহন করেছেন অসাধারণ দৃপ্ততায় ও প্রকাশ-নৈপুণ্যে। মুক্তিযুদ্ধের অন্তর-বাহির আর বাঙালি জাতির অকুতোভয় দুর্বার সংগ্রামের বহুবর্ণিল প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ নির্মাণ করেছে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানঋদ্ধ শিল্পীচৈতন্য; এবং এই ঔপন্যাসিকদের মধ্যে যাঁর নাম স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখযোগ্য, প্রাতিস্বিকতায় প্রোজ্জ্বল যাঁর উপন্যাসসমূহ- তিনি সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬)। উপন্যাসমালায়, বিশেষত ‘নিষিদ্ধ লোবান’ (১৯৮১) উপন্যাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে বাঙালি জাতিসত্তার মর্মবেদনা, হাহাকার, অবরুদ্ধ সময়ের যন্ত্রণাদগ্ধ ছবি একদিকে যেমন তিনি এঁকেছেন অসাধারণ শৈল্পিক নৈপুণ্যে, অন্যদিকে তেমনি তুলে ধরেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি সাধারণ বাঙালি নারীর দ্রোহ, সংগ্রাম, প্রতিবাদ এবং তাদের অসীম বীরত্বগাথা, আশ্চর্য দুঃসাহস ও নিখাদ দেশপ্রেম। স্মর্তব্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সর্বব্যাপী হতাশা, নির্বেদ ও বিপর্যয় কাটিয়ে মহৎ শিল্পীমানস অনুসন্ধান করে জীবন ও শিল্পের জন্যে সদর্থক এবং আলোকোজ্জ্বল এক মানসভূমি- সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ (১৯৮১) উপন্যাসে এ-জাতীয় অভিজ্ঞান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রয়ী উপন্যাসের আশাব্যঞ্জক দিক।
সূচকশব্দ : সৈয়দ শামসুল হক, উপন্যাস, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, নিষিদ্ধ লোবান, নারী, দ্রোহ, সংগ্রাম, প্রতিবাদ, আশাব্যঞ্জক।
মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হিংস্র বৈরী নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত ব্যক্তিমানসের বহুমুখী সঙ্কট, বহুভুজ জটিলতা, আতঙ্কগ্রস্ত, ভীত মানবসত্তার নির্জিত বিপন্ন ও বিধ্বস্ত জীবন, তাদের শোক-তাপ, দুঃখ-ক্ষোভ ও যন্ত্রণা এবং পরিণামে একজন সাধারণ বাঙালি নারীর এক প্রোজ্জ্বল, দীপ্তিময় ইতিবাচক এবং সদর্থক জীবনচেতনায় ক্রম-উত্তরণের ইতিকথা সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬)-এর ‘নিষিদ্ধ লোবান’ (১৯৮১) উপন্যাসের মৌল উপজীব্য। এই উপন্যাসে একজন সাধারণ বাঙালি নারী বিলকিস, যার সর্বস্ব- আত্মীয়-স্বজন, পিতা-মাতা, ভাই-বোন নিহত হলো, লুণ্ঠিত হলো ঘর-বাড়ি যুদ্ধের শুরুতেই, সেই দুঃসময়ে যখন কোনো কিছুই স্বাভাবিক নয়, কেউ তা আশাও করে না- তখন কী অসম্ভব জেদ, স্নায়ু-চাঞ্চল্য ও আচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে ঢাকা থেকে নবগ্রামে পৌঁছোলো বিলকিস; এবং কীভাবে ভ্রাতৃপ্রতিম এক তরুণ সিরাজ (প্রকৃত নাম শ্রী প্রদীপকুমার বিশ্বাস এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধৃত হবার পর হিন্দু বলে শনাক্তও হয়) বিলকিসকে সাহায্য করতে এসে জড়িয়ে পড়ে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়- তাদের উদ্বিগ্নতা, ব্যাকুলতা, রহস্য ও স্মৃতি এবং দুঃসাহসিকতা অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ও বিশ্বস্তভাবে ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসের বিস্তৃত ক্যানভাসে উপস্থাপন করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। পাশাপাশি মনুষ্যছদ্মবেশধারী পাকিস্তানি হায়েনাদের নির্বিচারে গণহত্যার করুণ ও বীভৎস চিত্রও অঙ্কিত করেছেন তিনি ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসের পরতে পরতে। ফলে, এই উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্ধকারময় ও অবরুদ্ধ-রক্তাক্ত মানবজীবন, বিপন্ন মানবসমাজ আর বৈরী সময়ের রূপকল্প :
ক. “বাজারের খোলা চত্বরময় ছড়িয়ে আছে লাশ। বেড়াহীন উলঙ্গ দোকানের খুঁটি আঁকড়ে পড়ে আছে লাশ। খালের দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে যে গলিটা, তার উপরে উপুড় হয়ে আছে লাশ। লাশের পর লাশ। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয় সারি চোখে পড়ে।... দুটো বাচ্চা উল্টে থাকা গরুর গাড়ির ছাউনি জড়িয়ে ধরে লাশ; চত্বর আর খালের ঢালু জুড়ে ইতস্তত বাঁশের গোল গোল ঝাঁকা, কলস, সবজি; আর সমস্ত কিছুর ওপর স্তব্ধতা, স্থিরতা, প্রত্যাবর্তনের আশাহীন অক্ষমতা।”১
খ. “জনপদে এখন কন্টিকারি ও গুল্মলতার বিস্তার। শস্য অকালমৃত, ফল কীটদষ্ট, ইঁদারা জলশূন্য। সড়কগুলো শ্বাপদেরা ব্যবহার করে এবং মানুষ অরণ্যে লুকোয়। দিন এখন ভীত করে, রাত আশ্বস্ত করে। বাতাস এখনো গন্ধবহ, তবে কুসুমের নয়, মৃত মাংসের।”২
পাকিস্তানি বর্বর পশুদের হাতে নির্মমভাবে নিহত ছোটো ভাইয়ের মৃতদেহ কবর দিতে গিয়ে বিলকিস দেখে সেখানে পাক-হানাদারদের হাতে নিহত আরও অনেকেরই লাশ পড়ে আছে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে। জ্যোৎস্না রাতের নির্জনতায় বিলকিস আর প্রদীপ এই অর্ধ-গলিত লাশগুলো সৎকার করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় পাকিস্তানি দালাল বিহারীদের হাতে। অতঃপর জলেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত সেনাবাহিনী-ক্যাম্পের দু’টি আলাদা ঘরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বিলকিস ও প্রদীপ। নির্জন কক্ষে কামাতুর পাকিস্তানি মেজর প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকে বিলকিসকে। কামোন্মত্ত পাক-মেজরের নারীদেহ সম্পর্কে দুর্দমনীয় কৌতূহল, সর্বোপরি তার অবচেতনাগত মনোভূমে সতত ক্রিয়াশীল অবদমিত যৌনাকাঙ্ক্ষা ও তার বিকারগ্রস্ত অভিব্যক্তির স্বরূপ উন্মোচনে ঔপন্যাসিক নির্মাণ করেন এক থমথমে, রুদ্ধশ্বাস ইন্দ্রিয়সঞ্চারী পরিবেশ :
“তুমি স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে মিলিত হবে’।
নীরবতা।
‘পানি দেয়া হয়েছে, গোসল করনি কেন?’
নীরবতা।...
‘আমাকে একটা কথা বলো, হিন্দু কী প্রতিদিন গোসল করে?’
নীরবতা।
‘হিন্দু মেয়েদের গায়ে নাকি কটু গন্ধ? তাদের জায়গাটা পরিষ্কার?’
নীরবতা।
‘শুনেছি মাদী কুকুরের মতো। সত্যি?’
নীরবতা।
‘শুনেছি হয়ে যাবার পর সহজে বের করে নেয়া যায় না? সত্যি?’...
বিলকিস মৃত প্রদীপের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেজরের দিকে তাকায়-
‘আমি এর সৎকার করতে চাই।’
‘তোমাকে এখন বাধ্য করতে ইচ্ছে করছে।’
‘আমার ভাইয়ের সৎকার আমি করবো।’
বিলকিস উঠে এসে মেজরের সম্মুখে দাঁড়ায়। দ্রুত নিজের পা টেনে নেয় মেজর।
কাপড় খুলে ফ্যালে।”৩
‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসে লিবিডো-চেতনার আধিক্য কখনো কখনো পীড়াদায়ক হলেও বিলকিসের পরিণাম সদর্থক জীবনচেতনায় উজ্জ্বল। উপন্যাসের অন্তিমে নারী-লোলুপ পাকিস্তানি মেজরকে ভ্রাতৃপ্রতিম প্রদীপের মৃতদেহ সৎকারে বাধ্য করে বিলকিস। নদীর তীরে প্রজ্জ্বলিত চিতায় প্রদীপের মৃতদেহ দগ্ধ হতে থাকে। অতঃপর যখন সঞ্চরণশীল কালো অন্ধকার রাত্রির পটভূমি দিগন্ত প্লাবিত করে অশনি আতঙ্ক ও অশুভ পরিণাম নিয়ে ধাবিত হয়, তখন বিলকিস ‘মশালের মতো প্রজ্জ্বলিত সমস্ত শরীর দিয়ে’ প্রতিবাদ জানায় এক অসম্ভব এবং অভাবনীয় প্রক্রিয়ায় :
“মেজর এসে বিলকিসকে বলে, ‘এরপর কী?’
বিলকিস সাড়া দেয় না।
তার পেছনে নদীর জল হঠাৎ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।
পোড়া মাংসের গন্ধে পেটের ভেতর থেকে সব উল্টে আসতে চায়, সে সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও। আগুনের প্রবল হলকা অনুভব করে সে। নাক-মুখ ঢাকবার চেষ্টা করে মেজর প্রাণপণে। বিলকিসকে আকর্ষণ করে।
ঠিক তখন বিলকিসও তাকে আলিঙ্গন করে। সে আলিঙ্গনে বিস্মিত হয়ে যায় মেজর। পরমুহূর্তেই বিস্ফারিত দুই চোখে সে আবিষ্কার করে, রমণী তাকে চিতার উপর ঠেসে ধরেছে, রমণীর চুল ও পোশাকে আগুন ধরে যাচ্ছে, তার নিজের পিঠও বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
রমণীকে সে ঠেলে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারতো। কিন্তু রমণীকে আগুন দিয়ে নির্মিত বলে এখন তার মনে হয়। তার স্মরণ হয়, মানুষ মাটি দিয়ে এবং শয়তান আগুন দিয়ে তৈরি। জাতিস্মর আতঙ্কে সে শেষবারের মতো শিউরে ওঠে।
মশালের মতো প্রজ্জ্বলিত সমস্ত শরীর দিয়ে তাকে ধরে রাখে বিলকিস।”৪
পঁচিশে মার্চ-পরবর্তী রক্তাক্ত ঘটনাপ্রবাহ, ব্যক্তি ও সমষ্টির টেনশান, নিরস্তিত্বের যন্ত্রণা এবং অস্তিত্বময় জীবন-অভীপ্সা রতির তীব্রতাকে শেষ পর্যন্ত ম্লান করে দেয়। বিলকিস এবং আগুনের মধ্যে নির্দেশিত হয় এক গভীর প্রতীকী তৎপর্য৫; অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজন বিদ্রোহী নারীর এই অভিনব প্রতিবাদ, সংগ্রাম এবং চূড়ান্ত আত্মত্যাগের ঐতিহ্য ও গৌরবের সঙ্গে বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রাম যোজনা করে এক স্বতন্ত্রমাত্রা। একজন সাধারণ নারীও স্ব-শ্রেণির সমাজভূমি থেকে নিজের শেকড় ছিঁড়ে গেলে কী অভাবিত মাত্রায় দ্রোহী ও প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে, তার দৃষ্টান্ত মেলে সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসে। বস্তুত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা, গৌরব ও বহুমাত্রিকতার রূপায়ণে উপর্যুক্ত উপন্যাসটি সন্দেহাতীতভাবে সাফল্যস্পর্শী।
তথ্যনির্দেশ
১. হক, সৈয়দ শামসুল, নিষিদ্ধ লোবান, ৩য় সং-১৯৯০, অনন্যা, ঢাকা, পৃ. ১৫
২. তদেব, পৃ. ২৪
৩. তদেব, পৃ. ৩৮
৪. তদেব, পৃ. ৫৬
৫. খান, রফিকউল্লাহ, বাংলাদেশের উপন্যাস : বিষয় ও শিল্পরূপ, ১ম সং-১৯৯৭, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ. ৩২৪
খ. সহায়ক গ্রন্থ
আল আজাদ, আলাউদ্দিন, সাহিত্যের আগন্তুক ঋতু, ১ম সং-১৯৭৪, মুক্তধারা, ঢাকা।
খান, রফিকউল্লাহ, বাংলাদেশের উপন্যাস : বিষয় ও শিল্পরূপ, ১ম সং-১৯৯৭, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
ঘোষ, বিশ্বজিৎ, বাংলাদেশের সাহিত্য, ২য় সং-২০০৯, আজকাল প্রকাশনী, ঢাকা।
জাহান, সারোয়ার, বাংলা উপন্যাস : সেকাল-একাল, ১ম সং-১৯৯১, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
পরিমল, রিষিণ, প্রসঙ্গ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ও অন্যান্য, ১ম সং-২০০৯, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।
মাহমুদ, অনীক, বাংলা উপন্যাসের চিত্তবৈভব : ফিরে দেখা, ১ম সং-২০০৬, সময় প্রকাশন, ঢাকা।
সুলতান, আমিনুর রহমান, বাংলাদেশের কবিতা ও উপন্যাস : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ১ম সং-১৯৯৬, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
==================
লেখক-পরিচিতি :
মোরশেদুল আলম
পিএইচ.ডি. গবেষক, বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ
এবং
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
উনাহত-সিংড়া কলেজ, বগুড়া, বাংলাদেশ
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন