Featured Post
নিবন্ধ ।। কর্মরতা মা -- একজন যোদ্ধা ।। তৃষা সানা
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
কর্মরতা মা - একজন যোদ্ধা
তৃষা সানা
আজকে যে মেয়েটি পরিবারে আদরে লালিত হচ্ছে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে, অদূর ভবিষ্যতে সে স্বনির্ভর হবে। তারপর তার নিজের সংসার হবে এই পর্যন্ত ঠিক আছে। এরপর যখন সে মা হবে তখন থেকে তার নতুন লড়াই শুরু। পরিবারের সহযোগিতা পেলে লড়াইটা লড়তে সুবিধা হয় আর পরিবারের পাশে না থাকলে ছাতি ফাটা রৌদ্রে, নগ্ন পায়ে, গলদঘর্ম অবস্থায় সে একাই লড়তে থাকে।
বর্তমান সময়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্রীর সংখ্যা ছাত্রের সংখ্যার চেয়ে কোন অংশে কম নয় বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাত্রীরা সংখ্যায় বেশি। চাকরির পরীক্ষার কোচিং সেন্টারগুলিতে ঢুঁ মারলে বোঝা যায় কত সংখ্যক ছাত্রী আগামী দিনে চাকরি করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা অনেকেই সফল হয়ে চাকরি করবে। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রশাসনিক, অধ্যাপনা, গবেষণা, শিক্ষকতা সহ সর্ব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বে তারা পালন করছে। অনেক মহিলা সফল ব্যাবসায়ী হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে।
যদিও কর্মক্ষেত্রে কর্মরত নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক কম তবুও ধীরে ধীরে এই সংখ্যা বাড়ছে। কর্মরত নারীরা আর পাঁচ জনের মতোই পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে কর্মজগতে পা দেন। কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হয় তখন যখন সে মা হয়। সরকারি ও বেশ কিছু বেসরকারি ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয়। যা খুবই জরুরী তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা থাকে না।
এই মাতৃত্বকালীন সময়টা কর্মজীবী মেয়েদের জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে ওঠে, ডাক্তারবাবু বলে দেন দিনে দুইঘণ্টা ও রাতে আটঘণ্টা ঘুম দরকার। দুইঘণ্টা ছাড়া ছাড়া খাবার ও পানীয় জল খেতে হবে নতুবা সন্তানের ওজন বাড়বে না কিন্তু প্রায় কোন কর্মক্ষেত্রেই দুপুরে বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকে না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কাজের ফাঁকে খাওয়ার সুযোগ হয় না। কর্মক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শৌচাগার থাকাও খুব জরুরী কারণ এই সময় ইউ.টি.আই. অর্থাৎ Urinary track infection এর সম্ভাবনা খুব বেড়ে যায়। বাসে, ট্রেনে বা অন্যান্য যানবাহনে করে যাদের প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয় তাদের ক্ষেত্রে এই যাতায়াতের পথটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এই সময় মেয়েদের অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন হয়। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা এই সময় খুবই প্রয়োজন। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে হবু মায়েদের জন্য বিশ্রাম কক্ষের ব্যবস্থা রাখা জরুরী, দীর্ঘ ৩০-৩৫ বছরের কর্মজীবনে ছয় থেকে আট মাস যদি দুপুরে একটু বিশ্রাম নেয় তবে কি খুবই কাজের অসুবিধা হবে? সেই মেয়েটি এইভাবে দীর্ঘ আট-নয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর সন্তানের জন্ম দেয়, মা হয়।
ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেখতে দেখতে কেটে যায় তারপর ৫-৬ মাসের ছোট্ট সন্তানকে বাড়িতে কাজের মাসি বা মা বা শাশুড়ি মায়ের কাছে রেখে তারা পুনরায় কাজে যোগ দেয়। দীর্ঘ নয়-দশ ঘণ্টা সন্তানকে ছেড়ে কাজ করে। মন পড়ে থাকে বাড়িতে ওই ছোট্ট শিশুটির জন্য। কি জানি তার পেট ভরে খাওয়া হল কিনা, মায়ের জন্য কাঁদছে কিনা, ঘুমালো কিনা। জন্মের পর থেকে মায়ের বুকের দুধ খেয়ে, মায়ের কোলের কাছে শুয়ে, মায়ের আদরে যার ঘুমানো অভ্যাস এখন সে প্রায় নয় -দশ ঘণ্টা মায়ের থেকে দূরে। প্রথম তিন-চার মাস মা ও সন্তান দুজনেরই খুব কষ্ট হয়। বাড়িতে যারা বাচ্চাটাকে সামলান তাদের ও বাচ্চার বাবার খুবই অসুবিধা হয়। অনেক সময় তারা বাচ্ছার মায়ের উপর বিরক্ত হন। আর মা তাকে তো বুকের ধন ছেড়ে, বুকে পাথর চাপিয়ে সকালে ঘুমন্ত সন্তানের মুখ দেখে, কোন রকমে নিজে তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে রওনা হতে হয়। এইভাবে দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে যায়।
বাচ্চাটা কখনো বাবা, কখনো ঠাকুরমা, দিদা, দাদু কিংবা কাজের মাসি এদের কাছে একটু একটু করে বড় হতে থাকে। সকালে মা যখন বেরিয়ে যায় তখন বাচ্চাটা মনে মনে কষ্ট পায়, কাঁদে আর সারাটা দিন অপেক্ষায় থাকে মায়ের ফিরে আসার। কখন সন্ধ্যা হবে মা ফিরবে, দরজার আওয়াজ হলে কান খাড়া করে থাকে, এই বুঝি মা ফিরল। মা ফিরলে তাকে আর ছাড়তেই চায় না। এমনকি খাওয়া ও বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ হয় না মায়ের। শিশু মায়ের কোল থেকে নামতে চাইছে না, মাকে ছাড়তে চাইছে না, কাঁদছে, সেই সন্তানকে জোর করে কিম্বা চকলেট আনবো, খেলনা আনবো, তাড়াতাড়ি ফিরব বলে অন্যের কোলে তুলে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। কি নিদারুন কান্নার স্রোত যে তার বুকের ভেতর দিয়ে অন্তর্বাহিনী নদীর মতো বয়ে চলে তার হিসাব কোথাও লেখা হয় না। আড়ালে চোখের জল মুছে সে বাস-ট্রেন ধরে, পরিচিতদের সাথে কান্না লুকিয়ে হেসে কথা বলে, কাজের ফাঁকে ফোন করে বাচ্ছার খবর নেয়।
দিনের শেষে বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামে সে ভাবে কখন বাড়ি গিয়ে সন্তানকে কোলে নেবে। সারাটা পথ দাঁড়িয়ে যেতে হবে জেনেও ভিড় বাসে বা ট্রেনে চেপে পড়ে কারণ ১০-১৫ মিনিট আগে পৌঁছে যাবে বাড়িতে। ছোট্ট বাচ্চা কোলে নিয়ে অন্য কোন মহিলাকে দেখলে, তার বাচ্চাকে আদর করে চুমু খাচ্ছে দেখলে তার মনের ভেতরটা হু করে। নিজের সন্তানকে কোলে পাওয়ার আকণ্ঠ ইচ্ছা তাকে আচ্ছন্ন করে। মনে মনে ভাবে কি জানি আমার মেয়েটা বা ছেলেটা শীতের পোশাক পরেছে কিনা, মাথায় টুপি, পায়ে মোজা পরেছে কিনা। তখনই একটা ফোন করে খবর নেয়। কোন কোনও দিন বাড়িতে বাচ্চাকে দেখে রাখার মত কাউকে পাওয়া যায় না সেদিন কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সন্তানকে নিয়ে যাওয়ার মত পরিস্থিতিও থাকেনা। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে যদি বাচ্চাকে রাখার জন্য সুব্যবস্থা থাকত তবে অনেক সুবিধা হতো। একটি কক্ষে ওদের খেলার ব্যবস্থা, ঘুমিয়ে পড়লে শোয়াবার ব্যবস্থা রাখলে এই মায়েরা বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে আসতে পারে।
এখন কথা হল বাচ্ছাকে সাথে নিয়ে এলে কাজের অসুবিধা হবে কিনা। বাড়িতে মা বাচ্চাকে নিয়ে রান্না করে, ঘর সংসারের যাবতীয় কাজ করে, পড়াশোনাও করে তাতেতো অসুবিধা হয় না। তাহলে কর্মক্ষেত্রে হবে কেন? বরং অন্যভাবে দেখলে সন্তান কাছে থাকলে তার মন শান্ত থাকে। নিশ্চিন্তভাবে সে কাজে মনসংযোগ করতে পারে। বাচ্চাটিও বাড়িতে মাকে দেখেছে যে মা কিভাবে দুহাতে সবদিক সামলায়, এবার দেখবে কর্মক্ষেত্রেও মা সমান দক্ষতার সাথে কাজ করে। মা কত কষ্ট করে প্রতিদিন পথে যাতায়াত করে, প্রতিদিন মাকে কত কাজ করতে হয় ঘরে বাইরের
কত দায়িত্ব সামলাতে হয়। এই কথা একজন বাবার ক্ষেত্রেও সত্য বাবাও যদি কোন কোন দিন সন্তানকে সাথে নিয়ে আসেন তবে একদিকে যাদের বাবা-মা দুজনেই কর্মরত তাদের যেমন সুবিধা হয় তেমনি সন্তানরা খুব কাছ থেকে দেখতে পায়, যে বাবা কত পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করছেন তাতে আগামী ভবিষ্যতে শ্রমের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও আস্থা জন্মায় এবং বাবা মায়ের উপার্জিত অর্থের প্রতি তারা যত্নবান হয়।
এই দুই গুন ভবিষ্যতে তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। আজকের শিশু কালকের ভবিষ্যৎ। এই শিশুদের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া উচিত মাতৃগর্ভ থেকে, জন্মের পরেও তাদের সুন্দর শৈশব উপহার দেওয়ার দায়িত্ব যেমন শিশুর বাবা-মা ও পরিবারের তেমনি সমাজ, সংসার ও সরকারেরও। আজকের কর্মরত মায়েদের ও তাদের সন্তানদের প্রতি পদে পদে অসুবিধার সম্মুখীন হলে হতে দেখলে আগামী দিনের মেয়েরা কর্ম জগতে পা দিতে দ্বিধা বোধ করবে। অনিশ্চয়তা ও অজানা সমস্যার ভয়ে পিছিয়ে যাবে। এর ফলে সমাজের সার্বিক অগ্রগতি ব্যাহত হবে।
কর্মরত মা একজন যোদ্ধা। সর্বশক্তি দিয়ে, নিজের জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেচনা দিয়ে সে তার কর্মক্ষেত্র, সন্তান ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করে চলেছে। এর পাশাপাশি নিজের স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের খেয়ালও তাকেই রাখতে হয়। কর্মক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের যাতে তারা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে ও রাখতে পারে তার ব্যবস্থা থাকুক। গর্ভবতী মায়ের বিশ্রামের ব্যবস্থা হোক এবং মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হোক।
লড়ো,
না লড়তে পারলে বলো।
না বলতে পারলে লেখো।
না লিখতে পারলে সঙ্গ দাও।
না সঙ্গ দিতে পারলে যারা এগুলো
করছে তাদের মনোবল বাড়াও।
যদি তাও না পারো, যে পারছে,
তার মনোবল কমিও না।
কারন, সে তোমার ভাগের লড়াই লড়ছে।
- ক্ষুদিরাম বসু
================
তৃষা সানা
কল্যানী, ব্লক - B, নদীয়া, ৭৪১২৩৫
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন