নারী স্বাধীনতা এবং সনাতন মানসিকতা
নূপুর দাস
নারী স্বাধীনতা আসলে
কী? এই প্রশ্নটি যদি জনসম্মুখে করা হয়, তাহলে বিজ্ঞ জনদের ধাক্কায় দাঁড়িয়ে থাকা
দায় হবে। নারী অধিকার নিয়ে, নারী স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলার লোকের অভাব হয় না। তাহলে
অভাবটা কিসের? অভাব হচ্ছে উপলব্ধিতে। নারী স্বাধীনতা যে কী, তা উপলব্ধি করার মানুষের
বড় অভাব। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি, বর্তমান সমাজে দুই ধরনের
জনগোষ্ঠী খুব তৎপর। এক ধরনের জনগোষ্ঠী উগ্রতার দোহাই দিয়ে নারী স্বাধীনতাকে কৌশলে
ধ্বংস করার চেষ্টায় মত্ত। আরেক ধরনের জনগোষ্ঠী নারী স্বাধীনতার আড়ালে উগ্রতাকে
প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত। নারী স্বাধীনতা মানে উগ্রতা নয়। তাই নারী স্বাধীনতায়
বিশ্বাসী হোন, উগ্রতায় নয়।
আমি বুঝি নারী
স্বাধীনতা অর্থ হলো, নারীর নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং নিজের সুস্থ
চিন্তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারা। বিষয়ের জটিলে না গিয়ে নারীবাদ নিয়ে একটা কথা না
বললেই নয়। নারীবাদের সৃষ্টি নারীকে পুরুষের মর্যাদায় তুলে আনার জন্য বা নারী
পুরুষের সমান অধিকারের দাবিতে এবং নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক অপরাধ কমানোর
লক্ষ্যে। কিন্তু নারীবাদী চেতনার মধ্যে দিনের পর দিন ধীর গতিতে স্থান করে নিয়েছে
একটি শরীরকেন্দ্রিক চেতনা, যা নারীকে আবার শরীরমাত্র করে তুলছে। কৌশলে অসম্ভব করে
তুলছে নারীর সত্যিকারের স্বাধীনতার সম্ভাবনাকে।
বিভিন্ন সভা-সমাবেশে
কিছু মানুষ গলা উঁচু করে নির্দ্বিধায় নারী স্বাধীনতার কথা বলেন, নারীদের এগিয়ে
যাওয়ার কথা বলেন। এই যে গলা উঁচু করে ভাষণ দেওয়া জনগোষ্ঠী, তাদের কী বিশ্বাস!
দিনশেষে তারাই যে নারী স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বুঝতে ব্যর্থ। সবচেয়ে দুঃখজনক, এটাই
যে সেই লোক দেখানো বড় বড় কথা বলা গোষ্ঠীই হয়তো ঘরে ফিরে নিজের স্ত্রী-সন্তানকে
কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টায় থাকেন।একজন নারীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত
প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীর দৃষ্টিতে চিন্তা করলে পরিষ্কারভাবে ওঠে আসবে নারীর জীবন
কতটা ভয়াবহ। এই ভয়াবহতার পেছনে যে কেবল পুরুষ সমাজ দায়ী তা নয়, বরং নারী ও পুরুষ
সমানভাবে দায়ী।আমরা কথায় কথায় পুরুষের দোষ খুঁজে বেড়াই, কিন্তু নিজেদের
দুর্বলতাগুলো নিয়ে কখনোই মুখ খুলি না। নারীবাদী হতে গিয়ে, আমরা অনেকটাই পুরুষ
বিদ্বেষী হয়ে উঠেছি, যা আসলে আমাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে শেখায়। কিন্তু
নারীরা যদি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে শেখে, নিজের জায়গাটা নিজে চিনে নিতে
শেখে, পুরুষের সাধ্য নেই নারীকে আটকানোর।
নারীকে নিজের পরিবার
থেকেই প্রথমত পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করা হয়। পরবর্তীতে অন্য পরিবারে গিয়েও নারী
সেই শিকলে আবদ্ধ থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ভালো লাগুক আর না লাগুক সবকিছুকে সায় দিতে
হয় তাকে। নারীর সাথে অন্যায় হলেও পরিস্থিতির কারণে মুখ বুজে সহ্য করে নিতে হয়। এর
বড় একটা কারণ নারীরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল। দুর্বল জায়গায় আঘাত করা মানুষের আজন্ম
স্বভাব। অনেক নারী আবার অধিকার আদায়ে কিছুটা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তাদেরকে দমানোর
চেষ্টায় পুরো সমাজ যেন উঠে পড়ে লাগে! আপনজনদের কাছ থেকে মুখস্থ বুলির মতো নারী
শোনে মানিয়ে নেওয়ার কথা! এই যে অত্যাচারের শিকার হচ্ছে, এ যেন নারীর দোষ।আরেকটি
মজার বিষয় হলো, সন্তান উৎপাদনের জন্য গর্ভ ধারণের মতো বিষয়টিকে সকল সমাজেই নারীর দায়বদ্ধতা
বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এটাকে একটা লজ্জার বিষয় বলে সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখনো,
আমাদের দেশে কোনো মেয়ে গর্ভবতী হলে তার আত্মীয়-স্বজনরা লুকিয়ে লুকিয়ে, কানে কানে
খবর দেয় যে অমুক গর্ভবতী।গর্ভবতী নারীকেও চাপে রাখা হয় গর্ভধারণের
কথা সহজে প্রকাশ না করতে। যেন গর্ভধারণ করে মেয়েটি এক লজ্জাজনক অপরাধ করে ফেলেছে।
সেই আত্নীয়-স্বজনদের মধ্যে নারী আত্মীয়রা রয়েছে। অথচ মানবসমাজে গর্ভধারণ করার
ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তার একচ্ছত্র আধিপত্য শুধু নারীর। দুঃখের বিষয়, এই যে নারীরাও এই
সত্য উপলব্ধিকরণে এখনো ব্যর্থ।
নারীকে বলা হয় মায়ের জাত। এই কথাটার পরিপ্রেক্ষিতে আছে নারীকে সম্মান
দেওয়া। কিন্তু বর্তমানে এই ‘মায়ের জাত’ শব্দটিকে পুঁজি করেও নারীকে কোণঠাসা করার
চেষ্টা দেখেছি।বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নারীকে বিভিন্ন সম্পর্কের নারী হয়ে যেতে হয়,
কিন্তু আলাদা করে সে কোনো জাত নয়। সে কেবলি একজন নারী, একজন মানুষ। এখনো অনেক নারী
এবং পুরুষও মনে করেন নারীবিষয়ক যেকোনো আলোচনা অশ্লীল, বিতর্কিত। নারীর অধিকার নিয়ে
কথা বলাও এই অশ্লীল, বিতর্কের অংশ।এ রকম ধারণা থেকে বের হয়ে আসা সবচেয়ে
জরুরি৷ মন-মানসিকতা স্বচ্ছ না হলে যতই আন্দোলন আর সভা-সমাবেশ হোক না কেন, গলা
ফাটিয়ে যতই নারী স্বাধীনতার কথা বলা হোক না কেন, দিন শেষে ফলাফল শূন্যই থাকবে।
মন-মানসিকতা স্বচ্ছ
করার প্রয়োজনীয়তা শুধু পুরুষের নয়, নারীরও। নারীর বুঝতে হবে, নারী স্বাধীনতা মানেই
স্বেচ্ছাচারিতা নয়। নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সবকিছুকে অগ্রাহ্য করতে হবে
এমন নয়, তবে সামনে বাধা আসবেই, তা ভেবে প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় নারীকেই প্রস্তুত
থাকতে হবে। নারীকে নারীর মতো করেই বাঁচতে দেওয়া উচিৎ। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে,
নারীর প্রথম পরিচয় হচ্ছে সে মানুষ। অন্য সব মানুষের মতো নারীও নিজের ইচ্ছের,
পছন্দের, ভালোবাসার সিদ্ধান্তের মানুষ।জনৈক নারী বলেছিলেন,
‘আমি নারী, আমি হৃদয় দিয়ে বিশ্ব জয় করবো’। হ্যাঁ উগ্রতা দিয়ে নয়, স্বেচ্ছাচারিতা
দিয়ে নয়। নারীর আছে হৃদয়, নারী সেই হৃদয় দিয়েই বিশ্বজয় করবে। আর এই হৃদয়ের কারণেই
নারীকে আটকানোর সাধ্যও কারো নেই। আমি মনে করি প্রতিটা দিনই নারীদের। তাদের
নিজেদেরই নিজেদের মতো করে নিজেদের দিন সাজিয়ে নিতে হবে। নারী দিবসে প্রতিটি নারীর
প্রতি রইলো শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
আজ আমরা মুখে নারী স্বাধীনতার কথা বলি। কিন্তু মূলত নারী স্বাধীনতা কি
তা আজও আমাদের কাছে স্পষ্ট? স্বাধীনতা মানেই মুক্তভাবে যা কিছু করার অধিকার কি?
নাকি যা ভাল সুস্থ চেতনার কার্যক্রম তা লক্ষ্য করে এগিয়ে যাওয়া? এটাকে অনেকে
গুলিয়ে ফেলেন। অনেকে মনে করেন স্বাধীনতা মানেই তো স্বাধীনতা। যা খুশি করার অধিকার।
কিংবা যেমন খুশি তেমনভাবে চলা। সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বোধের নিয়মনীতিগুলো আমরা
উপেক্ষা করতে পারি না। উপেক্ষা করলে বরং নিজেরই ক্ষতি। যা কিছু ভাল তা আমাদের
গ্রহণ করতে হবে আর তার অন্তরায় তা অবশ্যই বর্জনীয়। আজ অনেকেই ‘নারী স্বাধীনতার’
সঙ্গে ‘সনাতন’ অনেক অনেক নিয়মনীতি বা চলার বিষয়কে গুলিয়ে ফেলেন। অথচ বুঝেন না যে,
সনাতন যে নিয়মগুলো আমাদের শিকড়ে প্রোথিত তা কখনও উপেক্ষা করার নয়। নারী স্বাধীনতা
মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। নিজের চরিত্রে, পোশাক পরিচ্ছদ, কথাবার্তা সনাতনের ছাপ
থাকা অন্যায় নয়। বরং উগ্র আধুনিকতা, যা আমাদের সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যহীন
তেমনভাবে চলাই নারী স্বাধীনতার অপব্যবহার বলে মনে করি। একজন নারীকে বুঝতে হবে আমি
কে? আমার লক্ষ্য কি? কি করে একজন পুরুষের পাশাপাশি সসম্মানে কাজ করে নিজের দক্ষতা
অর্জন এবং নিজের যোগ্যতায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় তা ঠিক করা। অনেক সনাতন
মানসিকতা লালন করা নারীও ছিলেন এ সমাজে মাথা উঁচু করে। কিন্তু উগ্র আধুনিকতা তথা
নারী স্বাধীনতায় অপব্যবহারকারীগণ আজও তাদের আসন স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারেননি। আজও
তাই প্রথমত নারীকে বুঝতে হবে স্বাধীনতা কি? সেটা সনাতন মানসিকতাসম্পন্ন নারীই হোন
কিংবা উগ্র আধুনিকতাসম্পন্ন নারীই হোন। আমি বুঝি নারী স্বাধীনতা অর্থ হলো নারীর
নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা। নিজেকে শালীনভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে সমাজের
সকলের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া। আর এই দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে সনাতন কিংবা আধুনিক এ
দুটো যুগ হতেই কল্যাণমূলক, অর্থবহ নীতিকে গ্রহণ করে সমানতালে এগিয়ে যাওয়াই নারী
স্বাধীনতার তথা নারী অধিকারের মূলমন্ত্র নিহিত। আমি চাই প্রতিটি নারীই সময় নয়
কিংবা যুগ নয় নিজের স্বাধীনতা কিংবা অধিকার যাই বলেন সেটা সম্বন্ধে সচেতন হবেন
তবেই না আমাদের ‘স্বাধীনতা’ অর্থবহ হবে।
================
সহায়কগ্ৰন্থঃ
১) সুতপা ভট্টাচার্য, মেয়েদের
লেখালেখি, পুস্তকবিপণি, কলকাতা, ২০০৪
২) ধনঞ্জয়
ঘোষাল, নবচেতনায় বঙ্গনারী, আশাদীপ, কলকাতা, ২০১৫
৩) অমিত্রাসূদন ভট্টাচার্য, কুড়িএকুশ শতকের নারী ঔপন্যাসিক, আশাদীপ, কলকাতা, ২০১৪
৪) শেফালী মৈত্র, নৈতিকতা
ও নারীবাদ, নিউএজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৩
৫) মল্লিকা
সেনগুপ্ত, স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১১
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন