অদ্বিতীয়া শ্রেয়া
মিঠুন মুখার্জী
"অপরের দুঃখ দেখে যদি মন ভারাক্রান্ত না হয়, চোখ দুটি জলে ভিজে না আসে, দুঃখী মানুষের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে যেতে না পার, তবে আমরা মানুষ নই। মনুষ্যত্ব বোধের জাগরণ না ঘটলে এ জনম বৃথা"--- এমন কথাই বলেছিলেন শ্রেয়াদের বাড়িতে আসা স্বামী নিত্যানন্দ গোস্বামী মহারাজ। তাদের বাড়িতে অস্টম প্রহর নাম সংকীর্তনের আয়োজন করেছিলেন শ্রেয়ার বাবা আসিত বরন চক্রবর্তী মহাশয়। শ্রেয়া নবম শ্রেণীর একজন খুবই মেধাবী ছাত্রী। জীবনে কোনদিন প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি সে। শ্রেয়ার মার মানত থাকায় তার বাবা মায়াপুর থেকে নিজের গুরুদেবকে এনে বাড়িতে অস্টম প্রহর নাম সংকীর্তন দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কথায় কথায় গুরুদেব বলেন---"সবই প্রভুর ইচ্ছা। তিনি না চাইলে এই পৃথিবীর কিছুই হয় না। একটা পাতা পর্যন্ত নড়ে না। তার সেবা ছাড়া পরিত্রানের কোন উপায় নেই।" গুরুদেব নিত্যানন্দ গোস্বামীকে শ্রেয়ার বাবা-মা ও শ্রেয়া ভগবানের মতো মানে। এই বয়সে শ্রেয়া শিক্ষা-দীক্ষা সব নিয়েছে। তার বাবা-মার মত গলায় তুলসীর মালা পড়ে, কপাল থেকে নাক পর্যন্ত রসকলি কাটে। সারা বছর নিরামিষ ভোজন করে সে। যেখানেই হরিনাম হয় বাবা-মাকে নিয়ে সেখানেই উপস্থিত হয় শ্রেয়া।
গ্রামের লোকেরা শ্রেয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শ্রেয়াকে দেখিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের বলেন---"শ্রেয়াকে দেখে কিছু শেখ তোরা। এই বয়সে ওর মতো এত বড় ত্যাগ তোরা করতে পারবি না। আমিষ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে ও। বাজে সময় একটুও নষ্ট করে না। সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আনুগত্য প্রাণ। সংসারের কাজও করে মায়ের হাতে হাতে। এত কিছু করার পরও শ্রেয়া প্রতিবছর স্কুলে প্রথম হয়। এমন সন্তান ঘরে ঘরে দরকার। তবে প্রত্যেক বাবা-মার গর্বে বুকের ছাতি বড় হয়ে যাবে।" অনেকে আবার তার প্রতি প্রচন্ড হিংসা করে। তারা সব বাবা- মায়ের বকে যাওয়া সন্তান। ভালো হতে তাদের মনও চায় না।
শ্রেয়ার বাবা কলেজের বাংলার অধ্যাপক এবং মা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। সন্তান কিভাবে মানুষ করতে হয় তা তাদের জানা আছে। কারণ, বছরের পর বছর সন্তানসম ছাত্র-ছাত্রীদের তারা মানুষ করে এসেছেন। তারা দুজনে নিরহংকারী, ধার্মিক, পরোপকারী। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় এমন একটা মেয়ে পেয়েছেন তারা। নিশ্চয়ই আগের জন্মে তারা দুজন কোন মহাপুন্য করেছিলেন। অপরের যে ভালো করে ভগবানও তার ভালো চায়।
গুরুদেব নাম সংকীর্তনের আগের দিন রাতে অধিবাস শুরু করলে আসরে প্রচুর ভক্তবৃন্দের সমাগম হয়। শ্রেয়া তার বাবা-মার পাশে এসে বসে। শ্রীকৃষ্ণের ছবির দিকে তাকিয়ে তার দুচোখে বারিধারা নেমে আসে। সে এই সংসারের গরিব অসহায় অত্যাচারিত লাঞ্ছিত মানুষদের কথা চিন্তা করে আর ভাবে ---"এদের দুঃখের অন্ত নেই। আমি যদি কিছুটা হলেও এদের চোখের জল মুছতে পারতাম, তবে আমার মানব জনম সফল হতো। হে প্রভু আপনি আমায় আশীর্বাদ করেন, আমি যেন একজন ভালো মানুষ হয়ে মানুষের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারি।" এইটুকু মেয়ের মধ্যে এমন চিন্তা কল্পনাই করা যায় না। পরের জন্য এমনভাবে ভাবেন কজন?
নিত্যানন্দ গোস্বামী মহারাজ দুই দিন তাদের বাড়িতে ছিলেন। এই দুই দিন শ্রেয়াদের বাড়িতে যেন স্বর্গ নেমে এসেছিল। আসে পাশের বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীরাও তাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তারা গুরুদেবের সঙ্গে সঙ্গে সেবাও নিয়েছিলেন। শ্রেয়া ও শ্রেয়ার পিসিরা পুরো সেবা নেওয়ার দায়িত্বটা এই দুদিন সামলেছিল। শ্রেয়ার মার উপর কীর্তনের দিকটি ও গুরুদেবকে দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। প্রত্যেকেই তাদের দায়িত্ব ত্রুটিহীন ভাবে পালন করেছিলেন। ছয়টি কীর্তনের দল এসেছিল। তাদের সমস্ত দায়িত্বভার শ্রেয়ার বাবা-কাকারা ও গ্ৰামের লোকেরা নিয়েছিলেন। তাদের খাওয়া-দাওয়া, থাকার ব্যবস্থা সবই করা হয়েছিল। দ্বিতীয় দিন ভোর বেলা থেকে শ্রীকৃষ্ণের নাম গান শুরু হয়েছিল। সারারাত জেগে ভোর পাঁচটার সময় শ্রেয়ার চোখদুটো বুজে এসেছিল। কৃষ্ণ নাম কানের মধ্যে দিয়ে মরমে প্রবেশ করলে তার ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা ছেড়ে ছুটে চলে আসে বাইরে। নামগান শুনে দুহাত তুলে নৃত্য করে সে। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ বলে চোখের জল ফেলে। সেই দিনটি খুব আনন্দের সঙ্গে কাটে তার। সেদিন সারা দিনরাত্রি নামগান চলে। পরের দিন ধূলোট ও ভোগ মহোৎসব গুরুদেবের তত্ত্বাবোধনে খুব ভালোভাবে সম্পন্ন হয়। ভোগমহোৎসবের দিন বিকেলে গুরুদেবের চলে যাওয়ার সময় শ্রেয়াদের বাড়ির সকলের দুচোখে বারিধারা নেমে আসে । এমন গুরুভক্তি এখনকার সময় তেমন দেখা যায় না। একলব্যের ছিল গুরু দ্রোনাচায্যের প্রতি গভীর নিষ্ঠা ও ভক্তি। তাই নিজের আঙুল গুরুকে দক্ষিণাবাবদ দিয়েছিল। চলে যাওয়ার সময় গুরু নিত্যানন্দ গোস্বামী শ্রেয়ার বাবাকে বলেন--- " তুই একটা রত্ন জন্ম দিয়েছিস। তোর পত্নী রত্নগর্ভা। এই মেয়ের হৃদয় মানুষের জন্য কাঁদে। এর ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল তা আমি আমার জ্ঞানের নেত্রে দেখতে পাচ্ছি। এই মেয়ে তোদের বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। আর ঈশ্বরের প্রতি এর অগাধ বিশ্বাস। তোরা এমনকিছু করবি না যাতে ওর ঈশ্বর প্রেম দূর হয়ে যায়। এবার যখন আমি আসব তখন ওর জন্মকুন্ডলী ভালো করে বিচার করে দেব।"
গুরুদেব নিত্যানন্দ গোস্বামী শ্রেয়াদের বাড়ি থেকে যাওয়ার একসপ্তাহ পর পরলোক গমন করেন। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের কারণে তিনি চলে যান। এই খবর পাওয়ার পর খুব কষ্ট পেয়েছিল শ্রেয়ার পরিবারের সকলে । তিন দিন শ্রেয়ার দুচোখ দিয়ে অশ্রু নির্গত হয়েছিল। শ্রেয়ার বারংবার মনে পড়ছিল তার সম্পর্কে গুরুদেবের বলে যাওয়া কথাগুলো। সে ভাবে -- " গুরুজীর আমার সম্পর্কে বলে যাওয়া কথাগুলো বাস্তবে পূরণ আমাকেই করতে হবে। বসে থাকলে চলবে না। মানুষের জন্য কিছু করতেই হবে।"
এরপর দেখতে দেখতে দশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। এই দশ বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়। শ্রেয়ার বাবা অকালে চলে যান। মায়ের ও নিজের চেষ্টায় সে ডাক্তার হয়। বাড়ির পাশেই দাতব্য চিকিৎসালয় খোলে। বিনা পয়সায় গ্ৰামের মানুষদের চিকিৎসা করে সে। ঔষধ কেনার পয়সাও একেবারে গরিব মানুষদের হাতে গুজে দেয় । শ্রেয়ার বাবা ও মা দুজনা শিক্ষক-শিক্ষিকা হওয়ায় কোনো দিনই শ্রেয়ার অর্থনৈতিক কষ্ট অনুভব করতে হয় নি। এতোবড় ডাক্তার হলেও তার মন থেকে কৃষ্ণভক্তি চলে যায় নি। বাড়িতে বড় করে কৃষ্ণমন্দির করেছে সে। ডাক্তারি করার সাথে সাথে প্রভুর সেবায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে সে। অসহায় দরিদ্র মানুষদের বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা করলেও যাদের পারকতা আছে তাদের কাছ থেকে সে অর্থ নেয়।
গরীব মানুষদের চিকিৎসা করার সময় সে বলে --- " তোমাদের এতো পিছিয়ে থাকলে হবে না। ছেলে-মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ কর। দেখবে তোমাদের আর দুঃখ থাকবে না। কৃষ্ণনাম করো সর্বদা। তিনিই সঠিক পথে নিয়ে যাবেন।"এভাবে গরীব মানুষদের উৎসাহ দিত শ্রেয়া। গরীব ঘরের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে অর্থ সাহায্য করত সে । বলত-- " আমি যে তোমাদের টাকা দিচ্ছি তা কাউকে বলবে না। " সে ভাবত, দান করে লোককে বললে সে দানে কোনো মাহত্ম্য নেই। তাছাড়া শ্রেয়া মনে করত-- "সে নিমিত্তমাত্র, সবই শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছে। তিনিই তাকে দিয়ে এই সকল কাজ করাচ্ছেন। প্রভু তার প্রতি সদয় না থাকলে তারপক্ষে এক পা চলাও সম্ভব নয়।" এমন মনের মানুষ আজকালকার দিনে কদাচিৎ চোখে পড়ে।
শ্রেয়ার মা বিয়ের কথা বললে সে তাকে বলেছে --- " মা আমি বিয়ে করব না। বিয়ে আমার কাছে এগিয়ে চলার পথে অন্তরায়। আমার বাকিটা জীবন আমি দরিদ্র মানুষদের সেবা করে ও আমার প্রভুর পদসেবা করেই কাটিয়ে দেব। তুমি হয়তো ভাবছ তুমি না থাকলে আমার কী হবে। কিছু ভেবো না সব ঠিকঠাক চলবে। আমার শ্রীকৃষ্ণ আমাকে দেখবেন।" মেয়ের এইসব বিজ্ঞদের মতো কথা শুনে তিনি কিছুই বলতে পারেন না। রাধামাধবের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন --- " প্রভু, আমি যখন থাকব না আপনি ওকে দেখবেন। আপনার প্রতি ওর অগাধ বিশ্বাস আছে। এখনো ওর মনটা শিশুদের মতো সরল, নিষ্পাপ। ওর মনে অহংকার,হিংসা এখনো প্রবেশ করে নি। বাকি জীবনটাও ওকে এরকমই রাখবেন আপনি। দরিদ্র মানুষদের জন্য ওর হৃদয় কাঁদে। আমার শ্রেয়াকে নিয়ে আমি গর্ব করি। আশীর্বাদ করি ওর ভালো হোক।"
==================
মিঠুন মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন