google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re নিবন্ধ ।। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্যতম নারী মুখ ননীবালা দেবী ।। আবদুস সালাম - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫

নিবন্ধ ।। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্যতম নারী মুখ ননীবালা দেবী ।। আবদুস সালাম

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্যতম নারী মুখ ননীবালা দেবী

আবদুস সালাম


 পরাধীন মাতৃভূমির দাসত্ব ঘোচাতে ভারতের কতো যে নয়নের মণি তাদের অমূল্য সময় নষ্ট করে জীবন উৎসর্গ করেছেন তার খবর আমাদের মনে নেই। আমরা এই মহানুভবদের কতটা শ্রদ্ধার আসনে  বসাতে পেরছি এবং মনের মণি কোঠায় জায়গা দিতে পেরেছি তা নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হয়। আমরা স্বাধীন ভারতের নাগরিক যে কতটা অকৃতজ্ঞ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করার জন্য  নিজেদের সোনার সংসার, সোনার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে পিছপা হয়নি। 


১৯১৫ তে বাঘাযতীন শহীদ হবার পর বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবের ঝড় উঠেছিল। যদুনাথ মুখার্জীর নেতৃত্বে অস্ত্র জোগাড় করে বিদ্রোহ শুরু হলে সারা বাংলা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বাংলার যুব সমাজ গোপনে অস্ত্র যোগাড় করে সশস্ত্র বিপ্লবে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সাথে সাথে কিছু মহিলা যারা দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খলা মোচনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। 


আর আমাদের বাঙালি জাতির কিছু গদ্দার কেমন করে ইংরেজ জাতির পদলেহন করে নিজের চাকরির প্রমোশন আদায় করে নিয়েছিলেন তা আমরা বিভিন্ন গ্রন্থে দেখতে পাই। এমনই এক কুলাঙ্গার জিতেন ব্যানার্জী। দেশের ঐতিহাসিকগণ এদের আবার বিশ্বাস ঘাতক বলতে চান না। এরা নাকি কর্তব্য পরায়ন অফিসার। দেশের মেয়েদের যৌনাঙ্গে মরিচ বাটা দিয়ে যন্ত্রণা উপভোগ করেন। এরা কর্তব্য পরায়ন পুলিশ অফিসার। হায়রে আমাদের দেশের মানুষ। যাদের জন্য অমানবিক যন্ত্রণা সহ্য করে দেশকে ভালোবেসে নিজের মান সম্মান বিসর্জন দিয়ে  বিপ্লবী খাতায় নাম লেখান। 


হাওড়ার অমরেন্দ্র চ্যাটার্জী, রামচন্দ্র মজুমদার, অতুল ঘোষ বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিপ্লবী অমরেন্দ্র চ্যাটার্জীর পিসিমা ননীবালা দেবী ( ১৮৮৮-১৯৬৭) ষোল বছরে বিধবা হয়ে তাঁদের বাড়িতেই থাকতেন। নিজে উৎসাহী হয়ে ভাইপোর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। 

      ননীবালা দেবী কখনো চন্দননগরে কখনো রিষড়াতে গৃহকর্তৃ সেজে ঘরভাড়া নিয়ে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন আর পুলিশের চোখে ধুলো দিতেন। কলকাতার শ্রমজীবী সমবায়এ হঠাৎ পুলিশ এসে হাজির হয়েছিল। বিপ্লবী অমরেন্দ্র পালিয়ে গেলেও, ধরা পরেছিল রামচন্দ্র মজুমদার।

 রামচন্দ্র মজুমদার তাঁর 'মসার পিস্তল' (*) কোথায় রেখে গেছেন জানার জন্য কুলীন ব্রাহ্মণের বিধবা ননীবালা দেবী সধবা সেজেছিলেন। 

       না রঙ্গমঞ্চে নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমঞ্চে দাপিয়ে অভিনয় করেছিলেন ননীবালা। রামচন্দ্র বাবুর স্ত্রী সেজে শাখা সিঁদুর পরে জেলে গিয়ে জেনে এসেছিলেন পিস্তলের খবর। যেগুলো অন্য বিপ্লবীদের হাতে তুলে দিতে হবে। নইলে কাজের গতি থেমে যাবে। তাই সাত পাঁচ না ভেবে কে কী বলবে সেকথা না ভেবে সধবার বেশে রামচন্দ্র বাবুর স্ত্রী সেজে জেনে এসেছিলেন কোথায় লুকানো আছে তাদের এই সব অস্ত্র। 


    তাঁর মত বিধবাদের  তখন একাদশীর উপবাস ছিল জীবনসঙ্গী। চা খেলে  জাত যেতো।  সিন্দুর তো দূরের কথা লালরঙ থেকে দূরে থাকত তারা। অন্যের স্ত্রী সাজার জন্য শাখা সিঁদুর পরা অত্যন্ত দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিতে কুন্ঠিত হননি। যা ছিল তখন সমাজের চোখে বেশ্যাবৎ কর্ম।

 জিতেন ব্যানার্জীর মতো ইংরেজদের পা চাটা প্রভু ভক্ত পুলিশের তীব্র অনুসন্ধান তার অবস্থান জানতে বেশি দেরি হয়নি। অবিলম্বে প্রভু ভক্তদের দল জানতে পারল আগেই ননীবালা দেবী তাঁর ছোটবেলার বন্ধুর দাদা প্রবোধ চন্দ্র মিত্রের সঙ্গে পেশোয়া চলে গেছেন। এই সব প্রভু ভক্ত পুলিশেরা যদি ইংরেজদের সহায়তা না করতো তবে বহু আগেই তাদের এদেশ ছেড়ে চলে যেতে হতো। এই প্রভু ভক্তদের দল ছিলো বলেই একশো নব্বই বছর বহাল তবিয়তে  দেশের লোককে কুকুর বানিয়ে রাজত্ব চালিয়ে যেতে পেরেছে তারা। 

       হায়রে নিয়তি।   সেযুগে একজন বিধবার পরপুরুষের সঙ্গে দেশছাড়া মানে সমাজের কাছে 'চোখেরবালি' হওয়া। তবু সমাজকে থোড়াই কেয়ার করলেন তিনি।, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ভারত কে মুক্ত করতে হবে এই ছিল তাঁর একমাত্র কাম্য।      মেয়ে পালিয়েছে তার জন্য তার বাবাকে এনে হেনস্থা শুরু করেছে। সবই আমাদের দেশীয় পাচাটা কুকুরদের কর্ম।


গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ পেশোয়া গেলো। তিনি ধরাপড়লেন যখন তখন তিনদিনের কলেরার রুগী। স্ট্রেচারে করে আনা হয়েছিল তাঁকে হাজতে, তারপর কাশীর জেলে। জেরা করে কিছু জানতে না পেরে জিতেন ব্যানার্জী লংকা বেটে তাঁর যৌনাঙ্গে ঢেলে দেবার মত অত্যাচার চালিয়েছিল। যন্ত্রনায় ছটফট করেছেন, চিৎকার করেছেন তবু কারও সন্ধান দেননি। পরে আলো বাতাসহীন শেলেও সংজ্ঞা হারিয়েছেন বারবার তবু বিপ্লবীদের কোনো সন্ধান দেননি। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা রাজবন্দী।

          প্রখর ছিল তাঁর  মমত্ববোধ । তিনি  জানতে পারলেন দু কড়িবালা নামে এক বিপ্লবী ঐজেলে থার্ড গ্রেডের শাস্তি পাচ্ছেন জেনে  অনশন শুরু করেন। উনিশ দিন অনশন করে শরীর হয়ে পড়েছিল অতিশয় দুর্বল। নানা রকম ভাবে অত্যাচার করে ও পারেন নি তার      অনশন ভাঙাতে। অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়তে লাগলো ।

    জিতেন  ব্যানার্জী  জেরা  করার নামে শেলের ভিতর চালাতেন সব মর্মান্তিক অত্যাচার।যার বিবরণ দিতে গেলে গা শিউরে ওঠে। কোনো রকম ভাবে যখন বিপ্লবীদের  সন্ধান তাঁর কাছ থেকে আদায় করা গেলনা তখন অন্য রূপ ধরলেন।অনশন ভাঙতে অদ্ভুত  দাবি করেছিলেন, বামুনের মেয়ের হাতের রান্না না হলে অনশন ভাঙ্গবেন না। বামুনের মেয়ে বলতে দুকড়ি বালা দেবীর কথাই বুঝিয়েছিলেন যে! দুকড়িবালা দেবীর শাস্তি লাঘব করতে তাঁকে নিজের রান্না করিয়ে ঊনিশদিন পর অনশন ভাঙ্গেন। এহেন মহিলা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সকলের কাছে অবাঞ্ছিত হলেন। বালি ছেড়ে কলকাতায়  আসতে বাধ্য হলেন। শেষ জীবনে রান্নার কাজ করে ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে নিঃসঙ্গ জীবন কাটালেন।  শেষ জীবনে তাকে ভগবান ও ছাড়েন নি।শরীরে  দিয়েছিলেন টিবি রোগ। অসমর্থ শরীর তাই আক্রান্ত হয়েছিলেন বেশি।  কেমন করে দুমুঠো পেটে খাবার জুটবে এই চিন্তায় সবচেয়ে বেশি। ওষুধ কিনবেন কেমন করে। হায়রে আমাদের দেশের জনগণ। দেশের জন্য যে জীবনের সবটুকু  নিঃসার্থ দান করলেন তার জন্য সমাজ কি দিলো?  স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে ১৯৬৭ এর মে মাসে শেষ ৫০ টাকা পেনশন পেয়েছিলেন। এর পর তাঁর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।


 জেলের সুপার ইন্টেন্ডেন্ট গোল্ডির কথামত দরখাস্ত লিখেছিলেন জেলারকে সারদামায়ের কাছে যেতে চেয়ে কিন্তু গোল্ডি নিজে হাতে ননীবালার সামনে সেই দরখাস্ত ছিঁড়ে ফেললে সপাটে চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন গোল্ডির গালে। এর পর তাঁর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।এমনতর বিপ্লবী মা জন্মেছিলেন বলেই ১৯০ বছর পর স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল ভারতবর্ষ। আর জিতেন ব্যানার্জীর মতো  ফ্যান চাটা দারোগা বাবু আরও কিছু থাকলে আরও কতকাল যে ভারতবর্ষ কে পরাধীনতার ঘানি টানতে হতো কে জানে। বিপ্লবী ননী বালা দেবীকে জানাই সংগ্রামী অভিনন্দন। 


(* মসার পিস্তল:- এটি একটি স্ব-লোডিং পিস্তল  অটোপিস্টল বা অটোলোডিং পিস্তল । হ্যান্ডগান যা এর পরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার চেম্বারে  কার্তুজগুলিবের করে দেয় এবং লোড করে। প্রতিবার ট্রিগার টানলে এক রাউন্ড গোলা বারুদ করা হয় । একটি আধা-স্বয়ংক্রিয় পিস্তল তার বল্টুকে সরানোর জন্য প্রপেলান্ট দহন দ্বারা নির্গত শক্তির অংশ পুনর্বিবেচনা করে, যা সাধারণত স্লাইডের ভিতরে থাকে । এক রাউন্ড গোলাবারুদ নিক্ষেপ করার পর, স্লাইড/বোল্ট রিকোয়েলের বিরোধের দিকে সরে যাওয়ার সাথে শক্তি করা কার্তুজের আবরণ বের করা হয়, স্লাইড/বোল্টের নিয়ম দ্বারা  স্ট্রাইকারটি কোক করা হয়, এবং ম্যাগাজিন থেকে একটি নতুন রাউন্ড ঠেলে দেওয়া হয়।)

তথ্য সূত্র---

 ১) কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন।  

 ২) বীরভূম রাঢ় বাংলা, বীরভূম  সংখ্যা (৩ জুলাই ২০১৮)। "অস্ত্র আইনে দন্ডিতা প্রথম মহিলা"। 

৩) ভারতের স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন

সংখ্যা (কোরক) ২০১৭, সম্পাদক তাপস ভৌমিক


###


আবদুস সালাম

প্রয়াস শ্রীকান্তবাটি মাদারল্যান্ড

ডাক রঘুনাথগঞ্জ

মুর্শিদাবাদ৭৪২২২৫


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন