প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

প্রথামাফিক শিক্ষা না থাকলেও অন্তরের ভেতরে জাগরুক অদম্য সাহস, জ্ঞানপিপাসা সমস্ত তুচ্ছতাকে ভাসিয়ে দিয়ে আশাপূর্ণা দেবী মহান স্রষ্টার আসনে প্রতিষ্ঠিত হলেন আপন মহিমায় । ব্যর্থতার আবর্জনাকে পুড়িয়ে ফেলে যে জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন তাঁকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারো নেই । নারীশক্তির অপার মহিমা প্রকাশিত হল । বাংলা সাহিত্যে আশাপূর্ণা দেবীর অভ্যুদয় একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। তাঁর এই আবির্ভাব একটি জ্বলন্ত প্রতিবাদ ।
আশাপূর্ণা দেবী তাঁর সৃষ্টিশীলতায় যে অন্বেষণকে নিরন্তর জাগরুক রেখেছিলেন তা হ'ল চেনা মানুষকে নতুন করে খুঁজে দেয়া । হৃদয়ের অনেক গোপন অন্ধকারের কথা তাঁর সাহিত্য প্রতিভায় প্রকাশ পেলেও নিজের হৃদয়কে কখনো সেই অন্ধকারের শিকার হতে দেননি । আশাপূর্ণা দেবী দেখেছেন মানুষ কত অসহায় , কেবল পরিবেশের কাছে নয় , সমাজের কাছে নয় , নিজের চিত্তবৃত্তির কাছেও । আধুনিক সমাজের জাঁকজমকের মধ্যে কোথায় যেন বেশ বড়ো ফাঁকি আছে , যা সহজে চোখের সামনে ধরা পড়ে না – ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে। এই অসহিষ্ণুতা – ঔদাসীন্য তাঁর ভাবনায় একটি নিরন্তর ঘটে যেতে থাকা দ্বন্দ্বের প্রকাশ। এই বহমানতাকে তার কলমে প্রকাশরূপ দিয়েছিলেন বলেই আশাপূর্ণা দেবী প্রায় অর্ধশতকের পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে নিয়েছেন অনায়াসে ।
আশাপূর্ণা দেবীর জীবনীকার উপাসনা ঘোষের লেখায় আছে – 'নতুন পঞ্জিকাই ছিল মফস্বলের শ্বশুরবাড়িতে আশাপূর্ণা দেবীর মানসিক জলযোগের একমাত্র উপাদান ।' শুধুমাত্র হাতে পঞ্জিকা নিয়ে কোনো মানুষ কী এর আগে কখনও লেখক হয়েছেন ! তাঁর চল্লিশ বছর বয়স অবধি কেউ তেমন করে জানত না আশাপূর্ণা দেবীকে । অর্থাৎ তাঁর বিশেষ কোনো জনসংযোগই ছিল না । পরিবারের মানুষদের প্রশ্নবানের মুখোমুখি হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে তিনি দীর্ঘদিন শিশুসাহিত্য নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন । ১৯২২ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সে 'শিশুসাথী' পত্রিকায় ছাপা হল তাঁর প্রথম কবিতা 'বাইরের ডাক' । যার জন্য তিনি প্রথম স্বীকৃতি ও সন্মাননা পান । যার মধ্যে আছে দুরন্ত নির্ঝরের প্রাণতরঙ্গ-
বাইরে এখন নতুন আলো
আঁধার ঘর কি লাগছে ভালো ?
আঁধার কোণে একা একা রহিস কেন হায় ?
'শিশুসাথী' পত্রিকা-সম্পাদক রাজকুমার চক্রবর্তীর আমন্ত্রনে তাঁর কলমে 'পাশাপাশি' নামের গল্প প্রকাশিত হয় – যা তাঁর জীবনে প্রথম প্রকাশিত গল্প ।
যথারীতি মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের ঘেরাটোপে , মাত্র পনেরো বছর বয়সেই বালিকাবধূ হয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে আসেন । আঁধারঘর রূপকার্থে সেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর সংসার যার বিষজাল কেটে নতুন আলোর দিশারী হতে পেরেছিল তাঁর কথাসাহিত্য । আশাপূর্ণা দেবী সম্পর্কে বনফুল বলেছিলেন – 'স্যাঁতসেঁতে বাংলাদেশে বিদ্রোহিণী নারী ।' কিন্তু শিশুসাহিত্যে সাফল্য এলেও বয়স্কপাঠ্য সাহিত্য লিখতে তাঁর অনেকটা দেরী হয়ে যায় । প্রথম গল্প ১৯৩৬-এ এবং প্রথম উপন্যাস ১৯৪৪-এ । এরপর তাঁর চলা ঝড়ের গতিতে । এক এক বছর ২০-২২টি ছোটগল্প এবং ৭-৮টি উপন্যাসও লিখেছেন । ১৯৬৪তে প্রকাশিত হয় অবিস্মরণীয় উপন্যাস 'প্রথম প্রতিশ্রুতি' যা তাঁকে এনে দেয় ১৯৬৬-র রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার ও ১৯৭৬-এর জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার । এছাড়া আশাপূর্ণা দেবী ১৯৫৪ সালে পেয়েছিলেন লীলা পুরস্কার, ১৯৫৯ সালে মতিলাল পুরস্কার , ১৯৬৩তে ভুবনমোহিনী স্বর্ণ পদক , ১৯৭৬সালে পেলেন পদ্মশ্রী উপাধি। আর এর মধ্যেই বিভিন্ন সময়ে কলকাতা, জব্বলপুর , বর্ধমান , রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. লিট উপাধিতে সন্মানিত করেছেন । ১৯৮৯ সালে পেয়েছেন বিশ্বভারতীয় সর্বচ্চ সন্মান 'দেশিকোত্তম' । আশাপূর্ণা দেবী প্রায় ন'শো গল্প লিখেছেন । একটা গোটা শতকের সমাজ – ইতিহাস তাঁর ট্রিলজি- 'প্রথম প্রতিশ্রুতি' , ' সুবর্ণলতা ' ও 'বকুলকথা' । সত্তর বছর ধরে এক নাগাড়ে লিখেছেন । তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা তিনশ'র বেশি । আরো অজস্র লেখা অসংকলিত হয়ে পত্র – পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে । তাঁর এই ব্যাপক বিশাল কর্মযজ্ঞ এর জনপ্রিয়তার মূলে মানুষের যে ভালোবাসা কাজ করেছে , সেই ভালোবাসাই আশাপূর্ণা দেবীকে শক্তি যুগিয়েছে নিজের সীমাবদ্ধ জীবন –পরিধি থেকে অসীম মানব –সমাজের চেহারাটা দেখতে ।
আশাপূর্ণা দেবীর কথা সাহিত্যে প্রতিবাদ একটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য । আশাপূর্ণা দেবী প্রতিবাদের ভাষা অর্জন করেছিলেন নিজের জীবন থেকে। প্রতিবাদের ভেতর দিয়ে তিনি অসহায়তার জটাজাল থেকে নারীকে মুক্তির উপায় দেখাতে চেয়েছিলেন । সুবর্ণলতা সংসারকে ধ্বংস না করেও মূর্তিমতী এক প্রতিবাদ । 'প্রথম প্রতিশ্রুতি' উপন্যাসের নায়িকা সত্যবতীই গ্রাম বাংলার প্রতিনিধি চরিত্র হয়ে প্রতিশ্রুতি বহন করে এনেছে। সত্যবতী অনন্যা , প্রতিবাদী , স্বাধীনচেতা, আত্মনির্ভর ,শিক্ষিত ,দূরদর্শী ,বিদূষী, বিদ্রোহী – বাংলা সাহিত্যে এমন চরিত্র প্রথম যে সামাজিক বাংলার অন্ধকার সরিয়ে নতুন আলোয় নারীকে মর্যাদায় উপস্থাপিত করতে চেয়েছে । সমাজের কোনও দ্বিচারী নীতিকেই সত্যবতী নিঃসংশয়ে মেনে নেয় নি । তার জীবনের একমাত্র আদর্শ পুরুষ তার বাবাকেও একাধিকবার প্রত্যাখ্যান করেছে , নিজের মেয়ে সুবর্ণ আর শংকরীর মেয়ে সুহাসকে বেথুন স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছে , মেয়েদের শিক্ষকতা করেছে দিনের পর দিন , কাশীতে চলে গিয়েও সেখানে গড়ে তুলেছে বালিকা বিদ্যালয় । সত্যবতী – নবকুমারের দাম্পত্যে বারবার ভেঙে গেছে সামাজিক লিঙ্গনির্মাণ , প্রতিবাদে, প্রতিরোধে আজীবন সত্যবতী চঞ্চল । 'সুবর্ণলতা'য় রয়েছে সত্যবতীর আদর্শলালিতা সন্তান সুবর্ণলতার কথা । সুবর্ণলতা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে নাড়ির যোগ রাখতে চেয়েছে , দেশের পরাধীনতার অবসান চেয়েছে । গতানুগতিকতার নিয়মে সুবর্ণের উদারচেতনা বারবার বাধাপ্রাপ্তি হয় । সুবর্ণ তার পরিবেশকে ভেঙে গড়তে চায় । দুঃসাহসী স্বদেশমন্ত্রে ব্রতী অম্বিকার সংস্পর্শে তার আত্মাবিষ্কার ঘটে । চিরলাঞ্ছিত নারীত্বের প্রতিমূর্তি সুবর্ণ তার প্রতি অবিচারের প্রতিবাদে নিরন্তর সচেষ্ট থেকেছে । তার ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনে বিড়ম্বনা প্রকটিত হয় তার আত্মজীবনীর প্রকাশক্ষণে । তারপর নিজের হাতেই সে তার নিজের সৃষ্টিকে ধ্বংস করে । এরপর মেয়ে বকুল আবিষ্কার করে তার মা'র যন্ত্রনার ইতিহাস । 'অনামিকা দেবী' ছদ্মনামে সে প্রতিবাদী গদ্য লিখতে শুরু করে । আধুনিক মনস্কতা, নারীস্বাধীনতা বিষয়ের গভীরে যায় , দার্শনিক চিন্তার বিকাশ ঘটে তার । এ সবই হয়ে ওঠে 'বকুলতা' ।
আশাপূর্ণা দেবী নারীকে ভোগপণ্যে পরিনত করার নির্মমতাকে নিয়ে লিখলেন 'ব্রহ্মাস্ত্র' গল্পটি । যেখানে রণবীর তার সুন্দরী স্ত্রীকে তুরুপের তাস করে চাকরির উমেদারীতে পাঠায় । স্ত্রী অসীমা সেজেগুজে যখন সেই চাকরিটা বাগিয়ে নিয়ে আসে তখন রণবীরের 'পুড়ে কালো হয়ে ওঠা মুখখানা আরো পুড়তে পুড়তে পাঙাশমূর্তি হয়ে ওঠে ।' কিন্তু রণবীরের বিপর্যস্ত চেহারা অসীমার মনে বিন্দুমাত্র মমতা জাগায় না । 'যে মেয়ে নিজেরই নিভৃত নির্জনে পড়ে থাকা ছোট্ট একটু ঘরখানিতেও আগুন লাগাতে বাধ্য হল' তার জীবনে মায়া- মমতার আর স্থান কোথায় ? এইখানে নারীর মুক্ত পরিসরের ভাবনা বুনলেন লেখিকা ।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিচ্ছিন্নভাবে পুরুষের চাপানো জীবনছক বহন করেছে নারী । পুরুষ -শাসিত সমাজের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে নিরন্তর যুদ্ধ ঘোষণাই তাঁর সাহিত্যের মৌল । 'বন্দিনি' গল্পের চারুলতা স্বামীর অপদার্থতায় সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে যায় । সে ছেলেকে দিয়েই স্বামীকে সংসার থেকে বিতাড়িত করতে চায় । এই প্রতিরোধে যেন পুরুষের প্রতিকল্প নতুন পরিসর তৈরি করে দেয় মেয়েদের সামনে । আত্ম – স্বাতন্ত্র্যের উন্মোচন ঘটে যায় ।
আশাপূর্ণা দেবী প্রাণের আনন্দ পেতেন উপন্যাসে নয় , ছোটগল্পে । তিনি ছোটগল্পকে বলেছেন , 'ভালবাসার ধন' । উপন্যাস তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিলেও ছোটগল্পেই তাঁর 'প্রথম প্রেম' । নিজেই বলেছেন , 'উপন্যাস লেখাটা একটা 'কাজ' আর ছোটগল্প লেখা হ'ল 'আনন্দ' ।
আশাপূর্ণা দেবী নিজেই তাঁর শক্তির শেকড়টিকে এভাবে জানিয়েছেনঃ 'স্বর্গ যদি আমরা আজ হারিয়েই থাকি , স্বর্গভ্রষ্টকেই ডেকে আনতে হবে সাহিত্যে , কিন্তু ডেকে আনলেই তো হবে না , সেই ভ্রষ্ট আত্মাকে নিয়ে সাহিত্যিকের পৌঁছতে হবে আরেক স্বর্গে । রসের স্বর্গে , বেদনার স্বর্গে , প্রেমের স্বর্গে । প্রেম না থাকলে সাহিত্য অসার্থক । দেশের মাটিকে চিনতে না শিখলে আর সেই মাটি ও মানুষকে একাত্মতায় ভালোবাসতে না পারলে কোথা থেকে জেগে উঠবে জীবনধর্মী সাহিত্য ?'
আশাপূর্ণাদেবীর সমস্ত রচনাতেই দেখা যায় নারীর মর্যাদা রক্ষার লড়াই । আত্মপ্রতিষ্ঠার কাহিনী । আশাপূর্ণাদেবীর নারী চরিত্রগুলি প্রত্যেকেই স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছে । নিজে একজন গৃহকর্ত্রী হয়ে বুঝেছেন অন্য নারীদের বেদনা । উপলব্ধি করেছেন তাদের আত্মসংগ্রাম। ফলে তার সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলি প্রত্যেকেই স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত , আত্মোন্নত।
==========================
অঞ্জনা দেব রায়
৫৫৩, পি মজুমদার রোড , কলকাতা – ৭৮
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন