
মরিয়ম মির্জাখানি: এক অনন্য গণিতসূর্য
অনিন্দ্য পাল
১৯৯৪ সালের আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড, হয়েছিল হংকং-এ। সতেরো বছরের এক মেয়ে সেই অলিম্পিয়াডে চমকে দিয়েছিল সবাইকে। মোট নম্বর যেখানে ছিল ৪২ সেখানে মরিয়ম পেয়েছিল ৪১। সেবার স্বর্ণপদক উঠেছিল মরিয়মের গলায়। তবে এখানেই শেষ নয়, পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে কানাডার টরোন্টোতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড, সেখানেও মরিয়ম ৪২ এর মধ্যে ৪২ পেয়ে আবার স্বর্ণপদক পেল মরিয়ম। আবার একবার অবাক হবার পালা সবার।
এই রকম অঙ্কের মেধা যে মেয়ের, তার জন্ম হয়েছিল ইরানের তেহরানে, ১৯৭৭ সালের ৩ মে। বাবা আহমেদ মির্জাখানি ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন খুব একটা ভালো ছিল না, বিশেষত মেয়েদের জন্য, তাদের শিক্ষার জন্য পরিবেশটা ছিল প্রতিকূল। কিন্তু মরিয়ম সেই প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই নিজেকে কুঁড়ি থেকে ফুলে রূপান্তরিত করেছেন।
তিনি যখন ছোট ছিলেন, সেই সময় ইরাক-ইরান যুদ্ধ চলছিল। তাহলেও মরিয়ম প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রাথমিকের পর ভর্তি হয়েছিলেন তেহরান ফারজানেগান স্কুলে, আর সেখানেই তার মেধার বিকাশ ঘটে।
তবে ছোটবেলা থেকেই যে মরিয়ম খুব গণিতের পোকা ছিল ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। বরং ছোটবেলায় মরিয়ম লেখক হতে চেয়েছিলেন। প্রবল ভালোবাসতেন বই। বই এর দোকানে দোকানে ঘুরে কমদামে কোন বই পেলে তৎক্ষণাৎ কিনে নিয়ে আসতেন। মোটের উপর মরিয়ম তখন ছিলেন বইপোকা। গল্প, উপন্যাস, সাহিত্য কোনটাতেই ছিল না অরুচি।
আবার বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা বিষয়ে খুব আগ্রহ ছিল মরিয়মের। ডকুমেন্টারি দেখতে ভালোবাসতেন খুব। বিশেষকরে জীবনীমূলক তথ্যচিত্র দেখতেই বেশি ভালোবাসতেন। মেরি কুরি, হেলেন কেলার এর মত মহীয়সী মানুষদের জীবন তাকে অনুপ্রাণিত করেছে বরাবর।
নিজে যেমন বই পোকা ছিলেন, তেমনি বইপোকা এক বন্ধু ও জুটে গেল, রয়া বেহেশতি। আজীবন রয়ার সঙ্গে অটুট ছিল এই বন্ধুত্ব। রয়াও পরবর্তী সময়ে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের প্রফেসর হন।
২০১৭ সালের ১৪ই জুলাই মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত মরিয়ম গণিতের সেবা করে গেছেন। গণিতকে যেখানে প্রথাগত ভাবে পুরুষদের একচেটিয়া অধিকারের জায়গা বলে ভাবা হত, বা এখনও পর্যন্ত ভাবা হয়, সেই পরিস্থিতিতে এই একমুখো পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে চরম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন মরিয়ম। ২০১৪ সালে প্রথম নারী হিসেবে জিতে নেন ফিল্ডস মেডেল, যা আসলে এই গ্রহে গণিতের সর্বোচ্চ সম্মান। এই পুরস্কারকে গণিতের নোবেল পুরস্কার ও বলা হয়। সেই ১৯৩৬ সালে শুরু হয় ফিল্ডস মেডেল দেওয়া, আজও মরিয়ম মির্জাখানিই একমাত্র নারী যিনি গণিতের এই সর্বোচ্চ সম্মান অর্জন করেছেন।
ছোটবেলায় গণিতে যে মির্জাখানির খুব বেশি আগ্রহ ছিল না তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থাতেই। গণিত পরীক্ষায় খুব খারাপ করলেন। পরের বছর ভাগ্যক্রমে চমৎকার একজন শিক্ষক পেলেন যার প্রভাবে তিনি গণিতে আগ্রহ পেয়ে বসলেন। উন্নতি হতে লাগলো দ্রুত। অল্পতেই ক্লাসের মাঝে বিখ্যাত হয়ে গেলেন।
পরে গেলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে থাকা অবস্থায় একদিন তার এবং তার বান্ধবী বেহেশতির হাতে আসে সে বছরের জাতীয় পর্যায়ের ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডের প্রশ্ন। এই প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রোগ্রামিং দক্ষতা যাচাই করা হয়। জাতীয় পর্যায়ের এই প্রশ্নে মোট সমস্যা ছিল ছয়টি। প্রতিযোগিতায় এর উত্তর দিতে হয় মোট তিন ঘণ্টায়। মির্জাখানি ও তার বান্ধবী মিলে দুই দিন লাগিয়ে খেটেখুটে তিনটি সমস্যার সমাধান করলেন।
যেখানে একটি সমস্যার সমাধান করতে পারলেই তারা খুশি, সেখানে তারা করে ফেললেন তিন তিনটি। তিনটির সমাধান করতে পেরে বেশ উৎফুল্ল হয়ে দুজনে মিলে চলে গেলেন স্কুল প্রধানের কাছে। তখন মেয়েদের জন্য বিশেষভাবে প্রবলেম সলভিং করানো হতো না। তখনো ইরান থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো মেয়ে গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করেনি। তারা স্কুল প্রধানের কাছে দাবী করলেন, ছেলেদের মতো করে তাদেরকেও প্রবলেম সলভিংয়ের বিশেষ ক্লাস করাতে হবে।
তাদের ভাগ্য ভালো ছিল, কারণ স্কুল প্রধান বেশ ইতিবাচক ছিলেন। দাবী মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তাদের জন্য। কিন্তু তারপরেও কিছুটা শংকা রয়ে গিয়েছিল, এর আগে ইরান থেকে কোনো মেয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গণিত অলিম্পিয়াডে যায়নি, তারা যেতে পারবে তো? তবে তিনি ইতিবাচক ছিলেন, তাদেরকে উৎসাহ দিয়েছিলেন, এর আগে কোনো মেয়ে যায়নি তো কী হয়েছে? আগে কোনো মেয়ে অংশগ্রহণ করেনি তার মানে এই না যে তোমরা অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তোমরাই হবে মেয়েদের মাঝে প্রথম অংশগ্রহণকারী, কাউকে না কাউকে তো প্রথম হতেই হবে। কোয়ান্টাম ম্যাগাজিনের এক সাক্ষাৎকারে মির্জাখানি বলেছেন, তার পরবর্তী জীবনে এই কথাগুলো সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে- "I think that has influenced my life quite a lot."
১৯৯৯ সালে তেহরানের শরিফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করার পর স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন ২০০৪ সালে। ২০০৮ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন।
গণিতে তরতর করে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এই যাত্রা যে একদম সাবলীল ছিল তা না। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে যখন আসেন তখন কার্টিস ম্যাকমুলানের সেমিনারে অংশগ্রহণ করছিলেন। ম্যাকমুলানও অনেক বিখ্যাত গণিতবিদ। ১৯৯৮ সালে তিনি গণিতের ফিল্ডস পদক পেয়েছিলেন। মির্জাখানি প্রথম প্রথম যখন সেমিনারে অংশগ্রহণ করছিলেন, কিছুই বুঝতে পারছিলেন না তেমন। সেমিনার হচ্ছিল অধিবৃত্তিক জ্যামিতি (hyperbolic geometry)-র উপর। ম্যাকমুলানের কথার কিছু না বুঝলেও অধিবৃত্তিক জ্যামিতি নামক বিষয়টির বিষয়বস্তু তাকে মুগ্ধ করতে থাকে। এমনিতেও জ্যামিতির এই শাখাটি সূত্রের দিক থেকে দেখতে কঠিন হলেও বাইরের দিক থেকে বেশ সুন্দর!
১৯৯৮ সালে ফিল্ডস পদক জয়ী গণিতবিদ ছিলেন কার্টিস ম্যাকমুলান; সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মির্জাখানি ম্যাকমুলানের অফিসে যাওয়া শুরু করলেন এবং এই সংশ্লিষ্ট নানা ধরনের প্রশ্ন করতে থাকেন। এক সাক্ষাৎকারে ম্যাকমুলান বলছেন- "মির্জাখানির কল্পনা ছিল বাধহীন ও নির্ভীক। কল্পনায় গণিতের অসাধারণ কিছু তৈরি করে তাদেরকে সূত্রবদ্ধ করতো। আমার কাছে সেগুলো উপস্থাপন করার পর যখন জানতে চাইতো 'এগুলো ঠিক আছে কিনা?' তখন অন্যরকম অভিভূত হতাম। সে মনে করেছিল আমি হয়তো এগুলো সম্পর্কে জানি!"
মির্জাখানি অধিবৃত্তিক তল নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠলেন। সাধারণ জ্যামিতির সাথে এই তলের জ্যামিতির মাঝে বেশ পার্থক্য। নিচের ছবিতে ডোনাট আকৃতির বক্র একটি তল দেখা যাচ্ছে যার মাঝে তিনটি গর্ত আছে। এটি একটি অধিবৃত্তিক তল।
অধিবৃত্তিক তল; আরো কিছু ব্যাপার মির্জাখানিকে প্রচলিত গণিতের বাইরের এই জগৎ সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলে। যেমন সরল রেখা ও জিওডেসিক। এই জ্যামিতিতে দেখা যায় বাঁকানো রেখাও সরল রেখা হতে পারে। আসলে কোন রেখা বাঁকানো আর কোন রেখা সোজা তা দিয়ে সরল রেখার সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় না। কোনো তলে দুটি বিন্দুর মাঝে সর্বনিম্ন দূরত্বকে সরল রেখা বলে। বিন্দু দুটি যদি সমতলে অবস্থান করে তাহলে সংযোগ রেখাটি সোজা হবে আর বিন্দু দুটি যদি বক্র তলে অবস্থান করে তাহলে সংযোগ রেখা বাঁকা হবে। যেমন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আঁকা কাল্পনিক অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমা রেখা। এরা সরল রেখা।
এখানের লম্বালম্বি করে আঁকা রেখাগুলো বক্র দেখালেও আসলে তারা সরল রেখা। সমতলের পরিবর্তে বক্র তলে অবস্থান করছে বলে তাদেরকে বক্র বলে মনে হচ্ছে; গোলকীয় তলের উপর আঁকা আপাত বক্র কিন্তু আসলে সরল রেখাকে বলে জিওডেসিক। ২০০৪ সালে মির্জাখানি জিওডেসিকের উপর পিএইচডি সম্পন্ন করেন। গণিতের সেরা সেরা জার্নালে তার গণিত সংক্রান্ত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এদের মাঝে আছে অ্যানালস্ অব ম্যাথমেটিকস, ইনভেনশনস ম্যাথমেটিকা, জার্নাল অব দ্য আমেরিকান ম্যাথমেটিকাল সোসাইটি প্রভৃতি।
ব্যক্তিজীবনে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন ইয়ান ভনড্রেক নামে একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানীকে। তিনি পরবর্তীতে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এসোসিয়েট প্রফেসর হন। তাদের ঘরে একটি কন্যা সন্তানও হয়। কন্যার নাম আনাহিতা।
তাকে যখনই জিজ্ঞেস করা হয়েছে গণিতে আপনার গুরুত্বপূর্ণ অবদানটি সম্পর্কে কিছু বলবেন কি, তখন তিনি লজ্জা মিশ্রিত গলায় উত্তর দেন- আমার কাজ আসলে গণিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আমার কাছে কখনো তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি। আসলেই, জ্ঞানী মানুষরা নিজেদেরকে এবং নিজেদের কাজকে এভাবেই ব্যক্ত করেন- তার কাজ তেমন মূল্যবান কিছু না।
২০১৪ সালে যখন তাকে ইমেইল করে জানানো হয় যে তিনি ফিল্ডস পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন, তখন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। প্রতি চার বছর পর পর গণিতে অবদানের জন্য ফিল্ডস পদক প্রদান করা হয়।
ভিন্নরকম খেয়াল ছিল মির্জাখানির। খাতায় দলছুট হিজিবিজি আঁকাআঁকি করতেন। এসব আঁকাআঁকি আবার হতো গণিতকেন্দ্রিক। গণিতের যে ভাবনাগুলো তার মাথায় আসতো তাদেরকে যেন একটা শৈল্পিক রূপ দিয়ে দিতেন আঁকার কাগজে। গণিতের ইতিহাসে চিরদিন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থেকে যাবেন এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ নারী গণিতরানি মরিয়ম মির্জাখানি।
-----------------------
অনিন্দ্য পাল, চম্পাহাটি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। পশ্চিমবঙ্গ,
পিন : 743330
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন