প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। নবপ্রভাত ৮৫ ।। চৈত্র ১৪৩১ মার্চ ২০২৫

ভুবনেশ্বর মন্ডল
অরুণিমা যখন বাড়ি ফিরল তখন অনেকটা সন্ধ্যা হয়ে গেছে। প্রায় সাতটা। মেয়ে নিবেদিতা তখন টিউশন স্যারের কাছে পড়তে বসেছে। অরুনিমা বাড়ি ঢুকে বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর টিউশন স্যারকে চা বানিয়ে দিয়ে এলো। নিবেদিতা জল খেতে এসে বলল মা আজ বাড়ি ফিরতে এত দেরি হল যে? অরুণিমা একটু ইতস্তত করে বলল বাজারে একটু কাজ ছিল। যা তুই পড়গে যা। নিবেদিতা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল মা তোমার কি শরীর খারাপ? খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে। না না কিছু হয়নি আমার। অফিসে যা কাজের ঝামেলা। আজ খুব ধকল গেছে। তাই একটু ক্লান্তি বোধ করছি। যা যা ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। নিবেদিতা স্যারের কাছে পড়তে গেল দুতলায়। অরুণিমা এক কাপ চা বানিয়ে খেল। তারপর বেডরুমে গিয়ে শরীরটা এলিয়ে দিল। ভীষণ ক্লান্তি বোধ করছে। কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। টিভিটা চালিয়ে দিল সিরিয়াল দেখার জন্য। কিন্তু সিরিয়ালে মন বসলো না। মিনিট দশেক পরে টিভিটা বন্ধ করে দিল। স্বামী সৌরভের বাড়ি ফিরতে প্রায় রাত ন'টা বেজে যায়। সৌরভ একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। সকাল ন' টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ডিউটি। বাড়ি ফিরতে রাত সাড়ে আটটা ন'টা হয়ে যায়। এখন বাজছে সাড়ে সাতটা। সৌরভের ফিরতে ঘন্টাখানেক দেরি। ওদিকে মেয়েটা পড়ছে। বেডরুমে অরুণিমা একা। মাস ছয়েক থেকে ওর মনের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অরুণিমা নিজের সঙ্গে নিজেই যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধের খবর সৌরভ জানেনা। আসলে অরুণিমা মনের কষ্ট যন্ত্রণা চেপে রেখে সৌরভের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করে তাই সৌরভ তার আঁচ পায় না। ঘন্টা দেড়েক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা ওকে তীব্রভাবে দংশন করছে। একটা পাপবোধ ওকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। মনে মনে ভাবছে কাজটা ঠিক করেনি। সৌরভকে ঠকাল সে। ওদের দাম্পত্য জীবন ১৪ বছরে পা দিল। মেয়ে নিবেদিতার বয়স ১২ বছর। ও এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। বিয়ের দু'বছর পর নিবেদিতার জন্ম। সৌরভের সঙ্গে অরুণিমার সামাজিক বিয়ে। মেয়ে দেখতে এসে সৌরভের পছন্দ হয়ে যায়। অরুণিমারও তাকে পছন্দ হয়। তাই কোন কিছু আটকায়নি। অরুণিমার বাবা ওর বিয়ের বছর পাঁচেক আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। সংসারের আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। গ্রাজুয়েশন করার পর অরুণিমা আর এম এ পড়তে পারেনি। দেখাশোনা করে বিধবা মা সৌরভের সঙ্গে ওর বিয়ে পাকা করেন। দাবি দাওয়া কিছু ছিল না। সৌরভও গ্রাজুয়েট। তবে কোন সরকারি চাকরি পায়নি। সংসারের ঘানি টানার জন্য একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ নেয়। বেতন যৎসামান্য। কোন রকমে টানাটানি করে সংসার চলত। তাই অরুণিমা আর্থিক সচ্ছলতার জন্য একটা কাজের খোঁজে ছিল। ভাগ্যক্রমে আইসিডিএস দপ্তরে একটা কাজ পায়। সংসারে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আসে। সৌরভও আর্থিক টানাপোড়েন থেকে মুক্তি পায়। তবে সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা এলেও স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যে একটা চোরা ফাটল তৈরি হয়েছিল বিয়ের বছরখানেকের মধ্যেই। আসলে সৌরভের যৌনক্ষুধা থাকলেও যথাযথ যৌন সক্ষমতা ছিল না। এই নিয়েই টানাপোড়েন। চিকিৎসাও করিয়েছিল সৌরভ কিন্তু তেমন কোন ফল মেলেনি। দিনের পর দিন একটা মানসিক যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত হচ্ছিল অরুণিমা। গভীর রাতে বিছানায় ছটফট করত। দীর্ঘশ্বাস হয়ে উঠেছিল ওর প্রতিদিনের সঙ্গী। প্রথম দিকে ভাবতো হয়তো আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। এরকম পরিস্থিতিতেই অরুণিমার গর্ভে এলো নিবেদিতা। ও স্ত্রী থেকে মা হল। জড়িয়ে পড়লো মাতৃত্বের বাঁধনে। মাঝে মাঝে খুবই রাগ হতো সৌরভের উপর। ওর প্রতি বিতৃষ্ণা আসতো মনে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করতো সম্পর্ক ভেঙে দিতে। কিন্তু মা বোঝাতেন। একটু সহ্য কর মা। মেয়েদের অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়। দেখবি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। সৌরভ এ নিয়ে যন্ত্রণা যে ভোগ করত না তা নয়। একটা হীনমন্যতা ওকে ভিতরে ভিতরে অপরাধ বোধে জর্জরিত করত। নিজেকে অসহায় কাপুরুষ মনে হতো। কিন্তু ব্যাপারটা তো ওর হাতে নেই। সবটাই ভগবানের হাতে। ডাক্তার দেখিয়েও তেমন কিছু উন্নতি হয়নি। শেষ পর্যন্ত আশা ছেড়ে দেয় দুজনেই। তবুও মাঝেমধ্যে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে খিটিমিটি হতো। অরুণিমা বলতো- আমি মন্দিরের কোন পাথরের দেবী নই, রক্ত মাংসের মানুষ। আমার খিদে আছে, তৃষ্ণা আছে, চাহিদা আছে। এভাবে পাথর হয়ে কাল কাটাতে পারব না। যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব। সৌরভ অনেক অনুনয়-বিনয় করে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করত। বলতো সবটাই ভাগ্য। না হলে এমন হয়। প্লিজ মানিয়ে নাও। অরুণিমা বলতো তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলে। মাঝে মাঝে সৌরভও রেগে গিয়ে বলতো- যাও যাও চলে যাও, যেখানে খুশি চলে যাও। আমি কী করবো? আমার কিচ্ছু করার নেই। এভাবে যদি ঝামেলা করো তবে আমি গলায় দড়ি দেব।
মৃত্যুর কথা শুনে অরুণিমা চুপ করে যেত। ভাবতো সত্যিই তো সব কিছুর পেছনে অদৃশ্য ভগবানের হাত। সৌরভের করারও তো কিছু নেই। ওতো অসহায়। সৌরভ এমনিতে খারাপ নয়। ওকে ভালোও বাসে। সংসারের সব দায়িত্ব পালনও করে। তবু খিদেটা মাঝে মাঝে অরুণিমার কাঁধে ভুতের মতো চেপে বসে। তখন রাগে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অশান্তি করব না মনে করে কিন্তু অশান্তি হয়ে যায়। তবে নিবেদিতার মুখের দিকে তাকালে রাগী ভূতটা শান্ত হয়। ভাবে ও তো বাবারই মেয়ে। ওর মুখে বাবার আদল। ভগবানের কাছে সহ্য শক্তি প্রার্থনা করে অরুণিমা। সংসার ছেড়ে অনেকবার পালাবার কথা ভেবেছিল কিন্তু পালাতে পারেনি মেয়েটার কথা ভেবে। আস্তে আস্তে সব কিছুকে মানিয়ে নিয়েছে ভাগ্যের পরিহাস বলে। মাও মারা গেছে কয়েক বছর আগে। এখন আর এই বাড়ি ছাড়া কোথাও দাঁড়াবার জায়গাও নেই। ভাবে মেয়েকে ছেড়ে যাবেই বা কোথায়? বাড়িতে একটা ঠাকুর ঘর বানিয়েছে। ওখানেই ধ্যান জপ করে অনেকটা সময় কাটায়। মন শান্ত হয়। মামাতো দাদার বউ রমলা বৌদি বলেছিল -হরিতকি খেও অরুণিমা হরিতকি খেও। উপকার পাবে। দেহের খিদে কমে যাবে।তাই মাঝে মাঝে হরিতকি খায় অরুণিমা।
অরুণিমা এখন টিভিটা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছে। এতদিন কাটিয়ে দিল কিন্তু ১৪ বছর পর গত ৬ মাস থেকে ওর কাঁধে আবার সেই পুরনো ভূতটা যেন চেপে বসেছে। বছরখানেক থেকে অফিস থেকে বাড়ি ফেরে ওর অফিসের কলিগ সুদীপদার বাইকে। সুদীপ বছর দেড়েক আগে এখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে। থাকে একটা ভাড়া বাড়িতে। ওর ফ্যামিলি থাকে মেদিনীপুরে। তিন চার মাস অন্তর লম্বা ছুটি পেলে বাড়ি যায়। নিজেই রান্নাবান্না করে খায়। খুব মিশুকে। খোলামেলা মানুষ। অরুণিমার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে। বয়সে অরুণিমার থেকে বছর চারেকের বড় হবে। অফিস থেকে অরুণিমা বাড়ি ফেরার সময় বেশ নাকাল হতো। বিকেলের দিকে বাসগুলো সময় মতো চলতো না। খুব দুর্ভোগে পড়তো অরুণিমা। তাই সুদীপ নিজে থেকেই বলেছিল আপনি বাড়ি ফেরার সময় আমার বাইকে বাড়ি ফিরতে পারেন। অরুণিমা প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও সুবিধা হবে ভেবে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যায়। গত এক বছর থেকে সুদীপের বাইকেই বাড়ি ফেরে অরুণিমা। দুজনের মধ্যে আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। একটা বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়। দুজনেই নিজেদের পারিবারিক সুবিধা অসুবিধা সমস্যা নিয়ে পরস্পর আলোচনাও করে। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। পাথরের দেবী অরুণিমা আগের মত একটা রক্ত মাংসের মানুষে পরিণত হতে শুরু করে। কুম্ভকর্ণের মত ঘুমিয়ে থাকা ক্ষুধা তৃষ্ণা চাহিদাগুলো আবার জেগে ওঠে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার বাড়ি ফেরার পথে সুদীপের বাসাতেও গেছে। সুদীপ চা বানিয়ে খাইয়েছে, কখনো টিফিন খাইয়েছে। দৃষ্টির সম্মোহণে ওরা ভুলে গেছে দেশ, কাল, সমাজ, পরিবার। ইতিমধ্যে অফিস থেকে ফেরার পথে দুজনে বেশ কয়েকবার বাইকে চেপে নদীতীরের নির্জন বাগানে কিছুটা সময় কাটিয়েও এসেছে। পরস্পর সুখ-দুঃখের কথা হয়েছে। অরুণিমা ভুলেও কোনদিন বাড়িতে সুদীপের প্রসঙ্গ তোলেনি। তাই সৌরভ সুদীপ প্রসঙ্গে কিছু জানতেও পারেনি। আজ অফিস থেকে ফেরার পথে অরুণিমা গিয়েছিল সুদীপের বাসাতে। বাসাবাড়িটা শহরের নির্জন এলাকায়। মালিকও বাড়িতে থাকেন না। তাই কোন ঝুঁকি নেই। সুদীপের বাড়িতে আজ বিকেলে চা ও টিফিন বানিয়েছিল অরুণিমাই। তারপর গল্প করতে করতে ওরা একসময় খুব কাছাকাছি আসে,ঘনিষ্ঠ হয়। দুজনে হারিয়ে যায় এক জৈবিক ক্ষুধার জগতে। অরুণিমা কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙে সুনামির মত আছড়ে পড়ে সুদীপের লোমশ বুকে। তপ্ত পৃথিবীতে বহুকাল পরে যেন বৃষ্টি হয়। সে বৃষ্টিতে অরুণিমা ভিজলো পরম তৃপ্তিতে। এমন তৃপ্তি সে কোনদিন পায়নি। ওর অতৃপ্ত নারীত্বের কাছে এ যেন এক নতুন আস্বাদ। বাড়ি ফেরার আগে অরুণিমা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ও পোশাক ঠিক করে নিল। তারপর মুচকি হেসে চোখে চোখে কথা বলে যখন সুদীপের বাসা থেকে বেরিয়ে এলো তখন অনেকটা সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তারপর একটা অটো চেপে সাতটা নাগাদ বাড়ি ফিরলো। এখন বেডরুমে শুয়ে মনে মনে ভাবছে। সে তো মনে মনে এটাই চেয়েছিল। তাহলে বিবেকের দংশন কেন? কেন অপরাধবোধ? কেন পাপবোধ এ মুহূর্তে ওকে তাড়া করছে? ওতো পাথর নয়। রক্তমাংসের মানবী। খিদে পেলে মানুষ তো খাবে। তেষ্টা পেলে মানুষ তো জল পান করবে। এতে দোষ কিসের ? জোর করে বাঁধ দিয়ে কি নদীর জলস্রোতকে আটকানো যায় ? বাঁধ দিলে বরং সে ফুঁসে উঠে, গর্জে উঠে বাঁধ ভেঙে সঙ্গম ছুঁতে চায়। এটাই স্বাভাবিক। অরুণিমা তো কোন পাথরের দেবী নয় সে রক্তমাংসের মানবী-মানবী-মানবী।
_____________________________________
ভুবনেশ্বর মন্ডল
সাঁইথিয়া লেবুবাগান
পোস্ট -সাঁইথিয়া
জেলা -বীরভূম
পিন নাম্বার ৭৩১২৩৪
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন