বহমান কালের ধারায় নারী
দীপক পাল
প্রাচীন কালে নারীদের হাতেই ছিল সমাজ ব্যবস্থার চালিকা শক্তি। ছিল নারীতান্ত্রিক সমাজ
ব্যবস্থা। কালক্রমে তা সম্ভবত শক্তির জোরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয় এবং সেই ধারা বয়ে চলেছে। পূর্বে নারীদের স্থান ছিল অন্দর্মহলে। বাইরের জগতের গতি প্রকৃতির খবর রাখতো না। যতটুকু পেত তার বহুলাংশ আসতো ঘরের পিতা , স্বামী বা পুত্রের কাছ থেকে। তার গতিবিধি ছিল, খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার। ফরাসী বিপ্লবের পরে বিদেশে নারীরা কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষায় তাদের দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে। তার দরুন সেই সব দেশ উন্নতি করতে থাকে সর্ব বিষয়ে। কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বেশীর ভাগ দেশগুলো উন্নতি সাধনে অনেক পিছিয়ে থাকলো। তার দরুন উন্নত দেশগুলো এই সব দেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করলো।ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করতে ভারতীয় তথা বাংলার মহিলাদের অবদান নিতান্ত কম নয়। কিন্ত মূলত ভারতীয় তথা বাংলার নারীরা ছিলেন অন্তর্পুরবাসিনী। কিন্তু যখন নারীরা স্কুল বা উচ্চ শিক্ষার জন্য ঘরের বাইরে বেরোতে থাকলো তখন তাদের নানা ভাবে বহু পুরুষ বাধা দিতে থাকলো। কিন্তু সে বাধা অতিক্রম করে আরো আরো মেয়ে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা লাভ করতে থাকলো। কর্ম ক্ষেত্রেও তাই। মহিলারা কর্মক্ষেত্রে পথে বেরোলে তাদের অনেকের কটূক্তি সহ্য করতে হতো। এই কটূক্তিতে পুরুষের পাশাপাশি মহিলারা কম যেতেন না। পঞ্চাশ দশকের প্রথম পাদে এরকম ব্যাপার আমিও লক্ষ্য করেছি। আজ কর্মে ও
শিক্ষায় নারীরা আর একটুও পিছিয়ে নেই। সাংস্কৃতিক জগতেও নারীরা পুরুষদের সমকক্ষ। নৃত্য গীত সাহিত্য এর সবেতেই তারা প্রতিষ্ঠিত। নৃত্যে অমলাশংকর, থাংকমণি কুট্টি, রুক্কিনী দেবী, মৃণালিনী সারাভাই ইত্যাদি ক্লাসিক গায়িকা এম এস শুভলক্স্মী, লতা মংগেশকর, মালবিকা কানন, বেগম আখতার, কৌশিকী চক্রবর্তী ইত্যাদি, আধুনিক গানে, আশা ভোঁসলে, সন্ধা মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, সুমন কল্যাণপুর ইত্যাদি, চিত্র পরিচালনায় মীরা নায়ার, নন্দিত দাস,দীপা মেহেতা, কল্পনা লাজ্মী, অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন প্রমুখদের নাম কে না জানে। সাহিত্যে আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, লীলা মজুমদার, বানী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, লীনা গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, রবীন্দ্র সংগীতে ণিকা বন্দোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, বনানী ঘোষ, শ্রেয়া গুহঠাকুরতা ইত্যাদি চলচিত্র অভিনয়ে সুচিত্রা সেন, অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চ্যাটার্জি, শর্মিলা ঠাকুর ইত্যাদির কত যে আছে তার হিসাব রাখা খুবই মুস্কিল।
খেলা ধূলার ক্ষেত্রে গোটা পৃথিবীর সংগে তুলনা করলে শুধু ভারতের নারীরা না গোটা ভারতই না বহু পশ্চিমী দেশ এমন কি চীন জাপানের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। গত কয়েকটি অলিম্পিক আর কমনোওয়েল্থ গেমস্ এর ফলাফলের দিকে চোখ বোলালেই সেটা ধরা পরে। এই জায়গাটায় যদি নারীরা জোর দেয় তবে আখেরে ভারতেরই লাভ হবে। এটা পুরুষদের সাথে কোন রেষারেষির ব্যপার না। যদিও এখন ভারত সরকারও আগের তুলনায় এই খেলাধূলার ক্ষেত্রে অনেক বেশী নজর দিচ্ছে। এরমধ্যে ক্রিকেট ফুটবল আর হকিতে ভারতীয় মহিলাদের যোগদান ও তাদের খেলার ফলাফল বিশেষ উল্লখযোগ্য।
আমার মনে হয় নারী স্বাধীনতার ব্যপারে বলতে গেলে এই উপরের ক্ষেত্রগুলিতে কোনভাবেই যদি পুরুষদের কেউ বাধা দিয়ে থাকে তবে সে বাধা অতিক্রম করেই নারী এগিয়ে চলেছে এবং সেভাবেই চলবে।
আমার তাই মনে হয় স্বাধীনতা কেউ কাউকে দেয় না সেটা অর্জন করতে হয়। নারী পুরুষ যদি একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে তাহলে দেশেরও ভাল দশেরও ভাল। এটাই তো সঠিক গণতন্ত্র। কিন্ত নারী নিরাপত্তার দিকটা আমাদের রাজ্যে একটু দুর্বল। নারীদের প্রায়সই লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতে হয়। এটা মহাভারতের যুগেও ছিল। রাজ্যসভায় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন গঙ্গা পুত্র ভীষ্ম আর ধার্মিক বিদুর ও গুরু দ্রোণাচার্য। এতৎ সত্ত্বেও কি করে এত অপমান রাজরানী দ্রৌপদীর হতে পারলো? তাদের বিবেক তখন কোথায় ছিল? কেন তারা যুধীষ্ঠীরকে বলতে পারলো না যে পাশা খেলায় হেরে গিয়ে তুমি নিজেই কৌরবদের দাস হয়ে গেছ, তাই তুমি আর পাশা খেলায় অংশ নিতে পারবে না, আমরা তা কিছুতেই হতে দেব না। তারা নিশ্চয়ই দ্রৌপদীর অপমান দেখতে চায়নি। আর দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে সভাসদে এনে হাজির করে বস্ত্র হরণ করতে শুরু করলো তখন ওই সব মহাপুরুষ তাদের আসন থেকে উঠে বাধা দেয় নি। কিন্তু কেন? তারাও কি মনে মনে তাই চেয়েছিল? নারীর সে অপমান যুগে যুগে আজও হয়ে চলেছে। নারীর অপমান কি এভাবে চলতেই থাকবে? আমার মনে হয় নারীদের আরো বেশী মাত্রায় রাজনীতিতে আসার আর লোকসভা রাজ্যসভার আর বিধান সভায় জিতে আসা। এই মত একান্ত আমার নিজের। পাঠক পাঠিকা বলবে কোনটা ঠিক।
______________________
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights
Block-8 Flat-1B,
Diamond Harbour Road
Kolkata - 700104
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন