নারী দিবসে যা ভাবা উচিত
বিশ্বনাথ পাল
এই বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী , অর্ধেক তার নর।'
নজরুলের এই বিখ্যাত চরণ দুটি স্মরণ করলে আমাদের মন ভাল হয় , এর অনেক আগে অবশ্য বিশ্বজয়ী স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, এক পক্ষ বিশিষ্ট পাখি বেশিদূর উড়তে পারে না। নারী শিক্ষা ও নারী প্রগতিতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েও জীবনের শেষ প্রান্তে কার্মাটারে সাঁওতাল পল্লীতে ঠাঁই হয়েছিল প্রাতঃস্মরণীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের। পুরুষ এবং নারী--এই সমাজ দেহের দুটি দিক বললেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে -- মেয়েদের স্বতন্ত্র স্বাধীনতা আজও গড়ে ওঠেনি।
"ব্যাটা ছেলে ঘর আলা
বিটি ছেলে পথ আলা-"--বহু প্রচলিত এই প্রবাদের মূল বক্তব্য হল ব্যাটা ছেলে বংশের বাতি,তারা সংসারে আলোর ঠিকানা দেখাবে, অন্যদিকে মেয়েরা পরের বাড়ী যাওয়ার জন্যেই জন্মায় তাদের নিয়ে মাথা ব্যাথার দরকার নেই। মেয়ের নাম ফেলি--তাকে যমে নিলেও গেলি আর পরে নিলেও গেলি।চির অবহেলিত বঞ্চিত ও পদদলিত মেয়েদের আগে ছেলে যোগ করে "মেয়েছেলে" করে রাখাটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দস্তুর। ফলে একবিংশ শতাব্দীতে আকছার কন্যা ভ্রূণহত্যা এবং নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। ক্রাইম হিসেবে ধর্ষণ আজ খুনকে পিছনে ফেলে গণমাধ্যমের শিরোভূষণ হয়ে উঠেছে । নারী স্বাধীনতা বা নারী প্রগতির জোরদার মিছিল রাজপথ কাঁপালেও নারী বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীনা । সংসারে একটু জোরে কথা বললেই অনায়াসে যে কেউ বলে, বউটার টুঁটি দেখেছ,চালে কাক বসার জো নাই। কিম্বা বলবে মেয়ে মুড়ুলি বা মেয়ে মর্দানির জন্য ফ্যামিলির ইজ্জত রসাতলে গেল। সাহিত্য সিনেমা সংসার, রাজনীতি কিম্বা বিজ্ঞানের বিজয়কেতন ওড়ানোর ক্ষেত্রে মহিলারা বিশেষ অবদান রাখলেও দৃষ্টিভঙ্গির সঠিক পরিবর্তন না হওয়ায় আমাদের খেসারত গুণতে হচ্ছে। মাদাম কুরি, মাদার টেরেসা,ইন্দিরা গান্ধী, কল্পনা চাওলা, দূর্বা ব্যানার্জি, প্রতিভা পাতিল, দ্রৌপদী মূর্মু, নির্মলা সীতারমন, রোকেয়া বেগম, মমতা ব্যানার্জি, আশাপূর্ণা দেবী,মহাশ্বেতা দেবী,লতা মুঙ্গেশকর, সুচিত্রা সেন, ঝুলন গোস্বামী, তসলিমা নাসরিন, বেবি হালদারেরা স্বমহিমায় যেমন ভাস্বর, ঠিক তেমনি ইদানীং কালে পড়াশোনার ক্ষেত্রেও ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ক্রমোন্নতি সত্যিই আমাদের আশা জাগায় অথচ আমাদের মধ্যযুগীয় শাসন তর্জন আর গর্জন --মেয়েদের উন্নতি ভালো চোখে নেয় নি। তাই রাজস্থানে মাইলের পর মাইল হেঁটে জল আনতে হয় মেয়েদের। মেয়েদের কপালে সেবা করার পোস্টার সেঁটে পুরুষ খালি হাতে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়। ছেলের জন্যে গোটা ডিম মেয়ের জন্যে হাফ দামী পোশাক ছেলে পরে , মেয়ের জন্যে রাফ।
পুরুষেরা আগে খাবে, খাবার বাঁচলে তবে মেয়েদের ডাকা হবে। মুসলিমদের মধ্যে আজো আন্দোলন জারি রয়েছে মেয়েরা যাতে মসজিদে প্রবেশাধিকার পায়। নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার? রবীন্দ্রনাথের এই বাণী শুধু নারী দিবসে শোনা যায়। আমি নারী আমি পারি,আমি অসামান্যা আমি সম্পূর্ণা। নারীদের দূরে সরিয়ে আমরা যুগযুগ ধরে সমাজ ও সভ্যতার বারোটা বাজিয়ে যাচ্ছি।তাই তো পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণদেব, সারদার শ্রীচরণে মাতৃজ্ঞানে অঞ্জলি দিয়ে একটা মোক্ষম বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। পরবর্তী কালে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের জননী হয়ে জয়রামবাটীর এই গ্রাম্যবধূই জগতে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে গেছেন। সমদৃষ্টি,সদ্ভাব, স্নেহ মমতার স্বর্গীয় দ্যুতিতে তিনি প্রকৃষ্ট উদাহরন রেখে গেছেন। রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী প্রকল্প, বিধবা ভাতা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নির্যাতিতা অবহেলিতা নারীদের প্রাণবায়ুর মতো কাজ করছে। কেন্দ্র সরকারের প্রকল্প, বেটী বাঁচাও, বেটী পড়াও সৎ সংকল্প ও নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য একটি দিক।
নিলে আদর করলে যত্ন
কন্যা হবে দামী রত্ন
বুঝতে হবে এটা
কন্যা ছাড়া, ছন্নছাড়া--সমাজটা নয় গোটা।
নারীদের লাঞ্ছনা করে নিধন হয়েছিলেন রাবণ রাজা,কৌরব সভায় দ্রৌপদীর হেনস্থার ফল হাতে হাতে পেয়েছিলেন কৌরবরা তবুও আমরা নারীদের প্রকৃত পক্ষে যে সুরক্ষার দরকার তা আমরা দিতে পারি নি। তাই টোটো ওয়ালা,ঠেলাওয়ালা, সিভিক ভলেন্টিয়ার রূপে পুরুষ নিরাপত্তার বেষ্টনী ভেদ করে অভয়া নির্ভয়াদের মিডিয়ার মুখে ছেড়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি আর জি করের ঘটনা এবং তার পরবর্তী ঘটনা ক্রমে শুধু সরকারের মুখ পোড়ে নাই।সমগ্র সমাজের মুখ পুড়েছে। মানবিকতার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।তাই সমানাধিকার, নারীর মর্যাদা, নারী স্বাধীনতার গালভরা কথায় ভোলালে চলবে না। কাগজে কলমে আইনকে জারী রাখলে হবে না।মেনে নাও বলে পিছিয়ে পড়লেও চলবে না। আমাদের মনে নিতে হবে।কেন না আইনের চেয়ে অনেক গুণের বড় আন্তরিকতা। এই আন্তরিকতায় আমাদের মনকে বশে আনতে হলে আমাদের শুধু পুরুষমানুষ হলে চলবে না, হতে হবে পুরুষ সিংহ, দয়া মায়া মমতা যেমন হৃদয়ে থাকবে তেমনি থাকবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ । আমরা পুরুষ আমরা যে কোন জায়গায় যে কোন মূল্যে সমাজটাকে ভ্রষ্টাচারে ভরে যেতে দেব না,নারীরা শুধু ভোগবতী নয়,ভগবতী,রণচণ্ডী এই মায়েদের আমরাই সন্তান।তাই তাদের সুরক্ষা প্রদান হোক আমাদের একমাত্র ধ্যান ও জ্ঞান।
================
Biswanath pal
Village -Amarpur PO--Dwarnary PS -Galsi District --Purba Bardhaman
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন