Featured Post
নিবন্ধ ।। শারদীয়া ।। অঙ্কিতা পাল
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
শারদীয়া
অঙ্কিতা পাল
এসেছে শরৎ, আমরা জানি ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাস নিয়ে হয় শরৎকাল।।
ভাদ্র মাসে কিছুটা গরম আর তার সাথে বৃষ্টি প্যাচপ্যাচে ভাব থাকলেও, " আশ্বিন" মাস পরতেই মনে হয় যেন আমাদের " মা " "উমা" আসবেন কৈলাস ছেড়ে তার বাবার বাড়িতে, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি । চারিদিকে হাওয়ায় দোলা দেয় কাশের মেলা, সহস্র কমল কলিকা পাপড়ি মেলে ধরে, শিউলি ফুলের সুমিষ্ট গন্ধে ভরে ওঠে মোদের প্রাণ, নীল আকাশের বুকে ভেসে চলে সাদা মেঘের ভেলা, মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে সাত রঙা রামধনু যেন পড়ন্ত বেলায় হেসে ওঠে।
ভোরের বেলায় মহালয়ার শুভ লগ্ন শুরু হয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণের কন্ঠে ;
সূচনা হয় দেবীপক্ষের স্বয়ং "মা দুর্গা" যেন বসুন্ধরার বক্ষে নেমে আসেন । তার লাল আলতা পায়ের ছাপে অশুভ শক্তির বিনাশ হয় ।
উৎসব মুখর পরিবেশের, অন্তিম লগ্নে কুমোরের তুলিতে যেন শেষ টান ;
কোথাও আবার যেন মণ্ডপে মন্ডপে মায়ের যাত্রার শুভ সূচনা হতে চলেছে।
শহর কলকাতার রাজপথ যেন, জনজোয়ারের ঢেউ আবার চারিদিকে যেন আলোয় আলো।
রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে -
" আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবন ভরা, আলো নয়ন ধোয়া আমার আলো হৃদয় হরা" ।
যাই হোক "কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই "..................
আমাদের পূজা গ্রামের পূজা ;
কলিকাতা শহরের মতো জৌলুসতা হয়তো আমাদের নেই। তাই আমরা মনে করি মহানগরীর পুজোর থেকেও; মোদের পূজো মোদের কাছেই শ্রেষ্ঠতম।।।।
এ বছর আমাদের দুর্গা পূজার কাহিনি, আমার লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরছি।
আমাদের পুজো কোন থিমের পুজো বা এখনকার দিনের তুলনামূলক ভাবে প্রতিযোগিতায় যেতে হবে এমন কিছু মনোবৃত্তি নিয়ে করা হয় না।
আমাদের ঠাকুর সাবেকি এবং বারোয়ারি পূজো, আমাদের একটা ইট কাঠ পাথরের তৈরি মন্দির আছে যেখানে প্রতি বছরেই মা চতুর্থীর দিন সন্ধ্যেবেলা আমাদের মন্ডপে আসেন।
তাকে খুব যত্ন করে পাড়ার মা কাকিমারা বরণ করেন এবং তারপর মা দুর্গা এবং তার ছেলেমেয়েদের আমাদের মন্দিরের নির্দিষ্ট স্থানে বসানো হয়। এ বছরের মায়ের পরনের শাড়ি কোন কুমোরটুলির মাটির বা তাদের দেওয়া শাড়ি নয়, এবছর আমাদের সমিতি থেকে মা দুর্গা সরস্বতী এবং লক্ষ্মী ঠাকুরের বেনারসি শাড়িতে সজ্জিত করা হয়। পুরো গ্রামের রাস্তা আলো দিয়ে সুসজ্জিত ছিল।
চতুর্থীর সন্ধ্যেবেলা মা মন্দিরে এলেও ; পঞ্চমীর সন্ধ্যেবেলা যখন মায়ের বোধন পুজো শুরু হয় ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে দুর্গা পুজোর শুভ উদ্বোধন হলো মাননীয় সায়নী ঘোষ মহাশয়ের হাত ধরে। তিনি দুর্গাপূজার সম্পর্কে কিছু বক্তৃতা ও শীতকালীন বনভোজনের প্রতিশ্রুতি দিলেন। প্রতিটি গ্রামবাসীর কাছে করজোরে শারদীয়ার শুভেচ্ছা বার্তা এবং দরিদ্র গ্রামবাসীকে শাড়ি উপহার দিলেন।
মহা ষষ্ঠী এই দিনে পাড়ার কচিকাঁচাদের নিয়ে কবিতা আবৃত্তি, নৃত্য, গীত ,অংকন বিভিন্ন খেলা কুইজ এই নিয়ে ছোট্ট একটা সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাদের হাতে বিভিন্ন পুরস্কার দিয়ে তাদের উৎসাহিত করা হয় এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
মহা সপ্তমী এই দিনে পাড়ায় মেয়ে বউদের মোমবাতি প্রতিযোগিতা, মিউজিক্যাল, চেয়ার হাড়ি ভাঙা, শঙ্খ ধ্বনি, গানের লড়াই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এই সব শেষ হওয়ার পর আমরা একটি রেস্তোরাঁ য় নৈশ্য ভজন করলাম, নৈশ্য ভোজনে বিরিয়ানি আর মাংস। তারপর বাজারে জাগ্রত সংঘের এবং তারপর অফিস পাড়ার ঠাকুর দেখলাম , এখানকার থিম ছিল- অমরনাথ।
মহাঅষ্টমীর এই দিনে এ বছর খুব ভোরে অঞ্জলি হয়েছিল কিন্তু এত সকালে আমরা যেতে পারিনি। তারপরেই সন্ধি পূজার ধুম পড়ে যায় শত শত দ্বীপের বাতি সব অন্ধকার দূর করে অশুভ শক্তির বিনাশ করে আলোর দিকে নিয়ে যায় ।
অষ্টমীর দিন, দূর্গা পূজার মধ্য গগন পরিকল্পনা করা হলো আশপাশের ঠাকুর দেখতে যাবো, তাই যথারীতি সাজগোজ করে সন্ধ্যে হতে না হতেই বেরিয়ে পড়লাম পোলেরহাট এর উদ্দেশ্যে। আমি আমার ভাই দুই মেয়ে এবং তাদের বাবা একটি টোটোর সংযোগে যাওয়া হলো পোলেরহাটে, সেখানকার মণ্ডপ সজ্জা শিবলিঙ্গের আদলে তৈরি প্রতিমা ও খুব সুন্দর এবং নব দুর্গা মায়ের নয় খানি রূপ যেন মেলে ধরেছে এই মন্ডপে। দ্বিতীয় কাশীপুরের শতধারা প্যান্ডেল, এই মন্ডপের খড়ের অসাধারণ কারকার্য তার সাথে বেতের বিভিন্ন নকশা সত্যিই খুব সুন্দর এই প্যান্ডেলটি দর্শনার্থী দের নজর কেড়েছে। এটি ভাঙ্গড় দু নম্বর বিডিও অফিসের পক্ষ থেকে ,টিভি৯ বাংলা ,নিউজ ১৮ বাংলার পক্ষ থেকে কিছু পুরস্কার জিতে নিয়েছে। এখানকার প্রতিমা সাবেকি এবং ডাকের সাজ। তৃতীয় মঙ্গলপুর এখানকার মন্ডপ সজ্জা একটু লম্বাটে ধরনের কাপড়ের তৈরি মন্ডপ সজ্জা গ্রামের উপর খুব সুন্দর পুজো করে এরা । এখানে একটি ছোট্ট পুকুরের মধ্যে বেহুলা লক্ষিন্দর কেউ সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল সেই মনসামঙ্গল কাব্যের কথা মনে পড়ে গেল। খাওয়া হয়েছিল পাপড়ি চাট এবং আইসক্রিম। চতুর্থ কাশিপুর এখানে মন্দিরে পূজা করা হয় এবং মন্দিদের চারপাশে বোতল কেটে নকশা করা হয়েছিল। সেদিনের শেষ ঠাকুর দেখা হয়েছিল কাঠালিয়ায়, কাঠালিয়া বিশ্বাস পাড়া এখানে তেমন একটা উন্নত ধরনের পূজো না করলেও এদের প্রতিমা ছিল খুব ছোট্ট সাবেকি, ছোট্ট উমা যেন তার ছেলেমেয়ে নিয়ে বসে আছেন। বাড়ি ফিরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম পরের দিন নবমীর অপেক্ষা.................
এলো নবমীর দিন , মনটা যেন চির রঙিন। ভাইকে নিয়ে বিকেল বেলা বেরিয়ে পড়লাম আশেপাশে ঠাকুর দেখার উদ্দেশ্যে। আমাদের এখানে মায়ের আশ্রমের পুজো ছাড়াও ঘোষপাড়া নস্কর পাড়া মন্ডলপাড়া ও সাধু খাঁ পাড়ায় পুজো করা হয়। ঘোষপাড়ার পুজোটা তুলনামূলক ছোট এবং প্রতিমা খুব ছোট্ট সাবেকি ঘরনার। নস্কর দের পুজো হয় বড়ো মন্দিরের মধ্যে, এদের ঠাকুরগুলি খুব লম্বা এবং ময়ূরের পালক দ্বারা সুসজ্জিত থাকে। এরা আলোকসজ্জায় ভাঙ্গড় থানা থেকে প্রথম পুরস্কার পায়।
সাধুখাঁ পাড়ার ঠাকুর গুলো ছিল খুব উঁচু এবং সোনালী বর্ণের দেখে মনে হয় সোনার তৈরি মূর্তি। এদের রাস্তাঘাট গুলি ছোট ছোট আলোক মালা দিয়ে সাজানো ছিল। মন্ডলপাড়া এদের পুজো খুব একটা আরম্বরপূর্ণ না হলেও ভালো প্রতিমা সাবেকি এবং ছোট্ট।
সবকিছু দেখে মন কি আর মানতে চায় তবুও নিজেদের পুজো এবং ঠাকুর দুটোই যেন আকৃষ্ট করে আমার মন।
বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই একটি আনন্দের খবর মন ছুয়ে গেল যেটা আমাদের প্রতিমা ভাঙ্গড় এক নম্বর ভিডিও সেরার সেরা অর্থাৎ প্রথম স্থান অধিকার করেছে। তারপর সারারাত ধরে সেদিন বাউল গান অনুষ্ঠিত হলো, প্রথম যিনি মঞ্চ অলংকৃত করলেন তেনার অনবদ্য গলা মন ছুয়ে গেল যেন মনে হলেও আমরা মাটির কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে আছি।।।।
পরের দিন দশমী পুজো অর্থাৎ মায়ের বিসর্জনের পালা, দর্পণ বিসর্জন হলেও। আমরা ওই দিন মাকে কৈলাসে ফিরতে দেই না কারণ সেদিন আমাদের শেষ দিন অর্থাৎ নাচ গান আনন্দে মেতে থাকার দিন। কারণ ওই দিন আমাদের মঞ্চে বিচিত্রা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।।
অন্তিম অর্থাৎ শেষ মুহূর্তে আলোক স্ফুলিঙ্গের মতো আমাদের কাছে খরর আসে, আমাদের পুজো পরিবেশ সচেতনতা দিক থেকে কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে অর্থাৎ সরকারিভাবে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। প্রথম সুরুচি সংঘ, দ্বিতীয় ঢালা প্রত্যয়, তৃতীয় গ্রামীণ এক ছোট্ট পুজো কালিকাপুর মায়ের আশ্রম। পূজা কার্নিভাল যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয় কিন্তু বিশেষ কারণে আর যাওয়া সম্ভব হয়নি।
এই খবর বিদায় বেলার এক আনন্দের খবর।।।।।।
আশা করি সামনের বছর আরো ভালো পুজো করবে আমাদের মায়ের আশ্রম।। ।।।
দ্বাদশী দিনে মায়ের বিদায়ের সুর বেজে গেছে আকাশ বাতাস শুধুই জলভরা আঁখি মেলে যেন তাকিয়ে আছে।
সেদিন সিঁদুর খেলা ধুনুচি নাচ ঢাকির বলে বিদায়ের সুর। রাত আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত কচিকাঁচা মেয়ে বউ ছেলেমেয়ে উভয়ই সিঁদুর খেলা সম্পূর্ণ হলো, রাত একটার সময় মা আসতে আসতে জলে ভাসতে ভাসতে কৈলাসে পাড়ি দিলেন।।।।
:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
অঙ্কিতা পাল, ভাঙ্গড়, দক্ষিণ ২৪পরগনা
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন