Featured Post
উপন্যাসিকা ।। উদয় ।। তপন তরফদার
- লিঙ্ক পান
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
(উপন্যাসিকা)
উদয়
তপন তরফদার
কলকাতার অনেক জায়গা বিভিন্ন কারনে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। ডেকার্স লেন। নাম শুনেই চোখ বুঁজে বলে দেওয়া যায় ওখানে প্রসিদ্ধ ডেকরেটারদের আস্থানা। ডাঁহা ভুল। ওটার অঘোষিত অথচ সর্বজনবিদিত নাম -খাও গলি। কলকাতার অফিস পাড়ার অফিস বাবুদের পেটপূজার বা ভুড়িভোজের সর্বোত্তম তীর্থ ক্ষেত্র এই ডেকার্স লেন। অফিসের এক ঘেয়েমির যন্ত্রণা, এটুঁলি পোকার মত সর্বক্ষণ লেগে থাকা বুক চিন চিন করার একঘেয়েমি ভাবনায় কিছুক্ষণের জন্য বিশুদ্ধ অক্সিজেনের যোগান দেয় এই খাবার বিক্রেতারা। দোকানের কোনো সাইনবোর্ডের দরকার হয়না। চকচকে সবুজ কলাপাতায় লুচি,ডাল, ক্ষীরের শিঙাড়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তৃপ্তি করে খায় আর তাকিয়ে থাকে গণেশ ঘোষের দোকানের ক্যাশবাক্সে বসে কে। বসে গণেশের বড় ছেলে অসীম। এই অসীম সিনেমায় অভিনয় করবে বলে স্টুডিয়ো পাড়ায় ঘুরঘুর করতো। ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে যায়। পরিচালক তপন সিংহ ওকে পছন্দ করে ভিলেনের ভূমিকায়। ব্যাস, এক কোপেতেই ঠান্ডা। ক্ষীরের শিঙড়ার সঙ্গে চর্মচক্ষে দেখতে পাওয়া পর্দার মানুষকে। উপরি পাওনা হয়ে যেতে পারে অসীমের সঙ্গে কথা বলতে আসা তাবড় তাবড় তারার জগতের নায়ক শিল্পীদের সঙ্গে।
এই গণেশর দোকান সহ অগুনতি দোকানের জন্য প্রয়োজন অনেক অনেক কর্মচারী। শুধুমাত্র খাবার তৈরি করলেই হবেনা। খাবার পরিবেশন করা। সঠিকভাবে মনে রাখা কে কি খাচ্ছে। খেয়ে পয়সা ঠিকমতো দিচ্ছে কিনা তারও নজরদারি করতে হয়। এই দোকানগুলো বেশ কয়েকজন চাল চুলোহীন কিশোর কাজ করে। মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার মানুষেরাও আসে উদরপুর্তি করতে। মানুষের খিদের সময় খিদে ছাড়া আর কিছুই মনে থাকেনা। তাই এদেরকে নিয়ে ওদের মালিকের কাছে কোনো উচ্চ বাচ্চা কেউই করে না।
এই ছেলেরা কলকাতারই আশপাশের বস্তিতে থাকে। কলকাতার বড় রাস্তার পাশের ছোট রাস্তা ধরে এগোলেই গলির রাস্তা নজরে আসবে। এই গলির তস্য কানাগলির ভিতর কতযে বস্তি আছে কলকাতা কর্পোরেশন ও হিসাবে রাখতে পারে না। চওড়া নর্দমার উপরেই কাঠের পাটাতন ফেলে দর্মার বেড়া, মাথায় প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে ঘর বেধেছে। ওরা যদি এইভাবে বসবাস না করতো শহরের অনেকের বাড়ি অন্ধকার হয়ে যেত। ঝি, রাঁধুনি পাওয়া যেতনা। বাড়ির কি অবস্থা হত কল্পনা করুন। একদিন কামাই করলেই বাড়িতে সকাল থেকেই কাক-পক্ষীরা ধারে কাছে ঘেঁষতে পারেনা। আসলে সমাজের চলাচলের জন্য আপনা আপনিই একটা অলিখিত সামঞ্জস্য তৈরী হয়ে যায়। ছেলেরা আসে কাজ করে ডেরায় চলে যায়। এই ডেরায় থাকার সুযোগ ও কারো কারো থাকেনা। প্রকৃত অর্থে পথশিশু। এরা তিন -চার বছর বয়সেই মা-বাবা ছাড়া। কি ভাবে যে এগারো -বারো বছরে পৌঁছায় তার অনুসন্ধান করলে যে কোনো মর্মস্পর্শী আখ্যান জোলো হয়ে যাবে। এরকমই এক কিশোর যাকে সবাই ফালতু বলে ডাকে নজরে পড়ে যায় কাস্টমস অফিসের আরদালি নির্মলের চোখে। নির্মল প্রতিদিন খেতে আসে এখানে। বাড়ি থেকে না খেয়েই আসতে হয়, তাই পেট ভরে খেতে সময় লাগে। __নির্মল মালের মাঝারি উচ্চতা। বয়স অনুপাতে মাথায় কাঁচাপাকা চুল বেশি। চুলগুলো এলোমেলো। চওড়া কপাল। নাকটা টিকলো। ডানদিকের গালে, মেয়েরা যেমন কপালে টিপ পরে ঠিক সেই ধরনের গোল টিপের সাইজে একটা কালো আঁচিল। তোবড়ানো গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কিন্তু চোখটা উজ্জ্বল। বড় বড় চোখ দিয়ে নির্মল মাল ফালতুকে লক্ষ করে যায়। ছেলেটা কবে থেকে উদয় হলো কে জানে। ছেলেটা যেন হাওয়ার উপর হেঁটে বেড়ায়। আরও নজরে এসে যায় গত বুধবার এক খদ্দেরের পার্সটা পকেটে ঠিকমতো ঢোকাতে না পারার ফলে রাস্তায় পড়ে যায়। খদ্দের দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যায়। ফালতুর নজরে যখন আসে খদ্দের তখন বড় রাস্তায়। ফালতু ফড়িংয়ের মতো উড়ে গিয়ে মানিব্যাগটা দিয়ে আসে। নির্মলের নিজের ছেলের কথা মনের অন্দরে ভেসে ওঠে।
(২)
নির্মলের সুখের সংসার একদিনেই কালো অমাবস্যায় ঢেকে গেল। আজ পূর্ণিমার আলোয় অবগাহন করে তুরীয় আনন্দ উপভোগ করছি। কাল কি হবে কেউ বলতে পারেনা। তিথি অনুযায়ী চাঁদের আলো বাড়বে বা কমবে, বিঞ্জানকে অনুসরণ করে বলতে পারি। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে মানুষের জীবনে কাল কি হবে কেউই বলতে পারেনা। যত দিন যাচ্ছে আমরা বিঞ্জান মনস্ক হচ্ছি। সত্যকি তাই। এখন খবরের কাগজ খুললেই দেখা যাবে স্বয়ং ঈশ্বরের থেকেও শক্তিশালী ওই জ্যোতিশরা। বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল ওই ভবিষ্যতের ফলাফল জানিয়ে গাদাগাদা টাকা পকেটে পুড়ছে এখনো মানুষের হুঁশ হচ্ছেনা। উড়িষ্যার বালাসোরে করোমন্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় এতগুলো লোকজনের কি একই রকমের শনির দশা ছিল তা কি জ্যোতিশরা বলেছিল। নির্মল মনে করে সবচেয়ে খারাপ জীবিকা ওই ভবিষ্যতের কথা বলে, ভাঁওতা দিয়ে উপার্জন করা।
মিকি বিড়লা হাই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। মিকি নির্মলের একমাত্র সন্তান। লেখা পড়ায় যেমন ভালো খেলা ধুলায়ও তেমন ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়াশুনা করবে মিকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু হবেই হবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধূলায় বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে পুরস্কারজয়ী হলে তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের "ব্লু" স্বীকৃতি দেওয়া হয়। স্কুলের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় রেকর্ড সংখক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে হিন্দু হাই স্কুলের সর্বকালের রেকর্ড স্থাপন করেছে। আনন্দ আর আনন্দ। মিকির হাতে শ্রেষ্ঠ অ্যাথলিটের ট্রফি। মা মমতার হাতেও কয়েকটি পুরস্কার। কলকাতার এরিয়ান ক্লাবের মাঠ থেকে তাড়াতাড়ি পাড়ায় ফিরতে হবে। পাড়ার লোকজনকে পুরস্কারগুলো দেখাতে হবে। ওদের ঘর এ্ন্টালিতে ফিরতে হবে। গেটের সামনেই একটা বাস দাঁড়িয়ে। রাস্তার বাঁদিক দিয়ে দেখা যাচ্ছে এন্টালি যাওয়ার এস নাইন মিনিবাসটা আসছে রাস্তার ওপাশে দাঁড়াবে। ঐই বাস চলে গেলে কম করে আধঘন্টা তীর্থের কাকের মত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। মা, ছেলে দুজনেই দৌড়ে রাস্তার ওপাশে যেতে চায়। রাস্তা পার হচ্ছে ওরা। সেই সময়েই দ্রতগামী এক টাটাসুমো চোখের পলকে ওদের পিষে দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মিকির মাথা ফেটে চৌচির হয়ে ডিমের কুসুমের মতো মানব দেহের ঘিলু কালো পিচের উপরে লেপটে রয়েছে। হাতে ধরা আছে শ্রেষ্ঠ স্পোষর্টম্যানের ট্রফিটা। মমতার হাতে শক্ত করে ধরা অন্যান্য পুরস্কার। সামনের চাকা ছেলের মাথাকে খেয়েছে পিছনের চাকা মমতার কোমর গুড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। এক ঘন্টা আগেও মিকি, মমতা জানতে পারিনি ওদের ভাগ্যে কি ঘটতে চলেছে।
মমতার হৃদপিন্ড ধিক ধিক করে চলছে। প্রাণে বাঁচলেও এ বাঁচার কোন অর্থ হয়না। বিছানায় শয্যাশায়ী। প্রথমে মনে হয়ে ছিল স্মৃতি শক্তি ফিরে পাবেনা। ধীরে ধীরে স্মৃতি ফিরে পেলেও মমতা নিজের বিষন্ন মন নিয়ে নিজেই বলে যায়, এ বাঁচার থেকে মরে যাওয়া অনেক ভাল। নির্মল সকালে মমতাকে চান করিয়ে দুধ মুড়ি খাইয়ে অফিসে চলে আসে।। দুপুর একটার পরে বুড়ি সবিতা মাসি সব বাড়ির কাজ শেষ করে এখানে এসে চান করে এদের চাট্টি ভাত ফুটিয়ে দিয়ে নিজেও খায়, মমতাকে খাওয়ায়। রাতের জন্য কিছু ডাল-ভাত ঢাকা দিয়ে রেখে যায় নির্মল-মমতার জন্য। এইভাবে ধুঁকে ধুঁকে দিনক্ষয় করে নির্মলের সংসার চলছে।
(৩)
নির্মল অন্য একজনের থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছে, ফালতুর মা,বাবা আত্মীয় স্বজন নেই। শিয়ালদাহ স্টেশনের তেরো নম্বর প্যাল্টফরমের শেষে রেলের পরিতক্ত সিগন্যাল হাউসে ও কয়েকজন ভবঘুরের সঙ্গে থাকে। নির্মলের ছেলেটাকে খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে সেদিনের ওই মানিব্যাগ ফেরত দেওয়ার ঘটনাটা চোখে ভাসছে। ছেলেটার শরীরে ভালো মানুষের রক্তই বইছে। ওর মা হয়তো ওর পিতৃত্বের পরিচয় দিতে পারেনি বলেই অন্ধকার জগতে ফেলে রেখে পালিয়েছে। এমন একটি ছেলেকে যদি ঘরে রাখা যায় দুপক্ষেরই মঙ্গল। ছেলেটাকে পরিচিতি দিয়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। নির্মল রবিবারে ওই খাবারের দোকান বন্ধের দিনে খুঁজে খুঁজে রেল লাইন পেরিয়ে হাজির ওদের ডেরায়। ডেরাটা দেখে আরো কষ্ট পেল নির্মল। ছেলেটা এখনো কি করে ভালো আছে তাই ভেবেই ভয় পেয়ে যায় নির্মল। বেশ কয়েকজন গোল হয়ে বসে নেশা করছে। এখন এক নতুন নেশা বাজারে এসেছে "ইয়াবা"। হেরোইনের মতো করেই নেশা করতে হয় ইয়াবার। অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েলের উপর ইয়াবা ট্যাবলেটটা রেখে নিচ থেকে তাপ দিয়ে ওটাকে গলাতে হয়। গলানোর ফলে যে ধোঁয়া বেরোয় তা একটা নলের মাধ্যমে মুখ দিয়ে টানতে হয়। ধোঁয়া তত্ক্ষণাত সরাসরি স্নায়ুতন্ত্রকে উজ্জীবিত করে ফেলে। এই ইয়াবা ট্যাবলেট কে বলা হয় "আপার ড্রাগ" কারণ এটার প্রথম টানেই শারীরিক ও মানসিক একটা ঝটকা লাগে যার ফলে সব কিছু চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
পাঁচ-ছজন ছেলে গোল হয়ে বসে আছে। ঠিক মাঝখানে কাগজ পুড়িয়ে অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েলে তাপ দিয়ে ধোঁয়া গিলছে। নির্মলকে দেখেই ঝটপট সবাই এধার ওধারে সটকে গেল। ফালতু ফ্যাল ফ্যাল করে নির্মলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফালতু নির্মলকে চেনে। কতদিন খাবার তুলে দিয়েছে। চুপচাপ বসে খাবার খেয়ে চলে যায়। তেমন মনে রাখার মতো কোনো ঘটনা ফালতুর মনে পড়েনা। নির্মল সিধে এগিয়ে এসে আন্তরিক গলায় বলে, আমি তোর কাছেই এসেছি। ফালতু অবাক হয়ে বলে আমার কাছে। আমি তো কোনো খারাপ কাজ আপনার সঙ্গে করিনি। আমার সঙ্গে কি দরকার। নির্মল বলে, না না আমি তোকে খারাপ বলছিনা। ফালতু বলে, ওদের সঙ্গে আমাকে মেশাবেন না। পারত পক্ষে আমি ওদের সঙ্গে মিশিনা। আমি ভালো ছেলেদের মতো বাঁচতে চাই। আমি মানুষের মতো বাঁচতে চাই। আমার মা ভদ্রলোকের মেয়ে। আমি মায়ের মাথায় হাত রেখে শপথ নিয়েছি, আমি চুরি-চামারি, নেশা, কোনো অসৎকাজ করবোনা। মা বলেছে আমার বাবা ও ভদ্র ঘরের ছেলে। ভালো মানুষ। ভাগ্যের ফেরে আমার আজ এই অবস্থা। বাড়ির অমতে আমার বাবা বিয়ে করে। আমার মা নিচু জাতের মেয়ে বলে, দাদু, জ্যাঠারা আমার বাবাকে তাড়িয়ে দেয়। বাবা ও রাগে দুঃখে মা কে নিয়ে এক কাপড়ে ঘর ত্যাগ করে সংসার পাতেন। সংসার ভালোই চলছিল। আমার তখন পাঁচ বছরের। সব কিছু উলোটপালট হয়ে যায় এক দুর্ঘটনার জন্য। বাবা বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাসের ব্রেক ঠিক মতো কাজ না করার জন্য এক্সাইড মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনকে পিষে দেয়। নির্মলের পুরানো ক্ষতটা মনের মাঝে ভেসে উঠে। যন্ত্রণাটা সহ্য করে নিয়ে বলে, হাঁ ঘটনাটা খবরের কাগজে পড়েছিলাম। মা অনেক চেষ্টা করেছিল আমাকে নিয়ে বাঁচতে। বস্তির একটা ঘরে ঠাঁই পেয়েছিলাম। প্রতি রাতেই বিশুমামা যে ঘরটা যোগাড় করে দিয়েছিল সে প্রতি রাত্রেই ঝামেলা করতো মায়ের সঙ্গে। বস্তিতে ও কিছু ভালো মনের মানুষ থাকে। ওরাই বলে বিশু ভালো লোক নয়। তোমাকে নষ্ট করে দিয়ে মেয়ে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেবে। তোমরা পালিয়ে যাও। নির্মল জানতে চায় তোর মায়ের আর কোনো খবর পেয়েছিস। ফালতু ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। নির্মল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নিজেই ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে সান্ত্বনা দিতে থাকে। ফালতু বলে, আমি জানি মা সবারই সব সময় থাকেনা। ছোট্ট ফালতু যে এমন বড়দের মতো কথা বলবে নির্মলের ধারণাই ছিলনা। ফালতু বলে উঠে মা মরেনি গুণ্ডারা আমার মাকে ধরে নিয়ে গেছে। ওদের কথামত বস্তির ঘর ছেড়ে আমরা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে থাকতে শুরু করি। গভীর রাত। আমি আর মা পাল্টফরমে শুয়ে আছি। ধ্বসাতাধ্বস্তির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখি মাকে চ্যংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি মায়ের শাড়ি ধরে আছি। আমাকে এক থাপ্পড় মেরে ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে তুলে নিয়ে যায়। মায়ের সেই কান্না এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। আমাকে মানুষের মত মানুষ হতে হবে। নির্মল এত কিছু শুনবে আশা করেনি। ফালতুর মাথায় হাত বোলায়, বলে শান্ত হও। আমি না বুঝে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আমার পরিবারেও এক অঘটনের ফলে আমাদের সব থেকেও কিছু নেই। নির্মল সব ঘটনা ফালতু কে বলে। দুজনের মধ্যে এক অন্তরঙ্গ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সেই মোক্ষম সময়েই নির্মল বলে, তুই আমার সঙ্গে চল। তুই আমার বাড়িতে আমাদের ছেলে হয়ে থাকবি। ফালতু কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যায়।
(৪)
ফালতু নিজের মায়ের সেবা করতে পারেনি, মমতাকে মনপ্রাণ উজার করে সেবা করে। মমতা, নির্মল জ্যোতিষে বিশ্বাস না করলেও ঈশ্বরের প্রতি আস্থা রাখে। মনে করে ঈশ্বর সৎমানুষের সঙ্গে থাকে। নির্মল, মমতা, ওরা মনে করে তাদের ছেলে কে ঈশ্বরই ফেরত দিয়েছে। নিজের ছেলে হয়ে যায় ফালতু । ফালতুর নাম বদলে রাখা হয় উদয়।
নির্মল পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ক্লাবের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সবাই হতবাক হয়ে যায়,বলতে থাকে এ কোথা থেকে উদয় হলো। সবকটা দৌড় প্রতিযোগিতায় অবিশ্বাস্য কম সময়ে দৌড়ে প্রথম হয়ে যাচ্ছে। মাঠের লোকজন জেনে গেল ছেলেটার নাম উদয়। আমাদের পাড়ার নির্মল বাবুর বাড়িতে থাকে। কেউ রটিয়ে দিল ওনার দুরসর্ম্পকের আত্মীয়। কেউ কেউ বলতে লাগলো নির্মলবাবু দত্তক নিয়েছে। ফালতুর দৌড় কোনো অংশে ভারতের গর্ব মিলখা সিং এর থেকে কম নয়। আর উদয় মানে আর্বিভাব। এক নতুন অধ্যায়ের শুরু করলো উদয়। নতুন নতুন রেকর্ডের সৃষ্টি হবে এই উদয়ের দৌলতে। ছেলেটা ভালো দৌড়ায়। ক্লাবের ছেলেরা বলতে লাগল, ও আমাদের মিলখা সিংহ। সুযোগ পেলে ও ভালো দৌড়বীর হতে পারে। নির্মল ওই জ্যোর্তময়ীর রানার কোচিং সেন্টারে উদয়ের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে দিল। মমতা শুয়ে শুয়েই ওকে লেখাপড়া করাতে লাগল। পাড়ার সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রাইভেটে ভালো নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করলো। উদয় পড়াশুনার সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি, খেলাধুলা নিষ্ঠার সঙ্গে চালিয়ে যায়।
মাঠের ট্রেনিং শেষ করে কাস্টমস অফিসে নির্মলের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে বাড়িতে ফেরে। এই সময়ে অফিসের অনেকের ফাইফরমাশ হাসিমুখেই করে দেয়। অফিসের অনেকেই ভালোবাসে, পছন্দ করে উদয়কে। যে পরিশ্রমী হয়, মানুষের উপকারের জন সচেষ্ট তাকে সবাই ভালোবাসে, সে সহজেই মানুষের মনে স্থান করে নিতে পারে। সেদিনটা ছিল নভেম্বরের কোনো একদিন। সব বামপন্থী দল মিলিত হয়ে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মিছিলের ডাক দিয়েছিল। পুলিশের সঙ্গে খন্ড যুদ্ধ বেঁধে যায়। পুলিশ গুলি চালায়। প্রতিবাদীরা যানবাহন বন্ধ করে দেয়। শহর অচল হয়ে যায়। সেই সময়েই অফিসে ফোন আসলো একটা জরুরি ফাইল সুপারিনটে্ন্ডন নিয়ে যেতে ভুলে গেছেন। বস দিল্লী যাচ্ছেন রাজধানী এক্সপ্রেসে। শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ছেড়ে যাবে বিশ মিনিট পরেই। বড়বাবু ফ্যাকাশে মুখে বলছে কি করে এই সময়ের মধ্যে এই পরিস্থিতিতে শিয়ালদহ যাবো। উনিতো এসব মানবেননা। আমাকেই বলবেন অপদার্থ কোনো কাজের নয়। নির্মলের ও খারাপ লাগে। অফিসের সবাই নিরীহ পৌঢ় বড়বাবুকে ভালোবাসে। কি করা যায়। উদয় সব শুনছে। মাথা নিচু করেই বলে, আমি একবার চেষ্টা করবো। নির্মল বলে কি করে যাবি সব বন্ধ। উদয় বলে বন্ধ বলেইতো সুবিধা হবে। আমি দৌড়ে স্টেশনের পিছনের রেল লাইন ধরে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে যাবো। তোমারা উনাকে ফোন করে বলে দাও হলদে হাফশার্ট পরা, লম্বা একটা ছেলে যার নাম উদয় সে ফাইলটা নিয়ে যাচ্ছে।
উদয় স্ট্রান্ড রোডের দিকে দৌড় শুরু করে হাতে চকচকে রেক্সিনে বাঁধানো ফাইল। কলকাতার লোক না বুঝেই পরোপকারও করতে ওস্তাদ। দুজন লোক, চোর চোর বলে উদয়ের পিছনে দৌড়াচ্ছে। না পিছনে তাকিয়ে সময় নষ্টের সময় এখন নয়। কে যেন ওর কানে কানে বলছে, "ভাগ উদয় ভাগ।" জীবন যতদিন থাকবে যন্ত্রণাও ততদিন থাকবে। উদয় হেড পোষ্টঅফিসের গোলবাড়ির পিছনের সুলভ শৌচাগারে ঢুকে লাফিয়ে পিছনের পাঁচিলে উঠে পড়ে। পাঁচিল থেকে লাফ দিয়ে নেমে বাঁ দিকে ছুটে ঢুকে পড়ে ডেভিড লেনে। উদয় বাস্তবের ধাক্কা খেয়ে বুঝে গেছে আনপাড় পাবলিককে কি ভাবে বোকা বানাতে বা বোঝাতে হয়। উদয় দৌড়াতে দৌড়াতে বলছে, আমাকে ট্রেন ধরতেই হবে, আমাকে ট্রেন ধরতেই হবে। উদয়ের চিৎকারে পাবলিক ভয়ে বা ভক্তিতে রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছে। কেউ মনে করছে পাগল কেউ মনে করছে ক্ষেপা কুকুরের মোতো দৌড়াচ্ছে, সরে যাওয়াই ভালো। গায়ে পড়লে বিপদ। এই কানাগলি শর্টকাটে বাগরী মার্কেট মিশেছে। ওখান থেকে যায় কাশি দত্ত লেনে যা মেডিক্যাল কলেজে মিশেছে। মেডিক্যাল কলেজের বাঁ পাশের হ্যাারিসন রোড ধরে সুভাষ ইন্সটিউ্টকে পিছনে ফেলে রেললাইনটা ধরে পনেরো মিনিটেই পৌঁছে যায় রাজধানী এক্সপ্রেসে। বশ গুলারিয়া শাহ সাদা রুমাল দিয়ে ঘেমো টাক, মুখ মুছেই চলেছে। উদয়ের হাতে ফাইলটা দেখেই ধড়ে প্রাণ আসে। বাবারও বাবা থাকে। দিল্লীর কর্তা যা মধুর বাণী শুনাতো তাতে একটা প্যান্টের পাছা হলদে হয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কড়কড়ে একশো টাকার নোট এগিয়ে দেয় উদয়ের দিকে। উদয় বলে, সাহেব আমার বাবা ওখানে কাজ করে। আপনাদের নুন খাই। আমারও দায়িত্ব, সুযোগ পেলে আপনাদের সাহায্য করা। আজ গুলারিয়া সাহেবের সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম একজনকে দেখলো টাকা না নিয়ে ও খুশী। গদগদ হয়ে বলে, আমি দিল্লী থেকে ফিরে তোমার একটা ব্যবস্থা করে দেবো। উদয় কোনো কথা বলে না, মনে মনে হাসে। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে বড়রা বিপদ থেকে উদ্ধার হতে বা হয়ে প্রতিশ্রুতি দিতে কার্পণ্য করেনা, এবং ভুলে যেতেও ভোলেনা।
গুলারিয়া সাহেব এক সপ্তাহ হলো ফিরেছে। বড়োবাবুকে বলেছে ওই ফাইলটা না নিয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যেতো। বড়বাবুর উপস্থিত বুদ্ধির ও প্রশংসা করেছে। কালের নিয়মেই ঝড় থেমে গেছে, অফিস শান্ত হয়ে আগের মতই গতানুগতিক চলছে। অফিসে নতুন কোনো ঝঞ্ঝাটের উদয় হয়নি তাই স্বাভাবিক কারনেই উদয়ের খোঁজ পড়েনি। বৃহস্পতিবারের বারবেলায় অফিসে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়লো। দিল্লী থেকে খবর এসেছে এইবারের অল ইন্ডিয়া কাস্টমস স্পোর্টস মিট কলকাতায় হবে। সব কিছুর ব্যবস্থা এই অফিসকে করতে হবে। গুলারিয়া সাহেব বড়োবাবুকে ডেকে রুমাল দিয়ে টাক, মুখ মুছেই চলেছেন। বড়বাবু মাখন সমাদ্দার কে সামনে বসিয়ে সব কথা খুলেই বলেন,। বড়বাবু বলেন, সাহেব ঘাবড়াবেন না। ওরা বাজেট করে যা টাকা দেবে সেই অনুযায়ী "ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ঠিকাদার" কে বরাত দিয়ে দেবো বলেই ঠোঁটের পাশে মুচকি হাসি। এই হাসির অর্থ গুলারিয়ার মর্মে মর্মে গাথা। ঠিকাদারের থেকে কমিশন পাওয়া যাবে। গুলারিয়া এক ফ্যাকাশে মুখ করে বলে লেকিন স্পোর্টসমে হামারা অফিস কা কেয়া পজিশন হোগা। বিপদে পড়লে মাতৃভাষা অজান্তেই পেট থেকে বেরিয়ে আসে। গুলারিয়া সাহেবের কোন দোষ নেই। সারা ভারতের সব অফিসের সব কর্মচারিবৃন্দর এই প্রতিযোগিতা। কলকাতার শাখা যদি কোনো পদক না পায় তাহলে কলকাতার বদনামের থেকে গুলারিয়ার অযোগ্যতাই বেশি প্রমাণিত হবে। কেউ বুঝবানা কত দিন হলো নতুন লোকজন নেওয়া হয় নি। স্পোর্টস কোটার কোনো কর্মচারী এই অফিসে কাজ করেনা। সমাদ্দার বাবু বলেন, ও নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনি অস্থায়ী হিসাবে উদয় কে আমাদের দফতরে ঝাড়ুদার হিসাবে নিয়োগ করে নিন। সিনেমার পর্দায় যেমন দেখায় কড়াৎ করে বাজ পড়ার আওয়াজ আর পুরানো সব কথা মনে পরে যায়। প্রথম কথাটাই বলে, "আমি কোথায়।" গুলারিয়া টাকে রুমাল ঘষতে ঘষতে মনে পড়ে যায় শিয়ালদা স্টেশনের ঘটনা। গুলারিয়া মুখে চুক চুক আওয়াজ তুলে বলে, ভুলে গিয়েছিলাম, ও লেড়কা বহুত তেজি হ্যায় আচ্ছা হ্যায়।
কাস্টমস অফিসে সাজসাজ রব। কেউ হাঁটার রেসে নাম দেবে বলে বাস ছেড়ে দিয়ে হেঁটে অফিসে ঢুকছে। কিছুই বলতে পারছেনা গুলারিয়া। টিফিন টাইম পাস করে সবাই "প্রাক্টিসে যাচ্ছি" বলে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। গুলারিয়ার টাক আরও চওড়া হচ্ছে। দিল্লী থেকে হোমড়া চোমড়ারা আসবে। শোনা যাচ্ছে শুল্ক বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জ্ঞান সিং আসতে পারে।
২৩শে জানুয়ারি মোক্ষম দিনেই অনুষ্ঠান। এই দিনে সব পক্ষই এক হয়ে কে কত দেশকে ভালোবাসে নেতাজী অন্ত প্রাণ প্রমাণ করে ছাড়ে। তেরঙ্গা পতাকা তুলে জ্ঞান সিং জ্ঞান বিতরণ করতে শুরু করলেন। থামার কোন লক্ষণ নেই। সেই কথায় বলে না, যার কেউ নেই তার ভগবান আছে। এখানে ভগবান লোড শেডিং করে দিলেন। সবাই স্বস্তির নিঃশাস ফেলল। আশাতীত দর্শক উপস্থিত হয়েছে। কর্মী বর্গের প্রত্যকেই পরিবার পরিজনবর্গ নিয়ে হাজির। ফ্রি চা বিস্কুট। জম্পেশ লাঞ্চ প্যাকেট পাওয়া যাবে।
হুইসেল বাজিয়ে শুরু হলো প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগীরা সর্বোচ্চ কটি বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবে তার কোনো সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। দুটি -তিনটির বেশি বিষয়ে লড়তে গেলে যে দমের দরকার তা কজনের আছে। তাছাড়াও যত বেশি প্রতিযোগী থাকবে তত ভালো হবে। ফাঁকা ফাঁকা লাগবেনা। একেই বলে কপালের নাম গোপাল। উদয়ের কপাল ফুলে কলাগাছ। প্রত্যেকটি বিষয়ে সে একশ মিটার থেকে দুহাজার মিটার দৌড়। লং জাম্প থেকে হাই জাম্প। সব বিষয়েই প্রথম। মন্ত্রী জ্ঞান সিং ও খুব খুশি। হামারা ডিপার্টমেন্ট কি আদমী হামকো বহুত খুশ কিয়া। গুলারিয়া কানে কানে মন্ত্রীকে বলে, ও আমাদের কর্মচারী নয়। কয়েক দিনের জন্য ক্যজুয়াল লেবার হিসাবে নিয়েছি। মন্ত্রী বলে, আপনাদের এই বুদ্ধি নিয়ে কি করে ডিপার্টমেন্ট চালান। ওকে স্পোর্টস কোটায় চাকরির জন্য পাঠান, আমি সই করে দেবো। গুলারিয়া বড়বাবুকে সাক্ষী রাখতে খোঁজ করলো, পেলোনা। গুলারিয়া জানে পরের উপকার করবে নিজের ক্ষতি করে নয়। চিঠি লিখলে পাল্টি খেয়ে ওর ঘাড়েই যেন বন্দুক না চাপিয়ে দেয়।
এই সব অনুষ্ঠানে শেষ হয় "গো এজ ইয়ু লাইক" দিয়ে। প্রতিযোগীরা যেমন খুশী সেজে আসে। কিস্তিমাত করে দিলেন বড়বাবু। "মুঝে প্যায়র হোগায়া, মুঝে প্যায়র হো হো গেয়া গান গেয়ে, লুঙ্গি ড্যন্স, লুঙ্গি ড্যন্সের কায়দায় নেচে। সবাইকে ডেকে ওনার সঙ্গে নাচতে অনুরোধ করলেন। অনুরোধ কেউ উপেক্ষা করলোনা। ওনার সঙ্গে সবাই নাচতে শুরু করে দিল। মধুরেণুয়তে সমাপ্ত হলো।
(৫)
উদয়কে চাকরি দেওয়া হয়েছে। কোনো কাজ করতে হয়না বলে ক্ষোভ। কবে দৌড় প্রতিযোগিতা হবে তখন দৌড়াবে। উদয়কে বলে ও "রেইড" করতে ওই দলের সঙ্গে পথেঘাটে যাবে। ডিউটি করবে। উদয় দেখে লরি ভর্তি ফুডর্কপোরেশনের গম রবীন্দ্র সেতুতে উঠেছে। ড্রাইভার পকেট থেকে তাসের মতো কি একটা দেখিয়ে স্পীডে সেতুতে উঠে গেল। উদয় দৌড়ে লাফ দিয়ে ড্রাইভারের দরজা ধরে টান মেরে বলে, 'রোকো।' চোরাই মাল পাচার হচ্ছে। শোরগোল বেঁধে যায়। খবরের কাগজের লোক, টিভির লোক শকুনের মতো ঘিরে ধরে ছবি তুলতে থাকে। কতৃপক্ষ বাধ্য হলো অ্যরেষ্ট করতে। রাতেই পুলিশ কমিশনারের ফোন গুরালিয়াকে। "কি ব্যাপার। ওরা কমিশন দিয়েছে, আপনাকেও কমিশন দেওয়া হয়েছে তাও কেন ধরা হলো। আমি জানতে পারলাম ড্রাইভার "পাঞ্জা" দেখানোর পরও ধরা হয়েছে। গুলারিয়া টাকে হাত বুলাতে বোলাতে বলে টাকা পেয়েছি। কিন্তু বিপদ হয়েছে ওই উদয়। ওকে বলা যাচ্ছেনা আমরাই কমিশন খেয়ে ওদের কে ছেড়ে দিই।
কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে উদয়ের নাম অনেকেই জেনে গেছে। রাত বারোটায় ডন দাউদ মিঁয়া ফোন করে গুলারিয়াকে বলে, হচ্ছেটা কি। একটা লোককে কনট্রোল করতে পারছেন না। গুলারিয়া বলে, আমি শাঁখের করাতে পরে গেছি। ওকে তো এখন ডিউটি থেকে সরাতে পারিনা। ওকে সরালেই কাগজে কাগজে লেখা লেখি হবে। আমার সাত গুষ্ঠি ঘুষখোর প্রমাণ করে দেবে। ও যদি নিজে থেকে বলে যাবেনা তবেই সবার মঙ্গল। দাউদ বলে আপনাদের মাথায় গোবর ও নেই। যত সব ভূষিমালের দল। গুলারিয়া সাহেব, ওকে বদলি করে দিন যে কোনো জংলী জায়গায়। গুলারিয়া দাউদ মিঙাকে নিজের বিবির থেকেও বেশি ভয় পায়। বিবিরা মুখে টাইট দেবে প্রাণে মারবেনা দাউদের মতো। দাউদকে বলবেনা বলবনা মনে করেও বলে ফেলে, বদলি করলে, এখানে কর্মচারীদের ইউনিয়ন ঘেরাও করে কাজকর্ম বন্ধ করে বগল বাজাবে। টিভির লোকজন দের ডেকে এমন গরমাগরম বক্তৃতা দেবে যা শুনে পাবলিক আমাকে তো ভিলেন বানাবেই সঙ্গে সরকারকে জড়িয়ে রগরগে গল্পকথন শুরু করে দেবে। দাউদ এবার শোলের গব্বরের সেই ডায়লগটা স্মরণ করিয়ে বলে, আব তেরা কেয়া হোগা কালিয়া। গুলারিয়া সাহেব বাথরুমে যাওয়ার সময় পেলোনা। প্যান্টেই হয়ে গেল। ফোনে বলেই ফেলে উষকো প্রমোশন দেখে ভাগায়াঙ্গে। বড়বাবু এই সময়েই ঘরে ঢুকে কথাটা শুনেই চেপে ধরে গুলারিয়াকে। গুলারিয়া গড়গড় করে সব উগলে দেয়। বড়বাবু ও উদয়ের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। পুরো অফিসের বদনাম হয়ে যাবে। বড়বাবু বুদ্ধি দেয় ওকে ডেপুটেশনে উত্তর বঙ্গ পাঠিয়ে দিন। ওখানকার লোকজন দের কয়েক মাস সাহায্য করতে যাবে। গুলারিয়া মনে মনে বলে এই জন্যই বড়বাবুকে শকুন বলে।
(৬)
উদয় পাঠিয়ে দেওয়া হলো উত্তর বঙ্গের ফুলবাড়ি অফিসে। এই অঞ্চলে কাঠ মাফিয়া দের রাজত্ব। পুরানো অনেক গাছ আছে যার সন্ধানে আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা প্রচুর পরিমাণে টাকা খরচ করে। কোনো এক গাছের কাঠের টুকরো এক রাত্রি জলে ভিজিয়ে খেলে মধুমেহ অর্থাৎ ডায়াবেটিস রোগ সেরে যায়। সারা পৃথিবীতে অগুনতি কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে এই রোগের জন্য। সামান্য জলে ভিজিয়ে জলপান করলেই যদি রোগ সেরে যায় তার মূল্য হিরের থেকেও কম দামি নয়। এই অঞ্চলের বনে অনেক প্রাচীন মূল্যবান গাছ আছে যা দুস্প্রাপ্য। স্বাভাবিক কারনেই তার মূল্য অনেক অনেক। সমগ্র চোরাচালানিরা উত্তর বঙ্গের এই রাস্তা ধরেই চোরাচালান করে।
উদয়ের সঙ্গে আরো তিনজন আছে ডিউটিতে। উদয় ছাড়া তিন জনেরই বয়স ষাটের কাছাকাছি। এই অঞ্চলের বাসিন্দা, অবসরের শেষ পর্যায় সবাই বাড়িতে থাকতেই বেশি ভালোবাসে। তেমাথার ঢালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডিউটি দিচ্ছে ওরা। সাধারণত সন্ধ্যা নামলেই পাহাড়িরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তো। এখন টিভির দৌলতে সবাই ঘরে বসেই টিভি দেখে, যার ফলে যতদূর চোখ যায় দুর থেকে মনে হয় বড় আকার বিশিষ্ট জোনাকিরা পাহাড়ের ধাপে ধাপে জ্বলছে।
পাহাড়ি এলাকায় কখন বৃষ্টি নামবে কেউ জানে না। হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সমস্ত প্রকৃতি যেন রুদ্ধ-শ্বাসে প্রলয়ের প্রতীক্ষায়। একটা বিদুৎ আকাশকে এফোঁড় ওফোঁড়ে দীর্ণ-বিদীর্ণ করে দেবার পরই প্রচণ্ড শব্দ করে বজ্রপাত হল। তারপর আবার সব চুপচাপ। কয়েক পল পরেই সোঁ সোঁ শব্দের ঝড় এলো। কামান গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে যেন যুদ্ধ আরম্ভ হলো। গাছগুলো হাহাকার আওয়াজ তুলে আর্তনাদ করতে লাগলো। পাখিরা বিভ্রান্ত হয়ে উড়তে লাগল। বৃষ্টি নামল। বেশ মুষলধারে। ঝড় বৃষ্টি দুটোই সমানে চলতে লাগল। গাছের ডালপালা ভেঙে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, মনে হলো মৃত সৈনিকদের দেহ আছড়ে পড়ছে। ঝড়,বৃষ্টি আর অরণ্যের সমন্বয়ে এক বৈচিত্র্যময় শব্দের সৃষ্টি করলো। কখনও মনে হচ্ছে কেউ যেন অট্টহাসি হাসছে, পরক্ষণেই মনে হচ্ছিল কেউ যেন কাঁদছে। কান্নার আর্তনাদের সঙ্গে খিকখিক হাসি মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এক অসহনীয় আতঙ্কর পরিবেশ।
উদয়রা ওয়াটার প্রুফটা পড়ে নিয়ে ডিউটি দিচ্ছে।। উদয়ই রাস্তার ধারে। একটা জীপ মাঝামাঝি গতিতে চলে গেল। উদয় বুঝতে পারলো এই জীপ আগে আগে রেইকি করে মোবাইলে খবর দিয়ে দিচ্ছে "রাস্তা ক্লিয়ার।" উদয় ওদেরকে বলে রাস্তায় আসতে। পাখি ধরতে হবে। ওরা এগিয়ে আসলোনা। একটা লড়ি সোঁ সোঁ করে এগিয়ে আসছে। উদয় হাত দেখিয়ে থামাতে বলে। লরি না থেমে ওর গা ঘেঁষে এগিয়ে যায়। উদয় লরির পাশাপাশি দৌড়াতে থাকে। লরির নাগালের বাইরে, পিছন দিক থেকে আর একটা জিপ জোরে ধাক্কা মারে। রাস্তা থেকে ছিটকে এক গভীর খাদে পড়ার আগেই দুস্প্রাপ্য পাহাড়ি গাছ "সোনালু"র ডালের এক খাঁজে বাঁ হাতের পাঞ্জ্যা আটকে যায়। ভাগ্যিস ডালে হাতটা আটকে গিয়েছিল তা নাহলে পাঁচশো মিটার নিচের খাদে পাইনের বনে আছড়ে পড়তো। ঝুলতে থাকে উদয়, হাত ফসকালেই অতল খাদে। লরিটা এঁকে বেঁকে এগোচ্ছে। চড়াই রাস্তা টপ গিয়ারে ও কচ্ছপের গতি। উদয় ঝুলন্ত অবস্থায় ডান হাতে অত্যাআধুনিক নাইন এম এম পিস্তলটা টিপ করে ট্রিগার টিপে বলে, কালো বাজারিদের নিকেশ করবই। গুলিটা সিধে লরির ডিজেল ট্যাংকে। জ্বলন্ত লরিটা পাহাড়ের অতলস্পর্শ খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
উদয়ের বামহাতের পাঞ্জা সোনালু গাছের দুটি ডালের ফ্যঁকরার মাঝখানে আটকে গেছে। শরীর ঝুলছে। হাত খুলে গেলে নিচে আছড়ে পরতে হবে। ভোর হতে এখনো কয়েক ঘন্টা বাকি। কিছু অধিবাসি বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হয়েছে। উদয়ের সঙ্গে আরো যারা ডিউটি করছিল তারা ছুটে এসেছে। দু-তিনটে লরি মজা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে গেছে। ড্রাইভাররা মনে মনে বলছে বেশ হয়েছে। আমাদের ধরার ফল হাতেনাতে পেলি। সহকর্মীরা উপর তলায় ফোন করে দিয়েছে। রাত শেষ হয়ে আসছে। অহনার আলো বুঝিয়ে দিচ্ছে সূর্য দেবতার উদয় আসন্ন। উপর তলার আধিকারিকরা এখনো ঠিক করতে পারছেনা উদয়কে বাঁচতে টিম পাঠাবে কি পাঠাবেনা। সূর্যদেব উদিত হয়ে উদয়ের মুখেই পড়ছে। ওদিকে জ্ঞান হারিয়ে ঝুলতেই থাকে উদয়।
দর্শকদের একান্ত প্রার্থনা স্বমহিমায় আবার সমাজে ফিরে আসুক উদয়।
- লিঙ্ক পান
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন