কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ
শ্যামল হুদাতী
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence বা AI) কী?
মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা শক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তি নির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে। সহজ কথায়, এটি মেশিন দ্বারা প্রদর্শিত বুদ্ধি।
অপটিক্যাল অক্ষর স্বীকৃতিটি "কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার" উদাহরণ হিসাবে ধরা যায় না, তখন এটি একটি নিয়মিত প্রযুক্তি হয়ে ওঠে। যেমন, দাবা খেলা এটি কৌশলগত গেম সিস্টেম , স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ি চালান ইত্যাদি।
এআই গবেষণাকে কতগুলো উপশাখায় বিভক্ত করা যেতে পারে যা নির্দিষ্ট সমস্যা, দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষ সরঞ্জামের ব্যবহার বা নির্দিষ্ট অ্যাপ্লিকেশনগুলির সেরা পারফরমেন্সের দিকে নজর দেয়।
জন ম্যাকার্থি, একজন আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী। তিনি "কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা" ও প্রোগ্রামিং ভাষা লিস্পের জনক। তিনি "আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স" নামক পরিভাষার প্রচলন করেন।
মানব সভ্যতা যত অগ্রগতি হয়েছে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান উন্নতির সাথে সাথে ততোধিক উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। যেমন প্রযুক্তি শুধু তথ্য খোঁজে না, খুঁজে খানিকটা বিশ্লেষণ ও করে দেয়। তার মানে যন্ত্র মানুষের কাজ করে দিচ্ছে। যখন যন্ত্র মানুষের কোন কাজ করে দেয় তখন শুরু হয় বিরোধ। এটা হল উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের দ্বন্দ্ব। এবং তার হাত ধরে সৃষ্টি হয় মালিক এবং শ্রমিকের সংঘাত, লক্ষ্য এবং অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি বৈষম্য, নারী পুরুষ এর মজুরি বৈষম্য ইত্যাদি। আমি একটা সাধারণ উদাহরণ দিচ্ছি, কোন এক বড়লোকের বাড়িতে ইলেকট্রিক ফ্যান আসার পর বেশিরভাগ মুখে হাসি ফুটল যে মহিলা মনিবের মাথায় পাশে দাঁড়িয়ে পাখা টানতেন তাঁর চাকরিটি খোয়া গেছিল বলে তিনি কাঁদছিলেন। রোবটিক সার্জারি বড় বড় নামকরা হাসপাতালে এর ব্যবস্থা আছে। আজকাল তো আবার রোবটিক গৃহকর্মী ,নিরাপত্তারক্ষী, রিসেপশনিস্ট পাওয়া যাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছি প্রেমিক প্রেমিকা এমনকি স্বামী ও পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি জানতে পারলাম রোমান্না রামোস নামের এক ছত্রিশ বছর বয়সী নিউ ইয়র্কবাসী মহিলা এআই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তার প্রেমিক তৈরি করেছিলেন। যার নাম মিস্টার কার্টেল।
আরেক খবর সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে-
মাস কয়েক আগে সানি ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় একটি ছবি জমা দিয়েছিলেন জার্মান চিত্র গ্রাহক বরিস এলদাগসেন। বিখ্যাত এই প্রতিযোগিতায় ক্রিয়েটিভ ওপেন ক্যাটিগরিতে
প্রথম পুরস্কার জিতে নেন সেই ছবিটি।
এই পর্যন্ত ঠিক ছিল - গোলমালটা হল এর পরেই। পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেন শিল্পী নিজেই। জানিয়েছেন এই ছবি আসলে তিনি তোলেন নি। তাহলে এই অসাধারণ ছবি কে তুলল?
না ছবিটির পেছনে কোন মানুষ নেই - রয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
বরিসের নির্দেশে বা প্রম্পটে ছবিটা ফুটিয়ে তুলেছে মিড জার্নি নামে একটি এআই ইঞ্জিন।
প্রশ্ন ওঠে বরিস কেন এই কৃত্রিম ছবি পাঠালেন প্রতিযোগিতায়?
বরিসের দাবি মানুষের তোলা ছবি ও এ আই এর বানানো ছবির মধ্যে তুলনা করার জন্য তিনি এই ছবিটা প্রতিযোগিতা জমা দিয়েছে। তার ধারণা ছিল - প্রতিযোগিতায় নামজাদা বিচারকরা দুটি ছবির মধ্যে ফারাক করতে পারবেন না। বাস্তবে হয়েছে ঠিক তাই। তার দাবি এই আই এর ব্যবহার যে মানুষের সৃজন ক্ষমতাকে হারিয়ে যাচ্ছে তারই প্রমাণ । এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে তার প্রশ্ন - আপনাদের মধ্যে কজন ধরতে পেরেছিলেন যে ছবিটা মানুষের তোলা নয়।
বরিসের ছবির ঘটনা নিয়ে প্রবল শোরগোল পড়েছে শিল্পী দুনিয়ায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার ও প্রয়োগ নিয়ে বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যে তুমুল বিতর্ক চলছে। বিতর্কে কেন্দ্রবিন্দু রয়েছে ২০২২ শে নভেম্বরে বাজারে আসে চ্যাটজিপিটি, মিডজার্নির মতো এআই ইঞ্জিন।চ্যাটজিপিটি থেকে চালকহীন গাড়ি, গান লেখার সফটওয়্যার থেকে ফার্মেসিউটিক্যালস এর উন্নতি নানা ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এ আই এর উদ্ভাবন।
চিন্তাবিদদের অনেকেই বলছেন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা অপূরণীয়হভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে। স্কুল কলেজের শিক্ষা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং, গান থেকে একাউন্টিং , ছবি আঁকা থেকে ফটো তোলা সবেতেই ছাপ রেখে চলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা । এবার শোনা যাচ্ছে আবার মানুষের মত সংবেদনশীলতা থাকবে , এমন আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্সির কথাও। ফলে আশঙ্কা আগামী দিনে এ আই একবার বাজারে জাঁকিয়ে বসলে অনেক মানুষ তাদের কাজ হারাবে।
টমাস পিকেটির ক্যাপিটাল ইন দা টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিতে তিনি বলেছেন যে কোন দেশের জিডিপি বৃদ্ধিকে প্রায় ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি হারে বৃদ্ধি পাবে পুঁজির রিটার্ন। রিটার্ন বাড়াতে হলে প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা বা মারজিনাল প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে হবে। এই প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ শ্রমের যোগানের প্রাচুর্য। যত বেশি যোগান বাড়বে শ্রমিকদের মজুরি কত কমবে। পুঁজি ও শ্রমিকের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হবে এখানেই। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে পুঁজির মালিকরা ফুলে ফেঁপে উঠবে। পাশাপাশি আরেক শ্রেণীর মানুষের আবির্ভাব হবে সমাজে - অতি উচ্চ মেধা সম্পন্ন শ্রমিক বা টেকনোক্র্যাট - একমাত্র তাদেরই আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা থাকবে।
পিকেটি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে আগামী পৃথিবী আরও বেশি বৈষম্যময় হয়ে উঠতে পারে, যদি রাষ্ট্র বণ্টনের বিষয়টি আরো সহানুভূতির সঙ্গে খতিয়ে না দেখে কিংবা পর্যালোচনা না করে। ভবিষ্যৎ পৃথিবী মূলত দুটি দলের মানুষ দ্বারা পরিচালিত হবে এবং তাদের অধীনস্থ থাকবে - (১) উত্তরাধিকারজনিত ধনী এবং (২) মেধাজনিত অভিজাত সম্প্রদায় ।
তিনি আর ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে পর্যাপ্ত শিক্ষা, দক্ষতা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও বৈষম্য বিনাশ করা সম্ভব হবে না হলে এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না । বহু কম সংখ্যক লোকের ভাগ্য খুলবে কিন্তু বিশ্বের বিরাট অংশের মানুষের মজুরি যদিওবা
বাড়বে - তা বাড়বে খুবই সামান্য পরিমাণে।
এআই মূলত সেই সব শ্রমিকদের বাজারকে আঘাত করবে যারা মাঝারি দক্ষতা নিয়ে কাজ করে। যেসব শ্রমিকদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা আছে এবং নিজের কাজে লাগিয়ে নতুন ধারণাও যোগ করে তাদের প্রতিস্থাপন করা এখনই 'এই আই'-র পক্ষে সম্ভব নয়। আবার একেবারে অদক্ষ শ্রমিক যেমন নির্মাণ শ্রমিক, কৃষক এদের বদলি এ আই হতে পারবে না। কেননা এই আই বেশি খরচ সাপেক্ষ পোষাবে না। মাঝারি দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি - এদের নিয়েই দুশ্চিন্তা বেশি।
তবে সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে এ আই এর ব্যবহার সম্ভব নয়। কিছু বিশেষ বিশেষ কাজ যেগুলো তে তাই কায়িক শ্রম কম - সেসব ক্ষেত্রে এআই থাবা বসাতে পারে । তবে ভবিষ্যতে কায়িক শ্রম নিবিড় ক্ষেত্রে এআইর কবল থেকে মুক্ত থাকবে। এটাও মনে রাখার দরকার আছে যে, একটু বড় মাপের প্রতিষ্ঠান ছাড়া এ আইএর সঠিক ব্যবহার করার
মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকার দরকার আছে। তবে ছোট প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা আপাতত স্বস্তি পেলেও এ আই এর কিছু কু প্রভাব তাদের সইতে হতে পারে, যেমন, এই আই-র ব্যবহারের ফলে শ্রমিকদের ব্যবহার কমবে এবং শ্রমিকদের চাহিদাও কমবে।
মাঝারি দক্ষ শ্রমিকদের নিয়োজিত ক্ষেত্রগুলিতে এআইয়ের ব্যবহারের কারণে শ্রমিকদের চাহিদা কমবে, কমবে মজুরি। এরফলে লাভবান হবে পুঁজির মালিকরা। চলবে শ্রমিকদের আর পুঁজির মালিকদের দ্বন্দ্ব।
এ আই মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের সংযোগ স্থাপনের সহজ রাস্তা খুলে দিয়েছে। এই যেন হুকুম দিলেই কাজ করে দেবার আলাদিন প্রদীপের জিন। এই ভালোর মধ্যে লুকিয়ে আছে বিপদের। এই বিষয়ে সমগ্র গবেষণা কুল একমত নয়। আমাদের নিজেদের এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ও ওয়াকিবহাল হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে নিশ্চয়ই। আমাদের নিজেদের খতিয়ে দেখে নিতে হবে যে আদৌ কিছু সময় কি এখনো আছে যার মধ্যে সঠিক নীতিমালা উন্নয়ন প্রণয়নের মাধ্যম এই রেড জোন থেকে থেকে মানব জাতিকে সুরক্ষিত রাখা যাবে তো?
সম্প্রীতি দেখা যাচ্ছে যে এআই তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক পরিসর এতটাই বিস্তার করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে - যে কোন এক সময় হয়তো আমরা এআই দ্বারা পরিচালিত হতে পারি। সেটা গোটা বিশ্বের জন্য কতটা শুভ এবং অশুভ তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ঠিক যেমন ছোট পরিসরে জ্বলতে থাকা আগুন বিকাশের প্রতীক বিজ্ঞানের আশীর্বাদ। কিন্তু অসতর্কতা বশত সেই আগুনে যখন বাড়তে বাড়তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন তা হয়ে যায় সর্বগ্রাসী। সভ্যতা তখন সংকটের মুখে পড়ে।
ভারতকেন্দ্রিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে শিখরে থাকতে চায় রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিস। বার্ষিক সাধারণ সভায় এই বিষয়ে মুকেশ আম্বানি আলোকপাত করেন। গোটা দুনিয়ায় চিত্র বদলে দিয়েছে এবং ভারত কেন্দ্রিক মডেলে শীর্ষ স্থানীয় জায়গায় থাকতে চায় জিও প্ল্যাটফর্মে। ভারতীয়দের দক্ষতা নিয়ে আশাবাদী তিনি। তিনি আরো বলেন ভারতের কাছে ডেটা রয়েছে আছে প্রতিভা কিন্তু আমাদের এ আই সংক্রান্ত একটি প্রস্তুতি পরিকাঠামো প্রয়োজন যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপুল চাহিদা পূরণ করবে। তিনি আরও জানান ২০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন এ আই চালিত কমপিউটিং ক্ষমতা তৈরি করতে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
২০১২ সাল থেকে এ আইন প্রযুক্তির অন্যতম গডফাদার জেফ্রী হিন্টনের আশঙ্কা এআই-র দাপটে চাকরি তো বটে মানবতা ও বিপন্ন হতে পারে । যারা খারাপ কাজের জন্য এআই ব্যবহার করবে তাদের কিভাবে ঠেকানো যাবে তা আমি অন্তত বুঝে উঠতে পারছি না। সুন্দর পিচাই-এর আশঙ্কা, এ আই এর মত প্রযুক্তির ব্যবহার যদি ঠিকভাবে না হয় তাহলে প্রবল ক্ষতি হতে পারে।
যন্ত্র যত স্মার্ট হয়ে উঠছে, মানুষ কি ততই আনস্মার্ট হয়ে পড়বে? কোন পেশি অনেকদিন ব্যবহার না করলে যেমন তা শিথিল হয়ে পড়ে, আমাদের মস্তিষ্কও কি তেমনি অব্যবহারের ফলে একদিন জীর্ণ হয়ে পড়বে? এই প্রশ্নগুলো উঠবেই।
যন্ত্রের মধ্যে হয়তো ঘৃণা থাকবে না, হয়তো রং ধর্ম জাতি সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বৈষম্য করবে না যন্ত্র। কিন্তু যন্ত্র কি শিল্প-সংগীত সাহিত্য চলচ্চিত্র বা কমেডি তৈরি করতে পারবে মানুষের আবেগ দিয়ে? - এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সুসান বেনট, আপেল আইফোনের ভয়েস কম্যান্ডার।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা রিপোর্ট বলছে, আগামী দু'দশকের মধ্যে আমেরিকার ৪৭ শতাংশ কর্মীর জায়গা নিয়ে নেবে যন্ত্র। মানুষের মত রোবট পিপার তো ইতিমধ্যেই রিসেপশনিস্টের কাজ ছিনিয়ে নিতে শুরু করেছে। আমেরিকার অলিম্পিয়ানরা এআই সার্ভিস ব্রেন এফএম এর সৃষ্টি করা মিউজিক শুনতে শুনতে ট্রেন করছেন। এ আই প্রোগ্রাম কুইল অর্থনীতির খবর লিখছে সুপটু হাতে। মনে হচ্ছে সেদিন আর খুব দূরে নয়, যেদিন আমেরিকা সহ বিশ্বে কর্মীদের বেতন দেওয়ার ব্যাপারটাই আর থাকবে না!
------------------------------
Shyamal Hudati
Prince Anwar Shah Road
Kolkata - 700068
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন