নিষিদ্ধ পল্লীর কাজল
সমীর কুমার দত্ত
"নাও নাও, জামা কাপড় খোল। আমার অত সময় নেই। একটা কাস্টমার নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। মালকিন একেবারে খেয়ে ফেলবে। বেশি দেরি হলে দরজা ঠক ঠক করবে।"
ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই যৌনকর্মী কাজল মেজাজে কথাগুলো বলে চললো।
" আ: ব্যস্ত হচ্ছ কেন? সবাই যে উদ্দেশ্যে এখানে আসে, আমি সে উদ্দ্যেশ্যে আসি নি। সবাইকে যে চোখে দেখো, আমাকে না হয় একটু অন্য চোখে দেখলে।"
বিভাস কাজলের কথার প্রত্যুত্তরে বললো।
—তবে পয়সা দিয়ে কি করতে এসেছো শুনি । সবাই তো এখানে ফূর্তি করতে আসে।
—শোন শোন, এখানে বসো।সব বলছি। আমি একটু লিখি টিখি।
—কি লেখো?
—এই গপ্প টপ্প আর কি।
—বই লেখো? তা এখানে কেন?
শোন কথা মিন্সে আমার গপ্প শোনাবার আর জায়গা পেলো না। কতো রকমের লোকই যে আসে এখানে!
—গল্প লিখতে গেলে কোন ঘটনা জানা দরকার। সব সময় তো বানিয়ে বানিয়ে লেখা যায় না। বিশেষ করে তোমাদের জীবনের ঘটনা। এই ধরো তুমি। কী ছিলে, কী হলে, এখানে কী ভাবে এলে ইত্যাদি। কোন মহিলা তো আর শখ করে এখানে আসে না।
—এইবার বুঝলাম। তা ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে কেউ এখানে আসে আমাদের জীবনের ঘটনা শুনতে? কি জানি বাবা আমার তো জানা ছিলো না। এই প্রথম শুনছি। তা আমাদের জীবনের ঘটনা বলে আমাদের কি লাভ? শুধু শুধু কাজের সময় নষ্ট।
—না না,সময় নষ্ট নয়।ঐ যে আমি ভোগ না করেই তোমাকে তোমার চার্জ দিয়ে দিয়েছি।আর এই প্রথম শুনবে না তো কি। তোমার বয়স কি তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে?
বিভাসের কথাগুলো শুনে কাজল বিস্ময় মিশ্রিত খুশিতে ঝল মল করে উঠলো। যা তার জীবন থেকে কবেই হারিয়ে গেছে। তাকে দেখে একদিন এক পুরুষ তাকে ভোগ করা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি।আজ এই একজন পুরুষ, যেখানে ভোগের জন্য মানুষ পয়সা দিয়ে যায়, সেখানে পয়সা দিয়ে কোন প্রকার লালসা প্রদর্শনের চিহ্নও হাবেভাবে ফুটিয়ে তোলেনি। এই দুই পুরুষের মধ্যে তুলনা করতে বড়ো কষ্ট হচ্ছে।ওই মুহূর্তে বিভাসকে তার বড়ো আপনজন বলে মনে হলো। বহুদিন সে আপনজনেদের ছেড়ে দূরে পড়ে আছে। বিভাসের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে কাজল বললো, " তুমি আমার জীবনী লিখবে তো? বেশ বেশ , তা সবাই পড়বে তো?
—নিশ্চয়ই
—তা হলে তো মুশকিল। সবাই তো জেনে যাবে আমার কথা।
—না না, সে ভয় নেই।তোমার নাম থাকবে না। নাম বদল হয়ে যাবে। কেউ তোমাকে চিনতে পারবে না। ভয় নেই তুমি নির্ভয়ে বলো।
"তুমি চা খাবে তো, দাঁড়াও চা বলে আসি।গলাটা একটু ভিজিয়ে নিতে হবে।
— না না, চায়ের দরকার নেই। তুমি শুরু কর।বেশিক্ষণ তো সময় পাবো না।
—তুমি এলে আর একটু চা খাওয়াতে পারবো না।
—না না, তার দরকার নেই।আর তাছাড়া আমি চা খাই না।
—চা যখন খাবেই না, তাহলে শুরু করা যাক।
তবে শোনো। আমার আসল নাম অর্থাৎ পিতৃদত্ত নাম রাধিকা মান্না। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়ছিলাম। স্কুলের বন্দী দশা কাটিয়ে সবে কলেজের মুক্তির স্বাদ পেলাম। বন্ধুদের সঙ্গে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে যেখানে খুশি উড়ে বেড়াতে পারতাম। আমাদের মাছের পাইকারি ব্যবসা। বাবা মোহন মান্না খুব বদ্ মেজাজী মানুষ। সারাদিন মাছের আড়তে থেকে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে কাজ করে মেজাজটা কি রকম খিটখিটে ধরনের হয়ে গেছে। রাত্রি হলে মদ গিলে টলতে টলতে বাড়ি ফিরেন আর মায়ের ওপর চোটপাট করেন। ছোট থেকে এসব দেখে আমি অভ্যস্ত। কিন্তু স্বাভাবিক থাকলে মেজাজটা দিল দরিয়া। আমি কলেজে পড়ি বলে,যখন যা চাইতাম, বিনা প্রশ্নে বাবা তা দিয়ে দিতেন। অবশ্য মেজাজটা ভালো থাকলে । আমাদের কখনও কোন জিনিসের অভাব রাখেন নি। শুধু সংসারে শান্তির অভাব ছিল।
আমি সুন্দরী ছিলাম বলে মা খুব ভয়ে ভয়ে থাকতেন, পাছে আমি কোন বদ ছেলের পাল্লায় পড়ে যাই। তাই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর মা আমার বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বাবাই রাজি হননি। বলতেন," না পড়ছে পড়ুক। কলেজটা পাশ করলে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়া যাবে। আজকাল সরকারি চাকুরে ছেলে গ্র্যাজুয়েট মেয়ে ছাড়া বিয়ে করতে চায় না। তার পিছনে যথেষ্ট কারণ আছে । বলা তো যায় না, স্বামীর কিছু হলে, স্ত্রী তার চাকরিটা পেয়ে যেতে পারে।"
আমি একদিন এক সুন্দর অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে রৌণাকের পাল্লায় পড়ে গেলাম। অবস্থাপন্ন বলছি এইজন্য যে হাবেভাবে তাকে অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে বলেই মনে হতো। সুন্দর,সঙ্গতি সম্পন্ন ছেলের লোভ সংবরণ করতে না পেরে ওর সঙ্গে মজে গেলাম। জীবনে অভাব কী জিনিস বুঝতে পারিনি। ও আমাদের কলেজের কেউ নয়। গাড়ি হাঁকিয়ে আসতো । কলেজের গেটের পাশে গাড়ি পার্কিং করতো। গাড়ির দরজায় একটা হাত রেখে বাইরে দাঁড়িয়ে স্মোকিং করতো আর মেয়েদের দেখতো।এমন ভাব দেখাতো, সকলে যাতে জানতে পারে গাড়ির মালিক ও নিজে। পোশাক পরিচ্ছদে খুব পরিপাটি। এক নজরে দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। পরে জানতে পারা যায় গাড়ির মালিক অন্যজন আর ও তার ড্রাইভার। কিন্তু অবস্থা তখন হাতের বাইরে। ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আমি ওর দিকে না তাকিয়ে পারতাম না। কয়েক দিন চোখাচুখি হতেই ও আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো আর মুচকি মুচকি হাসতো । ওর চোখ মুখের মধ্যে কোন পাপ বা দুরভিসন্ধির কোন চিহ্ন ফুটে উঠতো না। বরং তার বিপরীত। একটা শিশুসুলভ ভাব আমি ওর মুখে ফুটে উঠতে দেখেছি। অনেকটা হিপ্নোটাইজ্ড হয়ে যেতাম। কাছে ডেকে কথা বলতে চাইতো। তখন ওর মুখোশের আড়ালে যে শয়তান মানুষটা লুকিয়ে আছে তা বুঝতে পারিনি। আমি ধরা দিয়ে দিলাম। কাউকে কিছু জানতে না দিয়ে, এমনকি আমার কলেজের বন্ধুদেরও না, বাড়ির লোক তো নয়ই, ওর সঙ্গে গাড়িতে করে হোটেল, রেস্টুরেন্টে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। দেরি করে বাড়ি ফিরে মাকে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলতাম। বলতাম, কলেজে এক্সট্রা ক্লাস ছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন বুঝতে পারিনি যে আমার পরম হিতাকাঙ্খী মাকে অন্ধকারে রেখে আমি নিজের জীবনটা কিভাবে নষ্ট করে দিচ্ছি লেখাপড়াকে জলাঞ্জলি দিয়ে। মা আমার কথাগুলো সরল মনে বিশ্বাস করে নিতেন কিন্তু মায়ের মনে সদাসর্বদা ভয় ছিল আমার নিয়ে।
একদিন আমাকে বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে হোটেলে নিয়ে গিয়ে আমার সঙ্গে সহবাস করে আমার সর্বনাশ করেছে।আমি অনেক বাধা দিতে চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। ট্রাপে পড়ে গেলে সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। মায়ের কাছে আমাকে অনেক মিথ্যে বলতে হয়েছে।
কলেজ থেকে প্রাক্টিক্যাল ক্লাসের জন্য সব মেয়েদের আউটিংয় যেতে হবে। সঙ্গে প্রোফেসাররাও থাকবেন। এইসব বলে বাবার অজান্তেই বেরিয়ে পড়ি। রাতে এসে শুনে বাবার মাথায় খুন চড়ে গিয়েছিল। বলেছিলেন,
"ফিরে আসুক তারপর দেখাচ্ছি। পড়া আমি বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দেবো।"
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মা তখন বলেন, " হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পরেই আমি তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে বলেছিলাম। তুমি আমার কথা শোনোনি। কলেজে ভর্তি হতে দিলে।"
ওর কোন খোঁজ খবর না নিয়ে সে রাতে ওর সঙ্গে সহবাস করা কতো বড়ো অন্যায় যে হয়ে ছিলো, তা আজও মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারি। গাড়িটা যে ওর নয়, ও যে কারোর ড্রাইভার সে কথা জানতে পারি ফোনে ওর কথোপকথন শুনে। তারপর ওকে আমি বিয়ে করার জন্য পীড়াপীড়ি করি। ও আমাকে রেজিস্ট্রি বিয়ে করবে বলে নিয়ে বের হয়। আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে তোলে। আসছি বলে আমাকে ফেলে রেখে কোথায় অন্তর্হিত হয়ে যায় । আর ওর দেখা পাইনি। পরে জেনেছিলাম, এটা যৌনকর্মীদের আস্তানা। এখানে যে একবার আসে, আর ফিরে যেতে পারে না। এ বাড়ির মালকিনের মুখে শুনেছিলাম,উনি আমাকে রৌনাকের কাছ থেকে এক লাখ টাকায় কিনেছেন। সেই থেকে আমি এখানে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছি। অনেক চেষ্টা করেও পালাতে পারিনি। এই এলাকায় দালালরা সব চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের মাসোহারার ব্যবস্থা আছে। এমনকি পুলিশেরও মাসোহারার ব্যবস্থা আছে। বাড়ির কোন খবর জানি না।বাবা মা কেমন আছে, মরেছে না বেঁচে আছে কিছুই না।" শেষের কথাগুলো বলতে বলতে রাধিকা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। বিদায় কালে কাজল তথা রাধিকার 'দাদা' সম্বোধনে শেষ কথা," দাদা, পারলে তোমার লেখাটার একটা কপি আমায় দিয়ে যেও আর শেষ বারের মতো আমায় দেখে যেও।"
শেষ কথাগুলো বিভাসের কানে অনুরণিত হয়ে চললো। নিজের বোন মনে করে কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। নিজেকে কোনরকম সংযত করলো এইভেবে — এটা কোন সম্পর্ক পাতাবার জায়গা নয়। এটা ভোগের ব্যবসার জায়গা।ফেলো কড়ি মাখো তেল। সোনাগাছির গৌরিশঙ্কর লেনের নিষিদ্ধ পল্লী থেকে কড়ি ফেলে তেল না মাখা বিভাস ভারাক্রান্ত মনে ফিরে এলো শুধু সাহিত্যের রসদ বহে এনে । কাজল ওরফে রাধিকার মুখে বাবার নাম, ঠিকানা বিভাস জেনেছিলো কিন্তু কোন উদ্যোগ নেয়নি কাজলের বাড়িতে খবর দেবার। কারণ কাজলের জীবনে একজন যৌনকর্মীর ছাপ পড়ে গেছে। সমাজ ওকে স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরে আসতে দেবে না।
================
Samir Kumar Dutta
Bally, Howrah
Mobile no. 9051095623(WhatsApp)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন