দুর্গা
ব্লক অফিসের বড়বাবুর গাড়িটা গ্রামের মাথায় এসে থেমে গেল । শরতের আকাশ। সকাল থেকেই মেঘ রোদের লুকোচুরি খেলা চলছে । সাদা পাখা মেলেছে নদীতীরের কাশবন। উঠোনের শিউলিতেও রং লেগেছে। জগৎ জুড়ে আনন্দময়ীর আগমন বার্তা অসীম ছন্দে বেজে উঠেছে । জগৎমাতা চিন্ময়ী মন্দিরে মন্দিরে মৃন্ময়ী রূপে পূজিত হতে দেরি নেই।
গাড়ির কাঁচটা খুলেই বড়বাবু একগাল পানের পিক ফেলে দিল রাস্তায়। তারপর মাথার চশমাটাকে চোখে । হৃষ্টপুষ্ট শরীর। তবে শরীর নয়, অসময়ে গাড়ি দেখে ছেলের দল অবাক। খেলা বন্ধ । হাঁ করে তাকিয়ে আছে। যেন সার্কাস দেখছে।
- "আরে বাবা! আমি বাঘ ভালুক নই। হাঁ করে তাকিয়ে দেখার আছেটা কী ?" হো হো করে হাসে তারা। দূরে বট তলায় বসে ছিল হরিপদ। গাঁয়ের সবাই মোড়ল বলে মানে। ইটভাটা আছে, সুদের ব্যবসাও আছে। গাছ তলায় বসে সুখটান দিচ্ছিল। আর সাঙ্গ পাঙ্গের কাছে নিজের কৃতিত্ব জাহির করছিল। গাড়িটা থামতে দেখে আর থাকতে পারল না। শেষবারের মতো ধোঁয়া ছেড়ে এগিয়ে এলো। কোমরের লুঙ্গিটা শক্ত করে বেঁধে , কাঁধের গামছা দিয়ে মুখটা একবার মুছে নিল।
দেখতে দেখতে ভিড় জমেছে। গাড়ির চারপাশেই লোক। সবাই অবাক। ভোট আসতে তো এখনো অনেক দেরি ! ভোট ছাড়া কেউ এই খুদিটাঁড়ের খবর রাখে না। গাড়ি আসার মতো ভালো রাস্তাও নেই । খুব বিপাকে পড়লে এম্বুলেন্স ড্রাইভার কপাল চাপড়ে আসে কখনো-সখনো।
স্বর্গীয় তরণী কালিন্দীর নামটা শুনে হরিপদর পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠলো। গগন কালিন্দীর বেঁটে মোটা বৌটা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে-"কত রঙ্গ দেখব কালা। জগত যে এক রঙ্গশালা ।"
উপস্থিত জনতা অবাক। সবাই তাকিয়ে দেখে গাড়িটা গিয়ে দাঁড়ালো তরনী কালিন্দীর ঘরের সামনে। তার মেয়ে দুর্গা। কদিন আগেই বিয়ে ভেঙ্গে স্বর্গগত বাবা আর অসহায়া মায়ের মুখে চুনকালি দিয়েছে। তাকেই কিনা দেওয়া হবে পুরষ্কার ! ধন্য সরকার।
তরণী কালিন্দী লোক হিসেবে মন্দ ছিলনা । চাষের সময় লোকের জমিতে খাটতো যমের মতো । সকাল-সন্ধ্যায় বউ বিটিকে নিয়ে ঝাঁটা কুলা বানাতো। দুটো বাড়তি পয়সা রোজগারের জন্য। অসময়ে হরিপদর ইট ভাটায় কাজ করতো। সবার চেয়ে বেশি ইট বানাত। হরি বলতো-"তরণী তোর হাত দুটোতে জাদু আছে।" মনে মনে বলতো-"তোর ঘরের দুটোকে নিয়ে জাদু খেলতে চাই।"
তরণীর বউ বিটির উপর অসম্ভব রকমের টান হরির। ওদের পথে-ঘাটে দেখলে হাত নিশপিশ করে তার। চোখগুলো মার্বেল হয়ে যায়। বহুবার বলেছে-"ইট দেওয়া একার কম্ম নয় হরি। বৌ বিটিকে নিয়ে আসিস" । ডোমের বৌ হয়ে ঘরে থাকবে, মানতে পারত না । কথায় কথায় বলে বউকে পুষে লাভ কি ? খাটাও তরণী খাটাও।ডোমের বিটি স্কুল যাবে, পড়াশোনা করবে অসহ্য লাগে তার। হরি বলে-"মেয়েদের পড়াশোনা করেই কী লাভ? সেইতো পরের ঘরে উনান ঠেলবে আর খুন্তি নাড়বে! মেয়েরা হলো বাচ্চা তৈরীর কারখানা"
তরণী কিছু বলে না। বললে যে কাজ পাবে না।তরণীর পেটে কালীর বিদ্যা নেই। ক বলতে কপাল ফাটে, চ বলতে চমকে উঠে। দুর্গা পূজার আগে দাদুর আমলের ঢাকটা বার করে মুছামুছি করত। তারপর একদিন খুব ভোরে চলে যেত শহরে । তবে বউ বিটিকে কাজ করতে বাইরে যেতে দেয়নি। হেসে হেসে বলে-"আমরা তো চোখ থাকতে অন্ধ খুড়া। বিটিটা হলেও শিখুক।"
ব্লকের বড়বাবু উঁচু গলায় ডাকতে শুরু করলো -"দুর্গামনি কালিন্দী । দুর্গামনি কালিন্দী ঘরে আছো ?" দুর্গা তখন বিধবা মাকে নিয়ে ঢেঁকিতে ধান ভানছিল। বাপ মারা যাওয়ার পর অভাবটা দিনে দিনে বেড়েছে। মাথায় তেল নেই। পেটে ভাত নেই। লজ্জা নিবারণের জামাটাও অসভ্য রকমের ছোট হয়ে গেছে। ছিঁড়েও গেছে। তরণী শহরের দুর্গা পূজায় ঢাক বাজানোর টাকা কোনদিন নগদ আনতো না। মা মেয়ের জন্য নতুন জামা-কাপড় নিয়ে ফিরতো। দুর্গা নতুন কাপড়ের গন্ধ নিত ।খিলখিল করে হাসতো। হাসলে বেশ লাগে মেয়েটাকে। মনে হয় দুর্গা ঠাকুর। হঠাৎ অভিমান করে বলতো-"বাবা, তোমার জন্য কিছু নিলে না ?" তরণী হেসে হেসে বলতো-"মেয়েরা হল মায়ের জাত। তোরা নিলেই আমার নেওয়া । তুই হলি আমার দুর্গা মা।" তারপর কত কিছু করার পর অভিমান ভাঙতো ।
এখন কার সঙ্গেই বা অভিমান করবে!দুর্গা স্কুল গেলে, মা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আর হাপুস নয়নে কাঁদে। পাঁচ লোকে পাঁচ কথা বলে। দিনকাল ভাল নয়। আইবুড়ো মেয়ে! বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে । গগন কালিন্দীর বউটা খোঁটা দিয়ে বলে-"কুজায় বলে সোজা হয়ে শুব। ডোমে বলে ব্যারিস্টার হব।আ হাহাহাহা!" দুর্গার মা শুনে কিন্তু কিছুই বলেনা।
বড়বাবু পা টিপে টিপে এঁদো গলিটাতে এগিয়ে যায়। এই গলির শেষেই নাকি দুর্গার বাড়ি। কি দুর্গন্ধ ! হাত দিয়ে শক্ত করে নাক আর মুখটা চেপে ধরে। মুখে বলে- "ছিঃ ছিঃ ছিঃ, এখানেও কি মানুষ থাকে!" সহজে কেউ কোনদিন এ গলি মাড়ায় না । তবে মকর সংক্রান্তির আগের রাতে কেউ এসেছিল। দুর্গা আজও জানেনা কে ছিল?
বাঁউড়ির রাত। সারা মানভূমে সেদিন টুসু জাগরণ। মন মানছিল না দুর্গারও। চটপট পড়াশোনা শেষ করে, গলি দিয়ে যাবে কাকার ঘরে। সেখানেই হবে সারারাত টুসু গান। ঘুটঘুটে অন্ধকার। গলিটাতে কয়েক পা চলতে চলতেই কেউ এসে তার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে। আর অন্য হাত দিয়ে খুঁজতে থাকে বুকের ফুটন্ত ফুল দুটো । যেন ছিঁড়ে নেবে।
দুর্গা ভয় পায় না। ভয়টা তার অভিধানে নেই। ফুটবল মাঠে তার চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকে বাঘা বাঘা খেলোয়াড়। পায়ের জাদুতে বলটা নিয়ে সে এগিয়ে যায়। লক্ষ্য গোল দেওয়া। স্কুল স্তর থেকে রাজ্য স্তরের খেলায় বহু অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছে। বুকের সাহস আর মনের আত্মবিশ্বাসে জয় ছিনিয়ে এনেছে। পথ দেখিয়েছে আকাশের শুকতারা। না ওটা শুধুই তারা নয়। ওর বাবা তরণী কালিন্দী।
আজও লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না। ডান পা টা তুলে শয়তানের বুকে মারল জোর একটা লাথি। যে পা টা বলে মেরে হাজার হাজার বার বিপক্ষ শিবিরকে কাবু করেছে। জয়ের হাসি হেসেছে। মাড় ভাত খাওয়া শরীর আর ফুটবল খেলা পায়ের আঘাতে লোকটা দূরে ছিটকে পড়লো। ভেবেছিল ওর নোংরা হাতদুটো ছিঁড়ে নেবে। গলা টিপে ভবলীলা সাঙ্গ করবে।কিন্তু আকাশের শুকতারাটা যেন বলতে লাগল 'না না না'। পরের দিন সকালে হরিপদর চশমাটা পড়ে থাকতে দেখেছিল। মাকে কিছুই বলেনি। সুখের ভাগি তো সবাই হয়। দুঃখটা না হয় তার একলারই থাক ।
তার পরেও হরিপদ এসেছিল এই গলিতে। একবার নয় কয়েক বার। দুর্গা না থাকার সময়। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। সতীশের সঙ্গে দুর্গার বিয়ে।হরিপদ ঠিক জানতো বিয়েটা হলে এক ঢিলে দুই পাখি মরবে। তার সন্তান দুর্গার বুকে খেলে বেড়াবে। দুর্গার মা জানে জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা যায় না। তাই রাজি হয়েছিল। কিন্তু দুর্গা?
বিপদের মুখে তার চিবুক শক্ত হয়ে যায়। রক্তমাংসের নরম শরীরটা লোহায় পরিণত হয়। আর আকাশের শুকতারাটা বলতে থাকে-"এগিয়ে যা দুর্গা। মাথা নোয়াবি না।এগিয়ে যা।" দুর্গার কাছে মায়েই জগত। তবু মায়ের উপরে গলা তুলে বলেছিল-"এই বিয়ে হবেনা। কোন মতেই হবে না।" কেন হবে না বলতে পারেনি। শুধু গুমরে কেঁদেছিলো।
বড়বাবু টিনের ভাঙা কপাট নাড়তে লাগলো। বাইরে তখন দাঁড়িয়ে আছে জনতা। গোটা গ্রামটাই উঠে এসেছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। হকচকিয়ে যায় তার মা। দুর্গাও ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না।চোখের চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বড়বাবু বলে-"দুর্গা আমাদের ব্লকের গর্ব। অসময়ে বিয়ে রুখে পথ দেখিয়েছে হাজার হাজার মেয়েকে।"
হরিপদও কাঁদার চেষ্টা করে। হাত দিয়ে বার কয়েক শুকনো চোখটা মুছে বলে-"জানেন বড়বাবু দুর্গার মাকে কত বোঝাই। ওর বাবা নেই তো কি হয়েছে ? আমি তো আছি। পড়ুক না মেয়েটা। ও খুদিটাঁড়ের গর্ব। অসুবিধা হলেই আমার ঘরে আসতে বলি। কি গো বলিনি?" দুর্গার মা কিছুই বলেনা। কাঁদে। আর আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে। দুর্গাকে বড় ভয় হয় তার মায়ের। কি জানি কি বলে বসে মেয়েটা! ভাঙবে তবু মচকাবে না। দুর্গাও ভেবেছিল দুঃখগুলো পুষে রেখে কি লাভ? বরং বলে দিলে বুকের ব্যথাটা কিছুটা হালকা হবে। কিন্তু বুক ফাটলেও কি মুখ ফুটে?
সবাই তাকিয়ে আছে দুর্গার দিকে। শুঁটকি মেয়েটার দেমাক কত ? গগন কালিন্দীর বউ ফোড়ন কেটে বলে-"গায়ে নাই কানি, মুখে কত ফুটানি!" সবাই অবাক! বিডিওর পাঠানো উপহারটা ফিরিয়ে দিচ্ছে দুর্গা। হরিপদ ফিসফিস করে বলে-" বোকা মেয়ে! পাচ্ছিস নিয়ে নে!"
দুর্গা আকাশের দিকে তাকিয়ে শুকতারাটা খুঁজতে থাকে। তারপর বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে-"দোহাই বড়বাবু , বুকের ভিতরে যে আগুনটা দাউদাউ করে জ্বলছে ওটাকে জ্বলতে দিন না ? পুরস্কার দিয়ে দুর্বল করে দেবেন না। মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছিলাম। তার জন্য কত হাসি ঠাট্টা তামাশা টিটকারি! বাংলার ঘরে ঘরে এইরকম দুর্গারা শুধু কাঁদতে জানে। আর অসময়ে সমাজ সাগরে স্বপ্ন বিসর্জন দিতে শিখেছে। সমাজের কথায় উঠবস করলে সবাই হাততালি দেয়। একটু বেঁকে বসলেই যে যেদিক থেকে পারে কালি ছিটায়। ধন্য সমাজ! আমি এই সমাজের কাছ থেকে কোনো পুরস্কার চাইনা। কিছু পুরস্কার চাইনা।"
দৌড়ে ঘরে আসে দুর্গা। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে-"দেখ মা আজকের শুকতারাটা কত জ্বলজ্বল করছে। ঐ তো দেখো দেখো।ঐ তো বাবা! দেখো দেখো বাবা বলছে-এগিয়ে যা দুর্গা। মাথা নোয়াস না। এগিয়ে যা। তুই ঠিক পারবি।"
=======০০০=======
অরূপ কুমার গোপ মন্ডল।
নতুন বাঘমুন্ডি রোড।
ঝালদা পুরুলিয়া।
মুঠোফোন-৭০০১৯১১৮১০
সহযোগিতা
কাম্য
এই সংখ্যার সমস্ত লেখা একত্রিত করে একটি
সুসজ্জিত ইবুক তৈরি করা হয়েছে। আপনি যদি সংগ্রহ করতে আগ্রহী হন তাহলে ৯৪৩৩৩৯৩৫৫৬
নম্বরে ন্যুনতম ১০ টাকা google pay, phonepe, paytm, freecharge বা amazon pay করতে
পারেন। প্রদানের স্ক্রীনশট ওই নম্বরে whatsapp করলেই ইবুকটি পেয়ে যাবেন। সহযোগিতা
কাম্য।
|
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন