Featured Post
গল্প || তাসফীর ইসলাম
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মধ্যবিও
দিনশেষে অভিনয়ের মিথ্যে হাসিগুলো রাতের আঁধারে বড্ড কষ্ট দেয়। রাত গভীর হয়ে আসলেই সব কষ্টগুলো নীরবে আঘাত হানে। ধুকে ধুকে খায় আমার মতো হাজারো নিম্নমধ্যবিত্ত কে!
-ওভারব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে আছি আমি। সন্ধার সূর্যটা বহু আগেই বাড়ি ফিরে গেছে, রাস্তার সোডিয়াম হলুদ বাতিগুলোও জ্বলে উঠেছে আলোকময় নগরীকে আরেকটু আলোকিত করে দিতে। এই সময় বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে মানুষের,ফিরে যাওয়ার নিরব প্রতিযোগীতা যেন শুরু হয়ে যায়। ভীড় বাড়ে বাসে, এই যাত্রাবাড়ি,গুলিস্তান,মিরপুর,শ্যামলী, ডাক হাঁকায় কন্ট্রাক্টাররা। আর যাত্রিদের ফিরে যাবার আকুলতা দেখতে থাকি আমি। মানুষের জীবনটা বড় বিচিত্র। দিন শেষে রাতে পরিবারের পিছুটান এড়াতে পারেনা মানুষ। অবাক লাগে মাঝে মাঝে এরকম পিছুটান। আমার পাশেও ভীড় বাড়ে,অস্থায়ী বাসিন্দারা ফিরতে শুরু করেছে আপন নীরে। শুধু আমিই ব্যস্ততার পাশ কাটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হাতের জ্বলন্ত বেনসন এন্ড হেজেসটাও আপন মহিমায় উজ্বল হয়ে উঠছে। আমাদের পৃথিবীটাও হয়ত কোন জ্বলন্ত সিগারেট,প্রতি মুহুর্তেই ছোট হয়ে আসছে। আমার মত নিম্নমধ্যবিত্ত বেকারের হাতে এজিনিস বেমানান। তবুও আজকের দিনে একটু বিলাসিতা হতেই পারে। এইভাবেই প্রতিটি রাত কেটে যায় "আমি" টার। আমিটা হলো আমাদের গল্প মূখ্য চরিত্রের অধিকারী -গল্পের নায়ক সুহাস। এভাবেই কেটে যায় তার প্রতিটি রাত।
আবার, খুব সকালে ঘুম ভেঙে যায়। ভোরের শিশির ভেজা মাঠে পা ডুবিয়ে শীতল হওয়াকে আত্মসাৎ করা, নিস্তব্ধ প্রস্তরখন্ডের আড়ালে বসে নদীর কলতানকে আত্মস্থ করা আর নীরবে নিভৃতে পাখিদের কলরবমুখর ধ্বনিকে অনুভব করার মাঝেই কেটে যায় সুহাসের' এর রাঙা সকাল। অতঃপর দিনের বাকিটা সময় কেটে যায় নানা আয়োজনে। ক্লাসের পর আবার টিউশনি-তে যেতে হয়। মধ্যবিত্তের সংসার; বাবা অবসর নিয়েছে অনেক দিন আগে। সামান্য টাকায় সংসার প্রায় অচল। তবুও থমকে নেই সুহাস। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ছুটে চলেছে পরিবারের দু-মুঠো সুখের ভীড়ে। সুহাস (বাসাই) তে সার্ভে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করছে - পড়াশোনা প্রায়ই শেষের দিকে একটা সেমিস্টার বাকি আছে। তার প্রখর মস্তিষ্কে পড়াশোনা এক অনবদ্য শক্তি। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের চাওয়া পাওয়াকে পূর্ণতা দিতে ছুটে চলেছে সুহাস। বাবা-মায়ের স্বপ্নের প্রতিটি মুকুল ছুঁতে আপ্রাণ চেষ্টা তার।
বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরনের জন্য আজ সে স্মৃতির শহর ছেড়ে বহুদুর গিয়ে পড়াশোনা করছে। বাড়িতে আছে অসুস্থ বাবা, মা ও আদরের ছোট বোন। সুহাস পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট্ট একটা চাকরি করে। টিউশনি লজিন করে নিজে পড়াশোনা করে আর চাকরির টাকা বাড়িতে পাঠায়। কিন্তু ওই কয়টা টাকায় কিভাবে চলে তার পরিবার। তবুও সে থেমে নেই।
ছোট বোন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে ফরম ফিলাপের জন্য টাকা লাগবে কিন্তু সাহস করে ভাইকে বলতে পারছে না,অন্যদিকে তার বাবাও অনেক অসুস্থ।
সুহাসের ফোন-
- হ্যালো মা! তুমি কেমন আছো?
- আলহামদুলিল্লাহ বাবা আমি ভালো আছি।
- তুই কেমন আছো?
- তোমরা ভালো আছো জেনেই আমি ভালো আছি।
- বাবা, তোকে একটা কথা বলতাম!
- জ্বী মা বলো। বাবা শান্তার পরীক্ষার ফরম ফিলাপের তারিখ এসে গেছে। কালকের ভিতরে ফরম ফিলাপ না করলে শান্তাকে আর পরীক্ষা দিতে দিবে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে মা। শান্তাকে চিন্তা করতে না করো আমি কাল সকালের ভিতরেই টাকা পাঠিয়ে দিবো।
- তোর অনেক কষ্ট হইতে আছে বাবা। আমি আর সইতে পারি না বাবা। এর থেকে আমার মরন হলে ভালো হতো।
- এইসব তুমি কি আবোল-তাবোল বলতে আছো মা। একদিন ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। নতুন ভোর আসবে আমাদের জীবনে। বাবা কেমন আছে মা?
- তোর বাবা আর কি-রকম থাকবে! যখন ঔষধ খায় তখন ভালো। তবে বুকের ব্যাথাটা একটু বাড়ছে।
- তুমি টেনশন কইরো না মা। আমি আগামী মাসে বেতন পেয়ে বাড়ি আসতে আছি। তখন বাবাকে ঢাকা নিয়ে এসে ভালো ডাক্তার দেখাবো।
ফোনটা রেখে দেয় সুহাস। দু'চোখ দিয়ে অঝড়ে টলটল করে পানি পড়তে আছে। কি করবে সুহাস?
সুহাসের মালিকটা খুব ভালো একজন মানুষ। সে সুহাসের পারিবারিক অবস্থার বিষয়ে সব জানে। কিছু টাকা দিয়ে সুহাসকে দেশের বাড়ি পাঠায়। সুহাসের দেশের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায়। সুহাস নদীপথে বাড়ি চলে যায়,গিয়ে বাবাকে বলে -
- বাবা তুমি আমার সাথে ঢাকা চলো। ঢাকা গিয়ে তোমাকে বড় ডাক্তার দেখাবো। তুমি তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।
- নারে বাবা। আমি ঠিক আছি আমার ঢাকা যেতে হবে না। তুই আসছো এতেই আমি ভালো হয়ে গেছি।
কিছুতেই সুহাসের বাবা ঢাকা গেলো না। সে তো জানে তার ছেলের পকেটে টাকা নেই। কি দিয়ে সে বড় ডাক্তার দেখাবে।
সুহাস ফিরে গেল কর্মস্থলে। গিয়ে মালিকের কাছে আরেকটা পার্টটাইম জবের কথা বলতে মালিক তার বেতন কিছু বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তাতে কি হবে?
কিছুদিন পরে বাড়ি থেকে নাইমের ফোন।
নাইম সুহাসের চাচাতো ভাই।
- সুহাস কই তুই?
- আমি তো ক্যাম্পাস থেকে বের হলাম মাত্র। কাজে যাবো এখন।
- ভারাক্রান্ত কন্ঠে নাইম বলো উঠলো - সুহাস তুই তাড়াতাড়ি আয় চাচা স্ট্রোক করেছে। আমরা তাকে নিয়ে সদর হাসপাতালে যাইতে আছি। তুই তাড়াতাড়ি আয় চাচি অনেক কান্না করতে আছে।
তাড়াতাড়ি ফিরে আসলো সুহাস। ডাক্তারের কাছে গেলো ডাক্তার বললো আপনার বাবার ফুসফুসে ক্ষত। অতিদ্রুত একটা অপারেশন করতে হবে অনেক টাকা লাগবে। আপনি টাকা দিন আমরা অপারেশনের ব্যাবস্তা করি।
এত টাকা কোথায় পাবে সুহাস? -
সিনথিয়ার কাছে হাত পাততেও নারাজ হলো না। সিনথিয়া সুহাসের ভালোবাসার মানুষ। মনে মনে সে চিন্তা করে মেয়েটার কাছ থেকে হাত পেতে অনেক টাকা এনেছি। এখন টাকা চাইতে নিজেরও লজ্জা করে। আর যাই হোক, সিনথি নিশ্চয়ই আমাকে বুঝতে পারবে; এই বিপদের সময় ও একটা না একটা ব্যাবস্থা করবেই। টাকা ও ঠিকই দিলো।
কিন্তু সুহাস পারবে কি তার বাবাকে বাঁচাতে?
অপারেশন থিয়েটার রুম থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এসে বললো - দুঃখিত আপনার বাবাকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না। কথাটা শুনে সুহাস আর সুহাসের মাঝে নেই। মেঝেতে শুয়ে পড়লো সুহাস। আর বলতে থাকে বাবা আমি হেরে গেলাম। দারিদ্রতার কাছে আমি হেরে গেলাম। পারিনি তোমাকে বাঁচাতে বাবা। আমায় ক্ষমা করে দিও তুমি। সুহাসের মা এসে বলে বাবা তুই হারিস নি। তুই ভেঙ্গে পরিস না বাবা। না, মা আমি ঠিক আছি। কেটে যায় কিছুদিন।
শুনতে পায় সিনথিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে।
এখন কি করবে সুহাস?
সবই কি নিয়তির খেলা!
রাতের অন্ধকারে সুহাস একা একা হাঁটছে আর ভাবছে -
দারিদ্রতা বড্ড সাদাকালো করে দেয় জীবনটাকে। মধ্যবিত্তের ছকের ভেতর থেকে বেরুতে পারিনি আমিও,তাইত বাবাকে বাঁচাতে পারিনি আমি, ভালোবাসার সিনথিকেও বিয়ে করতে পারলাম না। সবই কি আমার ভাগ্যের দোষ! নাকি দারিদ্রতা? নাকি আমি নিম্নমধ্যবিও সেজন্য। নানা প্রশ্ন ঘিরে আসছে। মা চাকরির কথা তুললে নিরবই ছিলাম আমি। ছকের জীবনটায় বাধা পরে গেছি আমরা, এই জীবনটাতেই সুখ খুঁজে নিতে চাই। আমি যে খুব অসুখি তা না, সুখেই আছি আমি। চারপাশের প্রাপ্তির খাতার দশমিক অংশটাও সুখ দিয়ে যায় আমাকে। অতৃপ্তির সুখ বিস্মিত করে,অবাক হয়ে ভাবি সুখটা আমাদের মাঝেই কত সহজে লুকিয়ে থাকে। শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে তা চোখে পড়েনা, আমরা ফেলতেই চাইনা। আমরা তুলনায় আটকে থাকি,সুখের তুলনাটা খুব সহজেই করে ফেলি, কিন্তু দু:খটা? কষ্ট পাওয়ার শত কারণের মাঝে সেই কষ্টে হাসার কারণ থাকে সহস্রাধিক। ভীষন সুখি মানুষ আমি, সুখ আমাকে একটু বেশীই ভালবাসে,তাইত আলিঙ্গন করে নেয় আমাকে,কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে প্রিয় বাবাকে, ভালোবাসার মানুষটিকে- এত সুখ আমি কিভাবে রাখবো। মৃদু হাসি আমি। সূর্য ডুবে যাচ্ছে, তার সকল আলো দিয়ে আধারে রেখে যাচ্ছে আমাদের,আমাকে। আচ্ছা, রাতটা কেন আসে? সুখের খাতার সাদা পাতা দেখতে,নাকি আদিমতার নেশাটা লুকিয়ে দিতে? হয়ত কোন চাঁপা আর্তনাদ কেই পথ খুঁজে দিয়ে যায় লাল সূর্য। রাতটা বড় নি:সঙ্গ কাটে আমার। একমাত্র রাতেই আমার আমিটার সাথে পরিচিত হই আমি। আজ রাতটা শুধু আমার জন্যে। চাপা আর্তনাদ কে বালিশ চাপা দিয়েই ঘুমোতে যাব আমি। হয়ত ঘুমাতে পারব,অথবা বালিশে কোন বর্ষার দমকা নামবে। আসলে আমরা অনিশ্চয়তার মাঝে বাস করি। এই অনিশ্চয়তার জন্যেই হয়ত প্রাপ্তির সুখটা এত দামী। একজন মধ্যবিও পরিবারের সন্তান বলেই আজ দারিদ্রতার কাছে আমি হেরে গেলাম। অতি সাধারণ সাদামাটা আমি যে এই অনিশ্চয়তার সম্ভাব্যতার ভগ্নাংশে বেঁচে থাকি।
কি করবো আমি? কি করার আছে আমার!
আমি যে মধ্যবিও!
হ্যাঁ আমি নিম্নমধ্যবিত্ত।
এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।
=================
লেখকঃ তাসফীর ইসলাম (ইমরান)
অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীঃ
বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের সার্ভে ডিপার্টমেন্টের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান -
বাসাই (১০৪ তম ব্যাচ)
বিভাগঃ সার্ভে ইঞ্জিনিয়ারিং
বর্তমান ঠিকানাঃ রামমালা,কুমিল্লা
নিজ জেলাঃ পটুয়াখালী
বিভাগঃ বরিশাল
দেশঃ বাংলাদেশ
যোগাযোগঃ
01779514534 imran187619@gmail.com
সহযোগিতা
কাম্য এই সংখ্যার সমস্ত লেখা একত্রিত করে একটি
সুসজ্জিত ইবুক তৈরি করা হয়েছে। আপনি যদি সংগ্রহ করতে আগ্রহী হন তাহলে ৯৪৩৩৩৯৩৫৫৬
নম্বরে ন্যুনতম ১০ টাকা google pay, phonepe, paytm, freecharge বা amazon pay করতে
পারেন। প্রদানের স্ক্রীনশট ওই নম্বরে whatsapp করলেই ইবুকটি পেয়ে যাবেন। সহযোগিতা
কাম্য। |
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন