আমার কম্পাস
-----------------------
নাবিক হইবার তরে জন্মাইয়াছিলাম, এই কথাখানা বুঝিতে বুঝিতে বহু বছর কাটিল, তথাপি হইলাম না। যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়িতাম আমার নিকট ছোটো মানুর (ছোটো মাসি, আমার তুলনায় কমপক্ষে ১৮ বছরের বড়) প্লাস্টিকের জ্যামিতি বাক্স আসিল, মেথি-হলুদ বর্ণের। প্রথমে তাহা নাড়াইয়া দেখিলাম, আশ্চর্য্য শব্দ শুনিতে পাইলাম। শব্দ থামাইয়া বাক্স খুলিলাম,কম্পাস ব্যতিত সকল যন্ত্রই নজরে পড়িল। বাক্সের এমত কম্পাসহীনতা বেদনা হইয়া কোমল অন্তরে বিঁধিয়া গেল। নতুন জ্যামিতি বাক্স কিনিবার মতো অবস্থা আমাদিগের সেইসময় ছিল না।মনে হইল সমুদ্রের মধ্যিখানে আসিয়া কম্পাস হারাইয়া ফেলিয়াছি, দিকভ্রষ্ট হইয়া কেবল শঙ্খনাদ কানে আসিল। ভাবিলাম এবারকার মতো বোধ করি আর সঠিক জ্যামিতি শিক্ষা হইল না। দুপুর গড়াইয়া অপরাহ্নের দিকে আমার ভাবনা যাইতে লাগিল।বাবা বাজারে চলিয়া গেলেন।কিছুক্ষণ পর বাই সাইকেলের ঘন্টি শুনিতে পাইলাম। এমত অসময়ে বাবার আগমনে উদগ্রীব হইয়া তাকাইলে পলিথিনের মোড়কে কী একটা বাড়াইয়া দিয়া তিনি মুচকি হাসিলেন।আমিও না বুঝিয়া আহাম্মকের ন্যায় হাসিলাম। খুলিয়া দেখি একখানা পেন্সিল কম্পাস। নতুন জ্যামিতি বাক্স নয় সামর্থ্যানুযায়ী কেবল একখানা কম্পাস আসিল। কম্পাসখানা রুপালি বর্ণের,পেন্সিল ঢুকাইয়া শক্ত করিবার গোল প্লাস্টিকখানা লাল।পেন্সিল ভরিয়া ক্ষুদ্র হইতে বৃহৎ বৃত্ত আঁকিতে লাগিলাম, তাহার ভিতরে বৃত্ত, তাহার বাহিরে বৃত্ত, বৃত্তের ভিড়ে নিজেকে হারাইয়া ফেলিলাম। বোধ হইল কম্পাসই নাবিকের আসল যন্ত্র। বাবার দেওয়া কম্পাস বুকে জড়াইয়া ভাবিলাম একদিন সমুদ্রে যাইব,জলের উপর হাঁটিবার, ভাসিয়া বেড়াইবার কৌশল আয়ত্ত করিব,নাবিক হইব।এই ভাবনায় ক্রমশ বড়ো হইতে লাগিলাম। সমুদ্র ক্রমে ক্ষুদ্র হইতে হইতে গনিত পুস্তকের পরিমিতির ভিতর পুকুরে আসিয়া নিজেকে লুকাইয়া ফেলিল।আমি কেবল ইহার আয়তন মাপিলাম,সাঁতারও শিখিলাম বটে, নাবিক হইতে পারিলাম না। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সহপাঠীরা কত প্রকারের জ্যামিতি বাক্স আনিল।আমি ছোটো মানুর সেই পুরাতন জ্যামিতি বাক্সে বাবার দেওয়া নতুন কম্পাস লইয়া মহাবিদ্যালয়ে প্রবেশ করিবার ছাড়পত্র গ্রহন করিলাম ।
অতঃপর পদার্থবিদ্যা শিখিলাম- পৃষ্ঠটান, সান্দ্রতা, প্লবতায় মাথায় কেবল সমুদ্র পাক খাইত। জল দেখিলেই কাগজের নৌকা ভাসাইতাম, মাঝেমাঝেই তাহাদের পালে হাওয়া লাগিত, মনে মনে নাবিক হইতাম। যেন তুফান-হাওয়া আমার সৈনিক, তাহাকে দিক দর্শাইবার দায়িত্ব আমার।পেন্সিল কম্পাস ছাড়িয়া কবে যে নৌ-কম্পাস নিয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িলাম বলা ভার। একদা সমুদ্র দর্শনে গেলাম। সুবিশাল জলরাশি শব্দের আদি-অন্ত লইয়া আমাকে গিলিয়া খাইতে লাগিল। দূরে, সমুদ্রের মধ্যিখানে নাবিকেরা তখন মত্ত হইয়া জলকেলি করিতেছে। আমার দিকে অট্টহাসি পাঠাইতেছে। ব্যঙ্গ করিতেছে। আমি হতভম্বের ন্যায় বিপুল শব্দ আর প্রবাহের মধ্যিখানে স্তব্ধ আর স্থির হইয়া বসিয়া পড়িলাম। বুঝিলাম আমি আসলে সমুদ্রের বিপ্রতীপ। আচ্ছন্ন কাটিয়া গেলে দেখিলাম সৈকতে শত শত মৃত জেলিফিশ। তাহারা আমার ন্যায় আর আমি তাহাদের ন্যায় হৃদয়ের অন্তঃস্থলে এক মৃত নাবিক।
=====০০০=====
পায়েল দেব
আগরতলা, ত্রিপুরা
সহযোগিতা
কাম্য
এই সংখ্যার সমস্ত লেখা একত্রিত করে একটি
সুসজ্জিত ইবুক তৈরি করা হয়েছে। আপনি যদি সংগ্রহ করতে আগ্রহী হন তাহলে ৯৪৩৩৩৯৩৫৫৬
নম্বরে ন্যুনতম ১০ টাকা google pay, phonepe, paytm, freecharge বা amazon pay করতে
পারেন। প্রদানের স্ক্রীনশট ওই নম্বরে whatsapp করলেই ইবুকটি পেয়ে যাবেন। সহযোগিতা
কাম্য।
|
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন