বর্ণপরিচয়
অ চ ল = অচল।
অ ধ ম = অধম।
অ প র = অপর।
ছোটবেলায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লেখা 'বর্ণপরিচয়' পাঠের কথা মনে পড়ছে। সকাল ও বিকাল -দুই বেলা আমার এক সম্পর্কিত আপন মামাতো দিদির পাঠশালাতে ছোটবেলায় পাঠলাভে নিয়মিত যেতাম। মাঝে মাঝে মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা। দৈনিক পাঠাভ্যাসের শুরুতে 'প্রার্থনা সঙ্গীত' (সকালে- 'জন গণ মন...' এবং বিকালে- 'হও ধর মেতে বীর...')ও অন্তিমে দৈনিক পাঠের অংশবিশেষ দলগতভাবে সশব্দে ঐক্যবদ্ধ স্বরে দলনেতার সুরে সুর মিলিয়ে 'শ্রুতিপঠন' -এ দুইয়ের আকর্ষণ আমাদের সতীর্থদের বিশেষভাবে পড়াশোনাতে আগ্রহী করে তুলেছিল।
এখন বুঝি, বাল্যকালেই শিশুকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা উচিৎ....সম্ভবও। এটিই উপযুক্ত সময়। ঠিক যেভাবে কুমোর চাকার ওপর নরম মাটিকে ফেলে তাকে মর্জি মাফিক রূপদানে সক্ষম হন এবং আনন্দ পান তাঁর সক্ষমতা সম্পর্কে। আমাদের 'বাল্যকাল' হল- এই নরম মাটির ন্যায়। তাকে নিজের মতো করে রূপদান সম্ভব। সময় যত এগোবে বাল্য...কৈশোর...যৌবন... মানব-মৃত্তিকাও হয়ে উঠবে কঠিন। আর তাকে ইচ্ছে খুশি রূপদানের ক্ষমতাও চলে যেতে থাকবে আমাদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে।
বাঙালি বালক-বালিকাদের এই শৈশব-বাল্যের গঠন ক্রিয়াটি বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রনে এনে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়, সেই উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে- 'বর্ণপরিচয়' রচনার মাধ্যমে। 'মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম' -কবিগুরুর এই উক্তির যথার্থতা বাংলা ভাষায় এনেছিলেন পূর্বসূরি বিদ্যাসাগর মহাশয়। মাতৃদুগ্ধের ন্যায় সুষম পুষ্টিগুণে ভরপুর ছিল বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়। -যা ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ হতে প্রায় দেড় শতক ধরে বাংলা ভাষাকে পুষ্টি দিয়ে এসেছে। ক্রমে রূপ-রস-গন্ধে ভরে উঠেছে বাঙালির বাল্য-শৈশব। কেবল ভাষার বৈভব নয়, গড়ে উঠলো বাঙালির পৃথক ভাষাকেন্দ্রিক সংস্কৃতি। -যা সাদরে সম্মানিত হয়েছে বিশ্বের দরবারে।
বিদ্যাসাগরের 'বর্ণপরিচয়' ও 'বোধদয়' -বাঙালির বাল্য-শৈশবকে মার্জিত, আদর্শবান, নিয়মিত, নিয়মানুবর্তী, সৎ ও বন্ধুসুলভ যৌবনে উত্তীর্ণ করে, তার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা মননশীলতা ও ধৈর্যের গুণে সমৃদ্ধ করেছে। তবেই কিনা- বাংলার আ কা শ=আকাশ, বা তা স=বাতাস-এ সাহিত্যের সুরভি ছড়িয়েছে। জন্ম নিয়েছেন কত নবতম প্রাতিভা, বিকশিত হয়েছে কত নব নব মাতৃভাষা সাহিত্য।
এ তো গেলো ভনিতা(গৌরচন্দ্রিকা)। যে প্রসঙ্গে বাল্যকালের এই বিদ্যাসাগরীয় বিশ্লেষণ ও স্মৃতিরোমন্থন -এবারে আসি সে প্রসঙ্গে। আজ সকালে বাজার করে ফেরার পথে আমার বাড়ি-মালিকের সঙ্গে পথে দেখা। বাড়ির অদূরেই। দুজনেরই হাতে ভারী ব্যাগে বাঙালি ঘরকন্নার শাক-সব্জি-মাছ ইত্যাদি। সঙ্গে বর্ষার সহযোগী ছাতা। করোনা প্রতিরোধে বিশ্বাসী মাস্ক। আপাতভাবে বয়স বাদ দিলে দু'জনের মধ্যে এই মুহূর্তে পার্থক্য- আমি সহজভাবে হেঁটে চলা এক যুবক। আর উনি- ভাঙ্গা পায়ে ক্র্যাচ হাতে খুঁড়িয়ে চলা একজন প্রৌঢ়।
কথার এক ফাঁকে ওনার হাঁটার কষ্ট দেখে আমি উনাকে বললাম- আপনি তো ছেলেকে (২১/২২ বছর বয়সী)নিয়ে স্কুটিতে বাজারে যেতে পারতেন? তার উত্তরে উনি প্রথমেই বললেন- অ চ ল = অচল। অ ধ ম = অধম। অ প র = অপর।
তারপর এক নাগাড়ে উনি বলে গেলেন- 'ছোটবেলায় বিদ্যাসাগরের 'বর্ণপরিচয়' পড়ে আমাদের যে সামাজিক দায়বদ্ধতা , শালীনতা , নিয়মানুবর্তিতা এসেছে; এখন সমাজ উন্নত হলেও সামাজিকতা আর নেই। এরা তো আর 'বর্ণপরিচয়' পড়েনি। সব আধুনিক বই। মোবাইল,গাড়ি সব আছে, শুধু ভালোবাসাটা নেই'।
উনি নিজে শিক্ষক। ওনার স্ত্রীও শিক্ষিকা। অবসরের দোরগড়ায় এসে ওনার পর্যবেক্ষণে- 'এখনকার আশি শতাংশ শিক্ষক/শিক্ষিকার কোনো সামাজিক জ্ঞান নেই। এমনকি বর্ণপরিচয়ের বাস্তব জ্ঞানও নেই'। পুনরায় বলতে থাকেন- 'মা-ই ওঠে সকাল ৯টা/১০টায়। ছেলেও তাই। এরা কি যে করে, কি যে করবে... কে জানে(ছেলে নামী প্রতিষ্ঠানে ইংরাজী এম.এ. পাঠরত)? বাস্তব জ্ঞান নেই। এদিকে 'করোনা'। ওদিকে কবে যে পরীক্ষা হবে, তার ঠিক নেই। শুধু খাচ্ছে...ঘুমাচ্ছে...মোবাইল নিয়ে পড়ে আছে। .....আর বাজারে যাবে কখন'?
এই বলতে বলতে... আরও কিছু কথার অন্তরে দু'জনের পথ আলাদা হল। উনি একইভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, ভেজা মাথায়,রেনকোট গায়ে, বাঁ হাতে ক্র্যাচ ও ছোট মাছের ব্যাগ এবং ডান হাতে ভারী শাকসবজির ব্যাগ নিয়ে নিজের দোতলা বাড়ির সিঁড়ির দিকে এগোলেন। আর আমি গেটের ছিটকিনি খুলে একই বাড়ির একতলায় ঢুকলাম।
ঢুকলাম। কিন্ত মনের মধ্যে থেকে 'বর্ণপরিচয়' আর ওনার বলা কথাগুলো কিছুতেই যাচ্ছিল না। ভাবলাম আমি চাইলে হয়তো একদিন... দুদিন সাহায্য করতে পারি। কিন্তু সবসময় তা অসম্ভব। আর উনি তা কারুর কাছে চানও না। বরং কুণ্ঠাবোধ করেন। কিন্তু যেখানে এই বয়সে কোনো কুণ্ঠা বা সংকোচনবোধ থাকবে না...উনি চান সেই নির্ভরতা...ভরসা...ভালোবাসা। সন্তানের...পুত্রের।
কিন্তু এত বছর পরে ছেলেকে শিক্ষা দিয়েও কোথাও যেন ঘাটতি থেকে যাওয়ার আশঙ্কা বোধ করছেন। এটাই হয়তো একবিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ বাবা-মায়ের আক্ষেপ। নিজেদের সবটুকু দিয়ে গড়ে তুলেও কোথাও যেন না পাওয়ার আশঙ্ক্ষা নিজেদের গ্রাস করছে। নিজেদের ছেলেমেয়েরা যেন আজ অ-চ-ল(অচল)হয়ে অ-ধ-ম(অধম)হয়ে গেছে। আর এভাবেই হয়তো একদিন তারা অ-প-র (অপর) হয়ে যাবে।
এতদিন পর 'বর্ণপরিচয়' পাঠের একটি সামাজিক প্রভাব উপলব্ধি করলাম। মনে পড়লো বাল্যের সেই পাঠঃ ঐক্য। বাক্য। মানিক্য। এ কেবল 'বর্ণপরিচয়' নয়। বর্ণপরিচয় আসলে 'মানুষ' হয়ে ওঠার পাঠও দিয়েছিল আমাদের, -সেই বাল্যেই।
===================
দেবীপ্রসাদ সাহু। সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা।
সহযোগিতা
কাম্য
এই সংখ্যার সমস্ত লেখা একত্রিত করে একটি
সুসজ্জিত ইবুক তৈরি করা হয়েছে। আপনি যদি সংগ্রহ করতে আগ্রহী হন তাহলে ৯৪৩৩৩৯৩৫৫৬
নম্বরে ন্যুনতম ১০ টাকা google pay, phonepe, paytm, freecharge বা amazon pay করতে
পারেন। প্রদানের স্ক্রীনশট ওই নম্বরে whatsapp করলেই ইবুকটি পেয়ে যাবেন। সহযোগিতা
কাম্য।
|
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন