Featured Post
গল্প ।। রণেশ রায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
একই সূত্রে
১
শহরের উপকণ্ঠে একটা ছিমছাম পল্লী। তারই একপ্রান্তে একটা ছোট অর্ধ সমাপ্ত বাড়ি। বাড়িটাতে অভাবের ক্লেদ যেমন চোখে পড়ে না তেমনি প্রাচুর্যের আতিশয্য নেই। এ বাড়িতে গত প্রায় পনেরো বছর ধরে থাকেন এক মহিলা তাঁর চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে। মহিলার বয়েস যা অনুমান করতে পারি আর ছেলের বয়সের হিসেব থেকে বলা যায় মহিলা একটু দেরীতে বিয়ে করেছেন বোধ হয় যদি অবশ্য ধরে নিই যে ওনার এই একই ছেলে। আর সেটা প্রতিবেশীদের ধরে নেওয়ার কারণ আছে বৈকি। কারণ গত পনের বছরে এ বাড়িতে এমন কাউকে আসতে দেখা যায় নি যাকে দেখলে তাঁর বড় ছেলে বা বড় মেয়ে বলে মনে হতে পারে। এসব অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে যে ওনার বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ বছর। আরেকটা বিষয় হল যে এ বাড়ীতে এমন কোন প্রবীণ পুরুষ দেখা যায় নি যাকে ওঁর স্বামী বলে মনে হতে পারে। তবে পাড়ার অনুসন্ধিৎসু অনেকের মতে ওনার স্বামী ওনাকে ছেড়ে গেছেন । ছেড়ে গেছেন বললে ভুল হবে। ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ওদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। আর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকলেই সমালোচকদের ওনার সম্পর্কে অনুমানগুলো সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ভেবে তারা তৃপ্তি পান। সম্ভবনা নয় কেউ কেউ নিশ্চিত যে ওনাদের বিবাহ বিচ্ছেদই হয়েছে। এনারা কারণটাও জানেন। সেটা রসিয়ে কষিয়ে আড্ডায় বলেন। ঊষাদেবীর স্বামী নাকি খুব বেচারা মানুষ। নেহাতই ভালোমানুষ। আর ঊষাদেবী দাম্ভিক, অহংকারে পা পড়ে না। স্বামী এত ভালোমানুষ হলে কি চলে? পৌরুষ কোথায়? তাই মানানো চলে না। বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। অন্তত ঊষাদেবীর তরফ থেকে।ওদের মতে আজ এর জন্য ঊষাদেবীকে ভুগতে হচ্ছে। এত ভালো রোজগেরে দেবতুল্য মানুষটাকে কষ্ট দেওয়ার ফল। বিচ্ছেদের গল্পে তাদের আলোচনার বিষয় বেশি প্রাণ পায় বলে তাদের ধারণা।এক এক জনের মুখে এক এক গল্প। আবার কেউ কেউ বলেন উনি মারা গেছেন। তবে হলপ করে কেউ কিছু বলতে পারেন না। নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে রঙ্গ রসিকতা করলেও কেউ কোনদিন সামনাসামনি ওনাকে জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পায় নি। কারণ মহিলা পাড়ায় বেশি মেশেন না। যেন একটু এড়িয়ে চলেন। দুচারজন যাদের সঙ্গে ওঁর আলাপ আছে, পথে দোকানে বাজারে দেখা হয়, দুচার কথা হয় তারাও কিন্তু ওনাকে কেন জানি না এসব কথা জিজ্ঞাসা করেন না। বা করতে ভরসা পান না। অবশ্য আমি যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয় ঊষাদেবীর চেহারায় এমন একটা ব্যক্তিত্ব বা বিশেষ কিছু আছে যা তাঁকে অন্যেদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। সব মিলিয়ে যেন একটা রহস্য না হোক অস্বাভিকতা জড়িয়ে আছে। পাড়ার সবাই এ নিয়ে তেমন মাথা না ঘামালেও কৌতূহলী মানুষের তো বঙ্গ সমাজে অভাব নেই। তাই অনেকের কাছে কবির 'সাল বনের এই দুরত্ব' একটা আলোচনার বিষয় তো নিশ্চয়। তবে সবার কাছে যেটা বিশেষ ভাবে কৌতূহলের সেটা হল বাড়িতে বসে ঊষাদেবী নিয়মিত গানের রেওয়াজ করেন। ছেলে সঙ্গে সঙ্গত করে। আর এটা তিনি খুব নিষ্ঠাভরেই করেন।বাড়ীর পাশ দিয়ে গেলে তাঁর গানের গলায় আকৃষ্ট হতেই হয়। তিনি সন্ধ্যার দিকে নিয়ম করে বের হন। সঙ্গে প্রায়ই ছেলে থাকে। আবার ছেলেকে নিয়ে ফেরেন। আমরা অনেকেই ভাবি ছেলেকে হয় তো পড়াতে নিয়ে যান। কিন্তু ওই যে কৌতূহলী মানুষেরা! তারা রোজই উনি কোথায় যান তা নিয়ে নিত্য নতুন গবেষণার ফল প্রকাশ করেন ঠিক আজের কভিড ১৯ এর ভ্যাকসিন এর মত। তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। তবে এই অনুসন্ধানে যে ফলরসের উদ্ভব হয় তাতে নেশার উপাদান আছে অস্বীকার করা যায় না। আড্ডায় সে 'সোম' রসের নেশা থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না।
মায়ের পরিচয় পেলেন। এবার ছেলের পরিচয় না পেলে ওই দুজনের খুদে সংসারের সামগ্রিক পরিচয়টা পাওয়া যায় না। দুজনে যে দুজনের পরিপূরক। ছেলেটি ছিমছিমে রোগা লম্বা। চোখ মুখে একটা উজ্জ্বলতা ধরা পড়ে। চোখের ইশারায় যেন নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলে। চোখে অজস্র প্রশ্ন জড়িত কোনোটারই যেন ও উত্তর পায় না। এমনিতে মিশুকে হলেও ঘরে মায়ের সাথে সময় কাটে। ক্লাস টেনে পড়ে অর্থাৎ সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। তবে তা নিয়ে খুব একটা দুর্ভাবনা আছে তা মনে হয় না। বন্ধু বান্ধব ইতস্তত থাকলেও তারা খুব একটা বাড়ি আসে না। পাড়ার ক্লাবে মধ্যে মধ্যে টেবিল টেনিস খেলতে যায়। বন্ধুবান্ধব যারা আছে তারাও ছেলেটির বাবা বা তাদের আত্মীয় স্বজন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না। ছেলেটি এ ব্যাপারে যেন উদাসীন। মায়ের সঙ্গেই তার জীবন। তবে ওর এক মেয়ে বন্ধুকে মাঝে মাঝে বাড়ি আসতে দেখা যায়। মেয়েটি অতি সাধারণ দেখতে। বোঝা যায় দুজন দুজনের খুব বন্ধু। ঊষা দেবী অর্থাৎ ছেলেটির মা ওকে খুব ভালোবাসে।ওদের বন্ধুত্বকে যেন একটু বেশি মদত করে যেটা আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে খুব স্বাভাবিক নয়। এ নিয়েও পাড়ায় কৌতূহলিদের মধ্যে কানাকানি শ্লেষা শ্লেষি।
ঘটনাচক্রে আমার সঙ্গে পরবর্তী কালে পরিবারটির ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে । আমি আঞ্চলিক একটা বিদ্যালয়ে মাস্টারি করতাম বলে এলাকায় বুড়ো বাচ্চা সবারই পরিচিত। আর প্রায় চল্লিশ বছর ধরে পাড়ার চায়ের দোকানে আমাদের একটা আড্ডা আছে। একদিন দেখি ছেলেটি পাড়ার কিছু আড্ডাবাজ ছেলের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েছে। ওকে ছেলেগুলো টিটকিরি মারছে উত্তেজিত করছে। ওকে সাধারণত মাথা তুলে জোরে কথা বলতে দেখা যায় না। আজ সে ব্যতিক্রমটা দেখি। ব্যাপারটা এতদূর এগোয় যে ওকে এবার মারধর খেতে না হয়! আমি এগিয়ে যাই। ছেলেগুলোকে নিরস্ত করি। আর ব্যাপারটা বাড়ে না। জানতে পারি ছেলেটি ও তার মায়ের ব্যাপারে ছেলেগুলো কিছু প্রশ্ন করে যেগুলো ওদের অধিকার বহির্ভূত বলে ছেলেটি মনে করে আর সেটা ওদের মুখের ওপর বলে। তাই নিয়ে বিবাদ। ছেলেটির সাথে কথা বলে মনে হলো ওর আত্মসম্মান বোধ তীব্র। সেখানে আঘাত লাগলে ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, ভয় পায় না। এটা আমার ভালো লাগে। ওকে নিয়ে আমি ওর বাড়ির দিকে এগোই। বাড়ির সামনে এসে ও আমাকে প্রায় জোর করে বাড়ির ভেতর নিয়ে যায়। মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। আমিও নিজের মধ্যে চাপা ঔৎসুক্যটার বশবর্তী হয়ে আলাপে একটু বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি। আলাপের মাধ্যমে যদি পরিবারের রহস্য কিছু থেকে থাকে সেটা যদি ভেদ করতে পারি। আর আমাদের সবার জীবনের অন্দরে রহস্য ভেদের জন্য একজন ফেলুদা আছে সেটা তো অস্বীকার করতে পারি না। ওর মায়ের সাথে কথায় কথায় জানি ছেলেটিকে পড়াবার জন্য ওরা একজন ইংরেজি শিক্ষক খুঁজছে। ঘটনা চক্রে ওটা আমার বিষয়। তাই স্বেচ্ছায় সেই দায়িত্ব নিই। তবে আমার তাগিদটা শিক্ষক হিসেবে যতটা তার থেকে গোয়েন্দা হিসেবে বেশি।
আমি খুব অল্পদিনের মধ্যে নিজের অজান্তেই যেন রন্টুদের পরিবারের একজন হয়ে পড়ি। বলা হয়নি ছেলেটির নাম রন্টু। আমাকে এখন মামা বলে ডাকে। আমার যেমন এ বাড়িতে অবাধ প্রবেশ ওরাও আমার বাড়ি যায়। ঊষা দেবী আমার স্ত্রীর বান্ধবী হয়ে উঠেছেন। আগে যেমন ওনাকে কোন এক ধোঁয়ার আড়ালে দেখতাম এখন সেটা অনেকটা দূর হয়ে গেছে। সূর্যের আলোক রশ্মি ওনার চোখে মুখে দেখি। ওনারা যেখানে যান আমাকে নিয়ে যান। এমন কি বিকেলের সেই রহস্যের অন্তরালে। আমার কাছেও যেন ফুলের প্রস্ফুটন। একটা একটা করে পাপড়ি খোলে। তবে ঊষাদেবীর স্বামীর অন্তরীণ হওয়ার রহস্য এখনও আমার অজানা। অবশ্য নিশ্চিত হয়েছি যে উনি বেঁচে আছেন। তবে কোথায় কেন জানি না। ঊষাদেবী একটা কঠিন রোগে আক্রান্ত। বোধ হয় সেইজন্য নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রাখেন। আর নিজেকে দূরে রেখে স্বামীকেও যেন অন্তরীণ রাখতে সাহায্য করেন।
কোন কোন দিন যেমন ওদের সঙ্গে যাই তেমনি সেদিনও গেছি। একটা গানের আসর। আসর বসিয়েছেন কিছু গণ্য মান্য ব্যক্তি। বলা চলে এক মজলিস। বোঝা যায় যে এ ধরণের মজলিসে ঊষাদেবীকে আসতে হয় তার জীবিকার জন্য। যারা পাড়ায় এ ধরণের একটা সন্দেহ প্রকাশ করেন সেই ফেলুদারা আমার আগেই রহস্য ভেদ করেছেন সন্দেহ নেই। সেখানে ঊষাদেবী গায়িকা। আজ তাঁর সঙ্গে তবলা সঙ্গত করবে তার ছেলে। যে নিয়মিত তবলায় সঙ্গত করে সে আজ আসতে পারবে না। ছেলের বান্ধবীও আজ সঙ্গে এসেছে।
মজলিস শুরু হয়েছে। আজ ঊষাদেবীর শরীর ভালো নেই। তাও পেটের তাগিদে আসতে হয়। গান ধরেছেন ঊষাদেবী। উপস্থিত অতিথিরা গুছিয়ে মেজাজে বসেছেন। ঊষাদেবীর গলা তাদের আমেজটা ফিরিয়ে আনে। একটা মাদকতার পরিবেশ তৈরি হয়। ছেলে সুন্দর সঙ্গত করছেন। সঙ্গে একটা বাদ্য যন্ত্র। মধ্যে মধ্যে মায়ের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। সে এই সংগীতের পরিবেশে অভ্যস্ত বোঝা যাচ্ছে। শ্রোতাদের মধ্যে কয়েকজন মদ মাতাল আছে যারা উচ্ছসিত প্রশংসায় আসর জমিয়ে তুলছে। দু তিনটে গান হয়েছে। আসর এখনও সে উচ্চতায় উঠতে বাকি। শ্রোতাদের পয়সা ছোড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন উচ্চে আসর উঠবে। হঠাৎ ঊষাদেবীর কাশি ওঠে। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারেন না। পুরোণ রোগটার আক্রমণ। গলা স্তব্ধ হয়ে আসে। ছেলেও বোঝে। বাজনা ছেড়ে মাকে এসে ধরে তোলে। ঊষা দেবী উঠতে থাকেন। শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন। সংগঠক বিড়ম্বনায় পড়েন। তিনি এসে ঊষাদেবীকে মনের জোর দেন, আবার গানে বসতে বলেন। ছেলে আমাকে মঞ্চ থেকে ইশারা করায় আমি আর বান্ধবী মেয়েটি এগিয়ে যাই। ঊষাদেবীকে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে মাইক্রোফোন নিয়ে গান শুরু করে মা যেখানে শেষ করেন সেখান থেকে। প্রথমে বিরক্ত হলেও এই অল্প বয়স্ক ছেলের গান আর তার সঙ্গে নাচ মাদকতার পরিবেশটা ফিরিয়ে আনে। ঊষাদেবী আমাদের সঙ্গে এসে বসেন। উনার পাশে এক ভদ্রলোক শ্রোতা। ঊষাদেবীকে জল খাইয়ে একটু সুস্থ হতে সাহায্য করেন। ছেলের গান জমে ওঠে । মায়ের জায়গা পূরণ হয়। আবার মেতে ওঠেন শ্রোতারা। বৃষ্টির মত পয়সা পড়তে থাকে। সংগঠক ভদ্রলোক সেগুলো কুড়িয়ে তোলে। তাই দেখে ছেলে বিরক্ত হয়। গানের মাঝে সেও পয়সা কিছু কুড়িয়ে নেয়। এভাবে চলতে চলতে অনুষ্ঠান শেষ হয়। উঠে জায়গায় ফিরতেই সংগঠক ভদ্রলোক এসে রন্টুর কুড়িয়ে নেওয়া টাকা ফেরত দিতে বলেন। তার মজুরি যেটা প্রাপ্য সেটা সে পাবে বলে আশ্বস্ত করেন। রন্টু মানে না। সে বলে ওই টাকা মায়ের আর তার শ্রমের পয়সা সেটা তাদের প্রাপ্য। সংগঠক হিসেবে ওনার যা প্রাপ্য সেটা ওরা ওনাকে দেবে। ঊষাদেবী ছেলেকে টাকা দিয়ে দিতে বলেন। ছেলে সেটা না দিয়ে দৌড়ে ওখান থেকে পালায়। ঊষাদেবী সংগঠককে বলেন উনি টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন। সংগঠক সেই প্রতিশ্রুতিতে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। আমি এতক্ষন খেয়াল করি নি। যে ভদ্রলোক ঊষাদেবীর শুশ্রূষা করছিলেন উনি তখনও দাঁড়িয়ে। ঊষাদেবী আমার সঙ্গে উনার পরিচয় করিয়ে দেন স্বামী বলে। এতক্ষন আমি উনার দিকে তাকাই নি। এবার তাকালাম। দেখি আরে এ তো আমার সেই কলেজের বন্ধু। শুনেছি ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দেয়। পুলিশ ওকে খুঁজে পায় নি। ও আমাকে চিনতে পারে। দুজনেই আবেগ তাড়িত হলেও সংযত থাকি। বুঝি এটা আবেগ প্রকাশের জায়গা নয়। এটা ঊষাদেবীর যেমন জীবিকার জায়গা তেমনি গোপনে স্বামীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ। একটু এদিক ওদিক হলে বিপত্তি। উনি বেরিয়ে যান। আমরাও বাড়ির দিকে এগোই। আমি বুঝি এ লড়াইটা ওদের তিনজনের, গোটা পরিবারের। পরিবারে কেউ হারিয়ে যায় নি। একই সূত্রে বাঁধা।
২
বেরিয়ে এসে দেখি রন্টু দাঁড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি ওর অধিকারের লড়াইটা যে সমর্থন করি তা ও বোঝে। ও এসে মায়ের দায়িত্ব নেয়। সবাই মিলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা ফিরে আসি। ওদের বাড়িতে নামিয়ে আমি নিজের বাড়িতে। আমার অতীতও যেন আমার সঙ্গে ফিরে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ার সময় সুহাস বিপ্লবী দলে ঢুকে যায়। আমিও ওদের সমর্থক ফেউ হয়ে ওদের সাথে ঘুরতাম। ওরা তখন ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতার প্রয়োজনের কথা বলত। বিশ্বাস করত যে ভারত প্রকৃত স্বাধীনতা পায় নি। আর দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধের সঙ্গে সমাজতন্ত্র গঠনের লড়াই এর সংহতি সাধন করা দরকার বলে মনে করত। তাই ওরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিল। সুহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ হওয়ার আগেই সব ছেড়ে চলে যায়। আমি মধ্যে মধ্যে ইতস্তত খবর পেলেও সব খবর পেতাম না। শুনেছিলাম বিয়ে করেছে।
স্ত্রী খাওয়ার তাগিদ দেয়। কিন্তু আমি যেন আমার অতীতের সঙ্গে মোকাবিলা করছি। নানা ঘটনা মনে করার চেষ্টা করছি। যেন কোন অঙ্ক মেলাতে আমি মশগুল। খাবার ইচ্ছে নেই। স্ত্রীকে পাশে বসাই। ওকে সব বলি। ও সুহাসকে না চিনলেও আমার কাছে ওর কথা শুনেছে। আর তখনকার বিপ্লবী রাজনীতির কথা ও জানে। দূর থেকে সুহাসের ওপর একটা শ্রদ্ধা ওর মনে। বোধ হয় আমাদের সমাজে সব মেয়েদের ক্ষত্রেই এটা সত্যি। ওদের মুক্তির ইচ্ছের মধ্যে ওরা বোধ হয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বিপ্লবীদের খুঁজে পায়। ওকে সব বলে আমিও কিছুটা হালকা হই। তারপর খেতে যাই। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ি।
শুয়ে শুয়ে ভাবি ঊষাদেবীর ছেলেকে নিয়ে বর্তমান এই কঠিন জীবন। পর্দার আড়ালে থেকে এক আত্মবলিদান। আর্থিক অনটন তার ওপর এই অসুস্থতা। ছেলেকে এক হাতে বড় করা। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। স্রোতে গা ভাসানো নেই। আছে খালি অধীর প্রতীক্ষা। আর প্রত্যয়। অথচ এই মহিলাকে নিয়ে কত অকথা কুকথা। যারা সুহাসকে চেনে না তারা এই মহিলাকে নিচে নামাবার জন্য সুহাসকে বেচারি বানায়।প্রচুর রোজগেরে বলে প্রচার করে। অথচ সুহাস ছিল ডান পিটে। শিক্ষকদের সঙ্গেও তর্ক করত। রোজগার কোনদিন করেছে বলে জানি না। সব ছেড়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিপ্লবের কাজে। একেবারেই বেচারি নয়। আসলে আমাদের মধ্যে জন্মের পর থেকে যে নারী বিদ্বেষ গড়ে ওঠে এই সমাজে তাই কালক্রমে বিষবৃক্ষ হয়ে এই ফল ই ফলায়। সেটাই পুরুষ প্রধান সমাজের নিয়ম। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে আবার দৈনন্দিন জীবন। আমি অনেক দিন হল অবসরজীবী। সকাল বিকেল আড্ডা আর পড়ানো যখন যেমন থাকে। যতটা বাড়ির কাজ না করলে চলে না ততটুকু করা। বাকিটা স্ত্রী করে। এর সঙ্গে রন্টুকে পড়াতে যাওয়া। অন্য ছাত্ররা আমার বাড়িতে এসে পড়লেও রন্টুকে আমি পড়াতে যাই। কেন সেটা আগেই বলেছি। গোয়েন্দা গিরির জন্য। সেটা আর সেদিনের পর থেকে দরকার নেই তাও আমি যাই। বলতে দ্বিধা নেই এখন যাই ঊষার আকর্ষণে। ওরা যেন আত্মীয় সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। এখন রন্টুকে পোড়ানোর আগে পরে ঊষার সঙ্গেও কথা হয়।
ঊষাদেবী বাড়ি এসে বিছানা নেয়। পূরণ রোগটা ভালোই মাথা চাড়া দেয়। এরই মধ্যে গেলে পরে ওনার সঙ্গে দেখা হয়। আমি যতটা সম্ভব উনার খবরাখবর নিই। একদিন আমি পড়াতে গেছি। রন্টু বাড়ি নেই। ঊষার সঙ্গে কথা শুরু হয়। এটা ওটা কথার পর সুহাসের কথা ওঠে। ওরা নিজেরা বিয়ে করেছে জানায় ঊষা। তাও যেন অনেক কিছু অবলা রয়ে যায়। আমি বলি ঊষাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। তবে কার সঙ্গে ওর মিল পাই। ঊষা হেসে ওঠে। ওকে আমি এই প্রথম মন খুলে হাসতে দেখলাম। মনে হল ও যেন নিজেকে মেলে দিতে চায়। এ যেন খাঁচায় বন্দি এক পাখি খাঁচার বাইরে ডানা মেলেছে। ও আমাকে বলে, " আমি আগেই আপনাকে চিনেছি। কিন্তু তাও অচেনাই রয়ে গেছি। জানান দিই নি। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে দিন কতক দেখা হয়েছে। প্রায় চল্লিশ বছর আগে। আপনি একই রকম আছেন বদলান নি। বয়স হলেও চিনতে অসুবিধে হয় না"।
"তবে তুমিই কাজল!" আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে।
আমার শুধু সুহাসের কথা মনে পড়ে। আর ওকে জড়িয়ে সেই মেয়েটির কথা যাকে আমি দুচারবার দেখেছি। আবছা যে চেহারাটা প্রায় চল্লিশ বছর আগের ওই মেয়েটার কথা মনে করিয়ে দেয় তার সঙ্গে ঊষাদেবীর চেহারার যে খুব মিল পাচ্ছি তা না। ও পরিচয় দেবার পর আজকে সব মিলিয়ে একটা মিল পাই। আমার স্মৃতিতে আবছা হলেও ফিরে আসে কাজল।
তখন মেয়েটি সুহাসদের বিপ্লবী কাজকর্মে যোগাযোগের বাহন ছিল। তবে আমার চেনার সুযোগ খুব হয় নি। আপাত শান্ত ওই মেয়েটি খুব বুদ্ধিমতী ছিল। খুব ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করত। সুহাস ওর খুব গুণগ্রাহী ছিল। আমি অবশ্য এর বেশি কিছু জানতাম না। কৌতূহলী হওয়াটাও আমাদের কারও নিষেধ না থাকা সত্ত্বেও বারণ ছিল। আত্মনির্ধারিত বারণ।
আজ জানলাম ওই মেয়েটিই আজকের ঊষাদেবী।
=========================
রণেশ রায়
সহযোগিতা
কাম্য এই সংখ্যার সমস্ত লেখা একত্রিত করে একটি
সুসজ্জিত ইবুক তৈরি করা হয়েছে। আপনি যদি সংগ্রহ করতে আগ্রহী হন তাহলে ৯৪৩৩৩৯৩৫৫৬
নম্বরে ন্যুনতম ১০ টাকা google pay, phonepe, paytm, freecharge বা amazon pay করতে
পারেন। প্রদানের স্ক্রীনশট ওই নম্বরে whatsapp করলেই ইবুকটি পেয়ে যাবেন। সহযোগিতা
কাম্য। |
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন