লেটার মার্কস
রঞ্জিত মল্লিক
"দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী......
মহিষাসুরমর্দিনী জয় মা দুর্গে......."
দেখতে দেখতে আরও একটা পুজো চলে এল। সবুজ ঘাসের মখমলে শিশিরের চন্দন। নীল সাদা মেঘ বালিকাদের কাশের খোলা চিঠি। শাপলা আর শালুকের আদরে পুষ্ট শান্ত টলটলে দীঘি। শিউলি ফোটা ভোর। বাইরে সোনা মুগ রোদের জলসাতে হামাগুড়ি খাচ্ছে অপূর্ব ঢাকের বন্দিশ।
পুজো আসলেই মনটা বেশ চনমনে করে ওঠে শিউলির। পুরানো জমা হওয়া স্মৃতি গুলো মনের ক্যানভাসে ভিড় জমায়। রান্না করতে আপণমনে কোথায় যে হারিয়ে গেল তার আর তল খুঁজে পেল না।
সুতপার ফোনেই হঠাৎ সম্বিৎ ফিরল। একটা দুসংবাদ শিউলির অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে দিল। সকালের সৌন্দর্য্যটা বেশ উপভোগ্য ছিল। হঠাৎ এক দুঃখের কালো মেঘ সব কিছুকে এলোমেলো করে দিল।
দীপ্তিশিখা যে এইভাবে নিজেকে শেষ করে দেবে শিউলিই ভাবতেই পারেনি। একটি ফুলের মতন জীবন অকালে ঝরে গেল।
সামনেই পুজো।পূজোর সামনে এই রকম একটি সংবাদ সত্যিই আনএক্সপেকটেড। রান্না করতে করতে কখন যে সেটা পুড়িয়ে ফেলেছে খেয়ালই করেনি।
...... ..... ....... ..... ......... ........
দীপ্তির সাথে ঋষভের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল। ওদের দুজনের কলেজেই আলাপ। পরে ধীরে ধীরে সেই সম্পর্ক গভীর আকার ধারণ করে। শেষে দীপ্তি ঋষভকেই বিয়ে করে।
বিয়ের পরই ওদের জীবনে নেমে আসে কালো মেঘ। দীপ্তির মা হতে না পারাটাই সেই কালো মেঘের জন্ম দেয়। জীবনের সব পরীক্ষায় পাশ করলেও, টপার হলেও মাতৃত্বের পরীক্ষায় দীপ্তি পাশ করতে পারেনি। ওটাই ওকে এক ড্রাস্টিক স্টেপ নিতে বাধ্য করে।
শ্বশুড়বাড়িতে তারজন্য কম অপমান সহ্য করতে হয়নি। বিয়ের পর এক ফোঁটাও সুখ পায়নি। সব সমীকরণ কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। ভীষণ অভিমানের বশে তাই দীপ্তি সুইসাইড করে বসে।
দীপ্তির ঘটনাটা সত্যিই শিউলিকে অবশ করে তুলল। আজ আর কাজে বেরোবে না।
দীপ্তিশিখার সাথে অনেক ঘটনাই আজ শিউলির মনে আঁচড় কাটছে। স্কুল জীবন থেকেই ওদের বন্ধুত্ব। একটা সুখী সংসারের স্বপ্ন দেখত দীপ্তি। সন্তান স্বামী নিয়ে সুখে সংসার করার ভাবত। অথচ ওর জীবনেই এই রকম অভিসম্পাত নেমে এল।
কলেজের লিটিল ম্যাগের ব্যস্ত সম্পাদক দীপ্তিশিখা যে এই ভাবে জীবনের একটা কঠিন অথচ সাবলীল পরীক্ষায় হেরে যাবে ভাবতেই শিউলির দুচোখের কোণ চিকচিক করে উঠছে।
সুতপার যদিও সেই ঝামেলা নেই। বড়লোকের মেয়ে। যাকে বলে নবাব নন্দিনী। স্বামীর বিশাল বড় বিজনেস।মাসে তিন, চারবার করে ফরেন ট্যুর করে। অনেকবার সন্তান গর্ভে এলেও নষ্ট করেছে। ওদের দুজনের সন্তান লাভের তেমন ইচ্ছে নেই। সন্তান হলেও তাকে মানুষ করার মতন সময় ওদের নেই।
..... ...... ...... ....... ..........
এই সুতপার জন্যই শিউলির সংসার করা হয়নি। ওর সবটাই কেমন যেন কাকতালীয় মনে হয়।
কলেজের এক ফাংশানে সুতপার সাথে যৌথভাবে নাচের অনুষ্ঠান ছিল শিউলির।বেশ ভালই হয়ছিল দুজনের যুগলবন্দি। প্রচুর প্রশংসা আর হাত তালি কুড়িয়েছিল তাদের যৌথ নৃত্য প্রদর্শন। অনুষ্ঠানের পর শিউলির কেমন মাথা ঘুরে যায়। তারপর ওকে নার্সিংহোমে নিয়ে গেলে অবস্থা বেশ সিরিয়াস হয়ে ওঠে।
অনেক কটা টেস্ট করাতে হয়। তখনই শিউলি কোনভাবে জানতে পারে যে ও কোনদিন মা হতে পারবে না। ডাক্তারবাবুই এই অপ্রিয় সংবাদটা সুতপাকেই প্রথম শোনায়।
পরে সুতপা সব দিক ভেবে ওকে বিয়ে না করার পরামর্শ দেয়। যদিও শিউলি এমনটি হোক চায় নি। পরে চোখের জলে ভিজে নিজের মনকে বুঝিয়েছিল যে, সে ছোটবেলার ভালবাসা মনোজকে কষ্ট দিতে চায়না। কারণ ও জানে ও মাতৃত্বের পরীক্ষায় কোনদিন পাশ করতে পারবে না । তাই আর এগোয়নি। চোখের জলটাকেও আর প্লাবিত হতে দেয়নি। ফারাক্কা ব্যারেজের মতন আটকে রেখেছিল চিরতরে।
.... ..... ...... ..... ...... ......
আজ দেখতে দেখতে অনেক বছর একাই কাটিয়ে দিল। বন্ধুরা একে একে সংসার করে মাতৃত্বের স্বাদ পেলেও শিউলি তা থেকে বঞ্চিত।
....... ....... ...... ....... ....... .......
দুপুরের ঘুম থেকে উঠেই আজ আর একটা সংবাদ পেল।যদিও সেটা শুভ সংবাদ। পাশের বাড়ির কাজল বৌদির কোল আলো করে একটা ফুটফুটে বাচ্চা এসেছে। যদিও উনি তা দত্তক নিয়েছেন। তবুও তো জীবনে মা হতে পারল।
কাজল বৌদি আর কুশলদার মধ্যে এই নিয়ে কম অশান্তি হয়নি। কাজলদার বেশী রাতে ড্রিঙ্ক করে ফেরা, মাঝে মাঝে উত্তেজনার বশে গালিগালাজ, বৌদির গায়ে হাত ওঠানো, অফিসের উইক এণ্ডের ছুটিতে দূরে নিজেকে নির্বাসনে রাখা সব কিছু চোখের সামনে দেখেও কোন প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পায় নি। নীরব স্বাক্ষী থেকে গেছে শিউলির এই স্তব্ধ হয়ে থাকাটা । বুকের মধ্যে দলাপাকানো কষ্টটা কাউকে বুঝতে দেয়নি।
আজ সত্যিই একটা বড় পরীক্ষায় পাশ করল কাজল বৌদি। সন্তান সুখ বড় সুখ। বাইরে বেশ জোরেই ঢাক বাজছে। ঢাকের তালে উঠতি চ্যাঙড়া ছেলে মেয়েরা কোমর দুলিয়ে নাচছে। শিউলির মনটাও বেশ ঢাকের মাতাল করা বন্দিশে আচ্ছন্ন।
...... ...... ...... ......... .......... .......
ক্যালেণ্ডারের বর্গাকার , লাল, কালো চৌকো খোপগুলো একটু একটু করে যত কাছে আসছে পুজো ততই এগিয়ে আসছে। পুজো আসলেই শিউলির বেশ ভাল লাগে। জীবনের যত কিছু চাওয়া পাওয়া সব এই পুজোকে ঘিরে।
জীবনের সব চাওয়া পাওয়ার পরীক্ষায় পাশ করেছে। আর সেই গুলি সব এই পুজোর বাতাবরণ কে ঘিরে।
নতুন চাকরি , শপিং মলে কেনা দামী শাড়ি, ঘুরতে যাওয়া, ভাল কাজের জন্য পেপারে ছবি বেরোন , নাচের অনুষ্ঠান , সব কিছুর ছোট বড় টেস্টে সে পাশ করলেও জীবনে একটা পরীক্ষায় আজও পাশ করতে পারেনি।
ভালবাসার পরীক্ষা! মাতৃত্বের পরীক্ষা! ওখানেই চোখের জলটা একটু বেশী বেরোয়। কষ্টের মেঘটা তাই গভীরভাবে জমাট হয়ে নোনা জোয়ার তৈরী করে।
দীপ্তির অভাবটা পুজো আসলে এবার আরো ভালভাবে টের পাবে। দুজনের পুজোতে বহু টুকরো টুকরো ঘটনা মনের ক্যানভাসে স্মৃতির তুলি বোলায়। যা আজও অমলিন। যদিও মাঝে মাঝে তাতে ধূলো জমলেও দু চোখের অতি ক্ষীণ জলপ্রপাতে তা ধুয়ে মুছে যায়। তবু কজল বৌদির কোলের শিশুটা দীপ্তির মা হতে না পারার কষ্টটা অনেকটাই লাঘব করবে। পুজোর এই কটা আনন্দঘন দিনে।
..... .... .......
দেখতে দেখতে পুজো চলে এল। মহালয়া টপকে এক লাফে পঞ্চমী। এখন তো চতুর্থী থেকেই পুজোর ঠাসা সমীকরণ শুরু। ষষ্ঠীর কমলা হলুদ রোদ্দুরে গা ভিজতে না ভিজতেই সপ্তমীর কাঁসর ঘন্টা বাজতে শুরু করে।
আজ বহু কাঙ্ক্ষিত মহাষ্টমী। কাজল বৌদি পুচকেটাকে নিয়ে মণ্ডবে এসেছে। মায়ের বুকের ওমে নিজেকে লেপ্টে রেখেছে। মাঝে চোখ পিটপিট করছে।
বাইরে ঢাকের দারুণ বন্দিশ। সবাই অঞ্জলি দিচ্ছে। মা উমা ফুল, বেলপাতা, ফল, মালার আদরে ডুবে রয়েছেন। মায়ের চোখ খুশীতে চিকচিক করছে। মায়ের তুলতুলে গালে যেন রক্ত করবীর বসন্ত। শিউলির আসতে একটু দেরী।
একটু পরেই ও মণ্ডবে আসল। বহু পুরোনো মনোজের কিনে দেওয়া কাঞ্জিভরমটা শরীরে মেখেছে। তার সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ। গলার হারে যেন এথনিক জুয়েলারির অতি ক্ষুদ্র একটা বৃত্তাকার রেললাইন পাতা।কপালের ছোট্ট টিপটা মহা সাগরের বুকে গজিয়ে ওঠা দ্বীপের মত জ্বলজ্বল করছে। ঠিক যেন মা অপর্ণা! কোলে একটা ফুটফুটে এক বছরের মেয়ে।
ওকে এত সুন্দর সাজে দেখে সবাই কেমন তাজ্জব। ও সচরাচর খুব একটা সাজগোজ.....। শিউলিই সব রহস্যের সমাধান করল।
পাশের ফ্ল্যাটের লাখোটিয়া দম্পতি দেরাদুন থেকে ফিরেছেন। ওরা এই বাচ্চা টাকে এলাহাবাদ স্টেশনে কুড়িয়ে পান। ভালই ছিল শিশুটা। ওদের কাছে। আদরে আর আরামে। দম্পতি নিঃসন্তান। দিন দিন মায়ার জড়িয়ে যাচ্ছিলেন।
উনারা ঠিক করেছিল বাচ্চাটাকে কোন অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসবেন। কিন্তু মায়ার এতই প্রবল টান যে উনারা শেষে রাজি.....। এবারে বেশ কিছু মাসের জন্যে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে উনাদের দুবাইয়ে সেটলড্ হতে হচ্ছে। ওখানে গরম। এবং আবহাওয়ারও তারতম্য হবে। তাই বাচ্চাটাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত।
পরে ওরা সব দিক ভেবে শিউলির হাতে ওকে তুলে দেয়। কারণ শিউলি একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারে। কারণ ও অবিবাহিতা। ভবিষ্যতে বিয়ে করলেও মা হবার সম্ভাবনা একদমই নেই। তাই পালস্ টা ভালই বুঝতে পারে। পুচকেটাকে বুকের ওমে বড় করে তুলতে পারবে।
অঞ্জলি শেষ। ঠাকুরমশাই সব কিছু গোছাচ্ছেন।
".......নমঃ ষষ্ঠি! নমঃ ষষ্ঠি ! নমঃ ষষ্ঠী!......."
উনার মন্ত্র পড়াও শেষ। শিশুটা মানে মানালি কি সুন্দর শিউলি ফোটা ভোরের মতন শিউলির কোল আলো করে আছে। মাঝে মাঝে হাসছে। সবাই ওদের দুজনকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। দু একজন এসে পুচকেটার গাল টিপে আদর করে যাচ্ছে।
.... ...... ...... ...... ....... ........
সন্ধ্যে বেলায় শিউলি মানালিকে নিয়ে শ্রীভূমির ঠাকুর দেখতে এসেই আর এক বিপদ। শাড়ির কোঁচাটা ঠিক করতে একজনের কোলে দিতেই ভিড়ের মধ্যে কি করে যে হারিয়ে গেল বুঝতেই পারেনি। ও নিজেও ভাবতে পারেনি ভর সন্ধ্যেবেলাতে এই রকম ভিড় হতে পারে।
শিউলির পাগলের মতন অবস্থা। মনে মনে বলছে মা দশভূজা ঠিক বিচার করেন নি। ধপ করে এক দোকানের ধাপিতে বসে পড়ল মাথায় হাত রেখে।
না , মা শারদার বিচার ঠিক ছিল। মা কখনোই ভক্তকে সন্তান ছাড়া করতে পারেন না। আর কোনদিন সেই অর্থে করেন নি। কোন কারণ ছাড়ায়।
সুতপাই ওকে ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পাই। হয়ত মা উমা তেমনটাই চেয়েছিলেন।
".......জাগো দুর্গা.......
........তুমি জাগো........"
সন্ধি পুজো শুরু হয়েছে। ১০৮ টা প্রদীপ জ্বলজ্বল করছে। মানালি সুতপাকে জড়িয়ে কি সুন্দর ওর কোলে ঘুমোচ্ছে! শিউলি পাশে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে তা দেখছে। মা উমার মুখ প্রদীপ আর চন্দননগরের বাহারী আলোতে আরো বেশী ঝলমল করছে। মায়ের আশীর্বাদ গোজাগরী চাঁদের অহংকারের মতন ঝরে ঝরে পড়ছে।
সুতপার একটা সন্তান খুব দরকার। নিজের অতীত ভুলগুলো জানে আর শুধরাতে পারবে না। তবু মানালীকে তো মানুষ করতে পারবে। শিউলি বন্ধুর এই আবদারটা হয়ত মেনে নেবে।
ওর হয়ত একটু কষ্ট হবে। তবু বন্ধুর কথা ভেবে.....
বাইরে ঢাকের সুনামি। তার সাথে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর, আর গান ভেসে আসছে -
"........আশ্বিনের শারদ প্রাতে......
জেগে উঠেছে.......
প্রকৃতির.... ........"
প্রদীপের পবিত্র আলো সুতপার মাতৃত্বকে আরো উজ্জীবীত আর প্রাণবন্ত করে তুলছে।
আজ মাতৃত্বের পরীক্ষায় আপাতদৃষ্টিতে শিউলি হেরে গিয়েও যেন জিতল। আর মাতৃত্বের চরম পরীক্ষায় সুতপাকে লেটার মার্কস্ দিয়ে পাশ করাল শিউলি।
সন্ধ্যে অনেক আগেই নেমেছে। এখন চারিদিকে শুধুই আলোর বন্যা। নৈঋত কোণে একটু একটু করে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে।
শিউলির চোখের কোণেও নিম্নচাপের পূর্বাভাস। ফোঁটায় ফোঁটায় ভীষণ খুশীতে ঝরতে শুরু করেছে আশ্বিনের পবিত্র, নিষ্পাপ শিশির।
=======================
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন