যুদ্ধ- প্রতিপত্তি বৃদ্ধির উদগ্র বাসনার এক অবশ্যম্ভাবী ফল
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
বিংশ শতাব্দীর দুই দশক পেরিয়ে এসেও মানুষ যেন সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারল না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারে সে উন্নত হয়েছে কেবল নিজের প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা বিস্তার করার জন্য। কিভাবে পারিপার্শ্বিককে ও চারপাশের পরিবেশকে,মানুষকে পরাভূত ও নিয়ন্ত্রিত করা যায়, তার বিভিন্ন ফন্দিফিকির বের করাই যেন হয়ে উঠছে রাষ্ট্রনেতা বা রাষ্ট্রনায়কদের একমাত্র লক্ষ্য। আসলে তারা তো অন্য কেউ নন, আমাদেরই মতো সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। গুহামানব থেকে জেটমানব হয়ে ওঠার এই পথে চেতন বা অবচেতন মনে এই প্রভুত্ব করার বিষয়টি বরাবর প্রাধান্য পায় বা পেয়ে এসেছে। যার কাছে কূটনীতি বা পররাষ্ট্রনীতি শুধু কয়েকটি হাতিয়ার মাত্র। যেখানে দেশসমূহের সংস্থা বা মঞ্চকে নির্ভর করতে হয় বৃহৎ ও শক্তিশালী দেশগুলোর অর্থ ও অনুদানের উপরে, সেখানে নিরপেক্ষ ও সময়োচিত পদক্ষেপ গৃহীত হবে এমন আশা বা ভরসা বোধহয় না করাই শ্রেয়। এমতাবস্থায় মেরুকরণ ঘটবে বা কেউ কেউ ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়বে, এটাই তো হওয়ার কথা। কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করে, বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন উদ্ভাবনাকে ব্যবহার করে মারণাস্ত্র তৈরি হবে, এ আর বিচিত্র কী! কোন ক্ষেপণাস্ত্র কোথা থেকে কোথায় গিয়ে পড়বে বা কত দূর অতিক্রম করবে, এ চর্চা অস্বাভাবিক কী! আখেরে সীমা লঙ্ঘন করা ও অন্য দেশের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়া মানুষের(!) যেন স্বভাবজাত ও মজ্জাগত। তাই তো সুদূরপরাহত কোন লাভ হবে কিনা সেই বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েও যুদ্ধ যুদ্ধ এই প্র্যাকটিস আজো শক্তি প্রদর্শনের এক কৌশল মাত্র। যা মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে। সেখানে আধুনিক বিশ্বের ন্যাটো বা জাতিসংঘের কী আর করার আছে! মানুষের এই মনস্তত্ব আর সহজাত লোভ ও প্রতিপত্তির প্রতি আকর্ষণ দেখার জন্য বা বোঝার জন্য রাশিয়া বা আমেরিকা যেতে হয় না। আশেপাশে তাকালেই তা হয়ত দেখা যাবে। আর সেই জন্যই হয়ত বারবার নেমে আসে এই বর্বরোচিত আক্রমণ- মানুষের ওপরে, মানবতার ওপরে।
মানুষ চাঁদে বা মঙ্গল গ্রহে চলে গেলেও পৃথিবীতে ভালো করে, শান্তিতে আজো বাঁচতে শেখেনি। তাই এই আগ্রাসী মনোভাব প্রত্যক্ষ করতে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করার দরকার পড়ে না। এই বীজ রোপিত হয় মনের অজান্তেই, মানুষের মাথায়। বিবেকের বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। নৈতিকতার পাঠ বিস্মৃত হয়ে। চাপিয়ে দেওয়া নরমেধযজ্ঞ কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বা সভ্যতা কোন পরিস্থিতি ও কী দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যায় তা ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বারবার।
একদিন এই যুদ্ধ থামলেও থেকে যাবে বারুদের গন্ধ, রক্তের দাগ আর স্বজনহারানো মানুষের আর্ত চিৎকার। ধ্বংসস্তূপ থেকেই আবার উঠে আসবে নবনির্মাণ। শুধু ফিরবে না তারাই যারা এই লোভ ও ক্ষমতাবিস্তারের পাশবিক উল্লাসের শিকার।
দুর্ভাগ্য এটাই যে, আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না। বরং ইতিহাস রচনা করতে থাকি বারবার, ইতিহাসের মূল তত্ত্বকে বজায় রেখেই। কবে হবে শুভবুদ্ধির উদয়!
.............
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
কোচবিহার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন