google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re গল্প ।। পাকামাগুর ।। চন্দন মিত্র - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

শুক্রবার, ১৭ জুন, ২০২২

গল্প ।। পাকামাগুর ।। চন্দন মিত্র

 

পাকামাগুর

চন্দন মিত্র 

 

 

ছফুটের মতো লম্বা, পাকা মাগুরের মতো তেলতেলে কালচে হলুদ রং। মাথায় কাফ্রিদের মত পাকানো পাকানো ঘন কালো চুল। খালি গা, গলায় গামছা, পরনে লুঙ্গি। নির্মেদ পেশিবহুল চেহারা। অন্ধকারে এমন চেহারার সম্মুখীন হলে হৃৎকম্প হওয়াই স্বাভাবিক। রাজুর মুখে তার বাবার কথা শুনেছি কয়েকবার, আজ চাক্ষুষ করলাম। বাবাকে নিয়ে রাজুর বলা ঘটনাগুলো যে নিছক বানোয়াট নয়, আজ তার বাবাকে দেখে তা হাড়েহাড়ে টের পেলাম। আমাদের সঙ্গে তাঁর তেমন কোনো কথাই হল না। শুধু রাজুকে তিনি বললেন কে বন্ধু নাকি! সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালে আমি বুকের সামনে দুহাত এনে নমস্কার জানালাম। তিনি খুব একটা খুশি হলেন বলে মনে হল না। কোনো প্রত্ত্যুতর পেলাম না। দেখলাম তিনি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সারাদিন আর তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখাই হল না। দেখা হল সন্ধ্যায়।      

    হস্টেল থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে পাঁচটা তিরিশের লোকাল ধরেও পৌছতে পৌঁছতে প্রায় আড়াইটা বেজে গেল। বাজবে নাই বা কেন ! ট্রেন থেকে নেমে অটো, তারপর লঞ্চ, তারপর আধঘণ্টা নদীবাঁধের উপর দিয়ে হাঁটা। তারপর এই ইঞ্জিন ভ্যানবাপরে বাপ ! এর আগে কোনোদিন পৃথিবীর এতটা পেটের ভিতরে ঢুকে পড়িনি। বর্ধমানের ছেলে আমি, রাজুর সৌজন্যে এমন অত্যাশ্চর্য  ভ্রমণে এসে কৃতার্থ হলাম। ষ্টেশন চত্বর পেরিয়ে যতই ভিতরে ঢুকেছি ততই প্রতিবেশ গেছে পালটে। মাছের ভেড়ি, নদীর খাঁড়ি, মাটির বাড়ি, আফ্রিকান বাবলার বন, ক্যাকটাস ঝোপ, ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, কোথাও কোথাও ম্যানগ্রোভের ঝাড়। এসব পেরিয়ে ঢালাই রাস্তা ধরে এক অলৌকিক অট্টালিকার সামনে থামল আমাদের যন্ত্রযান। রাজু বলল, নাম এসে গেছি। এমন পাণ্ডববর্জিত অঞ্চলে ঝকঝকে তিনতলা মহল দেখে আমি আশ্চর্য না-হয়ে পারলাম না। কই রাজু তো তাদের এমন প্রাসাদবাড়ির প্রসঙ্গ কখনও তোলেনি। তবে রাজুর পাঁচ দাদার কথা শুনেছি। তারা ভেড়ি অন্যান্য দিক দেখভাল করে। পড়াশোনা নামমাত্রই করেছে। রাজু তার বংশে প্রথম, যে কিনা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে।      

    ডাইনিং রুম, বাথরুম, সবই রাজকীয়। স্নান সেরে চিতল, পাবদা গলদা চিংড়ি সহযোগে আহারপর্ব শেষ হল। বাড়িতে অনেকগুলো বাচ্ছা। রাজুর ভাইপো-ভাইঝি এরা। খাবারটা তদারকি করলেন রাজুর মা। কাজের মেয়েরা পরিবেশনের দিকটা সামলেছে। রাজুর মা তার বাবার ঠিক বিপরীত। টুকটুকে ফরসা গায়ের রং। রাজু পেয়েছে তার মায়ের চেহারা ভাব। মায়ের মতো সেও ফরসা রোগা-পাতলা। মনের দিক থেকে তুলতুলে। হয়তো এই ধাতের কারণে পড়াশোনায় সে এতটা এগিয়েছে। নচেৎ সে তার দাদাদের মতো এতদিনে ভেড়ির নেশায় পড়ে বিয়েসাদি করে সংসারে জড়িয়ে পড়ত। 

     তিনতলায় যে কামরাটি আমাদের জন্য বরাদ্দ হল। ঠিক তার পাশেই একটি হলঘর ঘরের মাঝখানেই একটি বিশাল গোলাকার ধবধবে সাদা পাথুরে টেবিল তার চারদিকে নকশাদার কাঠের চেয়ার। ঘরটি আসলে মন্ত্রণাগার কাম অস্ত্রাগার। দেয়ালে বাঘছাল, হরিণের  শিংওয়ালা মুণ্ডু, কুমিরের চামড়া, ঢাল-তলোয়ার, তীরধনুক, বল্লম, বন্দুক সবই পরিপাটি করে সাজানো। মেঝেতে পাতা মহার্ঘ সবুজ কার্পেট। বেশ রাজকীয় আভিজাত্য অনুভব করলাম। মনে হল অনেকটা সময় এই আশ্চর্য ঘরটিতে অতিবাহিত করি।  ইচ্ছে হচ্ছিল একটা বন্দুক হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করি কিন্তু সংকোচবশত রাজুর কাছে একান্ত বাসনাটি প্রকাশ করা হল না। তাছাড়া এই ঘরটাতে ঢোকার পরে পরে রাজু কেমন যেন অস্বস্তিতে আছে। আসলে সে চায়নি আমি এই ঘরে ঢুকি। জানালা থেকে ভিতরে উঁকি মেরে দেয়ালে সাঁটানো বাঘছালটি দেখে ভিতরে ঢোকার আগ্রহ প্রকাশ না-করে পারি না। সে নিতান্ত বাধ্য হয়ে বড়দার কাছ থেকে চাবি আনিয়ে ভিতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেয়। আমি ভেবেই পেলাম না রাজুর এই অস্বস্তি বা সংকোচের কারণ কী! এমন রাজপ্রাসাদ, এমন বৈভব ছেড়ে রাজু কেন কলকাতার বাসিন্দা হতে চায়। কেনই বা সে এমকম পাশ করে যে-কোনো কাজ খুঁজে বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার স্বপ্ন দ্যাখেআহা ! এমন একটা পরিবারে জন্মালে বর্তে যেতাম। কাজকর্মের যা  হালচাল এখন। পড়াশোনার মুখে লাথি মেরে ভেড়ির ব্যবসায় নেমে পড়তাম। এক ধবধবে সুন্দরীকে বিয়ে করে ... সত্যি রাজুর মাথাটা গেছে একেবারে!  

    সন্ধ্যার কাছাকাছি রাজু বললচল ভেড়ির দিক থেকে ঘুরে একটা জয়েন্ট মেরে আসি। জয়েন্টের নাম শুনে আমার অন্তরাত্মা নেচে উঠল। জয়েন্ট  বানানো খুবই সহজ। সিগারেট থেকে প্রথমে মশলা বের করে নাও। তারপর হাতে তামাক পাকিয়ে মিহি করে নিয়ে সেই খোলের মধ্যে ভরে দাও। ব্যাস জয়েন্ট তৈরি। নেশাটা আমিও ধরে ফেলেছি। ছেড়ে দেব দেব করে আর পেরে উঠছি না। সুতরাং তাগিদ যখন দুজনের তখন আর দেরি কীসের ! বেরোনোর সময় রাজু হাতে নিল পাঁচ ব্যাটারি এক বিশাল টর্চ অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বললএই কাঠফাটা গরমে কালাচের রমরমা। 

সে কি রে সে তো ভয়ানক বিষধর।

হ্যাঁ, একেবারে সাক্ষাৎ যম। আমরা বলি শিয়রচাঁদা। কামড়ের দাগ বোঝা যায় না। যন্ত্রণাও হয় না।

আমাদের ওদিকে ডোমনা চিতি নামে সবাই চেনে।

এইসব কথাবার্তার মধ্যে আমরা এসে পড়েছি একটি দিগন্তপ্রসারী মাঠে। বোধ হয় পূর্ণিমা! সদ্যফোটা চাঁদের আলোয় চারদিক ঝকমক করছে। এদিকওদিক ছড়ানো বুক-সমান উঁচু আল দিয়ে ঘেরা মাছভেড়ি। কোনো আলে সুপুরি গাছ তো কোনো আলে তালগাছের সারি। ওগুলো বেশ পুরাতন ভেড়ি, নতুন  ভেড়িও আছে। তাদের আল এখনও ঝকঝক করছে, কোথাও ঘাসের  চিহ্নমাত্র নেই। আমরা একটি পুরানো ভেড়ির আলে উঠে পাশাপাশি দুটি তালগাছে হেলান দিয়ে জয়েন্ট বানাতে শুরু করলাম। ভেড়ির জলে হঠাৎ ঝুপঝাপ আওয়াজ শুরু হল, যেন দুরন্ত ছেলের দল ঝাঁপিয়ে পড়ছে। রাজু বলল, আফ্রিকান মাগুরের ঝাঁক খাবার দেওয়ার সময় হয়ে গেছে তাই আওয়াজ দিচ্ছে। জয়েন্ট তৈরি শেষ, এবার আগুন লাগিয়ে সুখটান দেওয়ার পালা। উপর্যুপরি কয়েকটি টান দেওয়ার পর বেশ ধুমকি লেগে গেল। লবণাম্বু বনের ফাঁক দিয়ে এতক্ষণ চাঁদ উঁকি মারছিল এবার বনের মাথা ছাড়িয়ে অনেকটা উপরে উঠে পড়ল। দুজনের মনে একই গান এসে আছড়ে পড়ল সেখান থেকে কণ্ঠে যেতে যেতে পথে পূর্ণিমা রাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে / দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে ...  আর গাইতে হল না, বিকট এক শব্দে চরাচর কেঁপে উঠল। মুহূর্তেই আমার  ধুমকি গেল ছুটে। পরপর আরও খানদশেক কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না। বিদেশ-বিভুয়ে এসে শেষে কী বিপদে না পড়াই গেল! রাজুর মধ্যে কোনো চাঞ্চল্যই দেখতে পেলাম না। শান্ত গলায় সে বলল চুপচাপ বসে থাক। ভয়ের কিছু নেই একটু পরেই বুঝতে পারবি কেন আমি এই পাপপুরীতে পা-রাখতে চাই না। 

   দূরে কোথাও শ্লোগানের মতো চিৎকার ফটফট শব্দ শুরু হল। এতক্ষণে বুঝলাম সামনের জঙ্গল ছাড়িয়ে আরও দূরবর্তী কোনো জায়গাই এসব ভীতিজনক রহস্যময় শব্দের আঁতুড়ঘর। ক্রমশ আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল সেই শব্দদানব। হঠাৎ চন্দ্রালোকে যা দেখলাম, তা পিলে  চমকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। একজন ঊর্ধ্বশ্বাসে আমাদের ভেড়ির দিকে দৌড়ে আসছে তার পিছনে জন পনেরো-কুড়ি লোক। শিকার একবার মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে আবার উঠে দৌড়াচ্ছে। শিকারিদের সঙ্গে তার দূরত্ব ক্রমশ কমছে। শেষমেশ শিকারটি এসে আছাড় খেয়ে পড়ে আমাদের আলের ঠিক নীচে। রাজু তৎক্ষণাৎ এক হ্যাঁচকায় আমাকে আলের উপর শুইয়ে দিয়ে হামাগুড়ি দেওয়াতে বাধ্য করে। দুজনে হামাগুড়ি দিয়ে হাত দশেক দূরের অরক্ষিত দরজাখোলা পাহারা-চৌকিতে ঢুকে পড়ি। খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির দেয়ালের কুঁড়েঘরটিতে তেমন কিছুই নেই, মেঝেতে একটা প্লাস্টিকের মাদুর পাতা, একটি জলের কলসি কয়েকটি খালি মদের বোতল ছাড়া আর কিছুই নেই। কম্পমান শরীরে জানালা দিয়ে চোখ চালিয়ে যা দেখলাম তা আমার হৃৎপিণ্ড থামিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ভাগ্যিস রাজু আমার মুখ হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে রেখেছিল! ততক্ষণে ভিড় এসে ঘিরে ধরেছে শিকারকে। ভিড়ের ভিতর থেকে একটা দশাসই দৈত্য বেরিয়ে এল, পাকা মাগুরের মতো রং, হাতে ঝকঝকে ছোরা। চিৎ হয়ে পড়ে থাকা শিকারের বুকে সে ডান পা চাপিয়ে দিয়ে বাম হাতে চুলের মুঠি ধরে। তারপর কী হয় দেখার জন্য চোখ খুলে রাখার মতো ধকটুকু আমি সে যাত্রায় ধরতে পারিনি। কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। দুটি লোক কাঁধে করে একটি দীর্ঘ মসৃণ বাঁশ নিয়ে আসে। একজনের হাতে বোধহয় মোটা নাইলন দড়ির গোছা। নিথর দেহটিকে বাঁশের গায়ে লেপটে কষে বাঁধে তারা। এরপর দুজন বাঁশের দুপ্রান্ত কাঁধে চাপিয়ে নেয়। রাজু অনেকক্ষণ থেকে আমার মুখ চেপে আছে না-হলে কী হত যে কে জানে! আমি কী কেঁদে ফেলতাম ? নাকি আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠতাম ? রাজু আমার কানে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বললতোকে আজ সবটা দেখাব, তবেই বুঝতে পারবি কেন আমি কোলকাতায় থেকে যেতে চাই। কী ঘটছে চুপচাপ শুধু দেখে যা। বলেই আমার হাত ধরে ভেড়ির দিকের জানালায় নিয়ে আসে। লোকদুটি ততক্ষণে জলে নেমে পড়েছে। বাঁশটি তারা ডুব মেরে জলের গভীরে পুঁতে দেয়। তারপর আরও কয়েকবার ডুব দিয়ে জল থেকে খানচারেক বাঁশ তুলে আনে। বাঁশগুলির গায়ে দড়ি দিয়ে কী জড়ানো ওগুলো ? আমি আর ভাবতে পারি না, রাজুর কোলের উপর নেতিয়ে পড়ি।

 

  ====================

 

চন্দন মিত্র

ভগবানপুর (হরিণডাঙা) 

ডায়মণ্ড হারবার

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন